ঝিনুকের ঝিলিক

রাকিবুল রকি

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধে রচনার দুটো গুণের কথা বলেছিলেন। এক. অর্থব্যক্তি; দুই. প্রাঞ্জলতা। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই প্রাঞ্জলতার কথা বললেও, সাহিত্যের নবীন কোনো পাঠক যদি বঙ্কিমচন্দ্র পাঠ করতে যায়, তাহলে রচনার শিল্পগুণের মূল বক্তব্য এবং বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ভাষা দুটোকে দুই মেরুর বলে মনে হবে। মানে কি না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ভাষাকে কখনোই তার প্রাঞ্জল মনে হবে না। অবশ্য এই প্রাঞ্জলতা না থাকার বেশ কিছু কারণ আছে বলে মনে করি।

এক. তখন বাংলা গদ্য ঠিক তেমন ভাবে দাঁড়ায়নি।
দুই. বঙ্কিমচন্দ্র যে-সময়ের গল্প বলতে চেয়েছেন ভাষাটা এমন গুরুগম্ভীর না হলে ওই সময়ের রোমান্স, রহস্যময়তা ঠিক মতো তৈরি হতো না।
তিন. সময়।
প্রশ্ন হতে পারে, ‘সময়’ বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি?

সময় বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, ওই সময়ে যে ভাষাটা নিতান্তই সহজ ছিল এখন তা আমাদের কাছে কঠিন। এই বক্তব্যের স্বপক্ষে জোড়ালো কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। ভাষা যেহেতু নদীর মতো বদলে যায়, তাই দূরের ভাষাকে আমাদের কাছে কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর পৃষ্ঠা উল্টাই। সেখানে পাবো, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় এক কিস্তি পড়ার পর পরের কিস্তির জন্য কী অধীর আগ্রহেই না অপেক্ষা করতেন তাঁরা।

বঙ্কিমচন্দ্র ভাষার প্রাঞ্জলতার পক্ষে মত দিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যিক-উত্তরপুরুষ অনেকেই তা মান্য করেননি। যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। যেমন কমলকুমার মজুমদার। এক্ষেত্রে আরও অনেকের নাম আসবে। তাই আমরা দুজনের নামোল্লেখ করেই বিরত থাকলাম।
আমি জানি না সবাই এক মত হবেন কি না, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্যের যে সৌন্দর্য তা ভাষার কাঠিন্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। অন্তত সাধারণ পাঠকের কাছে তা পৌঁছাতে পারেনি। যদিও তাঁদের ভাষার এই গাম্ভীর্যও তাদের সাহিত্য-সৌন্দর্যের অংশ। তবু বলতে হয়, ভাষাটা তাঁদেরকে সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে কিছুটা হলেও আড়াল করেছে।

আমরা যদি বুদ্ধদেব বসু, হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, ভাষার পেলবতা তাঁদের সাহিত্যকে পাঠকের কাছে উপভোগ্য করে তুলেছে। এটাই স্বাভাবিক। পাঠক সহজ-সরল ভাষার দিকে পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই গেছেন, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। পাঠক পাওয়ার সহজ কৌশল সত্ত্বেও সেই কঠিন কাজকে অনেক লেখক সুস্বাদু, নরোম, কাব্যগন্ধী গদ্যকে নাকচ করে দেন। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

সৈয়দ কামরুল হাসান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর ধারার গদ্যকারদের ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ ছিল। তাঁর সংশয় ছিল- সুস্বাদু, নরোম, কাব্যগন্ধী এইসব গদ্যে বেশিরভাগই ফেনা, প্রকৃত জীবনসত্য নাই।’ (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থাকেন পথের শেষ মাথায়)
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা বা বিশ্বাস নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়।

উপরিউক্ত কথাগুলো মাথায় এলো সৈয়দ কামরুল হাসানের গদ্যের বই ‘কুড়াই ঝিনুক’ পড়ে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, বলতে হয় সৈয়দ কামরুল হাসানের গদ্য পাঠ করে। সহজ, সাবলীল তাঁর গদ্য। চমৎকার বলার ভঙ্গি। আছে পাঠককে টেনে রাখার অসম্ভব দক্ষতা। সৈয়দ কামরুল হাসানের কোনো গল্প পড়ে নয়, স্মৃতিচারণ ও শিল্পভাবনা বিষয়ক গদ্য পাঠ করেই মনে হচ্ছে পাঠককে টেনে রাখার সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে তাঁর গদ্যের।
‘কুড়াই ঝিনুক’-এ তাঁর বিশটি গদ্য সংকলিত হয়েছে। বইয়ের কভারেই লেখা আছে, ‘স্মৃতি ও শিল্প ভাবনার এক গুচ্ছ মুক্ত গদ্য’। এ থেকেই বইয়ের চারিত্র অনুধাবন করা যায় আশা করি। বিশটি গদ্যের মধ্যে প্রথম সাতটি সাতজন কবি-সাহিত্যিক নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ, এগারোটি বইয়ের আলোচনা, দুইটি গদ্য বুলবুল চোধুরীর গল্প এবং শহীদুল জহিরের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লেখা; শেষের গদ্যটি সৈয়দ কামরুল হাসানের প্রথম বই প্রকাশের ঘটনার স্মৃতিচারণ।
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘গল্পপ্রহরে হাসান আজিজুল হক।’ হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুর পরে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে এই গদ্যটি লেখা হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের সাথে তাঁর প্রথম দেখার স্মৃতিই এই লেখার প্রধান উপজীব্য। তবে সেই সাথে সাথে আশির দশকের ‘সচিত্র সন্ধানী’র একটি প্রামাণ্যচিত্র আমরা এ লেখায় দেখতে পাই। বাংলাদেশে কথাশিল্পে তখন কারা কতটুকু সক্রিয় ছিল, সেই তথ্যও তিনি তুলে ধরেছেন। গল্পকার হাসান আজিজুল হকের পাশাপাশি একজন মানবিক হাসান আজিজুর হকের দেখা পাই এই প্রবন্ধে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে ধীরে ধীরে সখ্য উঠার স্মৃতিচারণ করেছেন ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থাকেন পথের শেষ মাথায়’ প্রবন্ধে। দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। সৈয়দ কামরুল হাসান যখন কোনো কিছুর বর্ণনা করেন, তখন আমাদের চোখের সামনে সেই বর্ণিত ঘটনার ছবি ভেসে ওঠে। ফলে তিনি যখন টিকাটুলিতে আখতারুজ্জামানের বাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন, তার সাথে সাথে আমরাও বেরিয়ে পড়ি। আমরা দেখতে পাই, রাস্তার পাশে ময়লা উপচে পড়া ড্রেন। শুনি, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে-যাওয়া রিকশার টুংটাং শব্দ।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাড়াও তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, কাশীনাথ রায়, আশুতোষ ভৌমিক এবং মুহম্মদ খসরুকে নিয়ে। এইসব গুণী ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি গুণী ব্যক্তিদের পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের ছবি এঁকেছেন নিপূণ হাতে। ফলে লেখার পটভূমি একজনকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও লেখাটি হয়ে ওঠে অনেক জ্ঞানী-গুণী ও সময়ের কোলাজ। পাশাপাশি যাঁদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁদের সাহিত্য এবং কর্মের মূল্যায়ন তো রয়েছেই। কখনো কখনো প্রাবন্ধিকের প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ মন্তব্য যোগান দেয় চিন্তার খোরাক, দেয় নতুন নির্দেশনা।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্লেটো তাঁর কল্পিত রাষ্ট্রে কবিদের ঠাঁই দিতে চায়নি। ওদিকে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি বলেছেন, ‘ক্ষমতা মানুষকে যখন দাম্ভিকতার দিয়ে নিয়ে যায়, কবিতা তখন তাকে সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ক্ষমতা যখন মানুষের চিন্তার জায়গা সংকুচিত করে ফেলে তখন কবিতা তাকে অস্তিত্বের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’
সৈয়দ কামরুল হাসান দ্বিতীয় ভাবনা-দলের অনুসারী। আশুতোষ ভৌমিককে নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি সব কবিদেরই সম্মান করে বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, কবিদের হাতেই ফোটে স্বপ্নের কুসুম, তাদের হাতেই আছে অদৃশ্যের অলৌকিক চাবী।’ [স্মৃতিপটে কবি আশুতোষ ভৌমিক]

‘কুড়াই ঝিনুক’ গ্রন্থে তিনি এগারোটি বই সম্পর্কে তাঁর পাঠ-প্রতিক্রিয়া, মতামত জানিয়েছেন। বইগুলো হলো, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, এবিএম মুসার ‘বেলাশেষের গান’, কানাইলাল চক্রবর্ত্তীর ‘শরণার্থীর দিনলিপি’, সিরাজুল ইসলামের ‘গুহা’, তলস্তয়ের ‘রেসারেকসন’, খলিল জীবরানের ‘দ্য ওয়ান্ডারারে’র শ্রীযুক্ত অসিতবরণ ঘোষ কর্তৃক অনূদিত ‘সেই পরিব্রাজক’, আলীম আজিজ অনূদিত নাজিম হিকমতের ‘জীবন বড় সুন্দর, ব্রাদার’, শেখ মাসুম কামালের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে রাজনীতি ও তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ এবং শওকত ওসমানের ‘জননী’।

সৈয়দ কামরুল হাসানের নানা স্বাদের মুক্ত গদ্য পাঠ করে মনে হচ্ছে, তিনি নিষ্ঠার সাথে ঝিনুকের মাঝ থেকে খুঁজে খুঁজে মুক্তো বের করেছেন। সেই মুক্তো নিয়ে গেঁথেছেন, মালা, যার নাম, ‘কুড়াই ঝিনুক

বই নিয়ে আলোচনা আমরা তার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। সেই সাথে বইবাছাইয়ের তালিকার দিকে একটু দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারবো গ্রন্থাকারের চেয়ে গ্রন্থই তাঁর কাছে মূল বিবেচ্য। এই আলোচনাগুলো সাধারণ বুক রিভিউ নয়। এখানে আছে বহুরৈখিকতা। তলস্তয়ের উপন্যাস নিয়ে আলোচনার সময় লেখক এই ঘরনার একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে লেখার সম্ভবনা, না লেখার কারণ বিষয়ক নানা ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। নাজিম হিকমতের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলা অনুবাদ সাহিত্য নিয়েও বলেন। ‘জননী’ উপন্যাসের আলোচনায় ‘জননী’র সমসাময়িক এবং আগে পরের উপন্যাসের সাথে পারম্পর্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

বুলবুল চৌধুরীর গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে ষাট দশকের বাংলাদেশের বোহেমিয়ান কবি সাহিত্যিকদের গল্প বলে সৈয়দ কামরুল হাসান পাঠকদের প্রস্তুত করে নিয়েছেন। ফলে গল্প বিষয়ক তাত্ত্বিক আলোচনা পাঠকদের কাছে বিরক্তিকর ঠেকে না।

শহীদুল জহির বর্তমানে সাহিত্যিক এবং পাঠক মহলে নিত্য আলোচিত নাম। কথা সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখা যশঃপ্রার্থী নবীন লেখক প্রায়োরিটির ভিত্তিতে শহীদুল জহির পাঠ করে নেন। সৈয়দ কামরুল হাসান ‘শহীদুল জহিরের অন্তরমহল’ প্রবন্ধে শহীদুল জহিরের গড়ে উঠার যে প্রস্তুতি এবং সংগ্রাম তা তুলে ধরেছেন শহীদুল জহিরের রচনার আলোকে। যদিও এটি ‘শহীদুল জহির সমগ্র’ বইয়ের উপর ভিত্তি করে লেখা আলোচনা।

এই বইয়ের শেষ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ফিরে দেখা প্রথম বই’। এটি সৈয়দ কামরুল হাসানের প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি নিয়ে লেখা। পাঠ করলে মনে হয় একটি সরস গল্প বললাম। এবং এই লেখা পড়ার পর বোঝা যায়, সৈয়দ হাসানের নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার সৎসাহস আছে। যা সচরাসচর সবার থাকে না। এই সাহস ছিল বলেই তাঁর লেখা এমন উপভোগ্য। তাছাড়া বিন্দু থেকে বৃহতের দিয়ে এগিয়ে যাওয়া তাঁর লেখার একটি বৈশিষ্ট্য।

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, ঝিনুক মুক্তো জন্ম দেয়। একেক ঝিনুকে একেক আকারের, একেক আয়তনের মুক্তো থাকে। কোনো কোনো ঝিনুকে মুক্তো থাকেও না। সৈয়দ কামরুল হাসানের নানা স্বাদের মুক্ত গদ্য পাঠ করে মনে হচ্ছে, তিনি নিষ্ঠার সাথে ঝিনুকের মাঝ থেকে খুঁজে খুঁজে মুক্তো বের করেছেন। সেই মুক্তো নিয়ে গেঁথেছেন, মালা, যার নাম, ‘কুড়াই ঝিনুক।’

রাকিবুল রকি : লেখক ও গবেষক।

আরও পড়তে পারেন রুখসানা কাজলের গদ্য

একুশ