অতনু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

সর্পসত্র

কূটশ্লোক গণেশকে দ্বন্দে ফেলে দিল, হস্তি মস্তিষ্কের জট, না দেয় এগোতে তাকে, না দেয় পিছোতে। এর ফলে দেবলোক, পিতৃলোক, গন্ধর্বলোক, মনুষ্যলোক বুনো ঝোপে ভরে গেল। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় এইসব বুনো ঝোপে ফুল ফুটল। আশ্চর্য হলুদ ফুল। নাগকূলপতিগণ, তক্ষক, ডুন্ডুভ, আরও কত হীন সরীসৃপ, শুধু পুষ্পশোভায় মোহিত হয়ে বসতি গড়ল সেই শ্লোকের জঙ্গলে। তারা মন্দবুদ্ধি নতমস্তক নিষাদ, সৌন্দর্য বোঝে কিন্তু অর্থ বোঝে না। তারকাখচিত রাত্রি, সমুদ্রের আমিষ বাতাস গহন ইন্দ্রিয়ে ঢেলে দিল বিষ। কালে কালে সর্পঅধ্যুষিত, শৈলবন, সাগর, জনপদাদি সমন্বিত এই শ্লোকঅরণ্য দক্ষিণবঙ্গ নামে সমাদৃত হল। এত সবের মাঝেও পুত্র কিন্তু ঠিকই বুঝেছিল শ্লোক তথা সর্পজিহ্বা একইভাবে দ্বিধায় বিভক্ত, ফলে মারুতির চাকায় জড়িয়ে থাকা মহাপ্রাণ হয়তোবা স্বয়ং শেষনাগ। এই অনুমান তর্কাতীত নয়, তবে গাড়িটির অগ্নিবর্ণচ্ছটা ছিল প্রথম গুরু লক্ষণ, দ্বিতীয়ত অদৃশ্য গরুঢ়পক্ষী মহাগিরিতুল্য গজ আর মহামেঘতুল্য কচ্ছপ ভোজনে ছিল সিদ্ধহস্ত। আর সবশেষে ওয়াশিং মেশিনের ঘূর্ণাবর্তে, দূরে হোগলা বনের পারে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছিল সর্প অনুকৃতি তথা উদ্যত ফণার হর্ষময়ী আত্মা। অতএব নিয়তিতাড়িত এই সমারোহে, মেঘের ফাটলে, ইটের পাঁজায় বাস্তুসাপ হল গিয়ে নিতান্তই এক জাগতিক কূটাভাস, আর শ্রীগণেশ হলেন কেবলই প্রাত্যহিক আনুষ্ঠানিকতা। পিতার অন্ধ আক্রোশ তার দেহে ছাপ রেখে গেছে, জন্মলগ্ন থেকে প্রতিটি বঞ্চনা তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বিরক্ত গণেশ একে একে লিখে চলে পদ্মবর্ণ তক্ষকের ক্রোধ, রূপান্তর, বিষের অনলে আলোকিত রাজগৃহ, বজ্রাহতের ন্যায় পরিক্ষিতের মৃত্যু দৃশ্য। লিখতে লিখতে আত্মকরুণাবশত আরও যোগ করে — এরপর এই অতলান্ত দেহে মাছি বসবে, নানাবিধ পোকা, পিঁপড়া, ইঁদুর, নির্দ্বিধায় ভাগ করে নেবে এই সাপে কাটা দেহ, বাঁশের আঘাতে এই শিমুলফলের মতো মাথা হবে শতধাবিদীর্ণ, রাশিরাশি পেঁজাতুলো ভেসে বেড়াবে শ্মশানে, লকলক করে উঠবে চিতা।
…….

রাতের হিসেব

সংকোচ আর রোমাঞ্চ লেপের তলায় আমার দু’পাশে অঘোরে ঘুমায়। সংকোচকে সম্মোহিত করে বৃদ্ধাঙ্গুলির সুদৃঢ় গঠন প্রণালী। প্রতি রাতে ওষ্ঠাধারে সে ধারণ করে এমনই বিরোধাভাস। রোমাঞ্চ অবশ্য সহজেই বুকের ওপর দাপিয়ে বেড়ায়। আধো তন্দ্রায় কখনও তার নিঃশ্বাসের ওঠাপড়া আমি টের পাই। কুণ্ঠিত ঠোঁটের কষ গড়িয়ে নামে তালুতে, চুলের দলাপাকানো নুটি বালিশের পাশে পড়ে থাকে, সংকোচ এই শিশুশরীরে অপর্যাপ্ত বোধ করে।রোমাঞ্চ কিন্তু সদাপ্রসন্ন, কর্ম তৎপর। ওর বিস্ময়ে আবিষ্ট প্রাণ, প্রসাবের ঘ্রাণ এখনও তেমন তীব্র নয়। ফলত ঘুমের আগে কে যে কোন দিকে শোবে এই নিয়ে চলে বিস্তর বিতণ্ডা।

১. লেখার তাগিদে আমি একা শুই। আলো জ্বলে, জলের বোতল টেবিলেই রাখা থাকে।

২. বিছানায় স্তুপ করা বইয়ের শহর।

৩. ধূমপান অতি আদিম প্রবাহ।

৪. সংসার সীমান্তে চটি পরে ফটফট করা বেয়াদপি।

৫. বুকের ব্যথাটা বাম কাঁধ থেকে ডান দিকে শিফট হতে বোঝা গেল এই দুই প্রহেলিকা ততটা জটিল কিছু নয়।

৬. সংকোচ, রোমাঞ্চ তথা পাথর মন্দার, এরা সব একসাথে জড়িয়ে ঘুমায়।

৭. তমসা চাদর টেনে একা একা অপেক্ষায় থাকে।

…….

বাগধারা

পুরনো বান্ধবীর মা তার পেট দেখে বলেছিল- “খোল এত ছোট হলে বাচ্চা বিয়বি কোত্থেকে?”
নারকোল ফোপড়ার মতো নরম অথচ অপ্রতুল পেটে আলতো হাত বুলিয়ে উধাও, লোকটা লোলুপ তো বটেই তাছাড়া বিকৃতকাম। এই নিয়ে ঘরে ফিরে দখযজ্ঞ বেধে গেল। পাস্টিকের বালতি জলে থইথই, বিদ্যুৎরেখায় ঝলসে উঠলো কাঁচ। তার সাথে মিশে গেল বাসন পড়ার ঝংকার।
এতদসত্বেও ক্যালিডোস্কোপের মতো এই পেটে পাখি, উভচর, স্তন্যপায়ী – একেএকে সব নড়াচড়া শুরু করলো। নাইকুন্ডুলের পাশে দেখা দিল গভীর ফাটল।
গজ ও কচ্ছপ এ ওর ওপর চড়ে বসলো। কামরুপী গরুড় তাদের ঠোকরাতে ব্যাস্ত। এমন ঠোকাঠুকিতে বিচিত্র ফুলের নক্সা তৈরি হয়। ফুটোতে চোখ লাগিয়ে বেমালুম বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। জঠর, উদর, গর্ভ, পাকস্থলী আরো যে কতো কে তুমুল নাচে মশগুল, তালে তালে উথলে উঠলো ফেনা।

…….

খেলা

বৈষয়িক বৃত্তি থেকে আড়াল রচনা, এই চ্যুতি আদতে একটি খেলামাত্র। মেরি গো রাউন্ড, রুমালচোর কিমবা বৌবসন্ত, সব খেলার মতো পূর্বনির্ধারিত কিছু বোঝাপড়া কার্যত রয়েই গেছে। ঝুলন পূর্ণিমার রাতে সমূহ সমারোহে প্রাধান্য পেত রূপকের আয়োজন। জিত ও হারের মধ্যবর্তী চুক্তিপত্রটি সাক্ষরিত হত কল্পনাবিলাসের দিকে জোর দিয়ে। বয়ঃসন্ধিতে এভাবেই আমাকে পেয়ে বসে পুস্তকনির্মাণ ক্রীড়া।
অথচ তোতাটি ছিল ঘাড়মুণ্ডুনত মুমূর্ষু পথিক। আমি তাকে খুঁজে পাই পথিমধ্যে, নিভৃতে, নিয়ত পীড়ায়। সন্ধ্যায় নিস্ক্রমণের আগমুহূর্ততক তার ঠোঁটে লেগেছিল হরেকৃষ্ণ বুলি।
পতিত কুয়ার জলে, মায়ার অতলে বিসর্জনকালে বোঝা গেল কন্যাভাষাটিরও ছিল বিষদাঁত, একলা চেয়ে থাকা ।
…….

কম্পোজিশন

মূক ও বধির শতদল ফুটে আছে ক্লেদে। খুব কাছে যাই, সন্তর্পণে বসি তার বুকের শিয়রে। কান পাতি, বুকের ফাটল থেকে টসটস লালা ঝরে পড়ে। রাতচরা পাখি উড়ে যায়। গলিমুখে নিরন্ন কুকুর ডেকে চলে একঘেয়ে। তার প্রাণপাত করা চিৎকারে হস্তমৈথুনের আড়ম্বর মনে পড়ে। মনে পড়ে সন্তানের ঠোঁটের উপরিভাগে ঈষৎ গোলাপি কালশিটে।
কী এমন পরদেশী সলিল চৌধুরী! তার সুরে লিবিডো তাকাবে দেবালয়ে, আমি তো চেয়েছি করপুটে অর্কেস্ট্রার এই জটিল খেলনা। তবু কেন ফিরে এসে রাতে, নারীলোভী কামিনী গাছের নীচে, নিরালায় একা কেন ফুরিয়ে গেলে না? কেনইবা এই হল্লাগাড়ির সন্ত্রাস, কবুতর, উট-প্রদক্ষিণরত তোমার আয়ুধ। করুণাপূজিত এই দেশে জীবিতের লাচার সন্তান তুমি কার পরিবারে শাশ্বত অভাব দেখে ফিরে এলে, ফেরবার পথে অনাচারী বইগুলো রেখে এলে কাদের জিম্মায়?
কতশত বই তুমি! চাপাবাজ, ছ্যাঁকা খাওয়া, ত্রিভঙ্গমুরারি। তোমার দ্বৈরথে জন্ম মৃত্যু একসাথে দোল খায়, রিকশায় বেসামাল ‘পাগল হাওয়া’, বেজে চলেছে বিবাগী স্যাক্সোফোন। যেন কৃশকায় এই পথ জোকারের দোমরানো টুপির পালক, অকৃপণ লাল রঙে আঁকা।
এইখানে পথ এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুইভাগে। পৃথিবীর ধুলোরঙ রোষানল কোমল হয়েছে সবে। কথার প্রত্যয় অস্তমিত। এইবার সুরে ফিরি। ফিরে দেখি, ফিরে গেছ। পশ্চিম দিগন্তে ওলটানো থালার পাশে আধখাওয়া মাছ পড়ে আছে।

…….

আরও পড়ুন – বাসব দাশগুপ্ত এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

কবিতা ভাবনা

আমাদের এলাকায় শিয়ালের উৎপাত ছিল আমার জন্মের কিছু আগে। আমার জন্মের পরপর বাঁশঝাড় কমে আসে। সংস্কারের অভাবে ঘাটের ইটগুলো নড়বড়ে হয়ে যায়। মজাপুকুরে কলমি লতা, ঝাঁঝি আরও বিচিত্র সব জলজ উদ্ভিদ বেড়ে চলে। তারপর শুরু হয় পুকুর বোজানো।
বর্ষার আকাশ কাদাজলে লেপে আছে। সাইকেলে মুখোমুখি, হুট করে অপার্থিব আলো। এমন আলোয় খ্যাক শিয়ালের বিয়ে হয়, মফস্বলে জমে ওঠে ঠেক।
পারঙ্গম রাত্রি পার করে বাড়ি ফিরছি একাএকা। দুর্বৃত্তের ঢঙে আমার পিছু নিল সে। মুখে কাঁচা রক্ত। অথচ এই আপাত অসঙ্গতি সাবলীল ঠেকলো। কারন মণ্ডপে কালী, শিব, ডাকিনী, যোগিনী সকলের ভিড়ে সে ছিল কেবলই রক্তমুখাপেক্ষী। কাটা মুণ্ডুর তলায় অধীর আগ্রহে , একাগ্রচিত্তে আসীন। ফেইসবুকে এক শিল্পীকে নিজের মাথা একে দিতে দেখি এই ঝুলন্ত মস্তকের বদলে।
ভাইবোনদের জমাটি আড্ডায় বরাবর আমি পারফর্ম করতে ভালোবাসি। একদিন আচমকাই ছোড়দির বাঁকা হাসি এসে ফুটে যায় আমার বাঁ-চোখে। চোখ কটকট করতে থাকে। মনেপড়ে ছোটবেলায় জেঠিমা অকর্মণ্য লোক দেখলেই নিজের মনেমনে বিড়বিড় করতো “শ্যালের গু কাজে লাগে, শ্যাল গিয়ে পর্বতে হাগে”। বাগধারার এমন পপিক্ষেত আমাকে তছনছ করে দেয়।

কবি পরিচিতি : কলকাতা বেষ্টিত শহরতলিতে কবি অতনু চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম, ১৯৮৪ সালে। বাবা অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, মা রীতা চট্টোপাধ্যায়। কারিগরি বিদ্যায় স্নাতকোত্তর। বাসস্থল আকড়া, চব্বিশ পরগণা(দঃ)। চাকরিসূত্রে কুরুক্ষেত্র সংলগ্ন কোনো গ্রাম, চন্ডীগড় উপকণ্ঠ ইত্যাকার নানা জায়গা ঘুরে এখন চুঁচুড়ায় বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনারত। স্ত্রী রিতু খাঁড়া , কন্যা অরিণি চট্টোপাধ্যায়, পুত্র অহন চট্টোপাধ্যায়। লেখালিখি শিলাদিত্য, পরিচয়, নবান্ন, কবিসম্মেলন সহ নানা পত্রিকা ও ওয়েবজিনে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – আলোর ইস্টিশন (২০০৭), বাসা ও বদল (২০১৪), সমবেত গান (২০১৮), সেইসব সেইসব (২০২১)।