আসিফ উদ্দীন রেজভী
বইয়ের ‘রিভিউ’ নামের একটাকিছু লেখার প্রথা বাংলাদেশে মুটামুটি তৈরি হয়েছে। আমি নিজে যেহেতু বইপত্র পড়ি, আমারও মাঝেমধ্যে রিভিউ লিখতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ করে এমন এমন কিছু বই হাতে চলে আসে, যে বই গুলোর প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার পর নড়েচড়ে বসি একদম। বইটা শেষ হওয়ার পরে মনে হয়, আমি যেন মহাশূন্যে সাইকেল চালাচ্ছি। একদম ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা। কিছু কিছু বই আসলেই এমন যে, পড়তে পড়তে দেখবেন, গল্পটা আপনাকে একদম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কমফোর্ট জোনের বাইরে। ঠিক এমনই একটা বড়সড় ধাক্কা আমি খেয়েছি, আহমদ বশীরের ‘মুদ্রারাক্ষস’ পড়ে।
আমি যেহেতু বইটির রিভিউ লিখতে বসেছি, তাহলে আমাকে বইটির ভেতরের কিছু কিছু সারপদার্থকে বাইরে এনে মানুষকে জানাতে হবে। জানি না, আসলে আদৌও কি কিছু লাভ হবে? আমি যদি লাভের হিসেব করি, তাহলে হিসেবটা এভাবে করা যায়, যে, রিভিউ লিখে ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। আরেকজনের বই নিয়ে নিজের সময় যায়, শক্তি যায়, চিন্তা খরচ করতে হয়। রিভিউ থেকে চাওয়ার মতো জিনিস খুবই অল্প। অন্তত ৫০ জন মানুষ যাদের বইটির নাম কিংবা লেখকের নাম কখনোই শোনার কথা নয়, তারা যদি নামটা শোনেন, সেটাই প্রাপ্তি। অন্তত ১০ জন মানুষ যদি বইটা পড়তে চান বলে মনে মনে ঠিক করেন, সেটা প্রাপ্তি। অন্তত ২ জন মানুষ যদি বইটা কিনে পড়েন, এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর নেই।
আমি আরো একটু নিজের কথা বলি, তারপর সোজা ঢুকে যাবো ‘মুদ্রারাক্ষসের’ অচেনা জগতের ভেতর। যেখানে কেউ কারো নয়, আবার সবাই সবার।
আমি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আমার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া। বাংলাদেশের এক প্রান্তে। বইটা আমি হাতে পেয়েছিলাম আমাদের রাঙ্গুনিয়ার এক পাঠাগার থেকে। আমাদের পাঠাগার বলতে, আমাদের এলাকার পাঠাগার। আমাদের পাঠাগারে আছেন একজন চমৎকার মানুষ। সৈয়দ মনজুর মোরশেদ রানা ভাই। মানুষটার সাথে আমার পরিচয় কিছুদিনের। কিন্তু এমনটা এখন আর মনে হয়না। মনে হয় কতদিন ধরে যেন তার সাথে পরিচয়। উনি হঠাৎ হঠাৎ আমাকে কিছু কিছু লেখকের নাম বলেন, পাঠাগারের শেলফ থেকে একটা বই বের করে দিয়ে বলেন, ‘এটা পড় তুমি। চমৎকার লিখেন। ভালো লাগবে তোমার।’
আমি সব বই ফেলে সেই বইটাই পড়া শুরু করি। এমন ভাবেই আমার হাতে আসে আহমদ বশীর। এর আগে আমি কখনো তাঁকে জানতাম না। দুই এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমি রানা ভাইকে বললাম, ‘রানা ভাই, বইটা তো দারুন’। কিন্তু রানা ভাই বললেন, লেখক আহমদ বশীরকে কেউ চেনে না।
আহমদ বশীরের মতো লেখকদের উপর সত্যিই রাগ হয়। এমন বই প্রচারবিহীন রেখে, পাঠককে বঞ্চিত করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানি না ! বইয়ের বিক্রয়কেন্দ্রে বইটার কোথাও কোন চিহ্ন নেই। কেউ এমন লেখকদের নিয়ে কথা বলেন না। বা বললেও তা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে না । আর আমি রানা ভাইয়ের এতো এতো প্রশ্রয়ের উপর দাঁড়িয়ে বইটার একটা রিভিউ লিখতে বসে গেলাম। যাতে কেউ যেন বইটা সম্পর্কে জানতে পারেন।
রিভিউ বলতে, বইটা পড়ে আমার কেমন লেগেছে, সেটাই জানাতে চাই। চিন্তা করে দেখলাম, এই বইয়ের রিভিউ লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম দুই-তিন পৃষ্ঠা পড়ে মনে হয়েছে বইটা কিছুটা ওভাররেটেড (?), কিছু কিছু জিনিস ধরতে সমস্যা হচ্ছিলো খানিকটা।
এবার আসি ‘মুদ্রারাক্ষসের’ নির্মম সেই জগতে : ওহ্ এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেষ্ট মান্থ। টি এস এলিয়টের ওই কবিতার মতোই নির্মম। একটা সংলাপের মধ্যে ওই কবিতাটা দিয়েই শুরু হয়েছে বইটা। কাহিনি প্রথমের দিকে একটা ধারা নিয়ে এগোতে থাকে। তথাকথিত সব উপন্যাসের মতো না এই বই। লেখক এখানে তিনটি পর্বে কাহিনি সাজিয়েছেন।এটা তার পড়াশোনার জগতের পান্ডিত্য বলা যায়। নয়তো প্রথম এবং শেষ পর্ব ঠিকঠাক রেখে মাঝের পার্টে উনি যে নির্মম খেলাটা খেলেছেন, তা একদম আমাদের চেনা। খুবই কাছের। দৃশ্যটা আমরা দেখি রোজ, কিন্তু ছুঁতে পারি না।
বইটি দাঁড়িয়েছে রাজনীতির নোংরা খেলা আর বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার নারীদের নির্মম ইতিহাস দিয়ে। আমরা গল্পের শুরুতে দেখি গার্মেন্ট শিল্পে চাকুরি করা জয়িতা নামের একজন মেয়েকে, যে কিনা থাকে এক নারীদের মেসে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি দৌড়ে যায় স্নান ঘরে। গিয়ে দেখে সেখানে জল নেই। ডেকে তুলে মহিলা হোস্টেলের সেই নারী ম্যানেজারকে । গজগজ করে সে বলে,‘পানি নাই কেন? একটু পরই কাজে বেরোতে হবে।’ কিন্তু কাজ হয় না। দেরী হয়ে যায় আধাঘন্টা।
আধাঘন্টা পরে জয়িতা পৌঁছে পান্না ফ্যাশন গার্মেন্টসে। পৌঁছে সে দেখে নতুন এক দৃশ্য। নাকে ভেসে আসে জ্যান্ত মানুষের মাংস পোড়া গন্ধ। মানুষের চিৎকার, বাঁচার আহাজারি…., পান্না ফ্যাশন গার্মেন্টসে আগুন লেগেছে। এমন ঘোলাটে পরিবেশের সামনে দাঁড়িয়ে জয়িতা ভাবে, সে যদি আজ আধাঘন্টা দেরী না করতো, তাহলে সে-ও হয়তো এখানে জ্বলতে থাকতো। কিন্তু জয়িতার মনে আনন্দ হয় না। জয়িতার দুঃখ হয়। বুক ভারী হয়ে আসে। তার এমন অসময়ে কেউ একজন যদি ফোন করে বলতো, ‘জয়িতা ঠিকঠাক আছো?’ এমনতো না যে জয়িতার কেউ নাই। আছেতো একজন, যে কি-না চাইলেই নিতে পারতো জয়িতার খবর। কিন্তু সেই একজনেরও আছে অন্য নিমগ্নতা।
জয়িতা শাফায়েতের কথা ভাবে। একজন ছন্নছাড়া যুবক, যে কি-না অপেক্ষা করে আছে একটা গল্প লেখার জন্য। আপাতত: তার সবচেয়ে জরুরি কাজটাই হলো, একটা গল্পের থিম তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মাঝেমধ্যে যুবকটি জয়িতার কাছে আসে, গল্পের কথা বলে। জয়িতাকে দিয়ে থাকে প্রতিশ্রæতি। কিন্তু শাফায়েতের গল্প লেখা আর হয়ে ওঠে না। উপন্যাসের কোন একটা সময়ে এসে আমরা দেখতে পাবো, শাফায়েত নামের সেই গল্পকার প্রেমিককে জীবনের একটা চেনা ফাঁদে পা দিয়ে হারিয়ে ফেলে জয়িতা।
এবার আসি দ্বিতীয় পর্বে। পুরো গল্পটার সবচেয়ে ক্লাইমেক্স দৃশ্যটা রয়েছে এখানেই। এই পর্র্বেই লেখক তার পান্ডিত্যকে নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন। টানটান উত্তেজনা দিয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে গল্পের মোড়।
এই অংশে আমাদের সাথে পরিচয় হয় একজন বেপরোয়া যুবকের সাথে। যার নাম জুলহাস। বাংলাদেশের এক মফস্বল শহরে তার বাস। যে দীর্ঘ একটি রাত অপেক্ষা করে শুধু মাত্র সকালের জন্য। সকাল হলেই বদলে যাবে তার ভাগ্য। সংসারের সাধারণ ঝড়-ঝঞ্ঝা ফেলে যুবকের ভেতর জেগে ওঠে রাজনৈতিক ঝড়। লেখক যুবককে নামিয়ে দেন একটা প্রতিযোগিতামূলক খেলায়। কিন্তু যুবক জিততে পারে না সেই খেলায়। ঘটনা হতে থাকে ক্রমশ রহস্যময়। জীবনের পাকচক্রে পড়ে যুবক তলিয়ে যায় অতলে। সমাজ, সমাজের রাজনৈতিক নেতা, সামান্য একটা স্বপ্ন, সবকিছু খানখান হয়ে যায় যুবকের। সেই যুবককে লেখক নিয়ে আসেন আমাদের সেই প্রথম অংশে, যেখানে আছে আমাদের জয়িতা।
জয়িতার গার্মেন্টস পুড়ে গেলে ভাগ্যচক্রে সে এসে যোগ দেয় নতুন একটা জায়গায়। যেখানে সে আন্দোলন করবে শ্রমিকের অধিকারের জন্য। জয়িতা ঘুরতে থাকতে একটার পর একটা গার্মেন্টেসে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়। সাথে থাকে সেই ক্ষিপ্ত যুবক জুলহাস। শাফায়াতের জায়গা দখল করে জুলহাস। জয়িতার নগ্ন স্তনে ঠোঁট রাখার অধিকার পেয়ে যায় সে। কিন্তু সে অধিকার বেশিদিন টিকে না। কিছু কিছু মানুষ জীবনে আসেই চলে যাওয়ার জন্য।
গল্পের শেষের দিকটা অনেকটা অন্য রকম। একের পর এক দেশের বড় বড় গার্মেন্টসে আগুন লাগতে থাকে। কেউ জানে না কে ঘটাচ্ছে এই ঘটনা। সবার মনের ভেতর সন্দেহের তীর ঝুঁকে আছে একেকজনের দিকে। কিন্তু কেউ কারো নাম বলে না।
লেখক হিসেবে তিনি আসলে তাঁর ক্ষমতা দেখিয়েছেন এই বইয়ে। গল্পের প্রতিটি মানুষ এতোটা নিঃস্ব, এতোটা একা যে, মাঝেমধ্যে সেই বিষন্নতার জগতে ঢুকে পড়েছি নিজেও। গল্পের প্রতিটি মানুষই একে অপরের, কিন্তু কেউ কারো নয়। কেবল আমরা দেখতে পাই, অসহায়ত্ব আর রাজনীতির নোংরা খেলা। আপনারা চাইলে প্রবেশ করতে পারেন, ‘মুদ্রারাক্ষসের’ সেই বিষন্ন জগতে। সুখপাঠ্য এই বইয়ের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
মুদ্রারাক্ষস ।। আহমদ বশীর
প্রকাশক : জনান্তিক, শাহবাগ, ঢাকা।। মূল্য ; ৩০০ টাকা রকমারি লিংক
আরও পড়ুন…