সাহিত্যের, কথাসাহিত্যের কোনো ধরাবাঁধা ছক হয় কি? কিম্বা নির্দিষ্ট “বাদ” বা ইজমের অনিবার্য অনুসরণ কখনও সাহিত্য হয়ে ওঠার আবশ্যিক শর্ত হতে পারে? এইসব, ইত্যাদি নানা মতামত, মতবাদ নিয়ে সাহিত্যের পণ্ডিতরা ব্যস্ত থাকেন। কড়া অধ্যাপকরা নজর রাখেন, কোন লেখাটা সাহিত্য হিসেবে জন্ম নিতে গিয়ে এক্লেমসিয়ায় ভুগে বা গলায় নাড়ি আটকে মারা গেলো।
তাতে অবশ্য সাধারন পাঠকদের কিছু যায় আসে না। তারা ছাপা গ্রন্থে বা ইদানিং ডিজিটাল স্ক্রিনেও খুঁজে নেন সেই লেখাটা যার মধ্যে কখনও নিজের জীবনের চেনা ছবিকে দেখতে পান। কখনও অন্য মানুষের কাহিনীতে অচেনা পরিণতি দেখে অবাক হয়ে যান। তাদের মনে আসে; এমনও হতে পারে? কখনও বয়ে চলা অসহ্য কষ্টের নিরসন দেখে স্বস্তি, শান্তি পান। আবার কখনওবা শুধুই লেখাটি পড়ার আনন্দে একটি লেখা পাঠক শেষ করে ফেলে।
যিনি এইযুগের শিক্ষিত লেখক তাঁর কাছে লেখালেখি করার এটা একটা বড় সমস্যা, তিনি কাদের জন্য লিখবেন ঐ মানদন্ড নির্ধারণকারী পণ্ডিতদের জন্য নাকি পয়সা দিয়ে যারা বাজার থেকে গ্রন্থটি কিনছেন সেই সাধারণ পাঠকদের জন্য, (অবশ্য তার সাথে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাদের মত অলক্ষ্যের বংশিধারীদের সেই জাদুসুর, “বিক্রি হইলে তবে লাভ, অতএব গ্রন্থে…ইহা, ইহা, ইহা থাকিতে হইবে” –তার টান বা আকর্ষণের বিষয়টি তো আছেই)। একটু সচেতনভাবে খুঁজলে মৌলিক কবিতা, গল্প , উপন্যাসে লেখকদের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের চিহ্ন খুঁজে পাওয়াই যায়।
তবে আরও একরকমের লেখক আছেন যারা সেই আদি ও অকৃত্রিম, একমাত্র চাওয়া ; “নিজের অনুভূতিকে পাঠকের মনে পৌছে দেওয়া”— এমনই একমাত্র শুদ্ধ তাগিদে লেখেন। সেইসব লেখা শেষ করলে শেফালির সুগন্ধ-সৌন্দর্যে মন ভরে যায়। যোগ্য গবেষক তার মধ্যে আবহমান জীবন-প্রকৃতির ছবিও খুঁজে পেয়ে যান। সম্প্রতি হাতে এলো, বাংলাদেশের লেখক ফয়সাল আহমেদের ‘চিরকুট’। একটানা পড়ে ফেলার পর। এইকথাগুলোই যেনো চোখের সামনে ভাসছিল।
সাতটি গল্পের শীর্ণকায় একটি সংকলন- চিরকুট। মাত্র ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠা। প্রকাশ-২০১৮। নামকরা কোন লেখক, পণ্ডিত বা আমলার ভূমিকা নেই। মিতা মেহেদীর বেশ আধুনিক অথচ সরল-সৌন্দর্যের প্রচ্ছদ। ঠিক যেন সন্ধ্যামালতির ফুল। লেখকের গল্প চেতনার সার্থক প্রকাশ। পাঠককে গল্পগুলোর দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান গল্পকার। কিন্তু পাঠক, কী পেলেন এই গল্পগুলোর জার্নির শেষে?
শুরু করা যাক প্রথম গল্প চিরকুট থেকে; একজন বোবা পাত্রের সততা, আর নিষ্ঠা! বাড়ির লোকেদের ধূর্ততাকে অস্বীকার করে সে বিয়ের আসরেই পাত্রীকে জানিয়ে দেয়, তার প্রতিবন্ধকতার কথা! আর জানিয়ে দেয় কোন পাত্রীকে? যে পাত্রী বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারের সুশ্রী একটি মেয়ে, যে কিডন্যাপ হওয়ার ভয়ে রাস্তায় বেরোনোর সাহস পায় না! চেনা ছকে এই সমস্যাটি হয়ত ফর্ম আর কন্টেন্টের যুগলবন্দীতে একটি ওন্যরকম ছোটগল্পের রূপ পেতো। কিন্তু জীবন? জীবন যে বড্ড বিচিত্র! সেখানে প্রান্তিকতার দুরকম রূপ এসে মিলে তৈরি হয় এক নতুন জীবনধারার সে ধারা, স্বচ্ছন্দ গতিতে বয়ে যাবে নাকি মিলিয়ে যাবে রুক্ষ সমাজভূমিতে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় কখনই লেখকের থাকে না। তিনি দেখছেন এবং আমাদের দেখাচ্ছেন সমাজের সেই প্রান্তিক জীবনকে এবং তার গতিপথকে। বয়ে যাওয়া জীবনের জন্য তার ক্ষোভ, হতাশা, ক্রোধ, দুঃখ পেলব তুলিতে বুলিয়ে দিয়েছেন গল্পে।
সাতটি গল্পেই প্রান্তিক জীবনের এমন বিচিত্র ছবি আর ঐ তুলির স্পর্শ আমাদের ছুঁয়ে যায়, কখনও বাকরুদ্ধ করে আবার কখনও বা হাসায়, কাঁদায়। “জবানা আর নেতার” গল্পে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রসঙ্গ আসে, আসে সেই মহান মানুষটির অপার্থিব জনপ্রিয়তা ইত্যাদির প্রসঙ্গ। কিন্তু গল্পের শেষে দরিদ্র জবানামামু; গ্রামের হয়ত একমাত্র সৎ ব্যক্তি, সালিশ-বিচারে যার কথাই হয়ত শেষ কথা সেই মানুষটির জীবিত বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতিতে বুকভাসানো চোখের জলের অনুভূতি বড় হয়ে ওঠে। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাত। কিন্তু একটি দরিদ্রতম নিপাট সৎ মানুষের মধ্যেও জাতির জন্য সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতি কতটা গভীর আবেগ আছে, তার প্রমাণ জবানার ঐ কান্না। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনই তার কাছে দেশ, জাতীয়তার প্রতীক! ইতিহাসে এই প্রান্তিক মানুষগুলোর আবেগের কথা লেখা থাকে না। ধরা পড়ে ফয়সালের মতো লেখকের গল্পে।
‘যেতে যেতে পথে’ গল্পে অনেকটা সিনেমার মতই আচমকা পিক-আপের ড্রাইভার মঞ্জিল খোঁজ পেয়ে যায় তার বাবার খুনির। মঞ্জিল সেই খুনির মৃতদেহের লাশ বয়ে নিয়ে আসে ট্রাকে। কিন্তু সিনেমা, মেলোড্রামার পরিণতির দিকে এগোলেন না লেখক। মঞ্জিল নিজের পিতার মৃত্যুর শোক বুকে বহন করেও ধনী পরিবারটির প্রত্যেকের নত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনাকে মেনে নেয়। পাঠককে লেখক অন্তর্লীন বাস্তবের সামনে নিয়ে আসেন, সত্যি সত্যি কি কোন প্রান্তিক ব্যক্তি মানুষের পক্ষে এই সমাজে ক্ষমতাবানদের অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব?
‘মাতাল রাতের গল্পে’ এখন রাজধানীর অধিবাসী আদতে মফস্বলের ছেলে রাসেল, সারা রাত নির্বান্ধব শহরে নিজের হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে বেড়ায়। পৃথিবীর সব আলোকোজ্জ্বল বড় শহরেই যুবতী মেয়ের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ও রাতের অচেনা অন্ধকারের ছবি প্রায় এক। সেই চেনা ক্যানভ্যাস থেকে উঠে আসা একটি প্রান্তিক চরিত্র, নামহীনা এক কলগার্ল আমাদের মন কেড়ে নেয়। লেখকের নিখুঁত জীবন দেখার মুন্সিয়ানা ঐ চরিত্রটিকে নির্মাণ করেছে। শেষ পর্যন্ত রাসেল দমবন্ধকরা নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বোনকে ফিরে পায়, কিন্তু বদনামের ভাগীদার হয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায় ঐ বারবধূটি। রাসেলকে একমাত্র সেই মেয়েটি সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল।
আরও রয়েছে দুটি গল্প, ‘ঠিক ভোরের আগে’ এবং ‘প্রত্যাবর্তন’। প্রথমটিতে হিপোক্রিট পরম ধার্মিক লোকের অসামাজিক চরিত্রের উন্মোচনের পাশাপাশি পরিচয়হীন শিশুর জন্ম সমাজে যে সমস্যা তৈরি করে, তার জলজ্যান্ত ছবি আঁকা। এই শিশুরাই তো প্রান্তিক সমাজের অঙ্কুর। আর পরেরটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস-রাজনীতির এক জীবন্ত দলিলে একটি সাধারণ শিক্ষক কীভাবে প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয় সেই কাহিনী। গাঁয়ের স্কুলের এক সাধারণ দরিদ্র শিক্ষকও আজ এই বাজার অর্থনীতির যুগে প্রান্তিক তো বটেই। সেই মানুষটা তাঁর প্রান্তিকতার মূল্য দেয়, রাজনীতির চোরাপাঁকে তলিয়ে গিয়ে, জীবন দিয়ে।
সাতটি গল্পে আমরা, পাঠকেরা এভাবেই ফয়সালের নির্মেদ গদ্যে রুদ্ধনিঃশ্বাসে জীবনের নানারঙের পথে ঘুরে আসি। আরও একবার হলেও বলতেই হয় যে আমাদেরই অজান্তে ফয়সাল আহমেদ তার বুকের ভেতরের শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাগীদার করে নেন আমাদের। পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক, ফয়সাল অবশ্যই গল্পকার ফয়সালকে এমন অজস্র গল্প লেখার সুযোগ আগামীদিনে করে দেবেন। এই আশা রইলো। দ্যু প্রকাশনকে ধন্যবাদ এমন একটি রুচিশীল গল্পগ্রন্থ প্রকাশের জন্য।
চিরকুট (গল্পগ্রন্থ) , ফয়সাল আহমেদ, প্রকাশক- দ্যু প্রকাশন, প্রকাশকাল- ২০১৮, প্রচ্ছদ- মিতা মেহেদী, মূল্য- ১২০ টাকা
নোট: লেখাটি সম্প্রতি দৈনিক কালবেলার প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। তবে পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনে না থাকায় পাঠকদের অনুরোধে এখানে পুন:প্রকাশ করা হলো।
আরও পড়ুন…
ফয়সাল আহমেদ এর নতুন বই- সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম : রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ