ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার নীলক্ষেত। পুরনো বইয়ের দোকান হায়দারের। কী নেই সে দোকানে? শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ , দস্তয়েভস্কি থেকে হুমায়ূন আহমেদ। মির্জা গালিব থেকে পদাবলী কীর্তন, শঙ্খ ঘোষ থেকে শামসুর রাহমান। খুঁজলে পাওয়া যায় সবই। হাতের নাগালে না থাকলে বড়োজোর দু-একদিন। সাগর সেঁচে মুক্তো খুঁজে আনতে পারে হায়দার। লেখকের নাম বললে ডজন ডজন বই হাজির করতে পারে নিমেষে। তাই তার বন্ধু তালিকায় অধ্যাপক থেকে রিসার্চ স্কলার, কলেজ ছাত্রী থেকে গৃহবধূ- সবাই আছেন।
শোনা যাচ্ছে হায়দার নাকি এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তার আবাল্য। বইয়ের কুষ্ঠি ঠিকুজিও গাঁথা থাকে মগজে। তবে একটা ছড়া লেখার কথাও সে কল্পনা করেনি কোনোদিন। সেই হায়দার মেঘনাদ বধ কাব্যের পুনর্নির্মাণ করে লিখে ফেলেছে ‘এ কালের মেঘনাদ বধ কাব্য’। বিষয়টা বেশ হইচই ফেলেছে দু’বাংলায়। মেধাজীবিরা বিষ্মিত। নামিদামি লিখিয়েদের চোখ উঠেছে কপালে। বিদগ্ধজনেরা হতবাক। যদিও খবরের কাগজের কলমচিদের বিষ্ময়ের পরিমাণ কিঞ্চিত কম। খবরটা শুনে কিন্তু কপালে ভাঁজ নেই তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মীদের। মিনহাজুর রহমান সৈকত কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক। বললেন, “এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। আর কিছু দিন অপেক্ষা করুন, ডজন ডজন সং অফারিংস, গন্ডা গন্ডা মিশির আলি, কয়েকশো ম্যাকবেথ, হ্যামলেট কিম্বা ইলিয়ড ওডিসির মতো সৃষ্টি হওয়া তো কেবল বোতাম টেপার খেলা!”
মেট্রোরেল প্রকল্পে মাটি কাটার ঠিকাদার নরহরি সাঁতরা। শাঁসেজলে বেশ টইটম্বুর ব্যাবসা। রেল প্রতিমন্ত্রীর মেয়ের বিয়েতে পাত পেড়ে খাওয়ার আমন্ত্রণ পায় নরহরি। মন্ত্রকের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির ছেলের বিলেতযাত্রার তদারকির দায়িত্বও তার কাঁধে। দু-দশটা বস্তি রাতারাতি ভ্যানিশ করে টানেলের কাজ শুরু করা তো হাতের ময়লা। তবে গঙ্গার নিচ দিয়ে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় টানেল তৈরির প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব নরহরি পেতে পারে, এ কথা তো কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই খবরটা শুনে চোখ কপালে উঠেছে অনেকেরই। কেউ করেছে বিদ্রূপ, কেউ হয়েছে হতবাক। রক্ষণশীল জ্যাঠামশাইরা বলছেন, আরে ছ্যা ছ্যা! কী দিন এল! মেধার কোনো মূল্যে নেই? সৌরাংশু মিত্র, কম্পিউটার সায়েন্সে এম টেক। কাজের ক্ষেত্র আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুনে বললে, “অবাক হওয়ার কী আছে? মেধা এখন যন্ত্রে বন্দি। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে সে। মানুষের মগজের থেকে লক্ষগুণ শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ওটা দিয়েই বাজিমাত করা সম্ভব।”
না, হায়দারভাই এখনো মেঘনাদ বধ কাব্যের বিনির্মাণ করে উঠতে পারেনি। নরহরি সাঁতরাও মেট্রোরেলের প্রজেক্ট ম্যানেজাররের দায়িত্ব পায়নি। দুটো ঘটনাই কাল্পনিক। কিন্তু অসম্ভব নয়। জিওফ্রে হিন্টন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার। ১৯৭৮ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই)-র ওপরে করেন পিএইচডি। জীবনের একটা বিরাট সময় কেটেছে শুধু এই গবেষণাতেই। ২০১৮ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজে তাঁর অবদানের জন্য পেয়েছেন টুরিং অ্যাওয়ার্ড (কম্পিউটার বিজ্ঞানের নোবেল সমতুল্য)। তাঁর সৃষ্ট দৈত্য আজ গিলে খেতে চাইছে সভ্যতাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তাঁর সচেতনতা দক্ষতার থেকে কম নয়। তাঁর মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত বৃদ্ধি পাবে, যন্ত্র যত জ্ঞান অর্জন করবে, ততই হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর! হিন্টন ভুগছেন বিবেকের দংশনে। গুগুলের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে বিশ্বকে সচেতন করতে তাই নেমে এসেছেন পথে।
তরুণ সুইস বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ইঙ্গোলস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবদেহের শারীরতত্ত্ব নিয়ে ছিলেন অধ্যয়নরত। প্রাণের উৎস নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী এই বিজ্ঞানীর স্বপ্ন ছিল এমন কিছু আবিষ্কার করার, যার দৌলতে তামাম দুনিয়া তাকে স্মরণ করবে চিরদিন। মানবদেহ এবং তার বিভিন্ন কোষ নিয়ে গবেষণায় ডুব দিলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। কীভাবে কোষ ধ্বংস হয়, কীভাবেই বা হয় পুনর্জন্ম- এসব বিষয়েই দিন কাটত তাঁর। হঠাৎ একদিন প্রাণের রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হলেন বিজ্ঞানী। সেদিন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিজেকে ভাবতে লাগলেন দুনিয়ার সুখীতম মানুষ।
এবার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এমন কিছু করার স্বপ্ন দেখলেন , যা এর আগে কেউ সাহস পায়নি। বেশ কিছু প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়ে সৃষ্টি করলেন এক অতিকায় প্রাণী। গবেষণাগারের মধ্যে বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে করলেন তার প্রাণসঞ্চার। প্রাণের স্পর্শে জেগে উঠলো অতিকায় দানব! নিজের সৃষ্টির সামনে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
অতিকায় দানবের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিজেই হলেন ভীত। নবজাতক দানবকে ভীত স্রষ্টা করলেন পরিত্যাগ। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক বিতাড়িত এই দানবের উন্মুক্ত শহরে শুরু হল নিঃসঙ্গ জীবন। এরপরই শুরু হয় দানবকে ঘিরে এক রোমাঞ্চকর আখ্যান। অসীম শক্তিশালী দানবের প্রতি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শুরু করলেন দুর্ব্যবহার। স্রষ্টার এ হেন আচরণে ব্যথিত দানবের মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিশোধ স্পৃহা। দানব শহর ছেড়ে আশ্রয় নেয় বনে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সহকারী ড. নীল ও এক আয়াকে হত্যা করে শুরু করে তার জিঘাংসার সফর। তার পরের লক্ষ্য হয় সৃষ্টিকর্তার ভাই। এভাবেই শহরের শয়ে শয়ে মানুষকে বধ করে আর আশ্রয় নেয় বনে। সৃষ্টিকর্তা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিয়ের রাতেও হানা দেয় দানব। নববধূসহ হত্যা করে তার পরিবারের বাকী সমস্ত সদস্যকে। এমন কী এক পর্যায়ে এসে সৃষ্টিকর্তাকেও বধ করে দানব। তবে শেষে অবশ্য পুলিশের গুলিতে তারও মৃত্যু হয় নামহীন সেই দানবের!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রচয়িতা ইংরেজ ঔপন্যাসিক মেরি শেলী দেখিয়েছিলেন কীভাবে সৃষ্টি চলে যায় স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণের বাইরে । ১৮১৮ সালে রচিত এই কাহিনিতে স্রষ্টার অসহায়তার ছবিই এঁকেছিলেন লেখিকা। বিশ্বের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের এই আখ্যান বিগত দুশো বছরে হয়ে গেছে মিথ। আজ একুশ শতকের দু’টো দশক পার করে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির আর এক জীবন্ত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন – জিওফ্রে হিন্টন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক আজ বিবেকের দংশনে জর্জরিত। কয়েক দিন আগে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এআই নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের থেকেও বিপজ্জনক হতে পারে এ আই।’’
এআই নিয়ে উদ্বেগের কথা উঠে এসেছিল ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বা ডব্লিউইএফের রিপোর্টে। সেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, কৃত্রিম মেধার ব্যবহারের কারণে আগামী ৫ বছরে বিশ্ব জুড়ে কাজ হারাতে পারেন প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে ভয়ঙ্কর দিকটি আগেই তুলে ধরেছিলেন হিন্টন। ‘গডফাদারের’ মুখেই এমন আশঙ্কার কথা বার বার যে ভাবে প্রকাশ্যে আসছে, তা নিয়ে আতঙ্কের কারণ আছে বইকি। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত মেধাভিত্তিক দক্ষতার আর কোনো মূল্যই হয়তো থাকবে না। পয়সা থাকলে একটা রোবোট বানিয়ে নিলেই চলবে। তাকে ডাক্তারির পাঠ দিলে একশো ডাক্তারের কাজ এক রোবোটেই সম্ভব। আবার তিনশো প্রযুক্তিবিদের কাজ এক রোবটকে দিয়েই হয়তো করানো যাবে।
কেবলমাত্র কর্মসংস্থান নয়, সামাজিক মাধ্যমেও বিরাট প্রভাব ফেলবে এআই। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো ছবি কিম্বা টেক্সট নিখুঁত ভাবে যায় বানানো। যার অপব্যবহারে পরিকল্পিত হিংসা ছড়ানো হয়ে যাবে জলভাত। দাঙ্গার আগুনে যারা গোপন অভিপ্রায় সেঁকে নিতে চায় , তাদের হবে পোয়া বারো। মিথ্যার জালে জড়িয়ে নিরপরাধকে দোষী সাজানো যাবে তুড়ি মেরে। আবার খুনের অপরাধীকেও হয়তো নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে খুব সহজেই। ঠিক এই আশঙ্কাতেই বিবেক দংশনে জর্জরিত এ প্রযুক্তির জনক জিওফ্রে হিন্টন। চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) সহ বেশ কিছু ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই সাধারণের নাগালে এসে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আরো শতগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন এআই সিস্টেম হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে সাধারণের।
১৯৯৬ সালে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল ডলি (Dolly) নামের এক ভেড়া। সে ছিল প্রথম কোনো স্তন্যপায়ীর ক্লোন। সেই স্রোতে ভেসেই আলোচনায় উঠে আসে মানব ক্লোনিংয়ের সম্ভবনা। তেমনটা হলে আজ কয়েকশো শেক্সপিয়ার আর আইনস্টাইন, কয়েক ডজন রবীন্দ্রনাথ আর ম্যাক্সিম গোর্কি কিম্বা শয়ে শয়ে শামসুর রাহমান বা জগদীশ বোস ঘুরে বেড়াত অলিতে গলিতে।
নৈতিকতার প্রশ্নে মোটামুটি গোটা বিশ্ব সেদিন একযোগে রায় দিয়েছিল এর বিপক্ষে। ‘না’ -এর পক্ষে উচ্চারণ ছিল অনেক জোরালো। সে উচ্চারণে মিশে ছিল নৈতিকতার পরশ। নেপথ্যে যাই থাকুক না, মানব ক্লোনিংয়ের মতলবকে ঘিরে লক্ষণরেখা কিন্তু টানা গিয়েছিল সেদিন। সে গণ্ডী যে আজও কেউ অতিক্রম করেনি, এ বিষয়ে খুব একটা সংশয়ের কারণ নেই। কিন্তু আজ এতো শান্ত কেন পরিবেশ? সভ্যতার এমন অশনিসংকেতের বার্তা শুনেও উপমহাদেশের মেধাজীবিদের মধ্যে এতো নিরুত্তাপ কেন? তবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বনাশা বার্তা পড়তে আমরা অক্ষম?
শুভাশিস ঘোষ : কবি, লেখক ও সম্পাদক
আরও পড়ুন….