রাস্তার দু’পাশের ঘন-সবুজ বৃক্ষের অকাল মৃত্যুর সাথে লটকে আছে আমার বই-বিষয়ক স্মৃতি। কারো বাড়ির গাছ কেটে ফেললে খারাপ তেমন লাগার কথা নয় কিন্তু সামাজিক বনায়নের বৃক্ষরাজি এমন গায়েব হয়ে যায় দিন-দুপুরে, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়! এর সমান্তরালে গড়ে ওঠে আমার পাঠ-অভ্যাস, লায়েক হওয়ার সমূহ স্মৃতি।
মনে পড়ে, হাই স্কুলের নবম মানের ছাত্র আমরা। ফরেস্টের কতিপয় অফিসারের আনাগোনা তখন গ্রামে। চেয়ারম্যানের কাচারিঘরে থাকেন তারা, বিকেলবেলা রাস্তা ধরে হাঁটেন, রেকি করেন। হাতা নিয়ে বাজারে যাবার কালে ফরেস্টের এক অফিসারের সাথে ভাব জমে ওঠে আমার। তিনি তথ্য নেন, রাস্তার ওপাশের জমি কার, ওদিকে কাদের। রাস্তার দু’পাশে গাছের চারা রোপন করলে কী কী সুবিধা ইত্যাদি। ভালোই লাগে, আগুনরঙা বিকেলে লম্বা-উচা লোকদের সাথে হাঁটতে।
এক সময় বৃক্ষেরা চারার নাম উজিয়ে গাছে রূপান্তর হবার কালে ফরেস্টের অফিসার আমার হাতে গছিয়ে দেয় একখানা বই। মলাট ছেঁড়া, হয়তো এজন্যই সাদা কাগজে মোড়ানো। পৃষ্টা উল্টালে তাতে লেখা, সোনালী দুঃখ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একে তো মেট্রিকের ক্লাস, তার উপর মাস্টারের খবরদারি, স্কুলের যাবতীয় পড়া শেষে খুলে বসি সাদায় মোড়ানো বইখানা। যতই পড়ি, যেন একটা প্রবাহ, খাল হয়ে নদী, নদী হয়ে সাগর, সাগর হয়ে মহাসাগর। বিশাল একটা ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে, উঠতে দিচ্ছে না কূলে। ত্রিস্তান! সাহসের এমন এক সমাচার ওই কৈশোরেই তো মানায়। পাগলের মতো পড়তে থাকি পৃষ্টার পর পৃষ্টা…
এক সময় বৃক্ষেরা চারার নাম উজিয়ে গাছে রূপান্তর হবার কালে ফরেস্টের অফিসার আমার হাতে গছিয়ে দেয় একখানা বই। মলাট ছেঁড়া, হয়তো এজন্যই সাদা কাগজে মোড়ানো।
তারও আগে, সপ্তম শ্রেণির বই কিনতে উপজেলা গিয়েছিলাম বন্ধু ওবাইদুলের সাথে। বাজেটেরও কম দামে পাঠ্যবই পেয়ে গেলে আমি কিনে নেই, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কেন কিনেছি, জানি না। কবিতা বুঝি আর না-বুঝি, জীবনবাবুর অনুকরণে ওই সময়ে আমিও লিখে ওঠি কবিতার মতোন কিছু, লাইনের শেষ শব্দের মিল দিয়ে! ততদিনে আরেকটা গোপন সুড়ঙ্গের সন্ধান করে দেয় পাশের বাড়ির মোজাম্মেল, সম্পর্কে তিনি কাকা। আমাদের বাড়ি অপেক্ষাকৃত বড়ো আর নিরাপদ ছিল বলে, তার একটা বই জমা দেয় আমাকে। এবং সময় করে তিনি সেটা পড়তেও আসেন আমাদের ঘরে! আরে, বই আবার লুকিয়ে পড়তে হবে কেন? কাকা পড়ে পাতা ভেঙে দিয়ে বইটা যথাস্থানে রেখে চলে যান। ধীরপায়ে ওই গোপন জিনিসে হাত পড়ে আমারও! কাসেম বিন আবু বকর নামের লেখকের বইটা পড়েছিলাম, মনে নেই তার কিছুই।
ফরেস্টের অফিসার গাছ কিছুটা বড়ো করে দায়িত্ব নিয়ে চলে যায় অন্যত্র। আমিও মেট্রিক পাশ দিয়ে পা দেই শহরের বুকে। ওই দমবন্ধ সময়ে, মা-বাবা ছেড়ে বাইরে থাকার কালে আমাকে তুমুল সঙ্গ দেয় একেকটা বই। টিউশনের টাকায় বই কিনি আর পড়ি। কষ্টের টাকায় বই কেনার মতো চোখ-খোলার ব্যাপারটা আমাকে করে দেয় কিছু বেকার সময়। অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, প্রফেসর গোলাম মোস্তফা ও ড. মাহবুবুল হক এর বাসায় গেলে সারি সারি বই আমাকে বলে, বৎস্য কুড়াতে থাকো স্বর্ণকমল, কিনতে থাকো, পড়তে থাকো। না, অত সাধু ছিলাম না রে, কিছু বই আমিও চুরি করেছি; আমার থেকে চুরি গেছে তারচে অনেক বেশি!
গ্রামে গেলে রাস্তা ধরে হাঁটি। অবাক হয়ে দেখি, আমাদের রোপন করা গাছগুলো বেশির ভাগই হাওয়া। উপকারভোগী তালিকায় সবচে কনিষ্ট সদস্য হবার গৌরব কোথাই হারিয়ে যায় নিমিষে। মন খারাপ হয়, বিষন্ন লাগে। ঘরে গিয়ে সেল্ফে থাকা বই উল্টাই। আশ্চর্য, কত কত প্রিয় বই নেই! ব্যাচেলর বাসায় কত দিন না-থেকেও ভাড়া গুণতে হয়েছিল এই বইয়ের জন্য? সামাজিক বনায়নের গাছ কাটে, লাকড়ি বানায়, ফার্নিচার বানায়, বিক্রি করে; বইও কি সবুজ? হয়তোবা। তাইতো বইও চুরি হয়, হাওয়া হয়ে যায়… ।
আরও পড়ুন কথাশিল্পী রোকসানা কাজলের গদ্য