সৈয়দ নূরুল আলম
অনেকে বলেন, ‘ছোটগল্পের প্রাণ হবে খুবই ছোট’। এই ছোট প্রাণের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। শুধু আয়ুষ্কাল দিয়ে বিচার করলে হবে না। এখানে চরিত্রের গভীরতা এবং পরিবেশনের মুনশিয়ানা অনস্বীকার্য। জীবনের নানা ঘটনা, বিচিত্রময় সব স্মৃতি কারো কারো মনকে বর্ণময় করে তোলে। এর মধ্যে কিছু ঘটনা জ্বলজ্বল করতে থাকে আবার কিছু ঘটনা আবছা আবছা, সহজে ধরা দিতে চায় না। এই টুকরো টুকরো ঘটনার থেকেই জন্ম নেয় গল্পের। আহমদ বশীর গল্প লিখছেন দীর্ঘদিন। জানুয়ারি, দুই হাজার তেইশে ‘আহমদ বশীরের গল্প’ শিরোনামে তার একটি গল্পগ্রন্থ জাগতিক থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থে রয়েছে দশটি গল্প। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা ধরনের সমস্যা, জটিলতা, পাওয়া, না-পাওয়ার অভাববোধ এসবই ঘুরেফিরে উঠে এসেছে আহমদ বশীরের প্রতিটি গল্পে। গল্পক্রম : বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা, তার অনুপস্থিতি, নায়ক কাপুরুষ, শরীর, হ্রদয়, অবশিষ্ট কথা, পাপ গ্রহ, কৈতুরী ও মজিদ মিয়ার বিবরণ, শহীদ শহীদুলের মা, মধুবালা-গৌরাঙ্গ-সোহরাওয়ার্দী-খোকা এবং ঈশ্বরের লজ্জা।
‘নায়ক কাপুরুষ’ একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। সজল, আমিনাকে ভালোবাসে। আমিনা রাতের অন্ধকারে বাবার চোখ ফাঁকি নিয়ে সজলের ডাকে ঘর থেকে বের হয়ে আসে, আগামী দিনে জীবনের গতিপথ ঠিক করতে চায়। এদিকে সজল, রিকশার পেছনে রংতুলি নিয়ে রাজ্জাক-শাবানার ছবি আঁকে, সেকি তাদের জীবনের ছবি আঁকতে পারবে। এরই মধ্যে বস্তির আরেক মাস্তান বিল্লু, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সজলের ঘাড়ে ভর দিয়ে যেতে যেতে বলে, সে আমিনাকে চায় এবং শুধু চায় না, এ ব্যাপারে সজলের সাহায্য চায়। এখন সজল কী করবে? এমন এক মনস্তাত্ত্বিক রক্তক্ষরণের গল্প এটা। তবে খোলা চোখে নিম্নবৃত্তের হতাসা-পাওয়া, না-পাওয়ার গল্প মনে হলেও, এখানে গল্পকারের দেখার চোখ, উপস্থাপনা ও চরিত্রচিত্রণ এসবই মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। একটি ধারালো গল্পে যেসব মসলা থাকার প্রয়োজন, তা সবই আছে।
আমরা একটু দেখে নিই- ‘বিল্লুকে কাঁধে নিয়ে আমি চিপাগলির ভেতর ঢুকলাম। বিল্লুর বিশাল শরীরটা টানতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, বিল্লুকে এভাবে ফেলে গেলে অন্যদিন বিল্লু নিশ্চয়ই আমাকে ঠ্যাঙ্গাবে। ভয়ে ভয়ে বিল্লুর আড়াইমণি শরীরটা টানতে থাকি। বিল্লুর মাতলামি অনেকটা কমে এসেছে। আমার কাঁধে হাত রেখেই সে একটা সিগারেট জ্বালায়, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘সজইল্যা, তরে একটা কথা কই, আমিনার লগে তুই নাকি দিল্লাগি শুরু করছস? ব্যাপারটা আমারে খুইলা ক দেহি’।’ এভাবেই আহমদ বশীর তার খড়খড়ে গদ্যে গল্পের শরীর তৈরি করেছেন। এ গদ্যে মেদ নেই, নেই কোনো শব্দের বাহুল্যতা।
জমিরন, কৈতুরী, মজিদ মিয়া, কালাচান্দের মা, জোবেদালী ফকির, এ ধরনের কয়েকটি নিম্নবৃত্তের চরিত্র নিয়ে গল্প- কৈতুরী ও মজিদ মিয়ার বিবরণ। এরা এব্রাহীম মিয়ার বস্তিতে থাকে। কেউ ম্যাচে কাজ করে, কেউ আবার অন্যের বাড়িতে, কৈতুরীর স্বামী মজিদ মিয়া মদ খায়, কোনো দিন বস্তিতে ফিরে, কোনো দিন ফেরে না, যেদিন ফেরে না, সেদিন কৈতুরী রিকশার চেইনের মার খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। এদিকে জোবেদালী নামের এক ভন্ড ফকির কৈতুরী ও মজিদ মিয়ার মধ্যে মহব্বত বাড়াতে এসে নানা ধরনের কবজ দেয়, পরে এক দিন কৈতুরী নিজেই ফকিরের হাত ধরে চলে যায় বস্তি ছেড়ে। এ সব বস্তি জীবনের নিত্যদিনের ঘটনা, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের ছবি, লেখক নিপুণভাবে তুলে এনেছেন এ গল্পে। চরিত্রের মুখে অকাঠ্য কথ্যভাষা পুড়ে দেওয়ায় গল্পটা বেশ শক্তিশালী হয়েছে।
শুধু এ গল্পে না, আলোচিত গ্রন্থে অনেকগুলো গল্পের পটভ‚ মিই গ্রাম এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আর এসব মানুষের জীবনচিত্র দক্ষতার সঙ্গে তিনি তুলে এনেছেন গল্পতে। কথ্যভাষা ব্যবহারে একটা অসুবিধা, একই গল্পে একাধিক অঞ্চলের ভাষা ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এদিক দিয়ে গল্পকার বিশ্বস্ত থেকেছেন বলে মনে হয়।
মোট কথা বলা যায়, আহমদ বশীর নগরকেন্দ্রিক গল্প লিখে খুশি হন না। তাই তার লেখার মধ্যে ঘুরেফিরে আসে ঘাসপাতা, ফড়িং, কাদাখোঁচা পাখি, পাখির ডানা ঝাপটানি, ডাংগুলি খেলা, বিস্তীর্ণ মাঠের হলুদ রং। এ রকম ভিন্ন ভিন্ন সব চিত্র, যা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক আবিলতায় ভরে ওঠে মন। গভীর এক অনুভূতি মনকে ছুঁয়ে যায়। এসব জিনিস আমরা হয়তো দেখি কিন্তু সেভাবে নজর দিই না। এসব দক্ষ লেখকের পরিবেশনার গুণে অন্য এক রূপ পায়। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আহমদ বশীর একজন দক্ষ কথাকার। ধন্যবাদ লেখককে।
আহমদ বশীরের গল্প
আহমদ বশীর
প্রকাশক : জাগতিক
দাম : ২৫০ টাকা
আরও পড়ুন….