একটি খুনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে আমি একজন রাজসাক্ষী

একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক। এ আবার কেমন কথা? একে তো খুন! তার ওপর তার প্রস্তুতি? সে বিষয়ে বৈঠক! কী আর্শ্চয কেমোফ্লেক্স! আসলেই কি? তার আবার রাজসাক্ষী! এর বাস্তবতা কী? নাকি কেবলই গল্প? গল্প! গল্পের আবার কথা কী? সে তো গল্পই। পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার বোথলা গ্রাম থেকে মাথায় করে গল্পের বোঝা টেনে এনে আকণ্ঠ নিমজ্জিত প্রমত্তা কচানদীর ভাঙনের সুরে লঞ্চে পার হয়ে মোকাম সদরঘাট অতিক্রম করে মনি হায়দার অসংখ্য গল্পে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। রাজধানীর বুকে। বাংলাদেশের মানচিত্রে। সাধারণের জনজীবনের আনাচ-কানাচজুড়ে তার গল্পের ‘অশ্বখুর ধ্বনি’ বেজে ওঠে ‘নিঃশব্দে’।

‘দ্বিতীয় কদমফুল’ হাতে ‘রিমি কেঁদে ওঠে’। ‘প্রথম কুসুম’, এ ‘তিনটি স্বপ্নের একটিতে ছ্যাঁকা’ লাগে ‘নগ্ন দরজায়’। ‘ভস্ম’ হয়ে যায় ‘সোঁনার খাঁচায় আবিদ হাসান’। ‘আহীর আলমের বাম পা’ টেনে ‘আর্তি ও আর্তনাদে’ ‘নয়মাস’, এ ‘সমরেন্দ্রনাথ, বুড়ি মা ও শেখ মুজিব’ ‘লিমপেট মাইন’ ‘ভেঙে যাওয়ার দরজায়’ ‘একজন মানুষের একদিনের গল্প’ বলতেই লেখক হবার স্বপ্ন নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার পর মাত্র ৯৩ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মনি হায়দার।

২০১১ সাল। সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রকাশ’-এর সাক্ষাৎকার-এ ‘আঁখি সিদ্দিকা’ নামের একটি ছোট্ট মেয়ের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেছিলেন ‘আমি আসলে ছোটগল্প লিখতে পছন্দ করি বেশি। এটি আমার সাধনার জায়গা। আমি আমার গল্পে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা জীবনগুলোর কথা বলতে ভালোবাসি বেশি। এ ছাড়া শিশুতোষ সাহিত্যের প্রতিও রয়েছে আমার টান।’

সহজ কথা যায় না বলা সহজে। আকারে সে ছোট্ট, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প হলো এক যুগ যন্ত্রণার ফসল। বিশ্বসাহিত্যে এমনকি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা ছোটগল্পের দিকে লক্ষ্য করলে এর অনেক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য ও বাংলা সাহিত্যে নতুন রূপে সৃষ্টি হয়েছিল তা ছোটগল্পের অন্যতম অনন্য বৈশিষ্ট্য।

যেমন- ছোটগল্পের প্রাণ হবে খুবই ছোট অর্থাৎ বিষয় হবে খুবই ছোট। ছোটগল্পের বিষয়ে বাহ্যিক কোনো বর্ণনা বা অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা থাকবে না।
জীবনের কোনো এক মুহূর্ত থেকে ছোটগল্পের পথ চলা শুরু হয় অর্থাৎ সাহিত্যিকদের মত অনুযায়ী চকিত চমকে ছোটগল্পের যাত্রা। রবীন্দ্রনাথের মত অনুযায়ী ছোটগল্পের সমাপ্তি হবে এমনভাবে যেখানে মন তৃপ্তি পাবে না, শেষ করতে ইচ্ছা থাকবে না, পাঠকের পরবর্তী ঘটনা জানার আগ্রহে মন ভরে থাকবে। ছোটগল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে সংযম বোধ থাকবে। নাটকীয়তা সংঘাত ব্যঞ্জনাধর্মী তা ছোটগল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ছোটগল্পের মধ্যে ঘটনার একটি শীর্ষ মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্স থাকবে, যেখানে গল্পের বিষয়বস্তু বাঁক নিয়ে অনন্য হয়ে উঠতে পারে।
১৯৮৬ সালে এক যুগ যন্ত্রণার ফসল নিয়ে দৈনিক বাংলার বাণী’র ‘শাপলা কুঁড়ি’র পাতায় প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘চোর’, দিয়ে যাত্রা শুরু করার পর মনি হায়দার এ-পর্যন্ত ২০০টির বেশি গল্প লিখেছেন।

এই ছোটগল্পের যাত্রায় নাটকীয়তা সংঘাত ব্যঞ্জনাধর্মী, গল্পের মধ্যে ঘটনার একটি শীর্ষ মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্স গল্পের বিষয়বস্তুর বাঁক নিয়ে অনন্য তার গল্পের খুনোখুনিতে কী প্রস্তুতি নিলেন বা কতদূর এগোলো তার সেই অভিযাত্রায় আমি একজন রাজসাক্ষী।

জীবন নিংড়ে, সমাজের চারপাশকে অবলোকন করে, অভিজ্ঞতার জারক রসে জারিত হয়ে; অনুপ্রাণন থেকে প্রকাশিত ‘একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক’-এ তিনি নতুন কী বলতে চাইলেন? সাহিত্যের আদালত থেকে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন এভাবে- ‘একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক’ বইটিতে শুধু বাংলাদেশের সমাজচিত্র নয়, খুঁজে পাওয়া যাবে এখানে বৈশ্বিক স্নিগ্ধ-নিষ্ঠুর, স্মৃতিময় জীবন-উপাখ্যান।’

জীবনের দুঃখ গিলে খেয়ে, সুখী মুুহূর্ত যাপন করে, অভিজ্ঞতাকে মননে ধারণ করে অবিন্যস্ত ক্ষেত্রফল, কাঁটা কম্পাস, তিক্ত- তিক্তস্বাদ, মধুর বিষ, অপ্রাপ্তির অভ্যুত্থান, রাজনীতির ভন্ডামি, প্রেমের সূচ্যাগ্র রক্তপাত, হত্যা এবং গুম, বিচিত্র ধরনের দখল ও আগ্রাসন- গল্পেরই জায়গা জমিন। ‘একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক’ গল্প বইয়ের গল্পগুলোতে এইসব অভিযোজনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার হলাহল ধারণ করার চেষ্টা হয়েছে।

সেই সময় ও এই সময়ের মানচিত্র, যেখানে মনুষ্যবেলার ক্রান্তিকাল আর নিনাদনৃত্য চিৎকার হাত ধরে যায় বধ্যভূমিতে, ‘একটি খুনের প্রস্তুতি বেঠক’ গল্পগ্রন্থের গল্পধারায় খুঁজে পাওয়া যাবে তারই বিষাক্ত ইতিহাস। বইয়ের প্রতিটি গল্প মানুষের জন্ম অপরাধের বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদের দলিল।

নব্বই দশকের গল্পের একটা প্রধান প্রবণতা অতিরিক্ত ভণিতা কিছুটা নিরীক্ষার মতো করে বলে যাওয়া। ফলে গল্প পড়তে গেলে মনে হয় কোনো প্রবন্ধ পাঠ করছি। অকারণ নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেককেই কলম থামাতে হয়েছে। বিশেষ করে মনি হায়দারের আগের গল্প বা পূর্বের উপন্যাসে তার পূর্ববর্তী গল্পকারের স্বর টের পাওয়া গেলেও তিনি কলম না থামিয়ে এক নতুন স্বর আনতে পেরেছেন। এক দশক ধরে তার গল্পে মনি হায়দারের গল্পে ভণিতা নেই, তাই গল্পগুলোকে বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। মনি হায়দারের গল্প পড়ার সময় মনে হয় পাশে বসে কেউ গল্প করছে। পাশে বসে গল্প করার সময় যেমন হাত নড়ে, চোখ নড়ে, গলার স্বর ওঠানামা করে, হঠাৎ উত্তেজনা ও চাপা আবেগ প্রকাশ পায় মনি হায়দারের গল্পগুলোও সে রকম, গল্পকারের শারীরিক উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

‘একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক’- এ যদি কিছুক্ষণ বসি, তাহলে কি কেবল খুনোখুনির গল্প শুনতে পারব? না তা’ নয়। কারণ এই বৈঠকখানায় খুনের প্রস্তুতি ছাড়াও পাঠককে প্রস্তুত করা হয়েছে আরও ১৬টি গল্প শুনবার, বলবার, ভাববার। জীবনের সাথে জীবন মিশিয়ে আদর করবার। অথবা নিষ্ঠুরতার পাশে দাঁড়িয়ে জীবন চিনবার বা একটি স্বাধীন… সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহানায়কের সাথে সমেরেন্দ্রনাথ বা বুড়ির মা সর্ম্পকের মেলবন্ধনের। প্রেম-দেহজ তৃষ্ণা তবে কি বাদ গেছে? না সেটিও ভণিতা না করে মৌলিকভাবে উঠে এসেছে। প্রতিটি গল্পই আলাদা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু সব গল্পের রাজসাক্ষী হলে আপনি পাঠক হিসেবে আমাকে নির্ঘাত বকবেন। আসলে প্রতিটি গল্পে জীবন ও জগৎকে নানামাত্রিকতায় দেখবার ও দেখাবার একটা প্রয়াস আছে, গল্প কথকের। সেটি তা পাঠান্তেই কেবল বোঝা সম্ভব।

বইয়ের প্রথম গল্প ‘আহীর আলমের বাম পা’।
‘বছর দশেক আগে আহীর আলম কোমরে একটা ব্যথা পায়। মতিঝিলের একটা অফিসে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শব্দ উৎপাদন হলো, মঝচ। খুব পাত্তা দিলেন না তিনি। এটাকে তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দেন না। শৈশব থেকে এই চল্লিশ বছর ওই রকম কত মঝচ শব্দ উঠেছে কোমর থেকে, কী হয়েছে?’
কিন্তু, এই সামান্য ব্যথা তাকে আস্তে আস্তে কাবু করে ফেলে। প্রায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ডাক্তার বলেন একটু সাবধানে চলাফেরা করার জন্য। কিন্তু, বোহেমিয়ান, বেখেয়ালি আহীর আলম তাও খুব বেশি পাত্তা দেন না। যেখানে সেখানে ঘুরতে চলে যান। একপর্যায়ে প্রায় বাঁকা হয়ে তিনি ডাক্তারের কাছে আসেন। ডাক্তার এমআরআই করতে দেন। এমআরআই রিপোর্ট দেখে বলেন, মেরুদণ্ডের একটা ডিস্ক সরে গেছে, সেটাকে অপারেশন করে ঠিক করতে হবে। প্রথমে দশ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে বললেও কার্যত থাকতে হয় আঠাশ দিন। দ্বিতীয়বার আবার অপারেশন করতে হয়। এর মধ্যে টাকা-পয়সা বেরিয়ে যায় জলের মতো। নিন্মমধ্যবিত্ত আহীর আলমের মাথায় হাত। হাসপাতালে পড়ে থাকার সময় কারো সান্নিধ্যও পান না। না পরিবারের না কোনো বন্ধুর।

বাসায় আসার পর আরো একলা হয়ে যান। ড্রইংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেন বাইরের মানুষের হাঁটাচলা। মানুষ যে সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে এটাই তাকে অবাক করে দেয়। পিঠের ব্যথাটা সেরে গেলেও বাঁ পাটা তাকে খুব ভোগাচ্ছে। থেরাপি নিয়েও সেটা সারছে না। সব সময় কেমন ভার ভার, অবশ অবশ। একদিন হঠাৎ আহীর আলমের মনে হয় তিনি যে কতদিন বাইরে যান না, বাইরের পৃথিবীটা এখন কেমন আছে? পত্রিকা কিনতে যান না, মুদির দোকানে যান না, কেউ কি জানতে চেয়েছে সেই মানুষটি আর আসছে না কেন! আহীর আলম জীবনের প্রবল এক নিঃসঙ্গতা ও অর্থহীনতায় আক্রান্ত হন।

এই গল্পটি তার ‘সিরিজ’ গল্প। এখানে তার বাম পায়ের, ‘ভোগান্তির পাশাপাশি স্ত্রী, বন্ধু ও পরিবারের নিষ্ঠুরতা, তার শরীরের নিষ্ঠুরতার চরম প্রকাশ পেয়েছে। গল্পের শেষটা নিষ্ঠুর বা বেদনাদায়ক। সেটা আমি আর এখানে বলব না।

তার গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পের মায়ার অন্তরালে অন্তঃশীলা থাকে চাপা এক নিষ্ঠুরতা। যেমন ‘আহীর আলমের বাম পা’ সিরিজ গল্পগুলো কীভাবে যেন আমাদের চিন্তার উৎসমুখ খুলে দেয় চুপিসারে, বুঝতেও পারি না। কেন আহীর আলমেরা হাতে তুলে নেয় হন্তারক ছুরি, তা আমাদের অজ্ঞাতই থেকে যায়। মানববৃত্তির জলছবি আঁকতে আঁকতে মনি হায়দার আসলে মানবিকতার পলেস্তারা খসিয়ে দেন এক লহমায়, মানবমনের গূঢ়তলচারী বিকারকে তার লিখনবিশ্ব করে তোলেন। মানুষ ও সমাজের সেই আশ্চর্য যৌক্তিক বিপর্যয় তার সমস্ত ট্র্যাজেডি নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়।

আমরা যে সময়ে দিনযাপন করছি বা সহাবস্থান করছি সে সময়টা অস্থির, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তার। তাই হয়ত নব্বই বা বিংশ শতকের মতো সামাজিক, পারিবারিক ও প্রেমের গল্প বা সিনেমার চেয়ে ভালো লাগে থ্রিল। থ্রিলিং আগেও ছিল কিন্তু ভীষণ প্রকট। রক্ত, সরাসরি খুন, সরাসরি কষ্ট দেবার চিত্র কি আমাদের বেশি টানছে? ওয়েব সিরিজ, সিনেমার প্লট থেকে শুরু করে গল্পকারের গল্পেও থাকছে এই সময়ের দাবি। তাই তো মনি হায়দারের বইয়ের নাম গল্পটা খুনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক দিয়ে শুরু করতে হয় সময়ের দাবিতেই, হয়তো।
‘আজকাল এক হাজার টাকায় একটা খুন করা যায়।

যায়। তয় যারে খুন করাইবেন তার দাম কতো? শিকারের দাম অনুসারে খুনের দাম বাইড়া যায়। যে ভদ্রমহিলারে আপনি খুন করাইতে চান আমি তার সম্পর্কে সব খোঁজখবর লইচি।
কেনো? আপনি তার খোঁজখবর নিতে যাবেন কেনো।

আবারও হাসে ক্যানন খিকখিক করে, গা জ্বালানো ভঙ্গিতে- যারে খুন করবো, তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া আমার বিসনেসের একটা ধর্ম। খোঁজখবর নিয়া জানলাম, ভদ্রমহিলা প্রায় দুই-আড়াই কোটি টাকার মালিক। এই জন্যে আমার রেট বাইড়া যায়। আমি জীবনের রিস্ক লইয়া খুন করবো আর আপনে বইস্যা বইস্যা দুই আড়াই কোটি টাকা ভোগ করবেন, বিষয়টা কী ঠিক? রিস্ক আমার আর আপনে দুই হাতে দুই পায়ে লুটবেন। সহ্য করি ক্যামনে? খুনের দামতো বাড়বোই’ (একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক)

সমাজের লুণ্ঠনে মানুষ খুন ভীষণ মামুলি ব্যপার। তা আসলে আমরা পেপার-পত্রিকা চারপাশ দেখলেই বুঝতে পারি।
‘বস আমার পৌঁছবার আগেই কে যেন আপনার ফুফু ফাতেমা রব্বানীকে খুন করে রেখে গেছে তার বিছানায়।
বলো কি! আমূল চমকে ওঠে ইরতাজ।

হাচাই কইছি। তার বেডরুমে ঢুইক্যা দেখি সাদা বিছানায় রক্তে লাল। তার মাথাটা শরীর থেকে আলাদা-নিচে পইড়া আছে। রক্তে মোজাইক কক্ষ ভাইস্যা যাইতেছে। আমি রক্তে পা দিয়ে টের পেয়েছি, রক্ত একেবারে গরম। আমার যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে কেউ ফাতেমা রব্বানীকে খুন করেছে। বস বলো তো কে খুনটা করলো?
ইরতাজের হাত থেকেই মোবাইল পড়ে যায়। সে পাথরের মতো বসে থাকে। মনে হচ্ছে, তার চারপাশে টাটকা রক্তের নহর বইছে। আর সে রক্তের ভেতর সাঁতার কাটছে’

রক্তের ভেতর সাঁতার কাটা সমাজটিকে তুলে ধরেছেন এই ইরতাজের ভেতর দিয়ে মনি হায়দার। একইভাবে তিনি গল্পের ভেতর দিয়ে নিজেকে ভেঙেছেন, নিজেকে নানামুখীভাবে নিরীক্ষা করে মৌলিক স্বর তৈরি করেছেন- হোমায়রা শাকিল, আতাউর, নীলুফা, নাহার, রুপালী আখতার, রোমান রায়হান, আবিদ হাসান রাহেলা, সমেরেন্দ্রনাথ, রিমি, সিলভিয়া, আহীর এমনকি শেখ মুজিব ভেতর দিয়েই তিনি আয়নার মতো তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। লেখকের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নিজ জীবনের ঘটে যাওয়া নানামুখী গল্প। সে গল্পের শিল্পিত রূপ দিতে গিয়ে মনি হায়দারও কখনও ব্যর্থ হন। হয়েছেন।
যৌনতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সাহিত্যে সরাসরি না বলে তার শিল্পিত রূপ পাঠক দাবি করে। ‘রাত এগারোটার সময়ে আরও তিন পেগ ঢালে। একটা হালকা নেশা জাগে শরীরে। এবং অনেক দিন রাত পর তার স্মৃতিতে উঠে আসে- এক গ্রাম্য লাস্যময়ী তরুণী। যে তরুণী তাকে একদিন দুপুরে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছিল। চুমু খেয়েছিল, বুক দুটো মুখে তুলে দিয়ে বলেছিল- ‘আমাকে একটু সুখ দাও’

আসলে গল্পগুলো পাঠকের জন্য লেখা, যিনি খুঁজে বেড়ান হারিয়ে যাওয়া গল্প, গল্পের পথে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাবেন হয়তো তার কাক্সিক্ষত গল্প।
‘সার্থক লেখা প্রকৃতপক্ষে কী? কীভাবে নির্ধারিত হয় এই লেখাটি সার্থক? আমি যে লেখাকে সার্থক বলব, আপনি বা অন্যরাও মানবেন? সুতরাং সার্থক লেখা বলে কিছু নেই। লেখা লেখাই। একজন প্রকৃত লেখক যখন লেখেন, তিনি সমস্ত সত্তার আলোকযাত্রায় নিবেদন করে লেখেন। হ্যাঁ, কারও পড়াশোনার ঘাটতি থাকতে পারে, অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে, তারা কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে, যাবে। লেখায় নিরন্তর সাধনা লাগে। আর লেগে থাকার ধৈর্য লাগে। যারা সাধনায় মগ্ন থাকেন না, তারা হারিয়ে যান ঝরা পাতার মতো’- এমন করেই নিজ গল্প নিয়ে ব্যাখা দিয়েছিলেন মনি হায়দার।

‘একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠক’ বইয়ে পাঠক হিসেবে খুনোখুনির গল্পে আমাকে জড়িয়ে, পেঁচিয়ে একজন উইটনেস বা রাজ সাক্ষী বানিয়েছেন মনি হায়দার। এড়াতে পারিনি তাকে। তাই সাহিত্যের আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মনি হায়দার খুনের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছেন মাত্র। গল্পে, বোধে, অস্তিত্বে খুনের অপেক্ষায় পাঠক এখনও। তাই গল্পকার, কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের গল্প অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক কচা নদী হতে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বাংলাদেশের লাল সবুজ অতিক্রম করে পুরো বিশ্বের আনাচ-কানাচ।

আরও পড়ুন..

চিরকুট একটি মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প-সংকলন