জন্মান্ধ জিরাফ
নিজের উচ্চতা থেকে সামান্য নীচে ঝুলে আছে
প্রাচীন বটের প্রশাখা,
তার শরীরে জন্ম নিয়েছে যে পরগাছা—
ওদের কোনো খাদ্যাভাব নেই
বৃক্ষেরা সাধারণত ক্ষুধায় চিৎকার করে না !
চিৎকারের জন্য উচ্চারণের প্রয়োজন হয়
জীব ও জড়- উভয়ের যদিও প্রাণ থাকে—
সকল প্রাণ লালন করে না লোভের বাজার।
ভূকন্যার ভার মাথায় নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে
যে জন্মান্ধ জিরাফ;
সে কখনও জানতে চায়নি নিজের উচ্চতা
জগতে সবাই পেতে চায় সর্বোচ্চ পাহাড়ের হিস্যা,
কেউ মাটিতে মাদুর পেতে বসেই
স্পর্শ করে আকাশের গরিমা,
ছায়া দিয়ে এগিয়ে নেয় ।
……
ফেরিঘাট
প্রতিটি পৃষ্ঠার উপর ঝুলে থাকে একপাতা বিজ্ঞাপন
যারা জুতো সেলাই করতে জানে—
তারা বদলে দিতে পারে পা,
যারা আঁকতে পারে সূর্যের ছবি,
তারা বদলে দিতে পারে ভোরের রঙ।
আমিও বদলাবার কাস্তে হাতে নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছি ফেরিঘাটে
যাত্রী পারাপার হচ্ছে,
ছায়া পারাপার হচ্ছে,
বেদনা পারাপার হচ্ছে,
এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে অনেকগুলো বাহন।
মাঝে মাঝে পড়ন্ত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে
নিজের ছায়াতেই ডুবে যাচ্ছে পুরো ফেরিঘাট
কেউ দেখতে পাচ্ছে,
কেউ দুচোখ বন্ধ করে গোল হয়ে
বসে শুনছে অচেনা বাউলের গান।
……
আরও পড়ুন – ইন্দ্রনীল সুমন এর কবিতা ও কবিতা ভাবনা
ঋতুদের ভাঙা আয়না
নিশ্চয়ই ভাঙা আয়নায় নিজেকে দেখলে
মুখমণ্ডল দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় না,
তবুও মা,
আমার পোশাক-টেবিল থেকে
ভাঙা আয়নাটি সরিয়ে রাখতেন, আর বলতেন—
অপয়া আয়নায় ছায়া দেখতে নেই !
অথচ আমি নদীভাঙনের আয়না দেখতে দেখতে
আর ঋতুবন্দী মানুষের কান্না শুনতে শুনতেই
গ্রামের প্রান্তর পেরিয়েছি।
কিছু মেঘ আমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে—
কিছু দুপুরের প্রতিবিম্বে জিরিয়ে নিতে নিতে
আমি সোজা করেছি চুলের সিঁথি !
মানুষ তার বুকের ভেতর একটি গোপন আয়না
বাঁচিয়ে রেখেই জগত দেখে,
জগতের সকল আলো সেখানে প্রবেশের
অধিকার পায় না।
……
বৃক্ষেরা ফিরবে, মানুষ ফিরবে না
সমতল ভূমির প্রতি মানুষের দখলবৃত্তি
বেড়ে গেলেই বৃক্ষেরা বিপদগ্রস্ত হয়।
পাখিরা নিতে থাকে অন্য প্রদেশে উড়ে যাওয়ার
প্রস্তুতি। যারা পালকবিহীন—
তারা গোণতে থাকে মৃত্যুর প্রহর।
মানুষের যত ঈর্ষা সুউচ্চ পাহাড়ের প্রতি !
আহা! আরেকটু উচ্চতায় পৌঁছা গেল না ;
বলে তারা বদল করে প্রতিযোগিতার হাট ।
লোভীদের হুংকার দেখে হেসে ওঠে
আদিম বাজার সভ্যতা!
কেটে নেয়া বৃক্ষের শিকড় থেকে একসময়
যে প্রশাখা গজায়,
তা দেখে মানুষের ঈর্ষা দ্বিগুণ হয়।
যে মানুষ কোনোদিনই লোকালয়ে
ফিরতে পারবে না-
তার জন্যে বৃক্ষেরা বিছিয়ে দেয়
করুণার চাদর। শীত আসে। ঝরে কুয়াশা—
বল্কলের সেই চাদর গায়ে দিয়েই মানুষ
সংকোচে কাটায় বাকীটা জীবন!
……
মেঘমাজার
মাথা দুলিয়ে আরাধনা করছে সমুদ্র,
ক্ষুদ্র থেকে অতিক্ষুদ্র
যে পরমাণু ডুবে থাকে মানব-আয়ুতে
অথবা যে বিরহ জেগে থাকে ক্ষেতে ও ক্ষতে
মেঘের জিকিরে কেঁপে উঠছে রাতের মাজার
একটি পাখির ঠোঁটে উড়ে চলছে জগতের ভার।
উত্তোলনের প্রকার জানে-; যার বহনে সাহসী
যারা পথকে পোষ মানায়, হয়ে গ্রহবাসী
বাসপ্রথা সকলের নিয়তি তো নয়
কেউ কাঁদে, কেউ হেসে হেসে খুঁজে পরিচয়।
……
আরও পড়ুন – বাসব দাশগুপ্ত এর কবিতা ও কবিতা ভাবনা
কবিতা ভাবনা
কবিতা নিয়ে আসলেই কি ভাবা যায়! কী ভাবা যায়! ধরুন, আপনি একটি গাছের নীচে বসে আছেন। সামনেই একটি বড় পথ। সেই পথ দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করছে। আপনি বসে বসে দেখছেন। এই যে মানুষেরা গেল আসলো, তারা একেকটা পরিচ্ছেদ। একেকটা গোপন কুটুরি! এই কুটুরি আপনি খুলতে পারছেন না। আপনি তাদের চেনেন না। জানেন না। তাদের গন্তব্য কোথায়- তাও অজানা আপনার! কবিতা সেরকমই। আপনার সামনে দিয়েই বয়ে যায়। আপনি দেখেন। ছুঁতে পারেন না। অনেক সময় আমরা তাকিয়ে থাকি দূরের পানে। কিছু বলতে চাই। পারি না। কেন পারি না? গলা আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। চেয়েও বলতে পারি না! এমন অনেক না পারা, অনেক না বলার সিঁড়ির নামই কবিতা।
আমি কখনও কবিতার শিরোনাম ঠিক করে ফেলি ! মনে হয়, কে যেন বলছে— এই শিরোনামে একটি কবিতা লিখতে হবে!
সেটাই করি আমি। অনেকটা দাসের মতো আজ্ঞাদেশ পালন করি। এই যে এখানে পাঁচটি কবিতা আপনারা পড়লেন— এর
সবগুলোর শিরোনামই আমার কাছে আগে এসেছিল ! অনেকটা নাম ধরে ‘রচনা’ লেখার মতো! আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন ! হ্যাঁ, কবিতাগুলো সেভাবেই লেখা।
তাই কবিতা লিখে কবি পরে শিরোনাম দেন— নাকি শিরোনাম ঠিক করে কবিতা লিখেন; তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই চলে না! একটি কবিতায় যদি অন্তত দুটি পংক্তি পাঠকের মনে ঘাঁই দিতে না পারে, তবে তা কবিতা হবে কেন ? হ্যাঁ, আমি তা বিবেচনায় রেখেই
কবিতা লিখি। বিবেচনা করি, একটি কবিতায় পাঠক যেন অন্তত এক চিলতে বিজলি দেখতে পান !আর দেখার ধরণ যে প্রত্যেকের আলাদা— তা তো আমরা জানিই।
তাই কবিতার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। ব্যাখ্যা চাওয়াও যায় না। কবিতাকে আমি নিজেকে ভাঙনের শাবল হিসেবে দেখি।
একটা করাত আমাকে কাটছে। আমি দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে। বহুখণ্ডিত হচ্ছি। এই বহুখণ্ডের ভেতরে সে আলোর ফোয়ারা আমাকে কাছে ডাকে, এগিয়ে নেয়— সেটাই পংক্তিঘোর। কবিতায় ঘোর না থাকলে তা ফ্যাকাশে লাগে। অনেকটা ঘ্রাণহীন পাপড়ির মতো।
কবি পরিচিতি: ফকির ইলিয়াস – কবি। প্রাবন্ধিক। লিখেছেন কিছু গল্পও। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা- ২৬ । রাজনীতি আর মানবকল্যাণ নিয়ে ভাবেন সবসময়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান প্রায় সকল মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে, হচ্ছে তার লেখা। পেয়েছেন- ‘ফোবানা সাহিত্য পুরষ্কার’, ‘ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরষ্কার’, ‘কবিতাস্বজন প্রীতি সম্মাননা’, ‘মৃত্তিকায় মহাকাল আবৃত্তি উৎসব স্মারক’, ‘রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার’। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘ঘুংঘুর’ এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তিনি ‘দ্যা একাডেমী অব আমেরিকান পোয়েটস’, ‘দ্যা এ্যমেনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল’, ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিষ্টস’, ‘আমেরিকান ইমেজ প্রেস’, – এর সদস্য দীর্ঘ বছর যাবৎ। স্থায়ীভাবে বাস করেন নিউইয়র্কে।