গল্পে কী থাকে? এরকম প্রশ্ন ধরে এগুলে সম্ভবত গল্পের ভূবন ও গল্পচর্চার একটা প্রেক্ষিত আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। একজন গল্পকার তার গল্পরাজ্য সাজান সমাজস্থিত বাস্তবতার নির্যাস দিয়ে। অধিবাস্তবতা অস্বাভাবিক নয় তবে মোটাদাগে গল্পের শরীরে হাজিরা দেয় মানুষ। মানুষই গল্পের আরাধ্য। একজন সচেতন গল্পকার অনেকটা “… মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে”। মানুষের ছায়ার সীমানায় গল্পকার পুঁতে দেন তার সৃজনের অনিঃশেষ বীক্ষণ। ফয়সাল আহমেদ সেইসব গল্পকারদের অন্তর্ভুক্ত যারা পরিপার্শ্বকে তুলে আনেন গল্পে, চারপাশকে মর্যাদা দেন তুমুলভাবে। অনাদরে পড়ে থাকা সম্পর্কটুকু, অবহেলায় অতীত হতে থাকা ছায়াটুকু, ক্রমশ ফিকে হয়ে যাওয়া মানুষের মুখ গলাগলি করে ফয়সাল আহমেদ এর গল্পে, অন্তত “চিরকুট” গল্পগ্রন্থ তা-ই সাক্ষ্য দেয়।
“চিরকুট” গল্পকিতাবটি সাতটি গল্পে সাজানো এক বৃহৎ বাগান। নানা রঙের, নানা ঘ্রাণের ফুলদের প্রাণময় উপস্থিতি নজর কাড়ে নানাভাবে। গ্রন্থস্থিত কোন কোন গল্প অনায়াসেই হতে পারতো নভেল, কোন কোন গল্পের সীমাবদ্ধ অক্ষরের ভেতর লুকিয়ে আছে সীমাহীন মানবিক আকুতি-স্তুতি। পরিপার্শ্ব দিয়ে, চরিত্র দিয়ে, সংলাপ দিয়ে, এমনকি দুই লাইনের মধ্যকার নিরবতা দিয়েও গল্পকার ফয়সাল আহমেদ গল্পগুলোকে করে তুলেছেন আক্ষরিকভাবেই মানবিক-ভূখন্ডে। এসব গল্পপাঠে অন্তরে ঢেউ ওঠে, বোধে নাড়া দিয়ে যায় অন্যরকম এক অদৃশ্যমানতা। পাঠশেষেও জেগে থাকে কতিপয় প্রশ্ন, যা কেবল অনুচ্চারিত বেদনার সহোদর হয়ে সাঙ্গ দেয় পাঠকের ভাবনাকে।
দৃশ্যমান পরিবর্তন হলেও আমাদের সমাজের ভেতরগত কতটুকু পরিবর্তন এসেছে? দিপালি পিসির কাল পেরিয়ে বেনুর কাল এসেছে বটে; আধুনিক প্রযুক্তি চালিত যাপনরীতি এসেছে তবুও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার কপালের ভাঁজ কমেনি এতটুকু। বেড়েছে বখাটেদের উৎপাত, অভিভাবকদের শংকা। “চিরকুট” গল্পটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। নামগল্প হিসেবে গল্পটির প্রতি পাঠকের থাকে আলাদা দৃষ্টি। “… আশেপাশে কারও বাড়ি গিয়েছে বোধহয়। না পালিয়েছে কারও হাত ধরে…” এখান থেকে যদি শুরু করি, গল্পটি নানা ইঙ্গিতে ভরপুর। যেকোন বিষয়কে গুজবে পরিণত করার যে আদি স্বভাব আমাদের, তা গল্পকার আলোচ্য গল্পের প্রাগুক্ত লাইন দিয়েই বুঝিয়ে দেন। সঠিক কার্যকারণ না ভেবে অনুমাননির্ভর মন্তব্যে আমরা সপেঁ দেই ভবিতব্যকে– যা অনেক সময় বয়ে আনে বিপদ। সৃষ্টি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত রটনার। বেনু পালায়নি, কেউ তাকে অপহরণ করেনি। আমাদের সামাজিক চোখ তার সাময়িক অনুপস্থিতিকে করে দিয়েছে ঘোলাটে; যা মোটেও ব্যক্তিক নয়, সামাজিক-রাষ্ট্রিক দীনতার মানচিত্র। দিপালি পিসি, অকালপ্রয়াত স্বামীর স্মৃতিহীন জীবন যার কাটে বাপের ভিটেয়, তার ক্ষীণ আহ্বান, “… মাইকে ঘোষণা না দিলে হয় না। বাড়ির মেয়ের ইজ্জতটা নষ্ট করিস না বাপ।” পেশীর আস্ফালনের বিপরীতে ম্লান হয়ে আসা জ্ঞানের আলোয় যেনবা প্রতিস্থাপিত হয় দিপালি পিসির আর্তস্বর। লেখক দিপালি পিসিকে নিমার্ণ করেন এদেশেরই হাজার বছরের নিকোটিন পেপার-জাতীয় রমনীর প্রতিভূ হিসেবে। কিন্তু নন্দু সাহা অসহায় পিতা হয়ে কিইবা করতে পারে আর? শেষতক নিজের দারিদ্রের কাছে পরাজিত হয়ে মেয়েকে তুলে দেয় বাকপ্রতিবন্ধির কাছে! একটি ছোট্ট চিরকুট, “আমি একজন বাকপ্রতিবন্ধী” বাক্যের ভেতর দিয়েই গল্পকার হেচকে টান দেন পাঠকের কলিজা ধরে।
নন্দু সাহার মুক্তির সমাধান পাঠককে দিয়ে ফয়সাল আহমেদ ঢুকে পড়েন আরেক নির্বাণে। “মাতাল রাতের গল্প” নামের এ গল্পে রাসেলের উপর সওয়ার হয় গল্পকার। বোনকে খুঁজে বের করতে অপার বেদনা নিয়ে রাসেল প্রথমে যায় হাসপাতালে। গল্পকার কায়দা করে এখানে পাঠককে মুখোমুখি করে এ দেশের সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় চলমান দূরবস্থার। মনের ইতি-উতি আর কানকথার জেরে রাসেলের থানামুখি যাত্রায় সঙ্গ দেয় এক বারবধূ! মধ্যরাতে চোর যেমন ইবাদতকারীকেও চোর মনে করে তেমনি বারবধূ খদ্দের ভেবে বাজিয়ে ছাড়ে রাসেলকে। থানায় গিয়ে রাসেল আবিস্কার করে এখানে ভোগদখলে রুচির বিভেদ নেই। কেবল লোকদেখানো চুৎমার্গ। সাথে আসা অনাহুত বারবধূটিও পুলিশকে শুনিয়ে দেয়, “… আর কত মাগনা শরীর দিমু, হ্যাঁ? কয়েকবার গেছি আপনার স্যারে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। এইটা আমার পেশা, টাকা না পাইলে বাঁচমু ক্যামনে?” থানা-পর্ব শেষে রাসেল ফিরে আসে বাড়িতে। ততক্ষণে সহিসালামতে তার বোন বাড়ি ফিরেছে বান্ধবীর বাড়ি থেকে। থানার ভিকটিম তো আর রাসেলের বোন নয়! মানবিক বিভৎসতায় ক্রমশ জেগে ওঠা জিঘাংসু মনোভাবে লেখক ঘুরিয়ে আনেন পাঠককে। সেইসাথে খুন-গুমের সংস্কৃতির যে চল এখানে শুরু হয়েছে তা-ও বিধৃত করেন। দ্রুত ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে আমরা কত বেশি এককেন্দ্রিক তা রাসেলকে দিয়েই কী গল্পকার উন্মোচন করেন না? নিজের বোন ঠিকাছে, পরের বোনের কী হলো তাতে কী আসে যায়! কিন্তু একদা ছিল বিশ্বাসের কঠিন প্রাচীর।
“জবানা ও নেতার গল্প”-এ জবানার সাক্ষ্যদানকে কেন্দ্র করে গল্পকার যেভাবে গল্পের জবানাকে বঙ্গবন্ধুর জবানা করে তোলে তা অনন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের সাথে বঙ্গবন্ধুর অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্বের বয়ান আছে গল্পটির শেষ প্রান্তে। অথচ জবানার বঙ্গবন্ধু-দর্শনের অধিক হৃদয় ছুঁয়ে যায় বিচারালয়ে উপস্থিত লোকদের তুলনারহিত নিস্তেজ হয়ে যাওয়াকে। একজন নেতা কতটা মানবিক আর হৃদয়ের গভীরে গেলে লোকেদের আবেগে এতটা ভর করে তা গল্পপাঠে পাঠক বুঝতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিতে নয় বরং এ গল্পে গল্পকারের সুযোগ ছিল আরো বিস্তৃত করার।
চিরকুট গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যানভাস জুড়ে থাকা গল্প “যেতে যেতে পথে”। অনেকটা সিনেমাটিক, মানবিক ক্ষমার অনন্য শাব্দিক দলিল গল্পটি। এটা অনায়াসে নভেলা হতে পারতো কিংবা সিনেমা।
তাপসেরা তাদের বাবাকে অন্তিমযাত্রায় শুইয়ে দিতে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে মঞ্জিলের ট্রাকে করে। যদিওবা গল্পকার পাঠককে মঞ্জিলের পরিচয় দেন পিকআপ ড্রাইভার হিসেবে। এই ভ্রম সচেতন পাঠকের নজর এড়িয়ে না যেতেই শুনতে হয়, “আব্বু এক জীবনে তোমার যা অর্জন, আমি হয়ত দুই জীবনেও তা পারব না”। ফলত পাঠকের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তাপসের পিতার এতই সম্বল তবে তাকে অন্য কোন বাহন বাদ দিয়ে কেনইবা ট্রাকে তুলতে হবে, অন্তিম যাত্রায়? ফুলপুর শুনেই দপ করে জ্বলে মঞ্জিলের হৃদয়। অকালে পিতৃহারার স্মৃতিসঞ্চয়, দাদা-মায়ের সংগ্রাম, পিতার গান-বাজনা একাকারে হয়ে ফিরে ফিরে আসে মঞ্জিলের রাডারে। এবং গল্পের কাকতালে মঞ্জিল জেনে যায় তার ট্রাকে যার লাশ তিনিই তার পিতার হন্তারক! একজন ট্রাক ড্রাইভারের কাছে কী আশা করে এই সমাজ? গল্পকারের নিয়তি মানবিক ভ্রুণে গড়া, ফলে তাকে গালাগালির বদলে তৈরি করতে হয় গলাগলির পরিবেশ! “চিরকুট” গল্পের মতো ছেড়ে দেন না “যেতে যেতে পথে” গল্পটি; শেষতক ক্ষমার মহান সৌন্দর্যে তাপস আর মঞ্জিলের ব্যবধান দূর করে গল্পকার দাঁড় করান মানুষের পরিচয়।
“রেখা আর আমার সময়গুলো” তুলনামূলক হালকা মেজাজের গল্প। বেকার জীবনের প্রেম, রক্ষণশীল সমাজে নাটকচর্চায় বিপত্তি, সামাজিক কানুন ইত্যাদি মিলে গল্পটি হতে চেয়েছে সময়ের অভিঘাতমাখা সঙ্গীত। রেখাকে পার্থিবতার কষ্টিপাথরে পোড়া হীরকখন্ড ভেবে পাঠক আপ্লুত হয় কিন্তু এ-ও বোঝে, একজন বেকারের কলেজ থাকার কথা না, অন্তত পড়াশেষ বেকারের। তবুও গল্পকার রেখাকে, “আমি তোমার কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি” বলে নিয়ে আসেন। ইতিহাসের ভেতর দিয়ে রেখা নিজেকে জায়মান রাখতে চায় সমাজের একজন হিসেবে। পরিপার্শ্বের চাপে তাকে ভাঙ্গতেই হয়। গল্পপাঠে পাঠকের উপলব্ধিতে জোর প্রভাব ফেলে, প্রযুক্তি আর যত ক্ষতিই করুক, কাউকে খুঁজে পেতেও সাহায্য করে। “ঠিক ভোরের আগে” চিরকুটে’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্প। আসমত শেখ “লালসালু”র আগে ছিল, বর্তমানেও আছে। আসমত শেখের স্বপ্নে নারী দা ঠিকই বসিয়ে দিত বুক বরাবর; তাতে আসমত শেখ শেষ হয়ে যেত মধ্যযুগীয় কায়দায়, হয়তো ড্রেনে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটিও। আসমত শেখের পাপের ফসল, যার স্থান কি না ড্রেনের ময়লা জলে ছিল, তার দায়িত্ব নেয় আসমত শেখেরই বড়ছেলে সুমন শেখ, একান্তই মানুষ হিসেবে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বুঝি এভাবেই হয়! শেষে ফয়সাল আহমেদ আসমত শেখের মুখ দিয়ে স্ববিরোধীতার চরম ন্যাংটামো উন্মোচন করেন এভাবে, “আমার বাড়িতে পাপের জায়গা নাই”। কিন্তু পাঠক ভেবে নিশ্চিন্ত হন, শিশুটি মরে না। গল্পকার সুন্দরের চর্চায় শিশু-মৃত্যুর সে সুযোগ রাখেননি।
“চিরকুট” গল্পগ্রন্থের ভাষা পাঠকের কাছাকাছি। গল্পের চরিত্রগুলো মাটিলগ্ন, তাদের মুখের কথাও মাটিগন্ধী। তবে কখনোসখনো আলগা প্রলেপের প্রমোদ নেই এমনটি বলা যাবে না। কখনো বানান বিভ্রাটের অশান্তিতে পড়তেও হয় পাঠককে। গল্পস্থিত মানুষগুলোর মানবিক হৃদয় অনেক দিন বেঁচেবর্তে থাকবে পাঠকের হৃদয়ে। “চিরকুট” পর্ব বিদেয় দিয়ে ফয়সাল আহমেদ এর কাছে এবার আরেকরকম গল্পেরই প্রত্যাশা থাকবে আমাদের। কেননা মানুষের ভেতর জেগে থাকার মানবিক কল্পনার বিনিয়োগ আছে এই গল্পকারের!
আরও পড়ুন – চিরকুট একটি মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প-সংকলন