প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ এর সাক্ষাৎকার

কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদের জন্ম ১৯৬০ সালে কুমিল্লায়। পেশায় প্রকৌশলী। আলম খোরশেদ প্রবাসে উচ্চশিক্ষা ও দীর্ঘ পেশাজীবন শেষে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন ২০০৪ সালে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চা ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে ‘বিস্তার : চিটাগং আর্টস কমপ্লেক্স’ নামে একটি সংস্কৃতিকেন্দ্র পরিচালনার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় সমকালীন বিশ্বসাহিত্য এবং অনুবাদচর্চা। সম্পাদনা, অনুবাদ ও মৌলিক রচনা মিলিয়ে তিনি এ-পর্যন্ত পঁচিশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ভার্জিনিয়া উল্ফের A Room of One‘s Own – এর অনুবাদ ‘নিজের একটি কামরা’, নোবেলজয়ী কবি ভিস্লাভা শিম্বর্স্কার ত্রিশটি কবিতার অনুবাদ, বাংলাদেশের নারীবাদী গল্প-সংকলন ‘কাটা জিহ্বার কথা’, স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনূদিত বোর্হেস ও বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর আলাপচারিতা, ন্গুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’র নাট্যানুবাদ ‘গির্জাবিয়ে’, হেনরি মিলারের আত্মজৈবনিক রচনা Reflections – এর অনুবাদ ‘ভাবনাগুচ্ছ’, সালমান রুশদি রচিত নিকারাগুয়ার ভ্রমণ আখ্যান The Jaguar Smile -এর অনুবাদ, ‘জাদুবাস্তবতার গাথা : লাতিন আমেরিকার গল্প’, ‘বোর্হেস-নাগিব-চিনুয়া- মার্কেস ও অন্যান্যের গল্প’, লাতিন আমেরিকার কবিতা সংকলন ‘নৈঃশব্দ্যের নামগান’, নারীবিশ্বের কবিতা সংকলন ‘নির্জন নিশ্বাস’, বিশ্বসাহিত্যের সংকলনগ্রন্থ ‘তরজমাগুচ্ছ’ ইত্যাদি। পেয়েছেন ‘বাংলা ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন’ প্রবর্তিত ‘অনুবাদ সাহিত্য পুরস্কার ২০২১’। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বই সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ

এবং বই: অনুবাদ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য গত বছরের শেষ দিকে আপনি একটি পুরস্কার পেয়েছেন। ‘আজীবন সম্মাননা’ বিভাগে আপনাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এবং বইয়ের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন

আলম খোরশেদ: ধন্যবাদ। এটি একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ ছিল। এবং আমি নিজে এই স্বীকৃতি ও সম্মাননায় যথেষ্ট অনুপ্রাণিত বোধ করেছি।

এবং বই: আমরা চেষ্টা করেছিলাম আরও আগেই আপনার সাথে বসতে, কিন্তু আপনার সময় হয়ে উঠছিল না। এই ব্যস্ততা কি নতুন কোনো অনুবাদ নিয়ে?

আলম খোরশেদ: ঠিক নির্দিষ্ট কোনো একটি অনুবাদ নিয়ে নয়। সত্যি বলতে কি, আমি সব সময়ই কিছু না কিছু অনুবাদ করে থাকি। তবে এই করোনাকালে আমি বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিলাম একটি ভিন্ন ধরনের অনুবাদ প্রকল্প নিয়ে। সেটি হচ্ছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের পঞ্চাশজন প্রতিনিধিত্বশীল নারীর কবিতার ইংরেজি অনুবাদের সংকলন প্রকাশ। অনুবাদ অবশ্য আমি নিজে নয়, ভারতের বিশিষ্ট কবি ও অনুবাদক নবীনা দাশ করেছেন, তবে এর সামগ্রিক সমন্বয় ও সম্পাদনার কাজটুকু আমাকেই করতে হয়েছিল আগাগোড়া। আপনারা জেনে খুশি হবেন, এই বইটি, ইংরেজিতে যার নাম রাখা হয়েছে : Arise out of the Lock: 50 Bangladeshi Women poets in English, গেল একুশে ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের একটি প্রকাশনা সংস্থা Balestier Press থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

আলম খোরশেদ এর বই সমূহ
আলম খোরশেদ এর বই সমূহ

এবং বই: আপনাকে আবারও অভিনন্দন, সঙ্গে অনুবাদক নবীনা দাশকেও…

আলম খোরশেদ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এবং বই: আপনার দৃষ্টিতে আমাদের দেশের অনুবাদ সাহিত্যের বর্তমান অবস্থাটা কেমন?

আলম খোরশেদ: এটি এমন একটি প্রশ্ন যার যথাযথ উত্তরের জন্য যথেষ্ট সময় ও বড়সড় পরিসরের প্রয়োজন। সংক্ষেপে এটুকু বলি যে, অনুবাদ সাহিত্যের দুটো ক্ষেত্র রয়েছে : একটি হলো বিদেশি সাহিত্য ও জ্ঞানকান্ডের বঙ্গানুবাদ এবং আরেকটি হচ্ছে, আমাদের নিজেদের সাহিত্যকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করে বৃহত্তর, বৈশ্বিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। প্রথম ক্ষেত্রে আমি বলব বেশ ভালোই কাজ হচ্ছে ইদানীং; যদিও সেখানেও একধরনের পরিকল্পনাহীনতা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচার, বাণিজ্যিক প্রবণতা, পেশাদারিত্বের অভাব ইত্যাদি সংকটগুলো ভালোভাবেই বিদ্যমান। তবে অপর ক্ষেত্রটিতে, অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে অন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পৌঁছে দেওয়ার কাজে আমাদের অর্জন প্রায় শূন্যের কোঠায় বলা চলে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভালো অনুবাদকের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি অভাব রয়েছে সরকারি, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার, সর্বোপরি আমাদের অগ্রণী প্রকাশকেরাও এর জন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, সম্পর্ক ও আস্থার জায়গা তৈরি এবং সমকালীন প্রাযুক্তিক দক্ষতা অর্জন ও বিশ্ব বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কাজে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেননি; যে-কারণে যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তিসমূহকে আমরা বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে সফল হইনি সেভাবে।

এবং বই: শোনা যায়, এই সময়ে ভারতের অনুবাদকেরাই বাংলাদেশের সাহিত্যের অনুবাদ করছেন অনেক বেশি, এর পেছনের কারণ কী?

আলম খোরশেদ: হ্যাঁ, আমাদের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে কথাটার কিছুটা সত্যতা রয়েছে বৈকি। যেমন, অরুণাভ সিনহা ও ভেঙ্কটেশ্বর রামস্বামীর কথা বলা যায়, যাঁরা দুহাতে অনুবাদ করে চলেছেন বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য। এর পেছনের একটা কারণ হয়তোবা এটা যে, তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুবাদ সংগঠন ও খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রকাশকদের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতি উল্লিখিত অনুবাদকদের বিশেষ আগ্রহ ও ভালোবাসা থাকার পাশাপাশি এই যোগাযোগগুলোও একধরনের ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে নিঃসন্দেহে।

আরও পড়ুন – আমার সুন্দরবন লাইব্রেরি

এবং বই: অনুবাদের কাজে আমাদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ কি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব?

আলম খোরশেদ: তা সেটা তো রয়েছেই। যেমন এই কাজে বাংলা একাডেমি, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি যতটা সক্রিয় ও তৎপর হতে পারত ততটা তো তারা আসলেই নয়। কিন্তু এর বাইরে সংশ্লিষ্ট অপরাপর প্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগসমূহ, নানান বেসরকারি বুদ্ধিভিত্তিক সংগঠন, যেমন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানও কিন্তু এই কাজে সেভাবে এগিয়ে আসেনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কয়েক বছর আগে বিদেশি বইয়ের বঙ্গানুবাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উপযুক্ত অনুবাদকদের এ-কাজে সম্পৃক্ত করতে না পারার কারণে সেটা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। 

এ ছাড়া এই বিষয়ে আমাদের প্রকাশনা সংস্থাসমূহের ব্যর্থতাও প্রকট। বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ তারা মোটামুটি প্রকাশ করেন বটে, কিন্তু স্বদেশি সাহিত্যকে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশের কাজে তারা তেমন উৎসাহী কিংবা পারঙ্গম নয়। তারা বছর বছর ফ্রাঙ্কফুর্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক বইমেলায় যায় বটে, কিন্তু সেখানকার বড় বড় প্রকাশকদের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক সই করে এসেছে বলে শুনিনি যে, তারা আমাদের সাহিত্যকে তাঁদের ভাষায় অনুবাদ করিয়ে প্রকাশের উদ্যোগ নেবে। নিদেনপক্ষে তাদের সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারলেও, আখেরে সেটা আমাদের সাহিত্যের অনুবাদে কাজে আসত বলে আমার বিশ্বাস। ব্যক্তিগত পর্যায়ে লেখক ও অনুবাদকেরাও যদি বৈশ্বিক যোগাযোগে আরো একটু তৎপর হতেন তাহলেও কিছুটা সুফল ফলত। এই সবকিছু মিলিয়েই আসলে আমাদের অনুবাদ সাহিত্য এ রকম পিছিয়ে আছে।

এবং বই: অনুবাদ নিয়ে প্রায় সময়ই চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ পাওয়া যায়। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

আলম খোরশেদ: না, আমার সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এবং এ নিয়ে আমি তেমন কিছু শুনিনিও অদ্যাবধি।

এবং বই: নতুন যারা অনুবাদের কাজে যুক্ত হতে চান তাদের জন্য আপনার পরামর্শ…

আলম খোরশেদ: পরামর্শ বলতে এটুকুই যে অনুবাদের কাজটা যেহেতু ভাষা নিয়ে, সেহেতু উৎস ভাষা ও লক্ষ্য ভাষা দুটোকে ভালোভাবে রপ্ত করা; তার ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, শব্দভান্ডার, যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে নিজেকে নিরন্তর সচেতন ও সমৃদ্ধ করে তোলা। বিশেষ করে প্রয়োজন, ‘লক্ষ্য’ ভাষাটির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্দ্বন্দ্ব দখল প্রতিষ্ঠা করা। আর এর জন্য চাই বিপুল পঠনপাঠন, নিয়মিত লেখালেখি ও অনুবাদের অনুশীলন। পাশাপাশি নানা দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে কৌত‚হল ও জ্ঞানার্জন। মনে রাখতে হবে, অনুবাদ একটি অত্যন্ত কঠিন, দুরূহ ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই আগ্রহীদের এই কাজে নামা উচিত।

এবং বই: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই…। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আমেরিকা গেলেন, চাকরিও করলেন কিছু সময়। এই উন্নত ও আধুনিক ব্যবস্থা ছেড়ে দেশে ফিরে আসলেন, কিন্তু কেন?

আলম খোরশেদ: সত্যি বলতে কী, বিদেশে গিয়েছিলাম একদিন আরও প্রবলভাবে স্বদেশে ফিরে আসব বলেই, সেখানে চিরস্থায়ী আসন গাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না আমার কখনোই। তাই প্রবাস থেকে যা যা নেবার : উচ্চশিক্ষা, উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা, বিশ্বসাহিত্য ও জ্ঞানকান্ডের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়, পাঠাভ্যাস তৈরি ও পুস্তকসম্ভার সংগ্রহ, বিদেশি ভাষাশিক্ষা, প্রাণভরে বিশ্বসংস্কৃতি আস্বাদন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক, শিল্পী, চিন্তক ও বন্ধুর সান্নিধ্যলাভ, সর্বোপরি দুর্লভ, অমূল্য জীবনাভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সঞ্চয় ইত্যাদি নিয়ে একদিন ঠিকই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছি।

এবং বই: আপনার প্রথম অনুবাদ বই?

আলম খোরশেদ: আমার লেখকজীবনের প্রথম বইটিই একটি অনুবাদগ্রন্থ, যদিও সেটি ছিল আমার সম্পাদিত গ্রন্থ। ‘জাদুবাস্তবতার গাথা : লাতিন আমেরিকার গল্প’ শিরোনামের এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, অধুনালুপ্ত ‘জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী’ থেকে।

আলম খোরশেদ এর বই সমূহ
আলম খোরশেদ এর বই সমূহ

এবং বই: কীভাবে তৈরি হলো? পেছনের গল্পটা কী?

আলম খোরশেদ: আমি তখন উচ্চশিক্ষার্থে নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলাম। ঘটনাচক্রে আমি আর আজকের প্রখ্যাত লেখক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান তখন একই ঘরের বাসিন্দা ছিলাম। আমার তখন সাধ হয়েছিল একটি অনুবাদ পত্রিকা প্রকাশের। কিন্তু তিনি আমাকে সেকাজে নিরস্ত করেন বরং একটি অনুবাদ সংকলন সম্পাদনা করার পরামর্শ দেন। আমরা তখন লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে, বিশেষ করে তার বিখ্যাত জাদুবাস্তবতায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। তাই সংকলনের বিষয় হিসেবে লাতিন আমেরিকার ছোটগল্পকেই বেছে নিয়েছিলাম। এতে আধুনিক লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যের কুড়িজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখকের গল্প ছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন আস্তুরিয়াস, বোর্হেস, কার্পেন্তিয়ের, কোর্তাসার, দোনোসো, মার্কেস, ফুয়েন্তেস থেকে শুরু করে বার্গাস য়োসা, লুইসা বালেনসুয়েলা, সের্হিও রামিরেসের মতো তরুণতর প্রজন্মের লেখকেরাও। গল্পগুলো যাঁরা অনুবাদ করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই তখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী, এবং তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিও ছিলেন। সলিমুল্লাহ খান এই গ্রন্থের জন্য আলেহো কার্পেন্তিয়েরের একটি বড় গল্পের দুর্দান্ত অনুবাদ করেছিলেন। আমি করেছিলাম য়োসার একটি গল্পের অনুবাদ। আমার ধারণা, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত এই বইটি আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের জন্য একটি পথ নির্দেশকের ভূমিকা রেখেছে। তো, এই হলো তার পেছনের গল্প।

এবং বই: প্রকৌশলী আলম খোরশেদের চাইতে অনুবাদক, লেখক আলম খোরশেদ সারা দেশে পরিচিত। এই পরিবর্তন কি সচেতনভাবেই?

আলম খোরশেদ: হ্যাঁ। আসলে প্রকৌশলবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য কিংবা অর্থনীতি নিয়ে পড়তে। কিন্তু আমি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তান হওয়ার কারণে এবং ঘটনাচক্রে ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াতে, সমাজ ও পরিবারের প্রবল চাপে ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে আমার কোনো উপায় ছিল না। তবে তখন থেকেই আমার সিদ্ধান্ত ছিল সারা জীবন আমি এই যন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা থাকব না। সে কারণেই প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসার পর আমি স্বেচ্ছায় প্রকৌশলী পরিচয়টিকে বিসর্জন দিয়ে, আমার প্রথম প্রেম শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কাছে ফিরে গেছি এবং অদ্যাবধি তার প্রেমেই যে মজে আছি, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।

এবং বই: তাহলে এখন অনুবাদ ও লেখালেখিই আপনার পেশা?

আলম খোরশেদ: পেশা বলা যাবে না, সেটা হলে তো কোনো কথাই ছিল না। তবে তা আমার এই মুহূর্তের প্রধান কর্মকান্ড নিঃসন্দেহে।

আশা করি, বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে লেখকদের জন্য এমন একটি অনুকূল ও সম্মানজনক পরিবেশ গড়ে উঠবে যখন তাঁরা লেখালেখি, অনুবাদকর্ম ইত্যাদিকেও নিশ্চিন্তে ও নির্দ্বিধায় পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন।

এবং বই: সমাজ পরিবর্তনে আপনার কমিটমেন্ট আছে। ‘বিস্তার : চিটাগাং আর্টস কমপ্লেক্স’ নামে একটি সংস্কৃতিকেন্দ্র পরিচালনা করছেন…

আলম খোরশেদ: তা আছে বৈকি। বিস্তার-এর আগেও বিশদ বাঙলা নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান চালিয়েছি আমি নয় বছর ধরে। সেটির উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত বিশ্বায়নের কুপ্রভাবে বাংলাদেশের সমাজ ও মানস থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকা বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, গৃহসজ্জা- এক কথায় বাংলার সবটুকুকে আরও বিশদে ও বিশুদ্ধতার সঙ্গে সবার সামনে তুলে ধরা এবং তার প্রচার, প্রসার ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরি করা। পরে, বিস্তার-এর কাজের মাধ্যমে আমরা মূলত আমাদের সমকালীন শিল্পের-চর্চার পাশাপাশি বিশ্বশিল্প ও শিল্পীদের সঙ্গে একটি সেতুবন্ধন গড়ার কাজে ব্যাপৃত থেকেছি। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, একটি দেশ কখনোই সত্যিকারভাবে সভ্য ও উন্নত বলে দাবি করতে পারে না তার শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও চেতনার যথাযথ উন্নয়ন না ঘটিয়ে। আমাদের দেশের বাহ্যিক অবকাঠামো তথা ভৌত উপরকাঠামো ও আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও, উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে প্রত্যাশিত উন্নতির পরিবর্তে বরং একধরনের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা তাই এই জায়গাটিতে আমাদের সাধ্যমতো একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে তৎপর হয়েছি।

এবং বই: আমরা দেখছি, বিস্তার-এর নিয়মিত অন্তর্জাল সাহিত্যালাপের আসর, ‘পান্ডুলিপি করে আয়োজন’ নামের একটি অনুষ্ঠান নিয়মিত পরিচালনা করছেন….

আলম খোরশেদ: হ্যাঁ, করোনার কারণে একপর্যায়ে সংগতকারণেই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান বিস্তার-এর ভাড়া করা কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার পর আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডকে অন্তর্জালে নিয়ে যেতে বাধ্য হই। এবং গেল দুবছরে আমরা শুধু সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানই নয়, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, সংগীত, স্থাপত্যকলা, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভাষা, ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রায় দুইশত অনুষ্ঠান করেছি।

এবং বই: আপনি নিয়মিত পত্রিকায় লিখছেন। সে তুলনায় লেখক সম্মানী পাচ্ছেন কি?

আলম খোরশেদ: পত্রিকাগুলো থেকে যাও বা কিছু না কিছু সম্মানী পাই, আমার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থাসমূহ থেকে, দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, কোনো রয়ালটিরই দেখা মেলে না কখনও। এটি লেখক হিসেবে একটি বড় মর্মপীড়ার কারণ আমার।

আরও পড়ুন – জীবনে কখনো প্রকাশক হবো, এই চিন্তা ছিল না- মজিবর রহমান খোকা

এবং বই: কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার যৌথ বই Arise out of the Lock : 50 Bangladeshi Women poets in English এর ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই নয় কি?

আলম খোরশেদ: হ্যাঁ। আমাদের এই গ্রন্থটির প্রকাশক সিঙ্গাপুরের দুজন সাহিত্যকর্মী ও শিক্ষক, যাঁরা লন্ডনভিত্তিক একটি প্রকাশনী গড়ে তুলেছেন Balestier Press নামে, যা মূলত দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য ও তার অনুবাদ প্রকাশ করে থাকে। তো, প্রাথমিক কথাবার্তার পর একপর্যায়ে তাঁরা বইটি প্রকাশে সম্মত হন এবং আমাদেরকে একটি খসড়া চুক্তিপত্র পাঠিয়ে দেন। তাতে অনুবাদক ও সম্পাদককে ২০% সম্মানী দেওয়ার কথা ছাড়াও আরও কিছু শর্তাবলির উল্লেখ ছিল। আমরা এর বাইরে আরও কিছু দাবিনামা পেশ করি, যেমন গ্রন্থভুক্ত সকল কবি, ভূমিকা লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী এমনকি গ্রন্থের দুজন ব্লার্ব লেখককেও সৌজন্যসংখ্যা প্রদান করা। তাঁরা আমাদের সকল দাবি সানন্দে মেনে নেন এবং সেইসঙ্গে এও যোগ করে দেন যে প্রতিবছর তিনবার আমরা তাঁদের কাছে বই বিক্রি বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারব এবং ফিবছর একবার তাঁরা নিজেরা যে গ্রন্থ বিক্রির হিসেব দেবেন আমাদের, সে বিষয়ে কোনো সংশয় থাকলে আমরা তাঁদের নিয়োগকৃত হিসাবরক্ষকের খাতা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে পারব। সেখানে পাঁচ শতাংশের বেশি গরমিল পাওয়া গেলে সেই টাকাটাও তাঁরা আমাদের পরিশোধ করে দেবেন। এ-ই হলো তাঁদের পেশাদারিত্বের দৃষ্টান্ত, যা এ দেশে অকল্পনীয় এবং নিতান্ত স্বপ্ন বলেই মনে হবে সকলের কাছে।

Image
প্রাবন্ধিক আলম খোরশেদ ও এবং বই সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ

এবং বই: আমরা ‘এবং বই’ শুরু থেকেই লেখকদের প্রাপ্য সম্মানীর বিষয়ে সচেতনভাবে কথা বলছি। লেখকদের সাথে একান্ত আলাপে প্রসঙ্গ টেনে আনছি। আমরা চাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক, লেখক তাঁর প্রাপ্য সম্মানী বা পারিশ্রমিক আদায়ে সোচ্চার হবেন। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন?

আলম খোরশেদ: হ্যাঁ, আমি সেটা লক্ষ করেছি। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই সোচ্চার হতে হবে।

কেননা লেখক-শিল্পীরা তাঁদের কাজের জন্য উপযুক্ত সম্মানী ও স্বীকৃতি না পেলে কখনোই এটাকে তাঁদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন না, আর সেটা না পারা গেলে, আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রত্যাশিত উন্নয়নও ঘটবে না।

এককথায়, পেশাদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই এবং এর জন্য আমাদের লেখক, প্রকাশক, পুস্তকবিক্রেতা, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যেককেই যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে বৈকি।

এবং বই: লেখকের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল থাকে। আপনার বিষয়েও ব্যতিক্রম নয়। আপনার পরিবার…

আলম খোরশেদ: আগেই বলেছি আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের সন্তান। আমার বাবা-মা গত হয়েছেন বেশ কবছর হলো। আমরা আট ভাইবোন দেশে বিদেশে নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। আমি ২০০৪ সালে দীর্ঘ প্রবাসজীবনের ইতি টেনে, স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসার পর থেকে আমার জীবনসঙ্গিনী মাহীয়া আবরার ও একটি আদুরে বিড়ালকে নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করছি।

এবং বই: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আলম খোরশেদ: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ। ‘এবং বই’-এর মতো একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, প্রভাববিস্তারী পত্রিকা সুসম্পাদিত ও সুমুদ্রিতভাবে নিয়মিত প্রকাশ করে, দেশে একটি পাঠ ও পুস্তকবান্ধব সমাজ নির্মাণে এবং আমাদের প্রকাশনাশিল্পের উন্নয়নে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন সন্দেহ নেই। সে জন্য আপনাদের আরও একবার জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।

আরও পড়ুন – “প্রেমের গল্পগুলোতে রয়েছে বর্তমান সময়ের ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের প্রতিফলন”