বাসব দাশগুপ্ত এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

দাম্পত্য

তোমার হাতের ভাঁজে আমার হাত থাকতে পারত,
ছায়ার গায়ে ছায়া

আমাদের প্রাচীন দাম্পত্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি নিষেধ,
ঢেউ-এর মতো মাঝখানে ভেঙে পড়ে জগতসংসার

জানলা দিয়ে তাকালে পার্কের রঙ চটা, কাঠের হেলান দেয়া
বেঞ্চটা দেখা যায়, কেউ‌ বসে, কেউ ভিজে কাপড় শুকাতে দেয়া

চল না আমরা ওখানে বসি, হিজল গাছে হাওয়া দিচ্ছে
একটু না হয় দূরত্ব রেখেই বসি।
……

রাতে শ্মশানে কয়েকজন

সদ্য রাতে, গঙ্গার বাতাসে, ধরে যায় প্রাচীন বৃক্ষের পাতা
কিছু বায়ুচর এদিক ওদিকে খোঁজে যামিনীর শ্বাস , অতীতের
ঘটে যাওয়া কথা, কথা-বার্তা, কে কাকে কষ্ট দিয়েছিল,
কে কোথায় গান গেয়েছিল

মাঝ রাতে, গঙ্গার হাওয়ায়, উড়ে যায় মধ্যবয়ষ্ক কিছু পাতা
রূপসী বৃদ্ধা পোড়ে, ছুটি দিয়ে আত্মীয়জন, চায়ের দোকানে
ধোঁয়া, দেহ জড়, জড় প্রাণ, উল্লাসবিভোর, আজ সব‌ বিষাদপ্রমাণ
তবু মৃতকথার অন্তরালে জন্মকথা চলে‌

শেষ রাতে, গঙ্গার বায়ুপথ, ফেলে দিল গাঢ় কচি পাতা
শ্রীম লেখে, শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, গঙ্গার বাতাসে দশ মাইল ব্যাসে
ক্রমশঃ পবিত্র, শুধু একা পুড়ে যান রূপসী বৃদ্ধা ।
……

সংঘর্ষ

প্রতিদিন আমাকে লক্ষ করে মায়াদর্পণের ঢাকনা খুলে দিচ্ছে
কে যেন বলছে, সামনে এসে দাঁড়াও, দেখ, তুমি সময়কে যেভাবে
দেখছো তার বিকল্পও কিছু হতে পারে, তুমি মানো না মানো
প্রতিটি ছবির আরও একটা বিকল্প প্রতিচ্ছবি থাকতেই পারে

সবকিছু যে তোমাকে মানতে হবে এ মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি
দলে টানাটানির খেলা আর কবে যে শেষ হবে!
সংখ্যাতত্ত্বের টানাপোড়েনে ক্লান্তি আসলেও উপায় নেই
এ কেমন মহিমা যে, সদ্যজাত থেকে মৃতজন সকলেই লাইনে সেজেছে

আকাশে মেঘ দেখে মনে করো না বৃষ্টি নামবে ভিজে যাবে কষ্টসমূহ
উল্লাসের কিছু নেই দর্পণে প্রবল বৃষ্টি, মুছে দিচ্ছে চরাচর, কোথা থেকে
শব্দ আসে, বজ্রপাতের মতো মনে হয়, লোক দুটো মূহুর্তে আলোতে
এক হয়ে গেল, মিলেমিশে এক কালখন্ড
শুধু মায়াবী দর্পণ শব্দ করে হাসে।
……

উট ও বেদুইনের কথা

আমি যখনই কোন উটের কথা ভেবেছি
তখন চর্তুদিকে কোন মরুভূমি ছিল না
না ছিল কাঁটা ঝোপ, বালিতে বসবাস করা সাপ
অথচ বেদুইনরা চলেছে, একসার মানুষ, উটের পিঠে
তাদের তাঁবু, যাবতীয় যৌনকর্ম, আগামী দিনগুলো

আমাদের চলাচলের রাস্তায় কথোপকথন শুয়ে আছে
তোমরা নিজেদের সর্বনাশের মধ্যে অদ্ভূত স্বরে গান গাইছো
বাতিল বাতাস, বাতিল জাহাজ আর বহু পুরাতন একটা
সুইসাইডাল নোট, এখনও ওখানে ঘামরক্ত লেগে আছে
কোন মায়ার টানে দুর্গম এলাকাই আমাদের প্রিয়

আমরা জানি পৃথিবীতে একমাত্র স্মৃতি তীব্রবেগে ছুটে চলা
রহস্যময় ট্যানেল, যাকে অনেকে মৃত্যু নামে ডাকে
……

বিষাদপুরাণ

যখনই কুমুদিনী এখানে ফিরে আসে,শুনতে পায়
ঢোল বাজিয়ে সকলে গান গাইছে,এর মধ্যে বৃদ্ধ মানুষটি
সকলের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদছে
তালশব্দ,সুরশব্দ,লয়শব্দ একটা গলি পথে ঢুকে
লাইটপোস্টের পাশে যেতে যেতে
প্রণয়শব্দের সঙ্গে মিশে যায়

প্রণয়শব্দ আমার শৈশবে জোৎস্না পিসির আশ্রয়ে
থাকতে থাকতে পাশের বাড়ির সুকুমারকাকুর
কররেখায় হারিয়ে গেছে, সেই থেকে
অতি বিষন্ন আমার পিসি কপালের উপর একটা এবং
ভুরুর মাঝখানে ছোট্ট অদৃশ্য একটা
টিপ লাগায়

আমি জোৎস্না পিসির দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে
সূর্যদয় ও সৃর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে পাই
কুমুদিনীকে এসব দৃশ্য থেকে আড়াল করার
মন্ত্রের সন্ধানে হাঁটছি, কেবলই হাঁটছি।

আরও পড়ুন – অতনু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

কবিতা ভাবনা

কবির সামনে একটা ঘন নিষ্প্রদীপ আবহ থাকে। সেই ছায়াময় জগতে, প্রকাশ্য দিনযাপনও নিজ-মুদ্রাদোষে চারপাশটা বাধ্যতামূলক নিভৃত হয়ে ওঠে। আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে চতুর্দিকে জ্যামিতিক রেখা নানা মাপের গন্ডী কেটে দেয়, ছোট্ট একটা জায়গায় আবদ্ধ করে রাখতে চায় সময়, সেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করে নিজের সঙ্গে বৃহৎ-এর সংযোগ ঘটাতে চান একজন সৃষ্টিশীল মানুষ।এটাই তাঁর সাধনা, এটাই নিরন্তর একটা প্রচেষ্টা। আমি‌ যখন কবিতার পাঠক তখন , নানা শব্দ বা দৃশ্যকল্পের উপস্থাপনায় , বিচিত্র অনুসঙ্গে আমাকেই , আমার বর্তমান-অতীতকে খুঁজে ফিরি আমি। পৃথিবীর অন্যতম সত্য হল স্বপ্ন। কে একজন বলেছিলেন না, যা ঘুমিয়ে দেখা যায় সেটা প্রকৃতপক্ষে স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের প্রতিরূপ মাত্র। আসলে স্বপ্ন সেটাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। আমার ভিতরে এমন অনেক স্বপ্নের বাসা আছে , তারা গাঢ় নীল সমুদ্রের জলরাশি ভেদ করে মাঝেমধ্যে মাথা তোলে। আমি সেই সব চূড়ান্ত ইচ্ছেগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে চাই। আদতে ইচ্ছাপত্রের সংক্রমণ ঘটানোর মাধ্যম হিসেবে আমার লেখালেখিকে ব্যবহার করতে চাই।

চোখের সামনে কতকিছু ঘটছে, টুকরোটাকরা নানা ঘটনা। জলস্রোতে কত বুদবুদ তৈরি হয়, জলে ভাসে, দোলে খায়, এদিক ওদিকে ছড়িয়ে যায়। নানা ঘটনাও সেরকম, হারিয়ে যাওয়া জন্যেই তাদের উৎপত্তি। চারিদিকের সমসময়ের অনুভূমিক বিস্তারে ঘটা সমস্ত ঘটনাবলির থেকে রশদ সংগ্রহ করতে পারেন সাংবাদিকরা কিন্তু কবি তো সাংবাদিক নন, তাঁকে উদ্দীপ্ত করতে বিশাল সরলরেখা নয় সামান্য একটি বিন্দুই যথেষ্ট। নিরন্তর বহমান সময়ের থেকে একটি মূহুর্ত তাঁর সৃষ্টির সূত্রের হয়ে যেতে পারে। এমনকী যা কখনও ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারতো, সেই রহস্যময় চিন্তাসূত্র আমার ভিতরে একটা শব্দ বা পংক্তির উন্মেষ ঘটায়।

বিষয়টা হল, কাকে কোন ঘটনা, কোন স্মৃতি, কোন শব্দ ঝাঁকুনি দিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল। বেশ মনে আছে একবার ট্রেনে ফিরছিলাম দূর থেকে, সঙ্গে ছিলেন দুজন আমার পরিচিত কবি। তাঁরা অন্য ধরনের মানুষ, বেশি ছটফটেভাব অথবা তেমনি দেখানোপনা নেই, মাথা ও শিরদাঁড়া সোজা, প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুল নন। ফলে অনেকের নিয়ত আলোচনার মধ্যে তাঁদের নাম উচ্চারিত হয় না। ট্রেনের কামরাতে ভিড় ছিল না, স্বেচ্ছায় দু’চারজন দাঁড়িয়ে। আমি শ্রোতা, ওঁরা কবিতা নিয়ে নানা আলোচনা করছিলেন। ট্রেন একএকটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে একটু পরে যথারীতি ছাড়ছে। কোন ট্রেন তো চিরকালই দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে সৃষ্টি হয় না, ট্রেনের নিয়তি ছুটে চলা। তো, সন্ধে হয়ে আসছে তখন। আলো ইষৎ কম, ছুটন্ত ট্রেনের বাইরেটা ক্রমে মায়াময়, সুন্দর। মনে আছে , শীত তখন যাই যাই করছে। বসন্তবাতাস আসছে ট্রেনের জানালা দিয়ে। একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই দেখি পরপর কতগুলো পলাশ গাছ। লাল আগুন লেগেছে ফুলে, পলাশের বর্ণে দিগন্ত ঢেকে আছে। গাছগুলোর নীচে সিমেন্টে বাঁধানো বেদির উপরে বিশ্রাম নিচ্ছেন ছাপোষা একটা পরিবার। বোধকরি, মাতা-পিতা আর দুটি শিশু। তাঁদের গায়ে ঝরে পড়ছে পলাশের আগুন রঙের পাপড়ি। ক্লান্ত শরীরে ফুলসাজ। এ দৃশ্য নাড়া দেয়ার মত। একজন কবি বললেন, ‘বাঃ, আমার তো এখুনি কয়েক লাইন লিখতে মন চাইছে।’ তারপর একটু থেমে আবার বললেন ‘লিখবেন নাকি এই দৃশ্যের প্রেক্ষিতে একটা কবিতা।’ দুজনেই আমাকে সাক্ষী রেখে বললেন, সাতদিন পরে কলেজস্ট্রিটে আমরা দেখা করব কবিতা নিয়ে।

বহু চেষ্টায় আমার এক লাইনেও লেখা হল না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমিও সেই দৃশ্যে উদ্বেল হয়েছিলাম, তবু একটা‌ লাইনও লিখতে পারলাম না সাদা‌পৃষ্ঠার সঙ্গে সহবাস করেও। ফলে খালি হাতে নির্ধারিত দিন কলেজস্ট্রিটে। যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি ঐ দৃশ্যকে ছুঁয়ে আশ্চর্য একটি কবিতা লিখে এনেছেন। অন্যজন একটা কবিতা লিখেছেন অবশ্য তার সঙ্গে ঐ দৃশ্যের সম্পর্ক নেই।

কবিতা এমনই। কখন আসে, কার কাছে আসে, কীভাবে আসে, তার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অলৌকিক এক প্রক্রিয়া। এক একটা লাইন কখনো কখনো বিদুৎ ঝলকের মত আসে। হয়তো বা একটি শব্দ। বাজারে, বাসে, ট্রেনে, বিপুল কোলাহলের মধ্যে। আবার সামনে অপার সুন্দর দৃশ্য, নীরবতা কিন্তু কোন পংক্তি ধরা দিল না। এই ধরা দেয়াটি আমার কাছে সত্য, কাব্যসত্য। অথবা, অন্যদিকে, কোন লাইন বা শব্দ কিম্বা অক্ষর অথবা একটা অনুভুতি নাছোড় থেকে যায় মনের গহনে। পরে হঠাৎই সেই অনুভূতির জারনে লেখা হয়ে গেল একটা কবিতা। আমার ক্ষেত্রে কবিতা লেখা হয়, জোর করে কবিতা লিখতে পারিনা। ফলে লেখার সংখ্যা কমতে থাকে। কাটাকুটি, মুছে ফেলা বাড়তে থাকে।

আমার লেখার প্রথম পাঠক আমি। বহু লেখা প্রথম পাঠেই বাতিল হয়ে যায়। কখনোবা পুরো লেখা, অনেক ক্ষেত্রে কয়েকটা লাইন অথবা কিছু শব্দ। এই শব্দ হল কবিতার প্রাণ। শব্দ ধারণ করে অনুভবকে। ফলে আমার লেখালেখির প্রধান সমস্যা হল শব্দ নির্বাচন। সুধীন্দ্রনাথের মত ভারি শব্দ লিখতে মন চায় না। বিষ্ণু দের মত অপ্রচলিত শব্দ লিখে দূরুহ বাতাবরণ তৈরির দিন আর নেই। লোককবিদের মতো দেশজ শব্দ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসে না। যা লিখতে চাই তা এক ধরণের শব্দ দাবী করে, আমার সন্ধান হল উপযুক্ত শব্দটিকে খুঁজে পাওয়া। এই কাজে বহু সময় চলে যায়। আমার বিশ্বাসে কোন শব্দ কখনো পুরানো হয় না। তবে কোনো কোনো শব্দ অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যায়। যেমন, ‘বুকের মধ্যে’ এই শব্দটা, একটা সময়ে এত লেখা হয়েছে যে শব্দটির ওজন, গভীরতা কমে গেছে। বেশ কিছু দিন হল বাংলা কবিতায় এই শব্দটির প্রয়োগ আর দেখি না। তেমনি প্রেম, চাঁদ, আকাশ ইত্যাদি শব্দের অধিক ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে এসেছে। কেই বা আর জীর্ণ শব্দ দিয়ে প্রাসাদ বানাতে চায়!

আরও একটা বিষয় অতীতে অতি পছন্দের ছিল, সেগুলো হলো , অক্ষরবৃত্ত এবং অন্তমিল। তখন কবিতা বলতে ছন্দের খেলাকেই বুঝতাম। সিনিয়ররা বলতেন, ছন্দের আড় ভাঙেনি এখনই কবিতা লিখতে এসেছে! সাম্প্রতিকে মনে হয়‌, আমার কবিতার ক্ষেত্রে এ’দুটোই ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে অল্প-বিস্তর অন্তরায় । মনে হয় দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে ফেলার ফলে চিন্তার মুক্তি ঘটছে না।

যিনি কবিতা লিখছেন, তার মনোজগতে একসঙ্গে ক্রিয়া করে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। কোন ক্ষেত্রে একটি অপরের উপর সেই মুহূর্তে প্রাধান্য বিস্তার করে। এটা ভাবা খুব ভুল হবে না যে, স্মৃতির অতি গভীর টান বহু কবিতার মূল সূত্র। তবে যা বর্তমানে ঘটছে, তাকে এড়িয়ে যেতে আমি পারিনা। যেহেতু কবিতা অসমাপ্ত দিনলিপির মতো আসে তাই কবিতা পাঠে অনেক ক্ষেত্রেই কবি এখন কেমন অবস্থায় বেঁচে আছে, সে কথা গোপন থাকে না।

প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বা আরও বেশি সময় ব্যাপি কবিতা পড়ে, নিয়মিত লেখালেখি করে যা বুঝেছি, তা হল, কবিতা বিস্তার চায়। জলের মধ্যে ঢিল ফেললে প্রথমে একটা ছোট্ট কম্পন বৃত্ত তৈরি হয়, সেই অতি ক্ষুদ্র জলবৃত্তটিই হল মূল কবিতা। তারপর ধীরে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, ছোট থেকে ক্রমে বৃহৎ, সেটাই কবিতার অনুরণন, বা ভাব বিস্তার। যে কবিতার অনুরণন যত প্রবল সে কবিতা তত সার্থক। আর প্রতি কবিতালেখকের লক্ষ হল এমন রচনা যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করবে পাঠকের মনে। অতি দীর্ঘ অনুরণন সৃষ্টি‌করবে। লেখার পর নিজের মনের মধ্যে অনাবিল আনন্দের উৎসার ঘটবে। কয়েক দিন পরে নিজে পড়তে গিয়ে বিস্ময় জাগবে, প্রশ্ন জাগবে ‘এই লেখা আমিই লিখেছি!’

অনেকে সময় দেখি, হঠাৎই মনোজগতে খুঁজে পাওয়া গেল, পাঠকে চমকে দেয়ার মত একটা লাইন। এ লাইনটি পরিবেশন করার জন্য আরও অনেকগুলো লাইনের অবতারণা, শেষে মোক্ষম লাইনটি লিখে কবিতা শেষ। এরকম লেখা একবার পড়তে ভালো লাগে কিন্তু বারবার পড়তে ইচ্ছে করে না। কবিতাতো প্রতিবার পাঠে নিজ রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচন করে, যতবার পড়া যায় ততবারই আরও গভীর অর্থ আবিষ্কার করা যায় বিদ্যুৎবাহী শব্দসজ্জা থেকে। আমার বিশ্বাস, কবিতার উদ্দেশ্য কিন্তু পাঠককে চমকে দেয়া নয়।

কবিতার অন্যতম টান হল, অপার রহস্যময়তা। সামান্য কতগুলো লাইনে অসীমকে প্রকাশ করার দাবি কবিতাই করতে পারে। একটা অব্যর্থ শব্দ কিম্বা ইঙ্গিত অথবা পংক্তি পাঠকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। পাঠক তখন নিজের মনেই ভিন্ন এক রচনায় মগ্ন হয়ে যায়, কোন টুকরো স্মৃতি, ভবিষ্যতের সম্ভবনার কাছে নতজানু হয়ে বসে। এখানেই কবিতার অন্য নেই। কবিতা লিখতে গিয়ে অক্ষরের সীমা দিয়ে অসীমকে স্পর্শ করার প্রয়াসে দিনযাপন করেছি। এটা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া, এর মধ্যে ঢুকে গেলে আর পরিত্রাণ নেই। নয় নয় করে চল্লিশ বছর পেরিয়ে এলাম। লিখেছিলাম —‘আমার অন্ন-জল, আমার নিত্যদিন লিখে যাওয়া স্মৃতি -কথা/যতই পাগল বলো, তুমি ঠিক পড়ে নেবে জানি।’

অনেকে বলেন, কবিতার দ্যোতনাই এই শিল্পের প্রধান। এ কথা অবশ্যই সত্য, তবে একমাত্র সত্য বিষয় কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বাংলা ভাষার বহু কালজয়ী কবিতায় সরাসরি কাহিনি বা কাহিনির আভাস পাওয়া যায়। জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগা অনেক কবিতাই এর প্রমাণ। এই কথা বলা হয়, কবিতায় কাহিনির আভাস থাকলে দ্যোতনা থাকে না। আমি এই সূত্রে বিশ্বাসী নই। কবিতা তো বটেই, এমনকী উত্তম কথাসাহিত্যের অন্যতম লক্ষন, না বলা কথার প্রসার। বর্তমানের কবিতার অভিমুখ বোধকরি সেদিকেই। যতটা বলা, তার থেকে অনেক বেশি না বলা। সেই বলা আর না বলার ভারসাম্য নিয়ে, লেখক পাঠকের যৌথ প্রয়াসে একটা সৃষ্টি সার্থক হয়ে ওঠে।

বিচিত্র শব্দ লিখে চমক দেয়ার একটা প্রবনতা দেখা, এমন কবিতা লেখার ফাঁক সহজেই ধরা যায়, যেখানে চমকে দেয়ার মতো লাইনটি লেখার জন্য আগের বেশ কয়েকটি লাইন কৃত্রিমভাবে সাজানো হয়। অনেকক্ষেত্রে কবিতা পড়তে‌ গিয়ে পরপর দুটো পংক্তির মধ্যে সাযূজ্য পাওয়া যায় না, পাশাপাশি দুটো শব্দের মধ্যে সংযোগ চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু এও সত্য যে, দেখা যায় সম্পূর্ণ কবিতাটা পড়ে একটা অনুরণন তৈরি হচ্ছে। ভাবি এতো কবিতার একটা প্রবণতা এবং সার্থক প্রবণতা। ছোটবেলায় পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো, কবিতার একটাদুটো লাইন তুলে বলা হত, পংক্তিটি ব্যাখ্যা‌ কর। এখন ভাবি, মূল কবিতার দেহ থেকে একটা বা দুটো লাইন নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।

কবিতার এক সর্বগ্রাসী মায়া আছে। যে সেই মায়াতে আবদ্ধ হয়, তার আর পরিত্রাণ নেই। জালে আটক মাছের মতো কবিতার শব্দমায়ার ঘেরাটোপে আনন্দে উত্তেজনায় বসবাস, যাপন তার। অভিশপ্ত জীবন একজন কবির, একাকী নিজের সঙ্গে তার বসবাস। অসম্পূর্ণ দিনলিপির সত্যতায় লেখা হয় অক্ষরসজ্জা কিম্বা কবিতা। আসলে কবির কষ্টযাপনের গোপন দিনলিপি।

এ পর্যন্ত কবিতার কাছে কোন মিথ্যা না বলে, দিনযাপনের আমূল সততায়‌ ভঙ্গুর দিনলিপি লেখার ছলেই লিখে চলেছি। আমার কবিতা আমার স্বীকারোক্তি, যাপনপ্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার। অনেক কিছু মানতে পারিনা, প্রবল কষ্ট হয়, অনেক আপোষ বাধ্যতামূলক, অপরিসীম বেদনাময়, অনেককে সরাসরি কোন কথা বলতে পারি না, সর্বত্রই আমার আশ্রয় কবিতা।

জীবনের যাবতীয় জয়-পরাজয় লিপিবদ্ধ করতে, সমস্ত অপার বোধ, হাসি-কান্নাকে ধারণ করতে কবিতার মতো আর কেই বা পারে! গভীরতম ক্লান্তি অথবা প্রত্যাখ্যাত ভালবাসা গোপন রক্তস্রোতের মতো অদৃশ্যে প্রবাহিত হয়, তার প্রতিরূপে লেখা অক্ষররাজীর রহস্যময় আঁচড় হল —কবিতা। আমার কবিতা আসলে নিজের সঙ্গে অতি গোপন কথাবার্তা। আবার বলি, আমার বিশ্বাস কবিতা লেখা যায় না, কবিতা লেখা হয়। এটা একটা অলৌকিক ক্রিয়া।

কবি পরিচিতি : জন্ম ১৯৫৮। গত শতকের আট দশকের শুরু থেকে কবিতা লেখা। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা আটটি। রাত ভোর কথায় কথায়, অশ্রুগ্রন্থি, পোড়া অক্ষরের কবিতা, তমস ধ্যানভূমি শিরোনামের কবিতার বইগুলো এখনও নানা পর্যায়ে আলোচিত হয়। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ কবিতা।‌ মিহির ঘরামী স্মৃতি পুরস্কার, পত্রিকা সম্পাদনার জন্য ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প লেখেন নিয়মিত। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।