আন্দাজির মা

টেমির আগুন নেভে না
তোর পিছে নাচে ফেউ
তুই কাদের বাড়ির বউ?

‘আর কি বলবো ভায়া, দেখছো তো পাগলিটার পিছু নিয়েছে বাচ্চাগুলো। গ্রামের  ছেলেপুলেগুলোর ওই আনন্দ, ছড়া করে ওর পিছুপিছু ছুটবে, বাড়িতে ঢিল মারবে। যেমন হয় আর কী, এতো আর তোমাদের শহর নয়।শিক্ষেদিক্ষে নেই মোটে’ লাজুক হেসে বললেন প্রতুল বিশ্বাস। যেন গ্রামের অশিক্ষার দায়টা ওনার ঘাড়েই বর্তেছে।

কলকাতা থেকে তার শালা জয়ন্ত, বউ আর দুই বন্ধু নিয়ে কালই এসেছে গ্রাম দেখতে। সকালে বারান্দায় বসে খাঁটি দার্জিলিং চা খেতে খেতে গপ্পো করছিলেন শালার বন্ধু অমলের সাথে। গ্রামের উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি, প্রকল্প নিয়ে ভাষণ দেবার মাঝেই, শহুরে বাবুটির চোখ গেল রাস্তায় হাঁটা পাগলি বুড়িটার দিকে।
‘ও কে প্রতুলদা? সাতসকালে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে যাচ্ছে কোথায়? বাচ্চা গুলো কী  বলছে?’

‘আরে এ হল আন্দাজির মা। আসল নাম লোকে ভুলতে বসেছে। গোটা গ্রাম ডাকে আন্দাজির মা। কার মা, কবে মা হল, কেউ জানে না। আন্দাজিই বা কে তার ও কোনো খবর আছে বলে মনে হয় না। আসলে ও হল হেমন্ত দলুই এর বিধবা বোন। অবশ্য হেমন্তও নেই বহুবছর, সেবার আটাত্তরের বন্যায় গোটা গ্রাম ভেসেছিল। দামোদরের জলে তলিয়ে গিয়েছিল গোটা জায়গাটা। মদ্দ জোয়ান ছেলে হেমন্ত গরুটাকে বাঁচাতে গিয়ে জলে ডুবে মরল। একা হেমন্ত নয়, গ্রামের অনেক বুড়ো, মদ্দ মরেছিলো ওই বন্যায়। চাষবাস, গরুছাগল, ক্ষয় ক্ষতির সীমা ছিল না।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসতে আসতে শুনছিলাম জয়ন্তর মুখে। ও আগেরবার এখানে এসে ফিরে যাবার দিন সাতেকের মধ্যেই দামোদরের জল ছাড়ে, আর সেই ভয়ঙ্কর বন্যা হয়।’

‘হ্যাঁ, তার ঠিক আগেই জয়ন্ত এসেছিলো, দুই বন্ধু নিয়ে, প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার এল। তা যা বলছিলাম, আটাত্তরের বন্যার আগের বছরই হেমন্তের বোনটা বিধবা হয়ে বাপেরবাড়ি ফেরে। বরটাকে সাপে কাটলো, তিনদিনের মধ্যে বাপের বাড়িতে এনে বসিয়ে দিয়ে গেল ভালোমানুষ মেয়েটাকে। অথচ মেয়েটা একটু শান্ত বোকাসোকা বলে হেমন্তের বাপ দেওয়া থোওয়া কম করেনি। সাইকেল থেকে শুরু করে, দশ হাজার টাকা নগদ দিয়ে ছিল সেই বাজারে।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন প্রতুল বিশ্বাস, গ্রামের পাঁচজন মানে তাকে। জয়ন্তর কাছে শুনেছে, সিপিমের জমানায়ও কেউকেটা ছিলেন আবার তৃণমূল জমানাতেও তাই। কথাটা বেশি বলেন বটে প্রতুল তবে বাঁধুনি খুব, ভাবছিলো অমল।
‘ভাই মরার পর আর কেউ নেই নাকি পাগলিটার প্রতুলদা?’ শালার বন্ধু অমলের কৌতূহল যায় না।

‘সেটাই তো বলছি,’ গলা খাঁকারি দিয়ে একটু নাটকীয় ভাবে বলল প্রতুল বিশ্বাস, ‘ওই  বন্যায় বুঝলে ভায়া দলুই পরিবারটা ছাড়খার হল। হেমন্ত মরলো, ওর মা শয্যা নিল আর তার পর থেকেই ওই জবা পাগল হল। পাগল মানে আর কিছু নয়। সারাদিন  ওই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাস্তায় ঘোরে আর বিড়বিড় করে। দুপুর রোদ্দুরেও কাউকে সামনে পেলে হ্যারিকেন ধরে মুখটা দেখে। বাপের ভিটাতে একাই থাকে। লোকের বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে খায়। কারোর ক্ষতি করেনা। আমার বাড়িতে তো সকালের চা পাঁউরুটি বাঁধা ওর। তবে এক মুহূর্তের জন্যও হ্যারিকেন নেভায় না। তা আমার শালাবাবু এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি ? কই হে জয়ন্ত, তোমার বন্ধুদের সাথে ফার্স্ট রাউন্ড চা হয়ে গেল তো। এবার ওঠো।’ হাঁক দিলেন প্রতুলবাবু।

কলকাতার বন্ধুদের নিয়ে বহুযুগ পরে গ্রামে দিদির বাড়ি এসেছে, জয়ন্ত। প্রতুল বিশ্বাসের শালা। সরকারি বড় মাপের অফিসার ছিল। বহুদিন হিল্লিদিল্লি করে এখন রিটায়ারের পর কলকাতায় থিতু। তার শহুরে বউ এর ভারি ইচ্ছে গ্রাম দেখবে। তাই গতকাল রাতেই এসে পৌঁছেছে, অবশ্য সাথে দুই বন্ধুও আছে। দুএক দিন থাকার ইচ্ছে।

প্রতুল বিশ্বাসের বকবকের আওয়াজে ঘুম ভাঙলেও কথাগুলো কানে গেল না জয়ন্তর। সে ভাবছিলো, প্রায় চল্লিশ বছর পর আসা এই চামরদা গ্রামে। সেবারও সাথে দুই বন্ধু ছিল, বীরু আর সন্তোষ। চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত। চাকরি হয়েও হচ্ছিল না। বাড়িতে নিত্য বাপের খ্যাঁচানি। শালা এত ভালো করে তৈরি করেও, ব্যাঙ্কের পরীক্ষাটা লাগলো না। রাগে দুঃখে দিদির বাড়ি চলে এলো। তুতো হলেও নিজের দিদির মতন।  আসার সময় ফেউ ধরল বীরুরা। আজকাল কোথায় আছে কে জানে। দশটা দিন দিব্যি ছিল পুকুরের মাছ, গাছের ফল খেয়ে। দিদিও যত্ন করেছিলো খুব। কপালের লাল জরুলটা দেখে প্রতুলদার বাবা বলেছিলো রাজযোগ আছে তার। ভেবে হাসি পেল এতদিন পরেও। এতবছর পরে এসে গ্রামটাকে অনেক অন্যরকম দেখছে। উন্নতি হয়েছে অনেক, রাস্তাঘাট, পাকাবাড়ি, টিভি, ছেলে ছোকরাদের হাতে সাইকেল, স্কুটি মোবাইল,অনেক বদলেছে।
প্রতুলদাও আর সেই আগের প্রতুলদা নেই। জমি, বাড়ি, ট্রাকটার, কোল্ড ষ্টোরেজ, অয়েল মিলে পেল্লাই ব্যাপার। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন হয়ে সব দলে মিশে আছে।
অবশ্য জয়ন্তও কি আর আগের জয়ন্ত আছে? পাকা চুল, রিটায়ার্ড অফিসার, সল্টলেকে বাড়ির আজকের জয়ন্তর সাথে, কোথাও মিল নেই ওই বখাটে বন্ধুবাজ ছেলেটার। মদ খেলে সিঙ্গল মল্ট খায়, সেদিনের মত রামের বোতল গলায় ঢালে না। ভাবনাটা আসা মাত্রই গাটা কেমন শিরশির করে উঠলো। তবে যতদিন পরেই আসুক চামরদার নাম সে ভোলেনি কখনও।

জয়ন্ত বারান্দায় আসে, ‘উঠেছি গো প্রতুলদা। সকাল বেলা থেকে যা বকবক লাগিয়েছো, না উঠে উপায় আছে। চা টা ঢালো দেখি, কি অ্যারোমা।’
‘আরে খেয়ে দেখো, দার্জিলিংএর নিজের বাগান থেকে পাঠিয়েছে এক বন্ধু। সমঝদার লোক এলে তবেই খাওয়াই’আত্মপ্রসাদে চকচক করছিলো প্রতুলের মুখটা। সল্টলেকের  শালাকে একটু ঠাটবাট না দেখালে চলে।
অমল জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আন্দাজির মা নাম হল কেন প্রতুলদা, সেটা তো বললেন না?’

‘তা জানিনা বাপু, হয়ত আন্দাজে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখে তাই এই নাম। তারপর, শালাবাবু জলখাবার খেয়ে বন্ধুদের নিয়ে গ্রাম দেখতে যাবে তো ? বৌমা তো ননদের সাথেই গল্পেই ব্যস্ত। আমরাই যাই চল।গরীব জামাইবাবুর জায়গাজমিন একটু দেখবে।’
সদলবলে গ্রাম ঘুরতে মন্দ লাগছিলো না জয়ন্তর। কিছু বাড়ি চেনাচেনা লাগলেও সবই বদলে গেছে। জামাইবাবুর কোল্ড স্টোরেজ, অয়েল মিল দেখতে দেখতে বেলা কাবার। শহরের ধাক্কা গ্রামে লেগেছে বটে, তবুও সর্ষে ক্ষেতের উজ্জ্বল হলুদ রঙ, আলু শাকের সবুজ মিশে বেশ একটা অন্যরকম। অমল আর পলাশ তো মুগ্ধ। তারা শহুরে মানুষ।

‘কি ভায়া কেমন লাগছে? এতবছর বলতে বলতে তো এতদিন পরে এলে। এবার থেকে এসো মাঝে মাঝে। তোমরাও চলে এসো।’ অমলদের দিকে তাকিয়ে বললেন প্রতুলবাবু। ‘দামোদরের পাড় ধরে একটা রের্সোট বানাবার ইচ্ছে আছে।পারমিশন পেয়েছি ওপর থেকে, দেখা যাক। কী হয়!’

‘বল কি প্রতুলদা, রেসোর্ট ? টুরিস্ট আসবে চামরদার মতন গ্রামে?’
‘খবর তো কিছুই রাখো না ভায়া, লক্ষণ ঘোষের দুটি রেসোর্ট চলছে অলরেডি। জায়গা দিতে পারছে না।’
‘বলো কী প্রতুলদা ? সত্যি দিনকাল কত বদলে গেল!’
‘ওই ক্ষেতটা চিনতে পারছো জয়ন্ত? আগের বার তোমরা বন্ধুরা ওখান থেকে আঁখ ছিড়ে খেয়েছিলে?’
‘না দাদা, একেবারে মনে নেই। কত যুগ আগের কথা বলতো !’
‘আরে দলুইদের জমি ছিল আগে। সেই হেমন্ত দলুই?  মনে নেই? তোমরা বন্ধুরা ওদের মাচায় উঠে অনেক রাত অবধি গল্প করতে। মদটদও খেতে বোধহয়। হে হে, আমার কিন্তু আজও মনে আছে। হঠাৎ করে একদিন চলে গেলে তোমরা। যেমন হঠাৎ এসেছিলে।’

‘না গো প্রতুলদা মনে পড়ছে না একেবারে। তুমি বলাতে এখন হেমন্তর কথা আবছা মনে হচ্ছে। আচ্ছা এবার বাড়ির দিকে চল, শহুরে শরীর এত হাঁটা সয় না। দিদিও তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে।’
‘তোমরা যাবার পরের দিন থেকেই বৃষ্টি শুরু হল। তার কয়েকদিন পরই তো বন্যা। হেমন্ত ডুবে মরল। তোমরা চলে যাবার পর বার দুয়েক বৃষ্টি মাথায় করে এসেছিলো হেমন্ত, তোমার ঠিকানাটা চাইতে। আমি দিইনি, কলকাতায় বেড়াবার ইচ্ছে ছিল বোধহয়।’
কথা বলার আনন্দে প্রতুলবাবু জয়ন্তর মুখের দিকে তাকায়নি ভাগ্যিস। তাহলে দেখতো মুখটা সাদা হয়ে গেছে। 

আন্দাজির মা
টেমির আগুন নেভেনা 
তোর পিছে নাচে ফেউ
তুই কাদের বাড়ির বউ?

আবার সেই এক দৃশ্য। প্রতুল বিশ্বাস হাঁক দিলেন, ‘এই ভাগ এখান থেকে। কেন বিরক্ত করছিস আন্দাজির মাকে?’ বাচ্চাগুলো ধানক্ষেতের আল ধরে ছুটে পালালো  বুড়ির পেছন ছেড়ে। চুলগুলো শনের নুড়ি, চোখে ভাষা নেই পাগলীটার। তবুও হাঁপাতে হাঁপাতে হ্যারিকেনটা তুলে ধরল, প্রতুল, জয়ন্ত, পলাশের মুখের ওপর। তারপর আল পথ দিয়ে বাচ্চাগুলো যে পথে গেছে সে পথেই মিলিয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে একগাদা খাওয়াদাওয়া করে বিকেলের পর ঘুম থেকে উঠলো জয়ন্ত। কলকাতায় এমন টেস্ট পায় না খাবারে। সত্যিই প্রতুলদারাই ভালো আছে। চাষের ধান, তরকারি, পুকুরের মাছ দুবেলা খাচ্ছে, গ্রামের লোকেরা হাত কচলাচ্ছে আর পড়াশোনা করে জয়ন্ত সারাটা জীবন শুধু এ শহরে দুবছর, ও শহরে দুবছর করে কাটিয়েছে। টাকাও মাপা, জীবনও। এখন তো সাতরকম রোগ ধরেছে। অমল আর পলাশের মুখেও একই কথা।

বিকেলে আবার কোল্ডস্টোরেজের ঘরে প্রচুর অনুপান সহ হুইস্কির আসর। সেখানে অবশ্য বিলিতি। প্রতুলদা বলছিলো ‘চাইলে আরও মজা আমদানি করতে পারি হে ভায়া, এ শর্মার এখন এমন মুরোদ আছে। তোমার দিদি, বৌমা টেরটি পাবেনা।’ অমল,পলাশের আপত্তি ছিলো না কিন্তু জয়ন্ত বেঁকে বসলো। আসলে এখানে এসে থেকে জয়ন্তর কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওকে লক্ষ করছে। তবুও রাজা উজির মারা আড্ডা চলল বেশ রাত পর্যন্ত।

প্রথমে একটা আর্ত চিৎকারে ঘুম ভাঙলো প্রতুল বিশ্বাসের। কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে এসেছিলো। আজ বোধহয় বেলা হয়ে গেছে। তারপরে আরও চিৎকার শুনে ধড়ফড় করে উঠে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে সামনের বিশাল উঠোন রক্তে ভেসে যাচ্ছে, গলা কাটা অবস্থায় পড়ে আছে জয়ন্ত। বৌ, মেয়েরা চিৎকার করছে। ভয়ে কাঁপছে অমল,পলাশ আর বাড়ির চাকরবাকরগুলো। আর এক দিকে আগুন চোখে দাঁড়িয়ে আছে আন্দাজির মা।
কাপড়টা রক্তে মাখামাখি, হাতে ধানকাটার কাস্তে। একটানে শাড়িটা খুলে ফেলে বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখেই চিনেছি, কপালের লাল আবটা। এতবছর খুঁজছি তোকে,  নে কর আরও ফূর্তি কর, বন্ধুদের নিয়ে। নে রে হারমজাদা, ন্যাংটো বুড়ি তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওঠ, ওঠ।’

প্রতুল বিশ্বাস দেখলো আন্দাজির মায়ের হ্যারিকেনটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। এই প্রথম নিভে গেছে আগুনটা।

—————————-  

সঙ্ঘশ্রী সেনগুপ্ত : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা করেছেন।  ছিলেন শিক্ষিকা। পারিবারিক প্রয়োজনে বিরতি নিয়েছেন। কবিতা না লিখলেও প্রচুর ভালোবাসা রয়েছে কবিতার প্রতি। অনুবাদ করেন। লেখালেখি বিশেষ করে গল্প  লিখতে ভালোবাসেন। স্বামী কন্যা বন্ধুদের উৎসাহে লেখালেখিতে মন দিয়েছেন সঙ্ঘশ্রী  সেনগুপ্ত। সঙ্ঘশ্রীর জন্ম ১৪ই জুন, কলকাতায়।    

আরও পড়ুন…

একুশ

মূত্র পদাবলি : কয়লাখনি অঞ্চলের অমলিন দলিল