কলেজস্ট্রিট থেকে – পর্ব ৩

আমাদের মত আম-আদমির কাছে কলেজস্ট্রিট মানে গোলদীঘির দক্ষিণপ্রান্ত থেকে হ্যারিসন রোড ক্রসিং। এখানেই তো বাঙালির ইন্টেলেকচুয়াল ঐতিহ্যের কিছু স্মারক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ থুড়ি ইউনিভার্সিটি, সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, কফি হাউস, মহাবোধি সোসাইটি ইত্যাদি। তারই সাথে আছে বইখাতা, অফিস স্টেশনারি কেনা বেচার বাজার, পুরোনো বইয়ের সারিবদ্ধ বিপনী। কিন্তু কর্পোরেশানের খাতায় দক্ষিণে সেই সুবোধ-মল্লিক স্কোয়ারে কলেজ স্ট্রিটের শুরু আর শেষ উত্তরে কেশব সেন স্ট্রিট আর বিধান সরণীর সংযোগস্থলে। প্রায় দেড় কিলোমিটার এই রাজপথে কত যে স্মারক, কত যে স্মৃতি। ওয়েলিংটনের মোড়; এখনকার রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পেরিয়ে এলেই শুরু হয়ে যায় লোহার কারবারিদের দোকানের সারি। সেই আড্ডা পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলে বৌবাজার মোড়ের আগে বাঁদিকে কলকাতার নিজের হেরিটেজ ভীমনাগের মিস্টির দোকান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলার বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখুজ্যের গাড়ি নাকি প্রতিদিন এখানেই এসে থামত। তিনি বাঁজখাই গলায় ডাক দিতেন…ভীম। নাগমহাশয় সন্দেশের চুবড়ি হাতে হাজির হতেন। বাংলা- ইতিহাসের শার্দূলমশাই তারপর সেই অমৃত-সন্দেশের স্বাদ গ্রহণ করতে করতে ও বিতরণ করতে করতে যেতেন তার কর্মস্থলে। তারপরেই বৌবাজার ক্রসিং।

১৯৪৯-এ কলকাতার বুক কাঁপানো রাজবন্দীদের মুক্তি আন্দোলন। চার লেলিহান নারী…লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা এবং এক যুবক বিমানের নির্মম মৃত্যু। সেই শহিদবেদী। কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গোপাল পাঁঠার কালিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত মাংসের দোকান। এখনও যেখানে শাস্ত্রমতে মাংস বিক্রি করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্ব, ডায়রেক্ট অ্যাকশেন ডে, ক্যালকাটা রায়ট এবং দেশভাগের একটুকরো অশ্রুভেজা নোনা ইতিহাস। আরও কিছুটা এগোলে সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের পরপর দোকান। আগেপিছে কিছু স্যানিটারি ওয়্যারের পাইকারি দোকান। পেরিয়ে এলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। রোমান স্থাপত্যের পুরোনো ভবনটি না থাকলেও এখনও ব্রিটিশ আর গথিক স্থাপত্যের এই বিশাল কমপ্লেক্স কলেজ স্ট্রিটের দৈত্য। বইপাড়া পেরিয়ে হ্যারিসন রোড ক্রসিং পার হলে পড়ে কলেজস্ট্রিট মার্কেট। শাড়ি, গয়না, মনোহারি এবং আরও যাবতীয় জিনিসপত্রের দোকান, কলকাতা শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। কিছুটা পরে বাঁদিকে আরেক স্মারক ঠনঠনিয়া কালিমন্দির। মনে করিয়ে দেয় সেই পুরোনো কলকাতার দিনরাত। জল-জঙ্গলে ভরা এই রাস্তা, ডাকাতের উৎপাত, মন্দিরের ঠনঠন ঘন্টার সতর্কবার্তা। মন্দির পেরিয়ে কলেজস্ট্রিট নাম হওয়ার আরেক স্মারক, বিদ্যাসাগর কলেজের দুই বাড়ি।

‘কলেজস্ট্রিট থেকে’ শুরু করতে গিয়ে আজ এত ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে শিবের গীত কেন?…পাঠক নিশ্চই ভাবছেন। পাঠকের সাথে লেখকও ভাবছেন। তবে লেখকের ভাবনাটা একটু অন্য পথে। কলেজস্ট্রিট বললে এই ঐতিহ্যশালী রাস্তাটর পুরো ইতিহাস-ভূগোলের মধ্যে এই দু-তিনশো মিটার বইপাড়াটাই কেন আমাদের মনে আগে জেগে ওঠে। যারা জীবনেও কলেজস্ট্রিটে যায়নি বা যাবে না তারাও কলেজস্ট্রিট শব্দটা শুনলেই লোহা-লক্কড়, সার্জিকাল যন্ত্রপাতি, প্লাম্বিং মেটিরিয়ালস, শাড়ি-গয়না না বলে, বই কেনার বা বই বিক্রির কথা বলে। এই শহরে অজস্র বইয়ের দোকান আছে তবুও বই-এর খোঁজ হলে কলেজস্ট্রিটে যেতে হবে এমন চিন্তা এই জেনারেশান এক্স, ওয়াই বা জেড যারা অ্যামাজন-ফ্লিপকার্টে স্বছন্দ তারাও বলে! প্রবাসের বাঙালি কলকাতায় এলে কলেজস্ট্রিট থেকে দু-একখানা বই কেনে এবং কফি হাউসের ধোঁয়া-ভ্যাপ্সানি মেশানো এককাপ কফি খেয়ে যায় এমন উদাহরণও আকছার দেখা যায়! এ কি শুধু পাঠ্য বইয়ের বাড়তি কমিশনের লোভ নাকি অন্য কিছু? একথা সত্যি, এপাড়ায় পড়ার বইয়ের বিক্রি বেশি। আর পাঠ্যবই তো প্রয়োজন ছাত্রর! সে পড়তে পড়তে যত বড় হয়ে ওঠে, ততই বিদ্যাচর্চা, শিল্পচর্চার প্রতি তার শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়। সেই সদ্য কিশোর-কিশোরী ছাত্র বা ছাত্রী যখন বইপাড়ায় নতুন পড়ার বই কেনার জন্য বা পুরোনো পাঠ্য পুস্তক বিক্রি করার জন্য পা দেয়, তখন এত অজস্র বই আর তাদের অসংখ্য লেখককুলের জন্য তাদের মনে বিস্ময়, ভালবাসা, শ্রদ্ধা যে জাগে না বা কারুর কারুর চোখে লেখক হওয়ার স্বপ্ন জাগে না সেকথা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না!

একজন অবাঙালি ব্যবসায়ী এই কলমচিকে একদিন বলেছিল…বাঙালি এত কালচার না করে কিছুটা এগ্রিকালচার শিখলে জাতটার উন্নতি হত! যে জবাব সে পেয়েছিল তার কথা এখন বাদ থাক কিন্তু এখনও যাদের অপেশাদার বলে ব্যঙ্গ করা হয় সেই লিটল ম্যাগাজিন, গ্রুপ থিয়েটার, ব্যান্ডগান, পেন্টারস ফোরামদের সংখ্যা আমাদের এই শহরে, এই রাজ্যে যে সারা দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি, চোখ বুজে সেকথা বলা যায়। বিনা টিকিটের কত যে বিতর্ক-তাৎক্ষণিক বক্তৃতাসভা, একাঙ্ক নাটক-সঙ্গীত-আবৃত্তি-নৃত্য প্রতিযোগিতা সারা বাংলায় হয়ে চলে সারা বছর সে খবর, স্যাটেলাইট চ্যানেলের লক্ষ টাকা-পুরস্কারের ট্যালেন্ট সার্চ কম্পিটিশনের টেলিকাস্টে চাপা পড়ে যায়! তবুও তো হয়! মেকলের গোলাম বানানোর কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়কে সামনে রেখে বাঙালি জাতি হিসাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কয়েক শতকব্যাপী দীর্ঘ লড়াই চলছে। তার একটা ফ্রন্ট আমাদের এই কালচারের কালচার। তো যুদ্ধ যখন, তাতে কখনও হার থাকবে, কখনও জিৎ। এগোনো, পিছোনো সবই চলতে থাকে। এই কলেজস্ট্রিট, এই বইপাড়া, এই লেখক-পাঠকদের মেলামেশা, পরস্পরকে চেনাজানা আমাদের সেই যুদ্ধে জেতার প্রবল এবং শক্তিশালী অস্ত্র। কিন্তু প্রতিপক্ষ ? হ্যাঁ আছে। তাদেরও প্রচুর ফ্রন্ট। সেই ফ্রন্টেও আছে রাসায়নিক বুদ্ধিজীবীরা। প্রশ্নের পর প্রশ্নের মিসাইল ছুঁড়তে থাকে। সংস্কৃতি দিয়ে দেশের সেরা হবে কী করে বাওয়া? পুঁজি কই তুমাদের? বড়াবাজার, আলিপুরের শেঠবাবুরা রোকড়া তুলে নিলে যে না খেয়ে মরতে হবে? আর যে কাঁকড়ার জাত বাঙ্গালি, একজন উঠলেই আরেকজন তার পা টেনে ধরে। দুইজন বাসু ভারতসেরা হতে হতেও পারল না। বাঙ্গালি কাঁকড়ারাই তো খেল তাঁদের!…ইত্যাদি প্রভৃতি কত যে কার্পেট বম্বিং! ধুলো ওড়ে, রক্তপাত হয় মনের গভীরে। কিছু তো সত্যি বটেই। আবার এটাও তো সত্যি মজা করে একটা জাতির বাসভূমিকে দুটুকরো করে দেওয়া হল তবুও সে হারিয়ে গেল না। কোটি কোটি উদ্বাস্তুকে বুকে নিয়ে প্রবল সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আলোড়নের পরেও সে এগোচ্ছে! কোথায় পায় সে এই শক্তি?

এটা তার ইতিহাস! বরেন্দ্র, সুহ্ম, রাঢ়, বঙ্গ, পৌন্ড্র অসংখ্য স্বতন্ত্র জনপদে বিভক্ত জনগোষ্ঠীরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বঙ্গভাষী জাতি হিসাবে গড়ে উঠেছে। আর সেই জাতিটাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে তার ভাষা এবং তার সাহিত্য। পনেরো শতকের মহানায়ক চৈতন্যদেব নিজে সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত অথচ তার মত প্রচার করলেন এই বাংলা ভাষায়। কথিত আছে তাঁর সংস্কৃত রচনাবলী তিনি বর্জন করেছিলেন গঙ্গায়। জাতির বুকে মায়ের ভাষার আবেগই কি সেদিন তাঁকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল? তাঁর প্রথম জীবনী থেকে সাধনার গান ইত্যাদি যা, যা তাঁর বাণীকে মানুষের মধ্যে নিয়ে গেছে সবই লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। একই উদাহরণ তো আরেক প্রধান ধর্ম ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখি, সুফি দরবেশরা কেউই এদেশের মানুষ ছিলেন না। অথচ যত ধর্মীয় সাহিত্য, কেচ্ছা-কাব্য সবই লেখা হল বাংলায়। বাকি সাহিত্যের আলোচনায় যাচ্ছি না কিন্তু তামিলের মত একটি জীবন্ত ক্লাসিক ভাষা ছাড়া এই দেশে ভাষাভিত্তিক জাতিগুলি গড়ে ওঠার পথে বাংলাসাহিত্যের ভূমিকা অন্য ভাষার সাহিত্যের তুলনায় যে যথেষ্ট বেশি সেকথা কি ইতিহাস বলে না? পর্তুগিজরা, উইলিয়াম কেরিরাও সেকথা বুঝেছিলেন তাই বাংলা ভাষাটার উন্নতি করেই ক্রিশ্চান ধর্মের প্রসার করতে চেয়েছিলেন, তারা। সেই ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আমাদের পুঁজি। আমরা আছি, আমরা লড়ছি।

এবার একটু অন্য কথায় আসা যাক। যদিও সেখানেও কলেজস্ট্রিট আছে। বলতে গেলে, কলেজস্ট্রিট হাঁটতে হাঁটতে বা ট্রামে ফিরতে ফিরতে বহুদিন আগের কথা। ষাটের দশকের কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের চেনা মুখ। রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইবলিশের আত্মদর্শণ, শবযাত্রা তার সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ। বাংলায় মহাকবিতার চর্চাতেও তাঁর ভূমিকা ভাস্বর। তিনি থাকতেন দক্ষিণ কলকাতায়। এই কলমচিও মাঝেমাঝে কফিহাউস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর সঙ্গী হত। কখনও ট্রামে ধর্মতলা আবার কখনও একেবারে কলেজস্ট্রিট ধরে হেঁটে ওয়েলিংটন, ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে ফেরা হত। বারবার বলতেন…গদ্য লেখ, মানুষ দেখ, মানুষ! আরও অনেক কথাই বলতেন তিনি। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কবিতা লিখে আপনার প্রাপ্তি কী? উত্তরে বলেছিলেন, মৃত্যুপথযাত্রীর শান্তি! শেষ পর্যায়ের ক্যানসার আক্রান্ত এক রোগীকে তাঁর কবিতার বই উপহার দিয়েছিলেন কবি-চিকিৎসক অঞ্জন কর। বইটি পড়ে সেই রোগী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তিনি গিয়েছিলেন এবং সেই রোগী তাঁর হাত চেপে ধরে বলেছিলেন আপনার কবিতা পড়ে কষ্ট ভুলে যাচ্ছি। আরও একটি ঘটনা। তাঁর তখন কবি হিসাবে বেশ পরিচিতি। কলকাতায় তখন নকশাল-কংশাল আন্দোলনের জোয়ার। রাত নটা-দশটার পরেই পাড়া শুনশান। তিনি কিন্তু প্রতিদিনই রাত করে বাড়ি ফেরেন। একদিন পথ আটকে দাঁড়াল কয়েকজন অ্যাকশন স্কোয়াড। তাঁকে রীতিমত জেরা করতে লাগল। চরম বিপদের দিকেই এগোচ্ছিল ঘটনার প্রবাহ। কিন্তু তার মধ্যে একজন বলে উঠল…আরে এ শালা কোবতে লেখে রে! তিনি ছাড় পেয়ে গেলেন। বাংলা সাহিত্য আরেকটা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচল।

ঐ ক্যান্সার রোগী কিংবা সেই উগ্র ছেলেটি দুজনেরই মনে কবি ও কবিতার প্রতি শ্রদ্ধা, সমীহভাব এবং অবশ্যই সেই ভালবাসা দেখলাম যা নিজের মৃত্যুর সামনে বা অন্য কারুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সময় প্রবলভাবে জেগে ওঠে। শুধু কবি, কবিতা কেন সাহিত্যচর্চা, বিদ্যাচর্চার জন্য বাঙালির গোষ্ঠী অবেচতনে এই ভালবাসা, শ্রদ্ধা যা আছে তা ঐতিহ্য, জাতির অন্যতম পরিচয়। অবক্ষয়ের এই ভরা কোটালেও বাঙালি তার কালচার নিয়েই কালচারাল। কলেজস্ট্রিট সেই কালচারের ভিত্তিভূমি। দেড় কিলোমিটার পথের অজস্র পরিচয়কে ঢেকে তাই বইপাড়াই কলেজস্ট্রিটের মুখ, চেহারা। যতই সে মুখে কালি লাগানোর চেষ্টা হোক কলেজস্ট্রিট বাঙালির কাছে জ্ঞানচর্চার খোলা দরজা হয়ে আছে এবং থাকবে। আজ এই পর্যন্ত কলেজস্ট্রিট থেকে। ভাল থাকবেন সবাই।

রাজেশ ধর : কথাশিল্পী, কলকাতা, ভারত।

আরও পড়ুন – কলেজস্ট্রিট থেকে – পর্ব ২