রবিবারের কলেজস্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জীস্ট্রিট, ভবানী দত্ত লেন সব মিলিয়ে বইপাড়ার চেহারা কেমন থাকে? ছুটির দিনে ব্যস্ত শহরের রাস্তা যেমন থাকে ঠিক তেমনই। দু-একটা ওষুধের দোকান, বহুজাতিক সংস্থার কেক-পেস্ট্রির দোকান ছাড়া সব বিপণী বন্ধ। রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম, ফুটপাতে হকার নেই। তারই মধ্যে বিদ্যা-মেধাচর্চার এই ফোকাস পয়েন্টে কিন্তু মানুষ আসে। সাহিত্য-সংস্কৃতি-সামজিক কাজ, নানা বিষয়ে এই চত্বরে রবিবারেই অধিবেশন বসে, মহাবোধি সোসাইটি, ভারতসভা, বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিকীর মত হলে।
সেসব আয়োজন বেশিটাই আনুষ্ঠানিকতায় ভরা থাকে। ছুটির দিনে শহর পেরিয়ে যান্ত্রিকতায় ভিড় বাড়াতে ইচ্ছে করে না। তবুও আসতে হয় ছুটির দিনে এই বইপাড়াতেই। কচ্চিৎ, কদাচিৎ হলেও আসতে হয়। রবিবারের ফাঁকা রাস্তার ধুলো, প্লাস্টিক, আবর্জনা, নেড়ি কুকুরের দল কিম্বা দু-একটা ছুটকোছাটকা বাইকদের অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়তে হয় তাদের রাজত্বে। ধোঁয়ার আসক্তিকে বুকে চেপে এগিয়ে যেতে হয়; সিগারেটস্টলদেরও ছুটি। এবং অবশেষে পৌঁছে যাওয়া যায় কোনো ঘরোয়া, আন্তরিকতায় ভরা, মার্জিত রুচির সাহিত্যসভায়। হয়ত সরকারি ভবনের নির্জন একটি ঘর খুব চেয়েচিন্তে যার অনুমতি পাওয়া গেছে বা বিদেশী প্রকাশকদের আদলে ইদানিং গড়ে ওঠা বাংলা প্রকাশকের ‘বই-ক্যাফ’ যেখানে সাকুল্যে হয়ত কুড়িজনের সংকুলান হতে পারে-এমনই সব ঠিকানায় চর্চা হয় নিখাদ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির।
সত্যি বলতে কি যেকথাটা পাঠকের জানার কথা নয় কিন্তু লেখালেখি নিয়ে যারা একটু অন্তত মেতে থাকেন তারা জানেন, সাহিত্যের চর্চায় একসাথে পাঠ, আলোচনা, আড্ডা এগুলো খুব জরুরি। যে ভাষার সাহিত্যে এই চর্চা নেই, তাদের সাহিত্যের উন্নতির আশা কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এমন আড্ডা, যেখানে লেখক-শ্রোতা-আলোচক সবাই নির্দ্বিধায় নিজের নিজের কথা বলবেন তা কখনওই সেমিনার-সিম্পোসিয়ামে হওয়া সম্ভব নয়।
নিজেদের দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক, ঠিক এই সময় এপার, ওপার দুপার বাংলায় অগুনতি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আছে আর আছে তাদের বাংলা বিভাগ। সিলেবাসে রিসাইটেশান, রিসার্চ পেপারের ছড়াছড়ি। বাধ্যতামূলক সেমিনার, সিম্পোসিয়াম। বিষয় হিসাবে আসছে আগেকার সাহিত্য এবং এখন বাজারে যেসব লেখা বেশি বিক্রি হচ্ছে, পুরস্কার পাচ্ছে সেইসব লেখা। অধ্যাপককুল বলছেন সেখানে। পুরস্কৃত লেখকেরা, বেশি বিক্রির লেখকেরা ডাক পাচ্ছেন। দেখলে মনে হয় বাংলাসাহিত্যার একটা ‘ফিলগুড সিচ্যুয়াশান’
চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরে এত আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল না। কিন্তু বাংলা ভাষার নতুন প্রকাশের দিক, তার শক্তি ও সাহিত্যের নতুন ফর্ম ও কন্টেন্টের যে খোঁজ, যে আন্দোলন জোয়ার আনত, বাজারও তাকে মান্যতা দিতে বাধ্য হত! এই প্রসঙ্গে অনেক নামের মধ্যে দুটো নাম না বললেই নয়; সতীনাথ ভাদুড়ি ও সমরেশ বসু। দুঃখের কথা এখন আর তা চোখে পড়ছে না!
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের কথা হচ্ছিল। সেদিকেই ফেরা যাক! সেখানেও দুঃখেরই কথা। যারা বাংলা ভাষার ছাত্রছাত্রী তারা প্রাইভেট ট্যুইশানের মত পয়সা দিয়ে রিসাইটেশান পেপার লেখাচ্ছে। মাস্টার্স ক্লাসেও প্রাইভেট দিব্যি ট্যুইশান চলছে। সেই ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতা-অধ্যাপনার চাকরি না পেলে, বাংলা মৌলিক কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক বা প্রবন্ধের বই কিনবে? আর মৌলিক সাহিত্যের নতুন নতুন ধারা যে জাতি তৈরি না করতে পারে, শুধুই অক্ষম বিদেশী ভাব ও ভাষার অনুকরণ করে বা প্রথা হয়ে যাওয়া জনপ্রিয় বিষয় আর রীতির গল্প, কবিতার উচ্ছিষ্ট চিবিয়ে চলে তাদের জাতির মেধা উৎকৃষ্ট এমন কথা ভবিষ্যতের ইতিহাস কিন্তু বলবে না।
কলকাতার বইমেলায় ইংরেজি ভাষার বই-এর ব্যবসা বেশি হয়। লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়ানেও জনপ্রিয় ধারার ছবি-প্রচ্ছদ দেওয়া ফিকশান-নন ফিকশান, রান্নার বই, বাগানের বই, ইদানিং রাশিফল-জ্যোতিষও থাকছে। গোটা কয়েক ধুঁকতে থাকা পত্রিকাই শুধু সময়কে ধরার, সাহিত্যের নতুনত্ব খোঁজার চেষ্টা করে। ক্রেতারা সবাই প্রায় লেখক। ছাত্রছাত্রীরা বা অধ্যাপকেরাও আসে সিলেবাসের রেফারেন্স খুঁজতে। অনেক সম্পাদক আজকাল আর মৌলিক কবিতা, গল্প ইত্যাদি ছাপতেই চান না। তাদের প্রতিটা সংখ্যাই যেন সিলেবাসের দিকে তাকিয়ে স্পেশাল ইস্যু। এই নাছোড়বান্দা লেখক-কবিদের বই যদি পঞ্চাশ-একশো কপি বিক্রি হয়, প্রকাশক-সম্পাদক মুদ্রণ শেষ বলে সমাজমাধ্যমে বিশেষ জ্ঞাপন দেন। বিনিময়ে লেখকরা কী পান? সেকথা … আজ না হয় থাক।
কলেজস্ট্রিটে ঘরোয়া সভার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। যারা এই কলাম নিয়মিত পড়েন, তাদের নিশ্চই মনে আছে, এ লেখা শুরুর সময় বলা হয়েছিল সাহিত্যের আড্ডার কথা থাকবে। আজ এমনই এক সভা যেখানে ‘পন্ডিতি কম আড্ডা বেশি’ তার কথা একটু বলি। বিশিষ্ট কথাশিল্পী সুকান্তি দত্তর সর্জন সাহিত্য সম্মিলন প্রায় আট-নমাসের ব্যবধানে, দুই রবিবার প্রায় জনা কুড়িকে ডেকে নিয়েছিলেন। কথা বলার বিষয় হিসাবে প্রথম দফায় ছিলেন অমিয়ভূষণ, দ্বিতীয় দফায় দীপেন্দ্রনাথ, আমাদের দীপেনবাবু! একবার লিখেছিলাম জাতে মার্কিন-বিলিতি রক্ত, আর ভাষা ইংরিজি হলে বাংলায়; এই রোদ-বৃষ্টি-ঘাম-জলের বাংলায় একগাদা নোবেল আসার কথা। আর অমিয়ভূষণ আর দীপেনবাবুর নাম সেই নোবেলজয়ীদের লিস্টে থাকতই। মুশকিল হচ্ছে এই শ্লাঘা, খুবই সীমিত লোকের। কজন এই দুই লেখককে পড়েছেন বা পড়ছেন? যদিও ইদানিং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও তাদের নিয়ে চর্চার পরিসর বাড়ছে। যাই হোক, ‘সর্জনে’র সভার কথায় আসি।
প্রতিভাবান, তরুণ শান্তনু ভট্টাচার্য, সৌরভ চক্রবর্তীর মত লেখক, স্বপন পান্ডা, অনিশ্চয় চক্রবর্তী, শরদিন্দু সাহার মত মেধাবী চিন্তাশীল বর্ষীয়ান সাহিত্যকারেরা আলোচ্য লেখকদের নানা দিক নিয়ে এই দুই আড্ডায় বলেছেন। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে এই দুজনের লেখা আজও কতটা, কেন প্রয়োজন সেকথা ফুটে উঠেছিল চোখের সামনে। তবে শুধুই কথার কচকচি ছিল না। বিরতিতে চা-বিস্কুট। আগেপরে রুচিশীল গান, কবিতাপাঠ । সমালোচনার সাথেসাথে রসসাহিত্যেরও আলাপ-বিস্তার । একসময় শেষ হল, সীমিত সময়। কিন্তু ভাষার নাম বাংলা, জাতির নাম বাঙালি; আড্ডাবাজ বাঙালি। সাহিত্য বিপণীর বাইরে এসে ফুটপাতে জমে উঠল লেখক-কবিদের আরেক আড্ডা। অবশ্য রবিবার ছুটির দিন, ফেরার বাস-ট্রেন-মেট্রো সংখ্যায় কম। তাই জমাট গুলতানি খুব একটা বাড়ে না। যে যার বাড়ির রাস্তা ধরতে হয়।
আবার সেই নির্জন বঙ্কিম চ্যাটার্জী বা ভবানী দত্ত এবং হুশ-হাশ করে গাড়ি চলেযাওয়া কলেজ স্ট্রিটের মৌতাত। কলকাতার এ এক নিজস্ব মেজাজ। একটু দূরের কলাবাগান, রমাজানের সন্ধ্যারাতে চাপ-বিরিয়ানি-পরোটা-কিমা-দই-লস্যি-আতর-জর্দাপানের জমজমাট, আর এখানে বন্ধ বই-এর দোকানের আলমারির ভেতরে ঘুমিয়ে আছে অজস্র চিন্তা আর জ্ঞানের রাশি। পাঠক কোনদিন সোনার কাঠি দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলবে তার প্রতীক্ষায়। রাতের প্রথম প্রহরে বইপাড়ার মাঝরাতে আচমকাই মনে পড়ে যায় দীপেন্দ্রনাথ, এই শহরের ভূমিপুত্র আমাদের দীপেনবাবুর কথা। ঐ তো বৌবাজার স্ট্রিট আর কলেজস্ট্রিট যেখানে কাটাকাটি করছে সেখানেই ‘কালান্তরের’ অফিস। আর এম জি রোডের ক্রসিং পেরিয়ে হাওড়ার দিকে গেলে ‘পরিচয়ের’ দপ্তর। আদ্যন্ত পার্টিম্যান দীপেনবাবু এই দুই অফিসেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। কঠোর পার্টি শৃঙ্খলার মানুষ দীপেনবাবু কি এমন ছুটি বা বন্ধের দিন সন্ধে বা রাতে বইপাড়া দিয়ে একাকী হেঁটেছেন? কী ভাবতেন তিনি? শহরের এই অচেনা নেশানেশা প্রকৃতি কি তাকে অচেনা জীবনরহস্যের দিকে তাকাতে বলেনি? প্রতিভায় ভাস্বর কয়েক জ্যোতিষ্ক যেমন ফুটপাতে শুয়ে রাত-শহরের ফ্যাকাশে আকাশে থাকা জ্যোতিষ্কদের আতুর চোখে দেখে মগ্ন হতেন। মানুষের সংগ্রাম আর পার্টির কাজে লক্ষ্যভেদী অর্জুন, পাখির চোখই যার লক্ষ্য! যার কথাসাহিত্যের বিষয় তাঁর নিজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির নির্মম আত্মবিশ্লেষণ কিম্বা দুঃখী লোকদের দুঃখের কারণকে নির্মোহ উপস্থাপন সেই লেখকের কি কখনও কোনদিন তেমন অনুভূতির মুহূর্ত আসেনি?
এসব অবান্তর প্রশ্নের কোনো মানে হয় না! কিন্তু দীপেনবাবু মধ্যবিত্তদের নিয়ে লিখেছেন, অশ্বমেধের ঘোড়ায় “…আমাদের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, মনে মনে আমরা আরও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ সেই মৌলিক ছকের ওপর ঘুঁটির মতো এগোচ্ছি, পেছোচ্ছি। এ যুগের নিয়তিই হল বাল্য এবং প্রৌঢ়তা-মধ্যিখানে বিশাল চড়ায় ইচ্ছা ও অভিজ্ঞতা, ভাললাগা আর কর্তব্যের বিরোধে আমরা পোকার মতো গর্ত খুঁড়ে নামছি-অথচ সামনে সমুদ্র ছিল!” এ সমুদ্র কি শুধুই শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজে মুক্ত সৌন্দর্য, ভালবাসা আর আনন্দের মহাসাগর? জড়প্রকৃতির মহাজগৎ ও জীবনের মহাভাষ্য কি তার মধ্যে মিশে যায় না?
বসন্তকেবিনের গোঁড়ায় পান-সিগারেটের স্টল খোলা। একটু থামি। অন্যরকমের এক সন্ধ্যায়, পান-সিগারেটের দোকানেও দীপেনের সময় ঘুরেফিরে আসে। সে সময়েও এইসব দোকান, একই রকম ছিল! এমনই ইউনিক গুমটি। দীপেনের নায়ক, সংসারখরচ বাঁচানোর চরম আবর্তেও এমন দোকান থেকেই কিনত চারমিনার! সেই প্লেন চারমিনার আর নেই! সিগারেটের প্যাকেট, দাম বাজার অর্থনীতিতে অনেক বদলেছে। বিড়ি এখন আর বান্ডিলে নয় প্যাকেটে বিক্রি হয়। তখনকার লেমনেড, এখন সফট ড্রিঙ্কস। আমার পাশে পাশে কি দীপেন হাঁটছেন? “…অথচ কলকাতা প্রতি মুহূর্তে বদলায়। পৃথিবী বদলায়। জীবন বদলায়।”
দীপেনের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন অনেক স্বচ্ছল। কলেজের অধ্যাপকদের, স্কুল শিক্ষকদের সংসার চালাতে আর ট্যুইশানি না করলেও বেশ চলে যায়। অর্থের অভাবে বিয়ে না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জাতপাতের গরিমাও হারিয়ে গেছে প্রায়। বাইরে-ভেতরে প্রচুর বদল এসেছে। কিন্তু সত্যি বদল এসেছে কি? ক্রেডিট কার্ড, শেয়ারবাজার, নতুন নতুন গ্যাজেট, ড্যানিয়েল-ওয়াকার সাহেবভাইরা… প্রি-ম্যারেজ, পোস্ট ম্যারেজ আবহে বিভোর মিডল-ক্লাস। তবুও এখন সুখের সূচকে কোথায় কলকাতা? মনের চিকিৎসকদের আস্তানায় কাদের ভিড়? এ কি সেই দশা নয়? যতই বদল ঘটে যাক। এই ব্যবসায়ীদের সভ্যতার সবে তো সকাল। আর সেই সকালই এই পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছে রাত, যে রাত একটু একটু করে ঘন হচ্ছে। রেকর্ড বিদ্যুতের উৎপাদনে সে অন্ধকারে বৈচিত্র্য আসছে। কিন্ত রাত?
“… দিনে দিনে রূপবতী হবে পৃথিবী। দিনের পর রাত্রি। কিন্তু রাত্রির পর? রাত্রির পর?” চরম কথাটাই শেষ করে দীপেন থেমে যান, আলো ঝলমলে হ্যারিসন রোডের ক্রসিংয়ে। বাড়ি ফিরতে হবে হাতছানি দেয় মেট্রোর সুড়ঙ্গপথ। সাদা আলোয় চিহ্নিত আরেক অন্ধকার টানেল! দীপেনের কাঞ্চন, রেখা , ঘোড়াগাড়ির গাড়োয়ানের অপমান সহ্য না করে পালিয়ে এলেও তাদের বহমান জীবন থেকে পালাতে পারেনি। এই প্রগাঢ় বিস্ময়কে বুকের ভেতর নিয়ে আমরাও পালাতে পারি না। দীপেনের কাছে বারবার ধরা পড়ে যাই আবার সেই দীপেনের কাছেই ফিরি উপশমের আশায়! আমাদের শোকমিছিলের শেষ নেই। বন্ধুপাঠক, কলেজেস্ট্রিট থেকে আজ এই পর্যন্তই। ভাল থাকবেন। চলুন আবার দীপেনবাবুকে আরও একবার পড়া যাক। ২৫/৩/২৪