রাকিবুল রকি এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

বাংলাদেশ

আইসিওতে টাকা আছে, অক্সিজেন নেই

মেঘ নেই- দিবারাত্রি সফেদ আকাশ
ঝুকে থাকে

মানুষের ঘাম জমে জমে
সেখানে সবসময় তুষার ঝরে, বরফ জমে

শীতে শীতে তুমি একা হয়ে যাবে
ভীষণ রকম!

চোখ থেকে ধীরেধীরে মুছে যাবে
হাসিকান্না, মুণ্ডু, দাড়ি-কমা
দৃশ্যসমগ্র

বাংলাদেশ, মা-রে, কষ্ট করে থাক
শ্বাসকষ্ট চলে যাবে
জীবন থাক, না থাক।
……

আগুন

বুকের ভেতর আগুন শুধু
খাঁচাটাকে পোড়াবে
দেখবে সবাই, হাসি মুখে
পোড়াভস্ম উড়াবে

আগুন আগুন বাড়বে ভীষণ
বৃষ্টি-জলের ছাঁট পেলে
নদীর জলে জ্বলবে আগুন
দগ্ধ বুকের আঁচ পেলে

বাড়ছে সবই, বাড়বে; শুধু
মানুষ বিকোয় খুব কমে
জীবনটা আজ থমকে গেছে
দুই মিনিটের কনডমে
……

ভুলে যেও

হারিয়ে যাওয়া বইয়ের মতো
আমাকেও ভুলে যেও

যে-রোদ হারিয়ে গেছে
খুঁজো না তাকে বিকেলের নির্জনতায়

বইয়ের ভাঁজে
ময়ূরের পালক জমিয়ে কী লাভ?

ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধুয়ে যাবে সব স্পর্শ!
……

আরও পড়ুন – সুদীপ দাস এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

বিধবা দুপুর

পৃথিবীর সব রোদ আঁচলে ভরে চলে গেছো

রঙহীন বিধবা দুপুর
পড়ে ছিলো চোখের টেবিলে

এভাবে চলে যেতে নেই

হাইওয়েতে পৃষ্ঠ হওয়া প্রজাপতির সাথে
মৌলিক কোনো ব্যবধান নেই আমার

দীর্ঘতর অপেক্ষা উপেক্ষা করে
অহঙ্কার ছুঁড়ে ফেলে
এভাবে যেও না, প্লিজ!
প্রকৃতির সব ফুল সুগন্ধি হারিয়ে
কাগজের হয়ে যায়।
……

দুমুঠো ভাত

অনবরত ছুটে চলা জিপ
আর অস্ত্রের মুখেও
আমার ক্ষুধা লাউয়ের ডগার মতো
লকলক করে ওঠে
এমনই বেয়াড়া

যেখানে ভোরের চাদরে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকে
সেইখানে কেন প্রেতপূর্ণ করাল রাত্রিকে ভয় পাবো?

চোখ থেকে একে একে মুছে গেছে রূপালি নক্ষত্ররাজি
ফুলের সুবাস
বৃষ্টির কোমল ঘ্রাণ

কে রাজরানী, কে ঘুঁটেকুড়ানি
আজ মন নেই তাতে
শালিক ডাকা ভোরে শিউলির মতো
দুমুঠো ভাত পেতে চাই পাতে\
……

সময়-অসময়

গায়ের ভাঁজে হচ্ছে লেখা- বয়স হলো
অথচ মেয়ে তুমি এখনো কলেজে পড়ো!
কেনো পড়ো?

রৌদ্রে ভেসে কতটা বেলা চলেই গেলো
তোমার ব্যাগে এখনো কেন ভোরের আলো?
শিউলি ফুল, শিশির, ধুলো?

একলা একা যাচ্ছে কেটে সময়গুলো
একলা একা থমকে আছে প্রহরগুলো

যখন রাতে আযান হবে, হবে আমার ঘুমের বেলা
সেদিন তুমি ফুটবে ফুল?
হবে তোমার বিকেল বেলা?
……

আরও পড়ুন – অতনু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

কবিতা ভাবনা

কবিতা কী- নানানজন নানান ভাবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তারা মহাজন। নমস্য। শিরোধার্য তাদের বাণী। তবু কি কবিতাকে সত্যি সত্যি সংজ্ঞায়িত করা গেছে? সেইসব সংজ্ঞার ছাঁচে ফেলে শব্দকে সাজালেই কি কবিতা হয়ে যাবে? না।
তবু প্রশ্ন জাগে, কবিতা কী? কোথায় থাকে কবিতা?
কবিতা যেন মানুষের আত্মার মতো। প্রাণের মতো। আছে। সবাই বুঝতে পারি কিন্তু সারা শরীর তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও, কুটে কুটে দেখলেও কোথাও সেই আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে সংজ্ঞার ছাঁচে কবিতাকে সৃষ্টি করা না গেলেও কবিতা জন্মের পর বোঝা যায়, এই হলো কবিতা। তখন তাকে নিয়ে নির্মাণ করা যায় সংজ্ঞা; সেই সংজ্ঞা, ধারণা হয়তো পূর্ববর্তী সংজ্ঞার সাথে মিলতেও পারে আবার সম্পূর্ণ নতুন রূপেও ধরা দিতে পারে। এজন্যই ‘কবিতা অনেক রকম’। আকারে, আয়তনে, গঠনে, বিন্যাসে, ভাবে, চলনে, বলনে- একেকজন একেকজনের চেয়ে আলাদা।
রমণীর মতো বোঝা যাবে না জেনেও মাঝেমধ্যে কবিতাকে বুঝতে চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতা হলো পুরোনো পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে নতুন, অদেখা, অনাবিষ্কৃত আকাশকে দেখার চেষ্টা করা। কখনো সে আকাশ দেখা দেয়, কখনো দেয় না।
যখন দেখা দেয়, মনে হয়, আরে চোখের সামনে এই বিশাল আকাশ, এ ভাবে তো কখনো দেখিনি। যখন দেখা দেয় না, তখন তা নিছকই মৃত শব্দের জঞ্জাল হয়ে যায়। যতই চেষ্টা করা হোক, তখন সে শব্দ মনকে নিয়ে আকাশে ওড়ে না। জমিনেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।

কবিতা হবে মানুষের মতো। একজন আরেকজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একই আদলের বার্গার দিয়ে হয়তো প্রতিবার পেট ভরবে কিন্তু একই আদলের কবিতা দিয়ে মন ভরবে না। তাই চাই আলাদা কিছু। তবে সে-আলাদা বস্তু উদ্ভট কিছু হবে না। সে বহন করবে পরম্পরা। হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস। দশজনের সাথে না হোক অন্তত একজনের সাথে কমিউনিকেশন করার সামর্থ কবিতার থাকতে হবে। বর্তমানের সাথে না হোক, ভবিষ্যতের সাথে তাকে তৈরি করতে হবে সেতুবন্ধন। আলাদা করতে গিয়ে, নতুন কবিতা লিখতে গিয়ে শব্দের মন্ডু তৈরি করার কোনো মানে হয় না। পথে ঘাটে চলতে গিয়ে, তরুণীর চোখের দিকে তাকিয়ে, স্নানঘরে জলের বেসিনে কান্না ধুতে গিয়ে যদি কবিতার একটি লাইনও না স্মরণে এলো, তবে তা কিসের কবিতা। একটি কবিতা পড়ার পর যদি সেই কবিতার রেশ মনের মধ্যে ভ্রমরের মতো গুণগুণ না করে, যদি পুনরায় কাছে না টানে তবে সেই কবিতার কোনো উপযোগিতা নেই, বুঝতে হবে।

কবি কবিতা লেখেন শব্দ দিয়ে। বিষয় নিয়ে। সেই শব্দ হতে হবে আধুনিক। সাম্প্রতিক। সেই শব্দকে আভিধানিক অর্থের ছাল ছাড়িয়ে পরাতে হবে নতুন ব্যঞ্জনা। পুরোনো বিষয়েরও হতে হবে অভিনব উপস্থাপন। আজকে শব্দ কাছে টানবে। কিন্তু সময় যখন শতবর্ষের ঘর পেরিয়ে যাবে, শব্দগুলো আবার ফিরে যাবে অভিধানের পাতায়, তখন বিষয়, অর্থালঙ্কারই প্রতিনিধিত্ব করবে কবির, কবিতার। তাই কবিতা দাবী করে পূর্ণ সচেতনা। সম্পূর্ণ মনোযোগ। হেলাফেলা একেবারেই সহ্য করে না সে।

প্রতিনিয়ত জীবন খরচ করে কবিতাকে আহ্বান করতে হয়। কখনো সে আসে, কখনো সে আসে না।
ইদানিং কবিতা লেখার ব্যাপারটাকে মাছ ধরার সাথে মিল আছে বলে মনে হয়। কেননা একজন কবিকে জেলে-র মতোই প্রতিনিয়ত জাল ফেলে বসে থাকতে হয়। সে জানে না, কোন খেপে তার বেশি মাছ ধরা পড়বে, বড় মাছ ধরা পড়বে? একবার জাল ফেলে কোনো জেলেই বলতে পারবে না সবচেয়ে বড় মাছটি এবার তার জালে ধরা দেবে। কবির বিষয়টিও তেমন। প্রতিনিয়ত তাকে কলমে অথবা কি-প্যাডে আঙুলকে সচল রাখতে হবে, কখন যে তার শ্রেষ্ঠকীর্তি ধরা পড়বে, তা সে নিজেও জানে না।
কবিতাকে ধরার জন্যে প্রতিনিয়ত জাল বিছিয়ে বসে থাকি। আসে না, আসে না, আবার যখন আসে, জালে মাছের ঝাঁক ধরা পড়ার মতোই অবস্থা হয়। শব্দগুলো নানা রঙে লাফাতে থাকে। একের পর এক পঙ্ক্তি মাথার মধ্যে এসে ঘাঁই দিতে থাকে। সবাইকে অনেক সময় ধরা সম্ভবও হয় না। ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। সাথে সাথে হয়তো ব্যাপারটি মনে দাগ কাটে না কিন্তু যখন একের পর এক খেপ দিয়েও চুনোপুঁটিও উঠে আসে না, তখন মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ্যা সময়ের কষ্ট বড় নির্মম।
ছন্দোবদ্ধ কবিতার প্রতি বেশকিছু দিন ধরে নেশা লেগেছে। বিশেষ করে স্বরবৃত্তের ঘোর কিছুতে যেন কাটাতেই পারছি না। তাই মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত কিছুটা দূরে সরে গেছে, অভিমানে। হয়তো স্বরবৃত্তের ঘোরও কিছুদিন পর কেটে যাবে, মাঝখানে যেমন সনেটের বাঁকা ঠোঁটের প্রেমে পড়েছিলাম। টানা তেরো চৌদ্দটি লেখার পর বিরতি দিতেই আর ধরতে পারিনি তাদের।

কবিতা কি আয়োজন করে লেখা সম্ভব? অন্যকারো পক্ষে সম্ভব কি না জানি না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সারাদিন বাসায় বসেও অনেক সময় মন মতো এক লাইন লিখতে পারি না। অথচ বিগত পাঁচ বছর ধরে চলার পথে, বাসে বসেই অধিকাংশ পদ্য লিখেছি ছন্দ-অন্তমিল-সহ।

কবিতা স্বর্গ থেকেই আসুক, আর যেখান থেকেই আসুক, কবিতাকে কাছে পাওয়ার জন্যে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে প্রতীক্ষার বিকল্প নেই।
অন্যকোনো পেশায় এত শ্রম এবং মেধার সংমিশ্রণ ঘটাতে পারলে উন্নতির শিখরে চড়া যতটা নিশ্চিত, কবিতাকে সব কিছু দেয়ার পরও সিদ্ধি লাভ করা ততটাই অনিশ্চিত। তবু কবিতার জন্য এতো আয়োজন। কারণ কবিতার বুকেই আছে আত্মার বিশ্রাম।

কবি পরিচিতি: রাকিবুল রকি ১৯৮৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার কাশীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আ. আউয়াল এবং রানু বেগমের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। পড়াশোনা করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। স্ত্রী মারজান আক্তার, পুত্র আহমদ রাইয়ান রৌদ্র।
প্রকাশিত বই-
কাব্যগ্রন্থ: তুমি হাসলে সূর্যটা কেমন মন খারাপ করে নিভে যায় (২০১৫), ধান-কাউনের গল্প (২০১৮), মায়াবতীর জলে (২০২০)
প্রবন্ধগ্রন্থ: কবিতার জানালা (২০২১), হুমায়ূন আহমেদ ও অন্যান্য গদ্য (২০২৩)
গল্পগ্রন্থ: নিষিদ্ধ গল্প (২০১৭)
কিশোরগ্রন্থ: আবীর ও হায়েনার গল্প (২০১৬), জমিদার বাড়ির গুপ্তধন (২০১৮), চাঁদবনের জাদুর বাড়ি (২০২৩), গুপ্তধন আবারো গুপ্তধন (২০২৩), বিপদ ভয়ংকর (২০২৩), চাঁদের বুকে এলিয়েন (২০২৩)
অনুবাদ গ্রন্থ: দ্য অ্যালকেমিস্ট (২০১৮), কাজুও ইশিগুরোর গল্প (২০১৮), এলিয়েন এলো স্কুলে (২০১৯), ম্যানস সার্চ ফর মিনিং (২০২০), দ্য পাওয়ার অব ইয়োর সাবকনশাস মাইন্ড (২০২১), ভারতীয় লোক-কাহিনী (২০২১), লিডারশিপ ১০১ (২০২২), দ্য কার্স অব দ্য মমি অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক ক্যাট (২০২২), সেলস সাকসেস (২০২২), গেট টু দ্য টপ (২০২২), হু মুভড মাই চিজ? (২০২৩)
যৌথ সম্পাদিত গ্রন্থ: মজার বই (২০১৫), পৌরাণিক শব্দকোষ (২০১৮)
পুরস্কার: বাবুই শিশুসাহিত্য পান্ডুলিপি পুরস্কার (২০১৮), প্রিয় বাংলা পান্ডুলিপি পুরস্কার’২১ (২০২১), নক্ষত্রের খোঁজে পান্ডুলিপি পুরস্কার ২০২২ (২০২২)