নিঃসঙ্গের অনুষঙ্গ এবং প্রেক্ষিত ভালোবাসা

ইকবাল রাহমান 

আধুনিক বাংলা কবিতার দশকওয়ারী হিসাব পর্ব ম্লান করে দিয়ে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন এক কাব্য চর্চার বহিঃপ্রকাশ কবিতার মূলধারার আলোকিত দর্শন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একমাত্র সময়ই নির্নয় করতে পারবে। কবিতার নান্দনিক সরলতার সৌন্দর্য বা স্নিগ্ধতা এখন আর ছন্দবদ্ধ মেলবন্ধনে ঠিক সেইভাবে জড়ায় না। কবিদের ভিন্ন ভিন্ন দল সময়ের দর্পণ কতটা তুলে ধরতে পারছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। মূলত ব্যক্তিগত প্রকাশের ভিন্নতর সামাজিক ঘরনা, কাব্য ভাবনাকেও সীমিত করছে।

তারপরও কবি ইভা ওসমান এর কাব্য ভাবনা, তার কাব্যগ্রন্থ থেকে  বিচ্ছুরিত শব্দালোক প্রায় তিন দশক ধরে তার পাঠকদের কাছে নিভৃতে নন্দিত হচ্ছে। ‘আমি জানতাম আজ সকালে বৃষ্টি হবে’ কবির পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ।  তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সময় নির্ধারন করে প্রায় ২৬ বছরের কাব্য প্রকাশের সৌন্দর্যে কবি এখনো তার নিজস্ব কাব্য ভাষায় উজ্জ্বল। 

গদ্য সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ হুমায়ুন আহমেদ এর সহজ গদ্য ভাষার এক ভিন্ন মাত্রার কাব্যিক প্রকাশ ইভা ওসমান এর পদ্য ভাষার সহজ বোধ্যতা। কবি’র রোমান্টিক, শান্ত, স্মৃতিকাতর  কাব্য ভাষার এক ভিন্ন আলো সহজেই পাঠকের সাথে সখ্যতার এক সাঁকো তৈরী করে। একাকী কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী তার কবিতার গঠন।  কাব্যগ্রন্থে মুখ্য বার্তায়, আমার কথায় কবি তার কবিতার ভাষায় বলেন-

‘আমার স্বপ্নে তুমি থাকো
তোমার স্বপ্নে হয়তো অন্য কেউ
আমি ও কি
অন্য কারো স্বপ্নে থাকি নাকি? ’

স্বতন্ত্র ভাবে চিহ্নিত করে কবি’র মানসিক গঠনের প্রাজ্ঞতাকে। আর এভাবেই প্রেমময়, মায়াময় কল্পনা আর বাস্তবতার অপুর্ব এক মেলবন্ধন সংযুক্ত হয়ে সংক্রামিত হয় পাঠকের মানস পটে।

এই কাব্যগ্রন্থে কবি ইভা ওসমান বিধিবদ্ধ সূচিপত্র তুলে দিয়ে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন তার কবিতার পরিসর। ভিন্ন এক রাবীন্দ্রিক আলো পথ দেখিয়েছে কবি’র ভাবনায়, রবীন্দ্র বানীবদ্ধ উৎসর্গ পরিকল্পনা।  তারপরই প্রেম পর্বের কবিতাগুলির শিরোনাম চিন্হিত করেছেন কবিগুরুর ভাষায়- ‘… আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ো মাঝে

আর কিছু নাহি চাই গো …’

এই শিরোনামে পঞ্চাশটি ভালোবাসার কবিতা। প্রায় সব কবিতায় অনায়াস দক্ষতায় কবি সাজিয়েছেন তার পঙতিমালা। আমরা প্রত্যক্ষ করি ভালোবাসার এক শিল্পীত জগৎ, তার ব্যক্তিগত দর্শন, দৃঢ় শব্দচিত্রে ফুটে ওঠে প্রগারো মায়াবদ্ধ ভিন্ন এক কবিতা বিলাস।

‘নদীতে ডুব দেবার চাতুর্য শিখে

ইচ্ছে হলেই তাকে বিসর্জন দেবো, নোনা জলে !’

-অথবা

‘আমার পদ্যবৃন্তের 

চারপাশে

ফুটে থাকে

তোমার ঠোঁটের আঁকিবুঁকি’

-কিংবা

‘আমি মেঘ চেয়েছিলাম

আর তুমি

বৃষ্টি দিয়েছো মন ভরে’

কিংবা-

‘কথা ছিল

শুধু

হাতটি ধরার

আর

তুমি

ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে’

-কিংবা

‘দেখি…

জলে ভেসে যাই কিনা আকূল পাথারে’

এইভাবেই বিভিন্ন কবিতা ভাসানে, ভাসতে ভাসতে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে যান কবি।  অথবা কবি’র ভাষায় কবিতার শিরোনাম হয়ে উঠেন সময়ের শ্রেষ্ঠতম কবি ‘জয় গোস্বামী ’ ও।  

আমি জানতাম আজ সকালে বৃষ্টি হবে- ইভা ওসমান
আমি জানতাম আজ সকালে বৃষ্টি হবে- ইভা ওসমান

কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় পর্যায়ে কবি আবারও কবিগুরুর ভাষায়  বিভক্ত করেন শিরোনাম-

‘যদি জানতেম আমার কিসেরও ব্যথা

তোমায় জানাতাম

কে যে আমায় কাঁদায়

আমি কি জানি তার নাম…’

আর এইভাবেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সাতাশটি বিরহ প্রধান কবিতা-

ছুঁয়ে দেখিনা হাত দুটো তোমার

আদর করিনা

রাখিনা তোমার বুকে কতকাল’

এই শুন্যতার ছায়া নিয়ে ফুটে ওঠে বিরহী সংলাপ-

‘তুমি চলে গেলে

আর রেখে গেলে

তোমার আদরের বিন্দু বিন্দু স্পর্শ’

অথবা কবিতা ভাষায় কবির ভারাক্রান্ত মন বলে ওঠে-

এই শহরে
তুমি আজ নেই
তাই
এই শহরের
বোধের গভীরে
ভালোবাসা বেঁচে নেই’

-কিংবা

সেই তুমি আর কবিতা পড়ো না

সেই আমি আর কবিতা লিখি না’

এভাবেই বিরহ, বেদনা বুনে দিয়ে পাঠকের মনে কবি ভিন্ন এক সময় আঁকেন। একজন প্রাজ্ঞ অথচ স্পষ্ট মৃদুভাসি কবি ইভা ওসমান পাঠকের জন্যে শব্দে ফুটিয়ে তুলেন প্রেমবদ্ধ মায়াবী জীবন দর্শন। সমাজ বাস্তবতায় নিজস্ব কাব্য দর্শন যত্ন নিয়ে শব্দে সাজান কবি তার নান্দনিক যাত্রায়। 

কবিতার বইটি প্রকাশ করেছেন জাগৃতি প্রকাশনী।  প্রচ্ছদ ভাবনায় ফুটে উঠে কবির নিজস্বতা, আর অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী পরিকল্পনা। সুন্দর অলংকরণ করেছেন আকিদুল ইসলাম।  গভীর গাঢ় অন্ধকার রাতের আকাশে দীপ্তমান উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো নিজস্বতায় আবারও পাঠক প্রিয় হোক এই নন্দিত মায়াবী প্রকাশ।