জীবনানন্দের মানচিত্র : জীবনানন্দবিষয়ক আকরগ্রন্থ

বাংলা কবিতার কিংবদন্তি কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯- ১৯৫৪)। কবি হিসেবে তিনি যুগপৎ পাঠকনন্দিত ও কালোত্তীর্ণ। কবিতার মতোই তার যাপিতজীবন ও জীবনপ্রবাহ নিয়ে পাঠকমনে রয়েছে সীমাহীন কৌতূহল। তার সৃষ্টিবৈভব নিয়ে এযাবৎ বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বোধকরি, এই অভিনিবেশনির্ভর গবেষণার ধারা অনাগত দিনেও অব্যাহত থাকবে। ধ্রপদি কবি ও কবিতার ইতিহাস অন্তত তা-ই সাক্ষ্য দেয়। কবিতার বিষয় ও প্রকরণ পরিচর্যার নিরিখে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই বাংলা কবিতার বাঁকবদলের প্রধান কবি।

সম্প্রতি ‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ (২০২১) নামে জীবনানন্দবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠের সুযোগ হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কেন? এই জিজ্ঞাসা সামনে রেখে বর্তমান লেখার অবতারণা। গ্রন্থের লেখক গবেষক আমীন আল রশীদ। তিনি জীবনানন্দের জীবন ও কর্মপ্রবাহ নিয়ে লিখেছেন। লেখকের ভাষ্য মতে, এই বই তাঁর প্রায় ১৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। সম্প্রতি বইটি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ অর্জন করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বইটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনোযোগ পেয়েছে।

আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে বইটির আদ্যন্ত পড়েছি। সাধারণত গবেষণামূলক অধিকাংশ বই তথ্য-উপাত্তের ভারে মোটা-তাজা হয়। আদতে পাঠ-বিশ্লেষণে রসাস্বাদন সম্ভব হয় না বিধায় শেষ হওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়। তবে উল্লিখিত ‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ বইয়ের সার্বিক আয়োজন ও পরিবেশন পদ্ধতি ঈষৎ ব্যতিক্রম। পাঠান্তে মনে হয়েছে, জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর কবিতা নিয়ে লেখা এত এত বইয়ের ভিড়ে এই বইয়ের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে- গবেষণায় পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি সত্যাসত্য যাচাইকল্পে লেখক জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত প্রায় প্রতিটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন।

আরও পড়ুন – চিরকুট: মানবিক বিনির্মাণের বিনিয়োগ

একজন একনিষ্ঠ গবেষক কেবল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না। অনুমাননির্ভর হয়ে গবেষণার কাজ হয়তো চালিয়ে নেওয়া যায়। তবে গবেষণার একাগ্রতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আমীন আল রশীদ বোধকরি তাঁর গবেষণায় এই অতৃপ্তি ঘোঁচাতে পেরেছেন। তিনি স্মৃতিচিহ্ন অন্বেষণের পাশাপাশি তুলনামূলক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অবস্থাভেদে যুক্ত করেছেন প্রাসঙ্গিক ছবি। ফলে তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে রয়েছে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রস্তুতি।

২৩৫ পৃষ্ঠার গবেষণাগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে জীবনানন্দবিষয়ক নিবেদিতপ্রাণ আরেক গবেষক প্রভাতকুমার দাসের প্রতি। উৎসর্গপত্রে লেখক কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করে লিখেছেন- ‘…যাঁর প্রত্যক্ষ তত্বাবধান, সাহচর্য, আনুকূল্য, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা ছাড়া এই বইটি লেখা সম্ভব হতো না।’

সূচিপত্রে স্থান পেয়েছে ৩৯টি শিরোনাম। মূলত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা বাঁকে যেখানে যেখানে জীবনানন্দের পদছাপ পড়েছে, গবেষক সেসকল স্থান-কাল ও প্রতিষ্ঠানের আঙিনা স্পর্শ করার প্রয়াস পেয়েছেন। বোধকরি, জীবনানন্দের জীবনকেন্দ্রিক এমন নির্মোহ-নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর কোনো গ্রন্থে পাওয়া কঠিন। গ্রন্থের তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে লেখক অপরাপর গ্রন্থের ভাষ্য উদ্ধৃত করার পাশাপাশি তথ্যনির্দেশ দিয়েছেন। একই সমান্তরালে যুক্তি-বিশ্লেষণের নিক্তিতে নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে প্রায় প্রতিটি অধ্যায় থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি হাজির করা যেতে পারে। তবে উদ্ধৃতির আধিক্য এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমি বরং যাচাইয়ের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে করি।

প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘জন্মস্থান, সেই আটচালা ঘর’। আমরা যদি অভিনিবেশ নিয়ে এই অধ্যায়টি খেয়াল করি, তবে দেখব জীবনানন্দের জন্মভিটা শনাক্ত করতে গিয়ে গবেষক কতটা নিরপেক্ষ অগ্রসরমানতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি চাইলে বিভিন্ন জনের বইয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভাসা-ভাসা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সরেজমিনে গিয়ে তৎকালীন সময়ের সঙ্গে বর্তমানের একটা যোগসূত্র উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় সংস্কৃতজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জীবনানন্দের জীবনীকার প্রভাতকুমার দাসের বক্তব্য এবং আবদুল মান্নান সৈয়দকে দেওয়া জীবনানন্দের অনুজ অশোকানন্দ দাশের সাক্ষাৎকারও প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃত করেছেন। এই অধ্যায়ে তিনি জীবনানন্দের জন্মতারিখ ও জন্মস্থান নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি নিয়ে বিস্তর তথ্য-প্রমাণ হাজির করে সমাধানের যে উৎসদুয়ার উন্মোচনে প্রয়াসী হয়েছেন, তা এককথায় তুলনারহিত।

‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ যেন কবির যাপিতজীবনের লিখিত স্কেচ। বরিশাল থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাংলা ভাষার মহত্তম কবির ৫৫ বছরের যে আয়ুরেখা, আমীন আল রশীদ সেই রেখা ধরে পাঠককে ভ্রমণ করাতে চেয়েছেন। সন-তারিখ ও সমসাময়িক ঘটনার আলোকে সেগুলো মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। ফেলে আসা ধূসর জীবনানন্দের জীবনকে ভিন্নভাবে অনুভব করতে চেয়েছেন। অবশ্য ‘কোথায় পাব তারে…’ শিরোনামের ভূমিকায় তাঁর কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়েছে- ‘এই কাজটি করতে গিয়ে কলকাতা শহরের নানা প্রান্তে ঘুরে যে বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করেছি তা হলো, এই শহরে কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। জীবনানন্দের সময় যেসব ভবন ছিল, অনেক কিছু এখনও সে রকমই আছে। ভবন জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও সেটি খুঁজে পাওয়া যায়…। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোয় তাঁকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’

গ্রন্থে দুর্লভ কিছু ছবি সন্নিবেশিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ যেখানে পড়েছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন ক্যাপশনসহ সেসব স্থাপনার ছবি দেখে পাঠক হয়তো জীবনানন্দকে অনুভব করবেন। ‘জীবনানন্দের ‘রকেটযাত্রা’ শিরোনামের অধ্যায়ে দুটি স্টিমারের ছবি আছে। ধারণা করা হয়, ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে লাবণ্য গুপ্তকে বিয়ে শেষে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা সদরঘাট টার্মিনাল থেকে স্টিমারে চড়ে বরিশালে গমন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে গবেষক জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর গন্ধ’ শিরোনামের গল্প এবং ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনা ও চরিত্রের সাযুজ্য দেখিয়েছেন।

জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার বাইরে এই গ্রন্থের বিশেষ কিছু অধ্যায় পাঠক হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেগুলো হলো- ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রের দ্বন্দ্ব, ‘ময়ূখ : একঝাঁক তরুণের ভালোবাসার গল্প’, ‘গণেশচন্দ্র এভিনিউ : পূর্ব্বাশা ও চতুরঙ্গের খোঁজে’, ‘ক্রিক রো : স্বরাজের দিনগুলি’, ‘কলকাতার অলিগলি’, ‘সকল লোকের মাঝে বসে’, ‘জীবনানন্দের বরিশাল-কলকাতা টানাটানি’, ‘বনলতা সেনের পরিচয় সন্ধান’, ‘জীবনানন্দের বিশ্বাস ও ধর্মচিন্তা’ ‘তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে’। এসব প্রবন্ধে জীবনানন্দের কবি হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে সংগ্রাম ও দুঃখকথা আড়াল হয়ে ছিল। আমীন আল রশীদ সেসব উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। জীবনানন্দের শিল্পবৈভবের ভেতরলোক সম্পর্কে আগ্রহীজন এই অধ্যায়গুলো পড়ে কবি জীবনানন্দের মানসচৈতন্যের খোঁজ পেতে পারেন। স্বল্পভাষী ও নিভৃতচারী কবি সমকালে সাহিত্যাঙ্গনে আড়াল হয়ে থাকার পেছনের গল্পও এসব লেখায় জানা যাবে। ‘ময়ূখ’ সম্পাদক জগদিন্দ্র মন্ডলের সঙ্গে আমীন আল রশীদের কথোপকথনে অনেক অজানা কথা উঠে আসে। সেসব জেনে আমাদের মন ব্যথাহত হবে সন্দেহ নেই। আমীন আল রশীদ জানতে চেয়েছেন-

‘-আপনাদের সঙ্গে যখন জীবনানন্দের পরিচয়, ১৯৫৩ সাল, তখন তো ওনার জীবনে খুব সংকট যাচ্ছে… -হ্যাঁ, যে বাড়িতে ছিলেন, সে বাড়িতে থাকতে পারবেন না। আমাদের বললেন, একটা বাড়ি খুঁজে দেবে তোমরা? এই যে সারল্য… দেখো উনি আমাদের কাছে ব্যক্তিজীবনের কথাও বলছেন। শুধু তাই নয়, আমাদের কাজ নিয়েও উনি উচ্ছ্বসিত।’ (পৃ. ১৩৫)

আরও পড়ুন – ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এর ইন্দুর কথা

‘তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে কিংবা কাশিমিত্রের তল্লাটে পড়ে রব’ শিরোনামের অধ্যায় পড়ে স্তম্ভিত হতে হয়। রবীন্দ্র-পরবর্তীসময়ের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। অথচ তার কোনো সমাধিচিহ্ন নেই। এমনকি ধারণা করেও বলা যায় না, হ্যাঁ এটাই কবির সমাধিচিহ্ন। ১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে মৃত জীবনানন্দকে কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশানে দাহ করা হয়। আমরা জানি, জীবদ্দশায় কবি হিসেবে জীবনানন্দ ততটা পাঠকনন্দিত ছিলেন না। ফলে তখন তাঁর সমাধিস্থলে মনে রাখার মতো কোনো সমাধিফলক স্থাপনের প্রয়োজনটুকু অনুভব করেনি কেউ।

সেদিন শবযাত্রায় কবি-লেখকদের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন- জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ, দেবপ্রসাদ ঘোষ, নির্মল ভট্টাচার্য, সরোজ দাস, সজনীকান্ত দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসুসহ আরো অনেকে। তবে তরুণদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও সেই শবযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। সেদিনের স্মৃতিচারণ, করে সুনীল লিখেছেন- ‘শবানুগমনে খুব বেশি লোক হয়নি। আমাদের অল্পবয়সী কাঁধ বেশ শক্ত, আমরা কয়েকজন কাঁধ দিয়েছিলাম পালা করে। জীবনে একবারই মাত্র সেই কবির শরীর আমি স্পর্শ করেছি, তখন নিস্পন্দ…। কবির শরীর যখন চিতায় জ্বলছে, কিছুদূরে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে আমরা কয়েকজন অনর্গল তার কবিতা বলছিলাম। কার কটা মুখস্থ আছে যেন তার একটা প্রতিযোগিতা চলছিল। জীবনে সেদিনই প্রথম আমি সিগারেট খাই। অনভ্যাসের জন্য কাশছিলাম খুব আর ধোঁয়ায় চোখে জল এসে গিয়েছিল।’ (আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য)

জীবনানন্দের অন্তিমযাত্রার দিনটি এভাবে প্রাণস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন গবেষক আমীন আল রশীদ। কবির মৃত্যুদিন ও সমাধিস্থলের নিশানাবিহীন কেওড়াতলা শ্মশানঘাট সম্পর্কে স্মৃতি-অভিজ্ঞতা পড়ে পাঠকের চোখ অশ্রুসিক্ত হবে বৈকি। সর্বোপরি, ‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ জীবনানন্দবিষয়ক গ্রন্থতালিকায় এক অসামান্য সংযোজন। এই গ্রন্থ জীবনানন্দের অনুরাগীদের জন্য তথ্য-উপাত্ত ও ছবিসংবলিত আকরগ্রন্থ বললে অত্যুক্তি হবে না।