ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে “বাংলার মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী”

‘শখের ইতিহাসকার’ কথাটার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে কি? এটা বাস্তব, যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অপবাদ সঙ্গী করে, ফিল্ড স্টাডি, বুক ওয়ার্ক সবকটি পদ্ধতি ঠিকমত মেনে নানা স্তরের ইতিহাস খোঁজা আর ব্যাখ্যা করার নেশায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখেন, যাদের নামের আগে ‘ড.’ বসানো থাকে না তারা অনেক সময় গোচরে, অগোচরে ঐ ‘শখের ইতিহাসকার’ উপাধিটি পেয়ে থাকেন। তারপরে তাদের কী অনুভূতি হয় সেসব কথা থাক। তবে কাজের কথা এটাই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, অধ্যাপকেরাও এখন নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক পত্রিকায় ইতিহাসের নানা স্তর নিয়ে কোন লেখা বেরোচ্ছে? কারা লিখছেন? সেসব লেখা দরকারে সংগৃহীত হচ্ছে। তারপর ইতিহাসচর্চার মূলধারায় মিশে যাচ্ছে। তবে সাধারণভাবে এই কাজগুলো বা প্রকল্পগুলো ছোট আকৃতির হয়। মূলধারার বাইরের এই ইতিহাসকারেরা সবাই যে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন এমন নয়। বিভিন্ন পেশার মানুষ এমনকি বেকাররাও এই ধরণের গবেষণা করছেন।

পাশাপাশি এমন ইতিহাসের অনুরাগী মানুষও আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারের কোন প্রেরণার বাইরে সম্পূর্ণ নিজের তাগিদে ইতিহাসের গবেষণাকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। তারা একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করছেন। সে গ্রন্থ বিক্রিও হচ্ছে। এই ধারাটির গবেষক যদিও কম। কিন্তু তাদের কাজও শেষ পর্যন্ত ঐ মূলধারার ইতিহাসচর্চাকেই সমৃদ্ধ করছে। বাংলাদেশের দ্যু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ফয়সাল আহমেদের লেখা ‘বাংলার মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী’ বইটি নিয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলোই প্রথমে মনে হল। কারণ তিনি অংশত সাহিত্যিক আর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তের এবং বৃত্তির বাইরের একজন ফুল-টাইম ইতিহাসকার । বইটির এখন দ্বিতীয় সংস্করণ চলছে। প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০২০। তার লেখা প্রথম ইতিহাসের বই ২০১৮ সালে প্রকাশিত; ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম মহাজীবনের প্রতিকৃতি’। যার জন্য তিনি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৯’ এ সম্মানিত হন। আলোচ্য ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের বইটির সাথে ২০২০ সালেই প্রকাশিত হয় অন্য একটি ইতিহাস গ্রন্থ ‘ সংবাদপত্রে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাম্প্রতিক, ২০২৩ সালে তার লেখা আরও একটি সম্পাদিত গ্রন্থ ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ’ প্রকশিত হয়েছে। জীবনীমূলক ইতিহাসই শুধু নয় ইতিহাসের অন্য একটি ধারা ওয়ার হিস্ট্রির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতির ভূমিকা নিয়েও তিনি আলোচনা শুরু করেছেন। ২০২২-এ প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে নদী’ তার ফসল। দেখা যাচ্ছে পাঁচটি ইতিহাস বিষয়ক বই এই লেখক লিখছেন মাত্র পাঁচ বছরে। ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ কতটা থাকলে এমন গবেষণায় মগ্ন থাকা যায়?

মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী

বাংলার ইতিহাস তথা ভারতবর্ষ , উপমহাদেশের ইতিহাসে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী একটি আকর্ষনীয় এবং জনপ্রিয় চরিত্র। কোথাও কোথাও হয়তো তিনি মিথের নায়কের মত এখনও মানুষের মনে রয়ে গেছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় অনুশীলন সমিতির নেতা হিসাবে প্রকাশ্যে বা গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। তার প্রতিক্রিয়া এতই প্রবল ছিল, বিদেশী শাসক তিরিশ বছর তাঁকে বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রেখেছেন। এমনকি সেলুলার জলের কুখ্যাত কঠোর পরিবেশ যেখানে নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বন্দীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিত সেই বন্দীশালাতেও তিনি সাজা ভোগ করেছেন। কিন্তু তাঁকে দমানো যায়নি।

যখনই মুক্তি পেয়েছেন তখনই নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য সফল করার চেষ্টা করেছেন। যদিও তাঁর, তাঁদের সে লক্ষ্য সফল হয়নি। সাম্প্রদায়িক মানদন্ডে বিভক্ত দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতার পর তিনি বেছে নিলেন, তাঁর জন্মভূমি পূর্ব পাকিস্তানই হবে তাঁর দেশ। আর এর পরেই তিনি পাকিস্তানের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। নির্বাচনে জিতে সাংসদ হলেও মিলিটারি শাসনে কারারুদ্ধ হন। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার প্রায় পরে পরেই সে দেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা বইতে শুরু হয়েছিল। সেই ধারা ধাপে ধাপে জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। তিনিও সেই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু বয়সজনিত কারণে, অসুস্থ পড়ছিলেন তাই ভারতে আসেন চিকিৎসা করতে। সেই সুযোগ তিনি কাজে লাগান। নিজের মাতৃভূমির দুর্দশা কীভাবে দূর করা যায়, জীবনের শেষকটা দিন সেই লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এবং প্রকাশ্যে, গোপনে সর্বত্র আসন্ন বাংলা জাতীয়তাবাদের বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর সাফল্যের কথা প্রচার করতে থাকেন। ভারতের সংসদে আমন্ত্রিত ভাষণ দেন। তারপরেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এমনই একটি বর্ণময় চরিত্রকে নিয়ে গবেষণা করার সুবিধা আছে। চরিত্রটির প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় স্তরে ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতে আগ্রহই সেই সুবিধার মূল কথা। আবার অসুবিধাও রয়েছে। গবেষণায় নতুন করে লেখক, এই মিথসমান চরিত্রটির কোন অভিমুখ আনবেন? ত্রৈলোক্যনাথের লেখা নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ তাকে যথেষ্ট জানা যায়। এছাড়াও ললিত কুমার সান্যালের ‘বিপ্লব-তাপস মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ’ রয়েছে। এর উত্তরে লেখকের নিজেরই ব্যাখ্যা রয়েছে মুখবন্ধে, “ বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরার উদ্দেশ্যই ছিল এই গ্রন্থের প্রেরণা।” কিন্তু বইটির পরিকল্পনা ও নিরাসক্ত তথ্য-সন্নিবেশ দেখিয়ে দেয় লেখকের বলা কারণের অতিরিক্ত; সমকালীন ইতিহাসের ওপর এই বিপ্লবীর অভিঘাত কী ছিল ও সেই ইতিহাস তাঁকেই কীভাবে নির্মাণ করেছে ইত্যাদি পাঠকের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হয়!

পনেরোটি স্বল্পায়তন প্রবন্ধ আর কিছু পরিশিষ্ট যার মধ্যে ভারতীয় সংসদে তাঁর ভাষণ ও কিছু প্রয়োজনীয় স্মৃতিকথা আর আনুষঙ্গিক তথ্যপঞ্জী ইত্যাদি নিয়ে বইটির গ্রন্থনা। জীবনের কালপর্বকে বজায় রেখে লেখক আলাদা আলাদা প্রবন্ধে মহারাজের জীবনের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এনেছেন। অধ্যায়গুলি প্রতিটি কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ ও একই তথ্য বারবার ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যায় ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে এসেছে। বইয়ের প্রথমদিকে প্রয়োজনে জীবনের শেষ ঘটনা এসেছে আবার উল্টোটাও ঘটেছে। একটানা জীবনীগ্রন্থ হিসাবে মোটেই লেখা হয়নি। যার ফলে প্রতিটি অধ্যায়ে এই বিপ্লবী এবং ঘটমান ইতিহাস ও তাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াই বক্তব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বিপ্লবী এই মানুষটির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের এই প্রচেষ্টা অধ্যায়গুলির নামকরণেই ফুটে ওঠে যেমন, অনুশীলন সমিতি ও ত্রৈলোক্যনাথ, নেতাজি ও মহারাজ, মহাত্মা ও মহারাজ, নির্বাচনে মহারাজ, জেল থেকে জেলে, ভারত সফরের শেষ দিনগুলো ইত্যাদি। মহারাজের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের এক-একটা পর্ব মূর্ত হয়ে ওঠে আর তার বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে।

বই-এর আলোচনাতে তো সব বিষয় ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভব না। তবু দু-একটা অধ্যায়ের কথা বলতেই হয়। সাড়ে চার পাতার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মহারাজ অধ্যায়টিতে লেখকের বক্তব্য দেড় পাতার। আর প্রায় আড়াই পাতা জুড়ে ধীরেনবাবুর আত্মজীবনীর অংশ। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সেই উদ্ধৃতির উল্লেখে আমরা জানতে পারি…হিন্দু সমাজের বহুসংখ্যক লোক পাকিস্তান ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে জাগিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে সংস্রবহীন থাকিয়া নিরপেক্ষ থাকিলে কর্তব্যের ত্রুটি হইবে…। মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ত্রৈলোক্যনাথ মহরাজেরা পাকিস্তানকে মাতৃভূমি মনে করেই থেকে গিয়েছিলেন। আর দেশভাগের সময়, দু-দেশের সংখ্যালঘুদেরই তো সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যাই হোক নিজের জন্মস্থানের প্রতি আবেগ থাকলে তবেই দেশপ্রেম। ত্রৈলোক্যনাথের সেই দেশপ্রেম প্রবল ছিল বলেই তিনি দেশভাগ হওয়ার পর আসেননি। আসেননি ধীরেন দত্তরাও। এবং নিজেদের মত করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার অভিঘাত ও ফলাফল এখানে আলোচ্য নয়। এমনভাবেই মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা ত্রৈলোক্যনাথের রাজনৈতিক আদর্শকে পরিবর্তনের ব্যর্থ চেষ্টা, সুভাষ বসু আর মহারাজের আদর্শের মিল থাকার জন্যই দুজনের প্রতি দুজনের অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, মহারাজের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে অনুশীলন সমিতির সাধ্য ও সাধনকে বিস্তারিতভাবে তুলে আনা ইত্যাদি প্রতিটি তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা প্রায় ষাট-সত্তর বছরের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের এক-একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিররুচারে লেখক করে রেখেছেন।

শুধু অংশের সন্ধান দিয়ে কিন্তু একটা বই-এর কাজ শেষ হতে পারে না। এই বইটার সব প্রবন্ধ মিলে মিশে যেকথা বলেছে তাতে দেখেছি এই বর্ণিল বিপ্লবী শেষ জীবনে এসে দুঃখ করে বলেছেন, ‘আমার সব স্বপ্ন সফল হয় নাই!’ ঠিকই তো, হয়নি! মূল উৎপাদন, শিল্পে পরিবর্তিত হয়ে এখনও এই উপমহাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সামন্ততন্ত্রের শেকল ছিড়তে পারেনি। আর যে সময় মহারাজ বিচরণ করেছেন তখন তো জমির সংস্কৃতিই প্রবল। হ্যাঁ শহরাঞ্চলে কেরানি বানানোর শিক্ষার অভিঘাতে পেশাজীবী মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়েছে। যে সমাজের নব্বই ভাগের বেশি ধর্মে অমুসলিম, হিন্দু। তাদের শেকড় সেই জমিতেই গাঁথা। এমনই এক সমাজে মহারাজ জন্মালেন। বড় হয়ে উঠছেন যখন, তখন মূলত হিন্দু জমিদারদের স্বার্থরক্ষাকারী স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠছে। জমির সাথে যাদের যোগ থাকে তাদের হৃদয়ে আবেগের অভিঘাত প্রবল হয় তিনিও দেশকে ভালবাসতে শিখছেন ঐ স্বদেশী আন্দোলন থেকে।

যে আন্দোলনের দার্শণিক ভিত গড়ে দিয়েছেন নবগোপাল মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্ররা। যে দর্শণে দেশ পূজনীয় ঈশ্বর, মায়ের সমান, তার মূর্তি তৈরি করে, হিন্দু উপাচারে আরাধনা করতে হয়! সেই মায়ের সন্তান হিসাবে মুসলমানরা ডাক পায় না। তো এই আবহেই তিনি যাবেন অনুশীলন সমিতিতে, দেশোদ্ধারের মন্ত্রে দীক্ষিত হবেন। কৃচ্ছ্রসাধনের মাহাত্ম্য প্রচার করে যে জাতি। সেই দেশে নিজের সাংসারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে তিরিশ বছর অবশ্যই জেলের কষ্ট স্বীকার করবেন এই বিপ্লবী। বিপ্লবী চরম পথ বেছে নেবেন–খুন, ডাকাতি, নোট-জাল যাই হোক না কেন। তাঁর ধর্ম- সংস্কৃতিই তো বলে কর্মে তোমার অধিকার ফলে নয়! মহাত্মা গান্ধীও তাঁর পথ পরিবর্তন করাতে পারেন না। কম্যুনিষ্ট , সমাজবাদী, কংগ্রেস সব মত ও পথের নেতা থেকে কর্মী তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়। কিন্তু তিনি গীতার নিষ্কাম তত্ত্বের উর্ধ্বে উঠে যতই সমাজতান্ত্রিক দল্লের অধিবেশনের সভাপতিত্ব করুন না কেন, চূড়ান্তভাবে সেই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে পারেন না। মাতৃভূমি হিসাবে পাকিস্তানকে মেনে নিয়েও দেখা যায় …তার মন ভেঙে গেছে। রাজনীতি করতে ইচ্ছা করে না…নিজের মত করে গঠণমূলক কাজ করেন। স্কুল, লাইব্রেরি ইত্যাদি। নির্বাচনে দাঁড়ালেও তা যে সমাজসেবারই নামান্তর হবে তিনি জানতেন। তবুও দাঁড়ান। বরখাস্ত হন, জেলে যান। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনে খুঁজে পান , তার ভেতরের দেশপ্রেমের সফল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা।

মহারাজের চরিত্রের এই দেশপ্রেমকেই চেনাতে চাইছেন বারবার ফয়সাল। আর তার লেখনীর গুণে আমরা দেখেছি একটি সংকীর্ন রাজনীতির মানুষ কীভাবে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে উঠলেন। কারাবাসে বৈপ্লবিক দর্শন সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। কারামুক্ত হয়ে ছুটে যান দাঙ্গা থামাতে। হিন্দু-মুসলমান হিসাবে যে মানুষের আসল পরিচয় হয় না, তা অনুশীলন সমিতির আইকন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ বুঝলেন অনেক পরে। লক্ষ্যনীয় তারপরে কিন্তু তিনি আর সমিতির পথে এগোননি, হয়ত সেই বাস্তবতা ছিল না! আবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সব থেকে কার্যকারী পথ হিসাবে পরিগণিত; শ্রেণি সংগ্রামের রাস্তাতেও এগিয়ে যাননি। কেন, সে প্রশ্ন হয়ত এই বইয়ের পরের সংস্করণে দেবেন লেখক। কিন্তু এটা বোঝাই যায় যিনি গীতার অনুবাদ করেন তিনি কীভাবে মনেপ্রাণে পরের প্রজন্মের কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষদের মত নাস্তিক বস্তুবাদী হবেন। আর তা না হলে তো শ্রেণি-সংগ্রামের দর্শণে বিশ্বাস করা যায় না। সামন্ততন্ত্রের আদর্শ নাইট-সামুরাই-শিভ্যালরি-হিরোইজম-রবিনহুড।

শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথের মত মহৎ হৃদয়ের মানুষ ত্রৈলোক্যনাথকে সেই আদর্শে নির্মাণ করেছিল সামন্ততন্ত্র। শেষ জীবনে এসে তিনি সীমারেখার ভূগোল ধরে দেশকে দূরে সরিয়ে দেশের মানুষকে দেশ হিসাবে জানার গন্তব্যে পৌঁছোতে পেরেছিলেন। হিন্দু হয়েও তিনি পাকিস্তানকে তাই ভালবেসেছেন আবার ভারতের মুসলমানদের সেই দেশকে নিজের দেশ মনে করে ভালবাসার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রজ্ঞার শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর উপলব্ধি হয়েছে আগে মানুষের ভেদাভেদ দূর করে জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলা দরকার। তারপর সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যের ছিয়াত্তর বছর পেরিয়ে এখনও সেই উদার জাতীয়তাবোধ উপমহাদেশে গড়ে ওঠেনি। তাই এই মহাচরিত্রটিকে সামনে নিয়ে আসার কাজ করেছেন ফয়সাল। আশা থাকুক বইটি পড়ে আজকের তরুণ প্রজন্ম নতুভাবে মহারাজকে জেনে সেই জাতীয়তাবোধে উদবুদ্ধ হবে। তবে ইতিহাসের আগ্রহীরা নিশ্চিতভাবেই পাঠের পর এই বিপ্লবী চরিত্রের পরিবর্তন-বিবর্তন দেখে উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনীতি-ধর্ম-সমাজ-ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বকে আবিষ্কার করবেন।

আরও পড়ুন – চিরকুট একটি মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প-সংকলন