বর্তমানে গল্প নিয়ে অনেক নিরীক্ষা হয়, হচ্ছে। ফলে নানা রঙের, নানা কিছিমের গল্পে দিনকে দিন ভরাট হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত গল্পসাহিত্যের প্রবহমান জমিন। স্বয়ং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা ছোটগল্পের বাঁচা-মরা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন একদা। তাঁর মতো ধীমান কথাকারের মনে যখন এ রকম প্রশ্ন আসে এবং তা লিখিতভাবে তখন সংশয় জাগা স্বাভাবিক তরিকার মধ্যে পড়ে। তবু মানুষ আশাবাদী। চারদিকের আবর্জনা, কলুষতা, ছোটলোকি, প্রতারণা, বিশ্বাসহীনতার ভেতরেও মানুষ জেগে থাকে সুড়ঙ্গ ধরে জ্বলে ওঠা আলোয় ভর করে।
মানুষের মন ছোট হচ্ছে সত্য, সহ্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে সত্য, সামান্য বৈষয়িক সুবিধা নিয়ে অসামান্য কাজিয়া-ফ্যাসাদ হচ্ছে সত্য কিন্তু একটা আদেখা কণ্ঠের সুষমায়, একটা পবিত্র হাসির উজ্জ্বলতায় ঝরে পড়ে অনেকানেক অসত্যের ধূসর অন্ধকার। এসব নিয়ে যখন ছোটগল্পের কারবার দৃশ্যমান হয়; মানুষই যখন হেসে ওঠে গল্পপাঠে, কখনোবা বেখেয়ালে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, তখন আমাদের আশাবাদী হবার যথেষ্ট কারণ থাকে। এ রকম সুন্দরের জেরে বলা যায়, বাংলা ছোটগল্প মরবে না বরং সমৃদ্ধ হবে নতুনতর বীক্ষণ আর জীবনদর্শনে।
ছোটগল্পের বাগানে বিশেষ সুবাসিত একটি ফুলের তোড়া যেনবা আশরাফ জুয়েলের- পাখিরোষ। ২০২২ সালের অমর একুশের বইমেলায় ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটির প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে নতুন মুদ্রণ আসা আমাদের সাক্ষ্য দেয়, গ্রন্থটি জনপ্রিয় হয়েছে; মুরব্বিদের ভাষায় বললে, ‘আদরণীয়’ হয়েছে। এখানে কেউ প্রশ্ন করবে, মুদ্রণই কি শেষ কথা? প্রচারযন্ত্রের কারসাজিও তো থাকে তাতে? কথা একেবারে অসত্য নয়। রাজধানীকেন্দ্রিক চতুরতার ডামাডোলে বহু কিছু হতে পারে মানলেও মানতে হবে, পাঠকপ্রিয়তার আরেক শর্ত গ্রন্থের ভেতর মাল বর্তমান থাকা। ‘পাখিরোষ’-এ মাল-মসলা কেমন আছে তার সুলুক সন্ধানে যাবার জন্যই এই অবতারণা।
পাখিরোষ -এর ভাষাটা কেমন? ভাষা অবশ্যই গল্পের সবকিছু নয়। কিন্তু পাঠককে তো কমিউনিকেট করবে ওই ভাষাই! কমল কুমারীয় ভাষা পন্ডিতমহলে গ্রাহ্য অথচ সাধারণ পাঠকের কাছে চাই বোধগম্য, চারদিকের দেখা-শোনা-বলা ও শেখার মতো ভাষা। ‘ছায়াসন্দেহ’ গল্পে পড়া যাক, ‘দেখছেন মানুষের বুঝের কত কমতি! আমাদের মানচিত্রের পশ্চিমে মাতবর বাড়ি, মাতবর আমাদের জমি দখল করে ঘর তুলছে- তার অর্থ পশ্চিম মানে মাতবর।’ ‘সুখনিদ্রা পরিত্যাজে, জাগো মৃগরাজতেজে’ গল্পের শুরু থেকেই পড়া যাক, ‘এই শুয়ে বসে থাকা। ভীষণ একা। কোথাও যাবার নেই। কোনো তাড়া নেই। ছোট একটি কেবিন। নাকের ফুটোর মতো একটা জানালা। সেটা দিয়ে নেমে আসা আধুলির সমান এক টুকরো আকাশ- সন্ধে নামলে সেই আকাশে অন্ধকারের সুতোয় ঝুলতে থাকে বেড়ালের চোখের মতো সাতটা তারা, একটি কপাট বন্ধ থাকলে তা নেমে আসে সাড়ে তিনটায়। দু-কপাট বন্ধ থাকলে মরে যায় আকাশটা। একটা ফ্যান নিশ্চিত ফাঁসির আসামির মতো ঝুলে থাকে। দেড় ধাপ সমান না-মাজা দাঁতের মতো একটা বাথরুম। বিছানাটা কবরের সমান।’
‘একটা নোংরামূল্যের গল্প’-এ পড়া যাক, ‘ছাইদা তাকে বলেছে, ‘শোন ব্যাডা, খিদা হইলো দুই ধরনের। প্যাডের খিদা আর চ্যাডের খিদা। চ্যাড হইল, যেডা দিয়া মুতোস। তুই যখন আরেক্টু বড় হইবি, তহন যদি গরিব থাহোস তাইলে তোর প্যাডের খিদা বেশি থাকব, আর বড়লোক অইলে চ্যাডের খিদা থাকব বেশি।’
‘ঘন বাতাসের সুলেখা’ গল্পে দেখা যায়, ‘আজ এই মুহূর্তে যা হচ্ছে, এমনটা সাধারণত হয় না- লাইনটা লিখে আর কিছুতেই সামনে এগোতে পারছে না সে। বর্ষার কাঁচামাটির গর্ভবতী চুলোর মতো অবস্থা যেন- খড়ি, কেরোসিন, দেয়াশলাই সবই আছে কিন্তু কিছুতেই আগুন জ্বলছে না। উপন্যাসটা শেষ করা জরুরি। নতুন খুশকির মতো জ্বালাতন করছে ভাবনাটা।’ অনেকানেক উদাহরণ দেয়া যাবে, উদ্ধৃতি দেয়া যাবে অসংখ্য। কিন্তু মুরব্বিরা বলেন, ডেকচির ভাত সবটা দেখার দরকার পড়ে না! প্রিয় পাঠক, ‘ছায়াসন্দেহ’ গল্পের উদ্ধৃতির প্রথম লাইনেই আমাদের ধাক্কা খেতে হয় ‘বুঝের’ শব্দের ব্যবহারে। আম পাবলিকের আলোচনায় এ রকম শব্দ আসে। ফলে ‘পশ্চিম মানে মাতবর’ এ রকম দর্শনমাখা শব্দবন্ধেও আমরা ভারিক্কির আভাস পাই না। অথচ গল্পকার চিন্তার এমনতর তীর দিয়ে বর্তমান সময়ের পুরো রাজনীতিকেই তুলে আনেন।
পরের গল্পের দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে আমরা দেখি, গল্পের ভেতর কাব্যের গুণপনা। কেউবা গন্ধ পাবেন জীবনানন্দের; আচমকা বলেও বসতে পারেন ‘চিত্রকল্পময়’। আমরা নানাবিধ উপমার ভেতর একেবারে শেষে এসে দেখি, বিছানাটা কবরের সমান! ‘কবর’ শব্দ দিয়ে কি তবে গল্পকার মানবজীবনের নেতি ভাবনার প্রত্যহ উন্মেষকে জানিয়ে দেয় প্রকাশ্যে? হতে পারে। কি চমৎকার কথাভাষ্য, নাকের ফুটোর মতো জানলা! পাঠক তখন নিজেকে গল্পের ভেতর সঁপে দেন, নিজেকেও ভাবতে থাকেন গল্পের চরিত্র হিসেবে। পরের উদাহরণ যখন আসি, লেখকের ভাষ্যে পাঠক চমকিত হয়।
খিদার প্রকারভেদ নিয়ে কেউ নিচু স্বরে কথা বলবে সত্য কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না লেখকের কথা। বড়লোক আর গরিব লোকের এই অভ্যাস কি চলন একেবারেই সত্য। এখানে ‘চ্যাড’ শব্দ শুনতে স্লাং মনে হতে পারে কারও কিন্তু এই শব্দই মূলত উপর্যুক্ত বক্তব্যের শক্তি। এবং এটা দিয়ে কানেক্ট হয়ে যায় পাঠকগোষ্ঠী। এটাকে বলা যায়, মুখ-চলতি শব্দকে ছাপার অক্ষরে মর্যাদা দেয়ার মাধ্যমে শক্তিসঞ্চয়। শেষের উদ্ধৃতিতে দেখা যায় লেখকের ভেতরকার যন্ত্রণা। এটা ব্যক্তিমানুষের হতেই পারে। সৃষ্টিশীলতায় নির্ঘুম রাত কাটে লেখকের, ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় যাবতীয় পার্থিবতাকে ছুটি দিয়ে।
এটাকে বোঝাতে ‘নতুন খুশকির মতো’ শব্দের ব্যবহার দেখে আঁতকে উঠি আমরা। যেটা কেউ দেখছে না, দেখলেও সামান্যতম কিন্তু এর ভেতরকার রেশ বড় বেশি প্রভাব ফেলে। মূলত এখানেই আশরাফ জুয়েলের সার্থকতা। এই সময়ে আমরা দেখি, তরুণ প্রজন্মের কথাকারদের ভেতর দারুণ বৈচিত্র্য, গতানুগতিক ধ্যানে তারা বসে থাকেন না। আশরাফ জুয়েলের গল্পভাষ্য দেখলেই বরং আমরা সময়ের পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান লেখকদের সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাই। ভাষা নিয়ে যেটা বলছিলাম, প্রাগুক্ত গল্পগ্রন্থের ভাষা পাঠকেরই যেন নিকট প্রতিবেশী।
পাখিরোষ -এর গল্পগুলোর আখ্যান কী বিষয় নিয়ে আলাপ করা যায় এক্ষণে। মূলত গল্প কী? গল্পের ভেতর বাস করে কারা? বিশ্বসাহিত্য কি বাংলা সাহিত্যের সুলুকসন্ধানকারী বহু তাত্ত্বিক নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন গল্পের সুরত নিয়ে। বহু রকম ইজম আর আয়নায় গল্প হয়ে উঠেছে জমাট, পাঠযোগ্য। গল্পে বাস্তব আছে নাকি পরাবাস্তব তা নয়, শেষতক মানুষই হয়ে উঠেছে গল্পের আধার, কেন্দ্রীয় পরাভব। ভাবা যায়, স্যান্ডেল, মশা, পকেট, সিগারেট এসবও গল্পের চরিত্র হয়? এরাও কথা বলে মানুষের স্বরে? কী নেই এসব আলাপে? দেশীয় কলুষতা থেকে আন্তর্জাতিক বিষয় পর্যন্ত এসব আলাপের প্রসঙ্গ। কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ‘ছায়াসন্দেহ’ গল্পটি অহরহ প্রকাশমান কথোপকথনে ভরা গার্বেজ থেকে আলাদা করে নেয়ার মতো গল্প।
‘এক চোখ ধর্মের তো আরেক চোখ মাতালের। এক চোখ ব্যবসার তো আরেক চোখ ডাকাতের।’ এমন কথা মানুষ বলার সাহস পায় না, ঠিকই বলে ফেলে ঘন কফ। এখানেই মূলত আশরাফ জুয়েলের খেল। হতে পারে তিনি পেশায় ডাক্তার, ঘন কফের শক্তি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল, ফলে এমন সাহসী উচ্চারণ তার দ্বারা সম্ভব। ‘সুখনিদ্রা পরিত্যাজে, জাগো মৃগরাজতেজে’ গল্পে কথকের ভূমিকায় বহু কিছু দেখা যায়, দৃশ্যের ভেতর ঢুকে যায় পাঠকেরাও। প্রকৃতি, জীবন নিয়ে ভরপুর গল্পটি। একেবারে শেষে দেখি, এখানে ভাস্বর হয়ে আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। কত যতন করে, কত অস্পষ্ট স্বরে আশরাফ এসব জাগিয়ে দেন গো! পূর্বজের ঋণে ভরা এই আমরাও স্যান্ডেল হতে চাই একটি পা কেটে ফেলা প্রণম্য কথাকারের।
‘একটি নোংরামূল্যের গল্প’ আশরাফের আরেক ল্যান্ডমার্ক সৃজন। এখানে ঘনিষ্ঠভাবে ছড়িয়ে আছে ঢাকা শহরের নিন্মবর্গের অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়া মানুষের ছবি। তারা নেশা করে, ভিক্ষা করে, প্রতারণা করে। কতভাবে ঠকে নগর ঢাকার মানুষ, কত রূপে-কত হাওয়ায় চলতে হয় নাগরিকদের তার বিশ্বস্ত চিত্র প্রাগুক্ত গল্পটি। নোংরা হতে হতে কোথায় গিয়ে ঠেকছে সময়ের বিষ সেটা ভুলতে পারে না পাঠক, আলোচ্য গল্পে। গল্পটির ভাষা টোকাই সম্প্রদায়ের মুখের কাছাকাছি। তবে কেউ যদি ‘মুতমুত’ কী ‘লাগানো’ শব্দ দিয়ে অশ্লীলতার অপরাধ খোঁজেন তা বোধহয় বড় অন্যায় হবে না। বলা চলে, যে ভাষা গল্পটার শক্তি, সে ভাষাই গল্পটির শত্রু!
লেখক অবশ্য নামকরণে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে দেন আগেই। ‘ঘন বাতাসের সুলেখা’ গল্পটি পড়লে সাম্প্রতিক সময়ে বিষফোঁড়ার মতো দাম্পত্য বিচ্ছেদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের। যে লেখক সৃষ্টি করে অজস্র চরিত্র, নির্মাণ করে মায়াবি রমণী, তার বধূই শেষতক হয়ে যায় পরের! ওই যে কলহ হয়ে ঢোকা দাম্পত্য-সন্দেহ তাতে হাওয়া দেয়। মামুল যতই প্রমাণ করতে চায় সে নির্দোষ, ততই যেন তার পায়ে তেড়ে আসে মিথ্যে শেকল। মায়া চলে যায় বাপের বাড়ি। অথচ সুলেখা নামের কাজের মেয়েটি যেন মাতৃহৃদয়ের অতলে বাস করে! তার সামাজিক দৌলত না থাকতে পারে কিন্তু মনের ভেতর দিনমান ঘাই মারা মাতৃত্ব তাকে আক্রমণ করে জোরালোভাবে, হোক না তা মিথ্যে। গল্পের শেষে মামুলের বোধে পাঠক শোনে মহার্ঘ এই কথাপুষ্প, ‘মামুল বোঝে, সন্তান কাছে না থাকা মা আর লিখতে না-পারা একজন লেখকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ এটাই জীবন, একজন লেখকের হৃদয়জ অনুভূতি।
‘এত নিশ্চিন্ত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুরে খায় ক্যামনে?’ গল্পের শিরোনাম যেমন লম্বাটে, গল্পের শরীরও কিছুটা চওড়া। লেখক পারতেন আরেকটু সঙ্কুচিত করতে। হয়তো আখ্যানের গড়নে তিনি ঢেলে দিতে চেয়েছেন সময়ের যাবতীয় বিষ। একজন মার্চেন্ট পিতার বিরুদ্ধে, বলা ভালো, তাদের পুঁজিবাদি চিন্তার বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়ানো সন্তানের প্রতিবাদে গল্পটি মুখর। এখানে আমরা দেখি, শিল্পপতি পিতার সময় হয় না, সন্তানকে সময় দেয়ার। তবু পিতা এগিয়ে যান থানায়; পিতার পাওয়ারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় অবাধ্য সন্তান। যে চেনে মুক্ত বাতাসের স্বর, সে কি আটকাতে পারে পারিবারিক বৈভবে? কিতাবের নামকবিতা কী নামগল্পে থাকে পাঠকের আলাদা নজর।
পাখিরোষ -গল্পটাও তাই। নিকট অতীত থেকে বর্তমান, নারী নির্যাতনের হার বেড়ে চলছে। এখানে নারীরা পণ্য, নারীরা লিপ্সার শিকার। অথচ নারী ক্ষমতায়নের আলো এখানে বিরাজমান, তবু যেন নারী হয়ে জন্ম নেয়া অপরাধ। নারীরা ভয়ে, ক্রোধে, অপমানে টুপ করে পাখি হয়ে যায়- পাখিরোষ গল্পে। আচমকা শহরের নাগরিকেরা খেয়াল করে, ‘এ শহরের সব নারী এবং মেয়েশিশুরা পাখি হয়ে গেছে’। গল্পটাতে ম্যাজিক রিয়েলিজমের ছায়া দেখবেন কেউবা। এখানে সত্য কবুল করা ফরজ হয়ে গেছে। নারী স্বাধীনতার অনেক সোপান থাকলেও নারীর অপমানে নারীরা হয়ে গেছে পাখি। গল্পকার আশরাফ জুয়েলের দেখার দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন এবং তা প্রকাশের ভঙ্গি অন্যরকম।
‘হত্যাখামার’ গল্পটি পড়ে রাতে ঘুমাতে পারেনি অনেক পাঠক, নিশ্চিত। মানুষের লোভ আর লিপ্সার শিকার নিরাপরাধ মানুষ। সমাজের উচ্চ স্তরের লোকের খাবার যেন নিন্মস্তরের লোকেরা। বাস্তুসংস্থানের কঠিন নিয়মে নীরবে মারা পড়ে শহরে পড়ুয়া ছেলেকে দেখতে আসা শফিক গাজী। এভাবে আমরা দেখি, তালুকদার ইমরান, যিনি কিনা বিরাট শিল্পপতি, যার কথায় ওঠানামা করে রাজনীতির লোকেরাও; তার মেয়ে কারিনার জন্মদিনে বিশেষ চাওয়া মানুষের চামড়ার তৈরি জুতো! আমরা কি তবে দিন দিন পশু হয়ে যাচ্ছি মানুষের শুরুতে? আমাদের শিক্ষায় কি তবে গলদ আছে? একটা মেয়ে, একটা মানুষের বাচ্চাই কিনা জন্মদিনে চায় মানুষের জুতো, ভাবা যায়? হচ্ছে কিন্তু সে রকম। তালুকদারদের এমত ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে কান্তুকে অর্ডার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে। কান্তু হুকুমের গোলাম, মান্য করে তালুকদারের আদেশ। সেসব চামড়ার জুতো কারিনা পছন্দ করবে কেন? তার চাই আরো অধিক চমৎকার জুতোজোড়া।
শহরের সবচে অভিজাত হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে পাঠক তালুকদারকে দেখে উচ্ছ্বসিত। জগৎজয়ের আনন্দে উদ্বেল তালুকদার। কী করুণ সত্য সামনে আসে পাঠকের! এটার জন্য তালুকদার কি প্রস্তুত থাকেন? কিন্তু মানুষ নিজেই তো কুড়াল মারে নিজের পায়ে; নিজেই ধ্বংস ডেকে আনে নিজের। ফলে কান্তুর কারিনার চামড়া দিয়েই জুতোজোড়া বানানো আমাদের সামনে ঝুলে থাকা দীর্ঘস্থায়ী অমঙ্গলকে নির্দেশ করে। সমকালীন বাংলা গল্পে ‘হত্যাখামার’ সবচে নিষ্ঠুর গল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত মানুষ দেখবে নিজের বিকারের হিসেব, কত নিচে নিয়ে গেছে নিজের ছায়া তার হিসেব।
পাখিরোষ আশরাফ জুয়েলের নয়, শুধু এবারকার বইমেলায় (২০২২) প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা গল্পের বই। বই আলোচনার যে পদ্ধতি তা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়, হতে পারে। কিন্তু যেখানে থাকে প্রেম; অনেকটা অন্ধ প্রেমিকের মতো, সে দেখে না মন্দ কিছু। কেবল ভালোটাই তার দৃশ্যে খেলা করে। ফলত পাখিরোষ গল্পের খামতি চোখে পড়বে অন্য অনেকের, প্রেমিকের নয়।
এটা বলা বোধহয় অন্যায় হবে না, আশরাফের দেখার শক্তি প্রখর কিন্তু সেখানটা জুড়ে আছে নগর। নগরের বহু ধাতে গড়া বিভিন্ন কাতারের নাগরিকেরা শক্তভাবে থাকে গল্পে, থাকে বদলে যাওয়া, বদলে দেয়ার গল্প। গ্রামটা কি সে অর্থে আছে? গল্পকার নিজে শহুরে বাসিন্দা, চলতে-ফিরতে দেখেন শহরের আলো-অন্ধকার; হতে পারে সেজন্যই তার চেনা ভ‚গোল গল্প আছড়ে পড়ে। কোনো কোনো গল্পের আয়তন পাঠকের মনে হতে পারে বেহুদা বড় হয়ে গেল! অবশ্য পাঠকের ভাবনার সাথে লেখকের ভাবনা মিলবে সে নিশ্চয়তা দেবে কে? তবে যুগ বদলেছে। যাত্রাপথের খুচরো সময়ে, জ্যামের বিরক্তিকর প্রহরে কেউবা পড়ে নেয় মনের খোরাক। সেখানে সময় বড় নিয়ামক। গ্রন্থভুক্ত দশটি গল্প দশ রকম। ভাষার বৈচিত্র্য, বৈভবের সৌন্দর্য, দর্শনের উপস্থিতি এবং উপস্থাপনের ভঙ্গিমা প্রেমে পড়ার মতো। কোথাও আছে নিরীক্ষার ছাপ, বক্তব্যের মায়াময়তা। প্রিয় পাঠককে ‘পাখিরোষ’ নামের করুণ মায়ার জগতে স্বাগত।
ইলিয়াস বাবর : কবি, গল্পকার ও সমালোচক
আরও পড়ুন …