হেলাল আনওয়ার >>
কবিরা মহামানব নন। অতি মানবও নন। বর্তমানকে উপজীব্য করে তাঁরা তাঁদের কল্পজগতের শানিত চিন্তাকে আগামীর জন্যে সজ্ঞায়িত করে থাকেন। কবির দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গি সমুচ্ছল বেগবান নদীর মতো। যাতে থাকে আগামীর বহুমাত্রিক দিক নির্দেশনা। সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র, অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সর্বভুক্ত চিন্তার ব্যঞ্জনা কবির স্বাধীন মানস সত্তার আওতায়।
মনসুর হেলাল তেমনি একজন দৃঢ়চেতা প্রতিশ্রুতিশীল শক্তিমান কবি। ভাবে, বিষয় বৈভবে, চিন্তনে, কাব্যিক গভীরতায়, ছন্দের পরীক্ষা-নিরিক্ষার কৌশল, শব্দের নান্দনিক ব্যবহার, উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব সবমিলে বলা যায় তিনি স্বার্থক কাব্য নির্মাতা।
কবি মনসুর হেলালের কবিতার সাথে খুব বেশিদিন আমার পরিচয় নয়। তবু যতটুকু পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে তাতে করে তার কাব্য নির্মাণ শৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে তার কাব্য বুননের দক্ষতা আমাকে সবিস্ময়ে অভিভূত করেছে। জীবনের দূরন্ত সময়ে বহু বন্ধুর পথ মাড়িয়ে অলৌকিক স্বপ্ন-বিশ্বাসের পাল তুলে প্রবাহিত হয় মানুষের জীবন তরী। কখনো কখনো নিষ্ঠুর বাস্তবতার নিঘাত আক্রোশে নিপতিত হয় বিশ্বাসের বিমল হাসি। কবির পাললিক চিন্তার বুননে এই মাটির মমতায় যে স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরোদগত, তা যেন বিনাশের বিষবাষ্পে আচ্ছাদিত। আত্ম জিজ্ঞাসায় বিমূঢ় কবি নিজেকে প্রশ্ন করেন ‘কেন এলে?’
না আসাটায় বোধহয় ভালো ছিল। কেননা, একজন কবি তার মানবিক মানস সত্তা নিয়ে কল্পিত পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী। তাই হতাশার সুরে কবি বলেন-
‘প্রাকৃতিক বর্ণবাদ, পাহাড়ের ধস
প্রাক্কলিত জোয়ারের নোনা
এই বুক দিয়ে তুমি কতটা ঠেকাবে?’
(বৈরীতার নুন/৯)
কতটা হতাশ কবিতার ভাব ব্যঞ্জনায় তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই বৈরিতা, মানুষের জিঘাংসা, হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ পৃথিবী কোনো মানবিক পৃথিবী বলা যায় না। এখানে কেবল রক্তের হোলি খেলা। জীবনের মূল্যহীনতা কবির কাছে বড় বেদনার, অনেক বেশি যন্ত্রণার। অগ্নিম্মুখ রক্তস্নাত পৃথিবীতে আগমন করার জন্য নিজেকে বড় দুর্ভাগা বলে মনে করেন। কবির সরল স্বীকারুক্তি-
‘ধীরলয়ে ওঠে আসে অব্যর্থ পীড়ন
কেউ গতি রোধ করে
কেউবা খামচে ধরে সমূহ বসন।’
(বিব্রত আঁধার /১১)
কবি মনসুর হেলালের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তিনি শব্দকে স্বার্থক করে তুলতে পারেন এবং তার সত্য প্রকাশের শঙ্কাহীন বৈভব নিশ্চল চিন্তার বিবর্তনে ম্লান হয়ে যায়না। এজন্যে তার কবিতার ঘুর্ণন দোলায়িত করে পাঠক হৃদয়কে। মূলত তার বোধের সীমানা নির্দ্ধারণ করা খুবই দুরূহ। কখনো কখনো তিনি অতিমাত্রায় দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছেন কবিতার মাঝে। তিনি বলেন-
‘পিছনে অনেক তাড়া
সামনে নির্ঘাত খাড়া
দুদিকে কঠিণ শৃঙ্গ
নিরেট পাষাণ।’
এই কঠিন সংকুল সংকটে কবি কাকে খোঁজেন? সরল উত্তর ‘তোমাকে’। কে সে? কবির মানসী। তার স্বপ্ন-আশা, ভালোবাসার অভ্রান্ত স্পর্ধিত প্রেম। তার নাম নিষ্কণ্টক পৃথিবী। দুর্বিনীত আশার পারদে জ্বলে ওঠা আমার গর্বিত স্বদেশ। যাকে ভালোবাসি জীবনের বিনিময়েও। যার নিরাপদ গন্তব্য আমাকে আশান্বিত করে। এটা কোনো বায়বীয় উক্তি নয়। দেশ মাতাকে ভালোবাসা এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। সাতচল্লিশ, বাহান্ন, একাত্তর তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবন দিয়েছি, রক্ত দিয়েছি তবু আমার স্বদেশের এক রত্তি ক্ষতি হতে দেইনি। কবি সেই চিত্রকে এভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছেন –
‘শত্রুর বুলেট ছিন্ন ভিন্ন করে বুকের পাঁজর
রাজপথে রক্তের আলপনা আঁকে
তামাটে যুবারা।’
(আর্ত শব্দাবলী /৬০)
অথচ এই তামাটে যুবাদের স্বপ্নের রঙিন জরীন যেন অমিতাচারিতার ঝড় আর হড়কা বানের স্রোতে এলোমেলো হয়ে যায়। কবি তার সূক্ষ কাব্য গাঁথুনীতে এভাবে তুলে ধরেন-
‘চর্চিত ভ‚মির ফাঁকে ক্ষয়িষ্ণু স্মারক
অঙ্কুরিত বাহুলতা, দীর্ণ তৃণমূল;
প্রবল তৃষায় কাঁপে সমূহ প্রকৃতি
প্রান্তিকের ক্ষতে দগ্ধ দ্রোহের বকুল।’
(খরা ও জলের সন্ধি/৪৮)
কবি তার অপরূপা কাব্যের গহীনে বহুমুখী চিন্তা, দর্শন, মানবিকতা, দেশ, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতিকে নিপুণ চিত্রকল্পে দক্ষ শিল্পীর মতো ফুটিয়ে তুলেছেন নান্দনিক ঐশ্বর্যে। তার কবিতার আর একটি দিক হলো- মানুষের আগমন প্রস্থানের নিদারুণ বাস্তবতাকে কোনোভাবেই তিনি এড়িয়ে যাননি। বরং পরাবাস্তবতাকে স্বীকার করে তার জন্যে এক প্রকার প্রস্তুতিও তিনি গ্রহণ করেছেন। কবি সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেন-
‘অবগাহনের দায়ে যতই তৃষিত হও তুমি
তবু ক্ষতি নেই
সমূলে উত্থিত শাওনের দলে
নিশ্চয় নিভৃত হবে তোমার প্রকৃতি।’
(স্রোতের বচন/১৫)
একজন কবির জন্যে সবচেয়ে মূখ্য তার ভেতরের বিশ্বাস। তার আলোড়িত চিন্তার ভাঁজে ভাঁজে বিশ্বাসের বহ্নিশিখা প্রদীপ্ত রবির মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবি মনসুর হেলালের কবিতার বিশেষ দিক হলো তার চিন্তার অবয়বে নিগুঢ় বিশ্বাসের প্রতিফলন। তিনি বলেন-
‘ভীষণ পড়েছে টান ক্ষয়িষ্ণু সঞ্চয়ে
ব্যবচ্ছেদ বড় বেশি নিবিষ্ট বলয়ে
দন্ডবৎ যৌগিকের ব্যর্থ রসায়ন
সমাগত আধারিতে ব্যথিত বসন।
সায়াহ্নের সন্নিকটে প্রসূত প্রত্যয়
প্রথার প্রোথিত পাঠে পরাস্ত অব্যয়।’
(সায়াহ্নের সন্নিকটে/৪০)
কবি মনসুর হেলালের ‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রুপ’ শুদ্ধি বচনের প্রলুব্ধ প্রবচন কখনো ম্লান হবে না বলে বোধ করি। তার শব্দ চয়নের মুন্সিয়ানা, উপমার নান্দনিক ব্যবহার, উপস্থাপনের কৌশল, মানবিক চিন্তার তত্তীয় প্রভা যেকোনো বোদ্ধা পাঠককে বিমোহিত করবে বলে বিশ্বাস করি।
‘গন্তব্যে বিপন্ন বিদ্রূপ’ নাম করণে যেমন রয়েছে স্পর্ধিত শিল্প সুষমায় ভরা। তেমনি সমকালীন কবিদের থেকে তাকে কিছুটা হলেও ভিন্নভাবে দাঁড় করিয়েছে। তাঁর কবিতা যেন নাক্ষত্রিক সম্ভাবনায় সমুদ্ভাসিত। কবি মনসুর হেলাল, নিরেট কবি সত্তার আলোক বিলাসী এক সমুদ্র নাবিক।
কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জাগতিক প্রকাশন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন বদরুল হায়দার। মূল্য : ২০০ টাকা।