বিপ্লব বিশ্বাস
‘শিল্পকর্মের বিচারে ছোটোগল্প পলকাটা হীরের মতো সংহতি ঘনত্বে নিরেট তথা বাহুল্যহীনতার জন্য নিখাদ। অসহ্য ও অস্বচ্ছ তার স্বচ্ছতা, যে কোনও আলোর রেখাকে সে যে কোনও কোণে বাঁকাতে পারে, চূর্ণ করতে পারে, পারে ঠিকরে দিতে – a flash that suddenly illumines, then passes। অতর্কিতে সে মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়। সার্জেনের ক্ষিপ্র ছুরির মতো তার প্রতিটি আঁচড় রক্তরেখার আগে আগে চলে। তার ক্ষত নিরাময়, নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরেও থেকে যায়। চোখের আড়ালে খচখচ করে জানান দেয়।’
-এ উক্তি আমার নয়। প্রখ্যাত ইংরেজ ছোটোগল্পকার, সাহিত্য সমালোচক ভিক্টর সডন প্রিচেটের। তবুও এই মহদুক্তি আমাতে চেপে বসে যখনই কোনও গল্পগ্রন্থের বিষয়ে এক দু কথা বলতে হয়। এখানে স্বাভাবিক স্বল্পপরিসরের আলোচনীয় বইটি অণুগল্পের হলেও গল্পের শরীরাকার বা শব্দসীমাকে বিভাজনরেখা থেকে মুছে দিলে প্রাগুক্ত বক্তব্য অণুগল্প সম্পর্কেও সমভাবে প্রযোজ্য। কেননা ক্ষণিক উদ্ভাসের নিরিখে ছোটোগল্পকে অণুগল্প থেকে আলাদা করা যায় না যদিও স্বল্প শব্দসীমার অজুহাতে অনেকেরই অণুগল্প বিষয়ে দ্বিষদ উন্নাসিকতা বর্তমান।
এখন কথা হলো, অণুগল্পের ক্ষুদ্রাকার যদি অপরাধ হয় তবে বলতে হয়, মানুষের যেমন উচ্চতা কমেছে তেমনই আকার কমেছে উপন্যাসের তথা ছোটোগল্পেরও। তাহলে সময়াভাবের এই যান্ত্রিকতার যুগে ছোটোগল্প যে অণু বা পরমাণু গল্পের রূপ নিয়েছে তাতে দোষটা কোথায়? আমি যদিও ব্যক্তিগতভাবে এই যান্ত্রিকতা, সময়াভাব বা চটজলদি স্বাদগ্রহণ – এ সব অজুহাতে আস্থা রাখি না। যে কোনো গহিনস্থ গল্পপাঠই বাস-ট্রেনের খবরকাগজ পড়া নয়। তাকে সময় নিয়ে আত্মীকৃত করতে হয়। আর তর্কের খাতিরে যদি সময়াভাবের যুক্তি মেনেও নিই তা হলেও সামগ্রিকভাবে আগ্রহীজনের গল্প- ক্ষুধা তো মেটাতে পারে এই অণুগল্পই।
ছোটোগল্পের উৎস সন্ধানে গিয়ে প্রাবন্ধিক শিশির কুমার দাশ ছোটোগল্পের পূর্বসূরি হিসেবে যে চার প্রকার গল্পের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটি ‘চূর্ণক’ যা একমাত্রিক তথা একস্তরীয়। এটি দ্বিস্তরীয়ও হতে পারে। এর অণুগল্পগত প্রেক্ষিত ততটা গুরুত্ববহ নয়। জীবনের বিশেষ স্তরের বিশেষ মুহূর্ত এখানে উদ্ভাসিত হয়। কাহিনি – বিন্যাস তথা চরিত্র – চিত্রণে কোনও জটিলতা না রেখেই গল্প পৌঁছে যায় চরম শিখরে। একদিকে যেমন তা criticism of life অন্যদিকে তা expression of purified perception of the artist। সুতরাং উপন্যাসের চাইতে বয়সে অনেকটা ছোটো হলেও গুরুত্ব বা প্রকরণে তা হীন তো নয়ই বরং অপ্রতর্ক্যঢঙে তা সুসন্নদ্ধ ও সমুর্ছ্রিত।
এমনতরো যে মুখব্যাদান ( ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর রস-কথন অনুযায়ী) করলাম তার বিশেষ কারণ হল আজকাল বেশিরভাগ গল্পই যখন মন ও মননের ক্ষুধা যথাযথ মেটায় না তখন এই গল্পকারের সমুদয় পঠিত অণুগল্প আমাকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে।
এবার বলি, ৪৬টি অণুগল্প নিয়ে অভিযান পাবলিশার্স প্রকাশিত সুব্রত ভৌমিকের ‘অণুগল্প সংগ্রহ’ বইটি ২০২১ সালে আলোকপ্রাপ্ত। আমার আলোচনা- নীতি অনুসারে প্রায় সব গল্পকেই কমবেশি তুলে ধরতে চাই। এখন পাঠক ধৈর্য রাখতে পারলেই হবে।
তার আগে বলি সুব্রতর গল্পের বিষয়বস্তুতে ফল্গুপ্রেমগত জোড়- ভাঙনের আধিক্য, সামসময়িকতা, নিম্নমধ্যবিত্তিয় যাপনের কূটকচাল সবিশেষ লক্ষণীয়। আর আছে নিপুণ তথা কৃপণ বাকবিন্যাস, শব্দব্যবহার যা তার গল্পাবলিকে ভিন্ন মাত্রায় উত্তরিত করেছে। personification, synecdoche, transferred epithet জাতীয় রেটোরিকসমৃদ্ধ লিখনশৈলী সুব্রতর গল্পের প্রতি বিশেষ ধ্যান দিতে বাধ্য করে। বেশ কিছু গল্পের শুরুয়াত শুধু চমকিতই করে না, সে সকল যেন অনেকটা ওই পূর্বোল্লিখত ‘রক্তরেখার আগে আগে চলে’।
‘গেল রাতে ফের রেপড হয়ে গেছে। কোল্ড ড্রিংকসের বোতলের ভিতর পাইপ ঢুকিয়ে সবটুকু টেনে নেওয়ার মতো মেয়েটা খালি হয়ে গেলে স্বামীটি মুখ মোছে। তারপর গলা তোলে। পালটা স্বরে ক্ষেপে যায়। গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় মাঝরাতে।’ – এটুকুতে মনোনিবেশ করলেই এ গল্পের হতাশা -পর্বে ঢোকা যায়। অনুভূত হয় আত্মহত্যার গূঢ় কারণ। সন্ধান মেলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ধর্ষকের। খুব সহজ নিয়ত অভ্যাসের পান- বর্ণনে শুষিত, শোষিত হওয়া এক নিরুদ্ধ নারীশরীর এখানে সাবলীল ঢঙে উপমিত। মরণের দৃঢ় পথরেখা ধরে ছোটার সিদ্ধান্তে অবিচল এক নারীপ্রাণকে রক্ষা করে ইতিপথে ফেরাতে চাওয়া অচিন মানুষটির আখ্যান, গল্পের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ আশা- পর্ব যেখানে জানা যায় সেই রক্ষক বন্দি পাখিদের খাঁচাদশা ঘুচিয়ে উদার আকাশে উড়িয়ে দেয়। এখানেই অশ্রুসিক্ত মেয়েটির সটান প্রশ্ন- ‘মানুষ ওড়াতে পারেন?’
এরপর মরণের দুঃসহ অবস্থান মাড়িয়ে দুজনে জীবনের পথে হেঁটে চলে। শাঁখা, পলাজাতীয় নিয়মিক ফোপরা অত্যাচার তোয়াক্কা না করে, আগ্রাসী রেলকে (রেল মানেই পড়ে থাকা লাইন। সুতরাং ‘রেললাইন’ বাহুল্য) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা চলতে থাকে অন্য এক আকাশ, ভিন্ন এক জীবন – পথের সামিল হয়ে। ‘ডানা’ গল্পের এমনই বয়ান। এখানে উল্লেখ্য, ব্যাকরণের খুঁটিনাটি মানলে ‘মেয়েটি’ আর ‘স্বামীটা’ লেখাই বাঞ্ছনীয় কেননা ‘টি’ আদরে ও ‘টা’ অনাদরে প্রযুক্ত হয়।
মহার্ঘ্য ইলিশ মাছের ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে একথালা ভাত সাবড়ে দেওয়ার রস-কথা আমাদের পরিচিত কিন্তু ‘খিদে’ গল্পে হাভাতে এক পরিবারের যে সব ছবি খাদ্যবস্তু এঁকে এঁকে দেখালেন গল্পকার তা নির্মম যা পাঠান্তে আমার মাথায় ঘা দিয়ে যায় প্রয়াত কবি রফিক আজাদের সেই দুর্মদ পঙক্তি (হসন্ত দিতে অপারগ হলাম) ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’। সমাগত রোববারের ছুটি – আলস্যরূপ মখমলি ভাবনায় শনিবার বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া ক্রমশ কীভাবে ফিরে যায়, রোববারের নানান কর্মচিন্তাচাপে – চাকুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের এই তিক্ত ছবিটাই ফুটে আছে শনিবারের হাওয়া ‘ গল্পে। নামগল্প ‘ মেচি ‘ নামের একটি ছোট্ট পোষ্যবিড়াল হঠাৎ বেপাত্তা হলে পারিবারিকজনেদের কাছে তেমন কোনও বেসুর ঠেকে না – ‘যে যার বুকের দরজা এঁটে’ নিরুপদ্রব থাকে। মেচি ফিরে এলে ফিরে আসে আমার বালকবেলার এক বিস্ময়কর স্মৃতি যেখানে ঠাকুরদা বারকয় বস্তাবন্দি করে বাড়ির কয়েকটি বেড়াল কয়েক মাইল পেরিয়ে দূরপথে ছেড়ে এলেও তারা যথারীতি ফিরে এসেছিল। একটা চালু কথা – বিড়ালের চোখ বেঁধে অন্যত্র ছেড়ে এলেও তা যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করে। এ গল্পেও সেই বাস্তবতা লক্ষণীয়।
‘হরিপদ কেরানি’ গল্পে স্বপ্নদীর্ণ হরিপদর কাছে পুরনো প্রেম পৃথা ফিরে এলে মনে হয় তার ‘শাঁখায় সে লেগে আছে।’ ( কী পেলব অনুভব!)। বাস্তবের পৃথা কিন্তু আসে না, আসার ভান করে মাত্র ; তাই সে ‘মিলিয়ে গিয়ে বহুদূর একটা তিনতলা বাড়ির বাসরঘরে ঢুকে’ যায়। এ গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘শুধু কেরানী’র বিয়োগান্ত ব্যঞ্জনা ভিন্নপটে সন্নিবিষ্ট। পথালাপের অমল সম্পর্কের অর্গলরুদ্ধতা ছিন্ন হয় আপন হাওয়ার তোড়ে – হয়তো শুরুতে মনে হবে এই ‘আগল’ গল্পটি বিশ্বাসভঙ্গের ; কিন্তু তা নয়। এ গল্প বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের। একটা বিটকেল পোড়া গন্ধ। পুড়েছে শরীররূপ মাংসপিণ্ড। পুড়েছে অন্তর্গত সত্তা। তা দেখতেই ভিড় ঠেলে চোখ উঁচিয়ে যে দেখে সে এক মধ্যবিত্ত চাকুরে, দিনান্তের ক্লান্তিশেষে যার পাওনা এক ‘পাশে শোওয়া’ স্ত্রী – ‘শরীর… এক ভালোবাসাহীন তীব্র নৈকট্য’।
এক ছারখার বিপ্রতীপতা – কোথাও যেন এই ‘ভিড়ের চোখ’ এ মিলে যায় দুটি সত্য অবস্থান, মেকি মোড়কে যা দৃশ্যমান হয় আমাদের চামড়া – চোখে। ‘বিনু মাসি( কাজ- মাসি)এলে বাড়িটা খোঁড়ায়।’ – একদিন না এলে ‘বাড়িটা দিশেহারা।’ – এরপর তার মেয়ে কাজে এলে ‘কাঁধ পালটায়। দিন নড়ে।’ তারপর সেও যখন আসে না, আসে শিলা । ‘এহেন তীব্র শব্দবন্ধে নির্মিত গল্প আমাদের রোজকার বাস্তবতা হয়ে সামনে দাঁড়ায়। আমরা কখনও ফুলে উঠি, চুপসে যাই কখনও বা। ‘শিলা’ কি কোনো একঘেয়ে পাষাণ – জীবনের প্রতীক যাদের না পেলে আমাদের মসৃণ প্রাত্যহিকতা নড়বড়ে হয়ে যায়! আমাদের ‘ঠিকানা’ অবলম্বনহীন হয়ে পড়ে? অণুপরিমাণ শব্দ সহযোগে নির্মিত একটি সার্থক গল্প – না, ‘ঘর’ ঠিক গল্প নয়, এক অক্ষীণ জীবনবোধ – তাৎক্ষণিক বিভ্রান্তিতে মানুষ যখন সম্পর্কে ফাটল ধরায় তখন সে বুঝতে পারে না, সেই সম্পর্ক আবার আর এক তাৎক্ষণিক বিপর্যয়ের সূত্রে কীভাবে জোড়া লেগে যায়। এটাই চলিষ্ণু জীবনের পাকদণ্ডী পথের নিকষিত হেম।
সাধারণত তুই- তোকারি সম্বোধনে যে প্রজাতির মানুষজন আমাদের আশপাশে থিকথিক করে তারাও যে ঘাড় ধরে আমাদের কিছু শিক্ষা দিতে পারে, ‘সুখের দাম’ তারই শব্দিত রূপ। এমনই এক রিকশোওয়ালা আছে এই গল্পে যার দিনগত পাপক্ষয়ের চাহিদা অতি নগণ্য, তাই গহিন সুখের সন্ধান সে জানে ও জানাতে চায়। দামি ডাক্তারের নির্দেশে তাই প্রাথমিক আপত্তি করলেও মানবিক খাতিরে সে চলমান হয়। হয়ে ওঠে পথচলতি শিক্ষক। একহাজারি ফি-এর ডাক্তারেরও হয় বোধোদয়। গল্পকারের বিস্ময়াবিষ্ট অন্তিম প্রশ্ন ‘কে জানে সে কী পেল!’ আসলে সে তো সবই পেল। হয়ে উঠল ‘চোখে আঙুল দাদা’।
এ প্রসঙ্গে আমার পরিচিত এক রিকশোওয়ালার কথা বলি যে কোনও ওজরেই পথের দূরত্বভেদে সওয়ারের কাছ থেকে দু টাকার বেশি ভাড়া নিত না। এই মহার্ঘ সময়েও। সেই মহান মানুষটি আমার কলমের ঘাড় ধরে তাকে নিয়ে একটি আখ্যান লিখিয়ে নিয়েছিল। ‘সাঁকো’ গল্পে যে সম্পর্ক -সেতু তা সরাসরি প্রজন্ম ছাড়িয়ে উত্তরপ্রজন্মে উত্তরিত। আবার এ নিষ্করুণ ছবি অথর্ব বৃদ্ধাবস্থারও যখন ময়ালমুখী অসহায়তা গ্রাস করে সরাসরি রক্ত- সম্পর্ককেও। আমাদের প্রায় ঘরেই এ ছবি অবিরলদৃষ্ট। তবে নাতির ইতিবাচক ভূমিকা দেখে মনে পড়ে সেই প্রচলিত আপ্তবাক্য যে ‘আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি’ বা ‘পোতা দাদাকা দুসরা জনম হ্যায়’। বিষম জীবনবোধের এক স্বল্পায়তনিক টাঁড় আখ্যান ‘নিহত জোনাকি’, দাম্পত্যের ঠুনকো পারস্পরিকতায় জারিত, বিপরীতগামিতা যার নকল অলংকার। ‘অবসরে অয়ন খোলে ’- কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা এক শুরুয়াত যা সুব্রতর গল্পবৈশিষ্ট্যের চিহ্নস্বরূপ। ছাত্রশূন্যতার অবকাশে ক্লাসঘরে গড়ে ওঠা বিষাক্ত বোলতার ( মৌচাক কেন!) বাসা বিশ্বাসের মন্ত্রবলে শিক্ষক রসিদবাবু ভেঙে দিতে পারলেও মন্দলোকের মধুচক্র ভাঙতে গিয়ে তিনি ক্ষতবিক্ষত হন। জয়ী মানুষের পরাজয়ের গল্প? না, বরং তা হাল না ছাড়ার ইতিকাহন এই ‘বোল্লা’।
মনখোলা মানুষের সন্ধানে এক বন্ধ – মানুষ, বিচ্ছিন্নতাবাদী কোভিড যাকে, যাদের একঘরে করে দিয়েছে। একজনকে সে পেল এবং তার ডাইরিতে লিখে দিল ‘ভালো’ আছে। লিখেই বুঝল, ভুল হল। অথচ পিছু নিয়েও চলমান লেখাটাকে আর ধরতে পারছে না – সঙ্গে চলে যাচ্ছে সব – কলজে, সময়, সমাজ – ফাঁস হয়ে যাচ্ছে সব। তারপর সেই ডাইরির মালিককে খুন করে দম নেয় সে। শান্ত হয় কেননা ‘আর কারও মনের কথা টুকতে পারবে না’ সে। এ গল্পের এক ভিন্নধর্মী শব্দবন্ধ ‘সার সার রাত লাগা বাড়ি’ যা তবলাবোলের টুকরাঢঙে বিশেষায়িত করে সুব্রতকে যার লেখায় এমনতরো টুকরা নিয়ত সঞ্চরনশীল। দুঃসময়ের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে সব, পড়শিরা হয়েছে অবিশ্বাসী, অসামাজিক। হঠাৎই ফিরে আসে সেই অলীকমানব যে এই সময়ের আলো খুঁজছে। পেয়েও গেল। প্রভুহীন, অভুক্ত ‘খসা পাতার মতো’ এক কুকুর আচমকা খাবার খুঁজে পায়। চকিতে যেন জ্বলে ওঠে ‘আলো’, জীবনের অন্ধকারপথে। বাথরুমের পুরনো দেওয়াল থেকে ‘একটা মুখ বেরিয়ে এল’। সে তেইশ বছর আগের ভাড়াটে লীনা। মস্ত গায়িকা হতে চেয়েছিল সে। তার দেওয়া নতুন ঠিকানায় গিয়ে বক্তা চয়ন খুঁজে পায় তাকে। লীনা তাকে ঠিক চিনতে পারে না। বলে, ‘সব বয়সে কি চেনা যায়?’
অথচ দেওয়ালের লেখাটি চয়ন মুছে দিতে গেলে লেখাটি মিনতি করে বলে ‘আমাকে মুছো না… মুছো না।’ জাদুময় transferred epithet সম্বলিত হ্যালুসিনেশনের এক জৈবনিক আখ্যান এই ‘দেওয়াল’। অমলিন ইমেজারিতে প্রস্ফুটিত অপর গল্প যেমন ‘পাঁচিল ডিঙোল / পা টিপে স্ত্রীর মধ্যে ঢুকল / একটা কালচে সাপ হয়ে গেল / সশব্দ ছোবল বসাল স্ত্রীকে’। তারপর নেতিয়ে পড়ে ‘দুই মরা বিষধর’। এখানেও transferred epithetময় সামূহিক বাক্যবন্ধের মধ্যে ঢুকলেই পুরো গল্পটি অনুধাবন করা যায়। এমনই একঘেয়ে প্রাত্যহিকতায় বর্ণিত ‘সুখ’ আড়ালে গিয়ে হাসতে থাকে।
‘নিক্কণ’ এক অসহনীয় গল্প যেখানে ভাইয়ের কিনে দেওয়া নূপুরের নিক্কণ চিনিয়ে দেয় ধর্ষিতা দিদিকে যেখানে ধর্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ করে সহোদর ভাই। ইতরেতর প্রাণী, পড়ে থাকা পথে মনুষ্যচরিত্র আরোপিত এই সামান্য আকারে বড় অণুগল্পে (চিতার জল) এক মৃত মানুষকে ধরা হয়েছে শ্মশানে যার ‘চিতা নিভছে না’। পথের কাছ থেকে এক বিবাহিতার ঠিকানা নিয়ে পাখি সেখানে যায় আর বউটাকে সব বলে। তার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক ছিল সেই মৃতের তাই তার জন্য চাই ‘একটু জল। চোখের জল।’ বউটি ঝরঝরিয়ে কেঁদে সেই অমলিন অশ্রু তুলে দেয় পাখিকে।
পার্সোনিফিকেশনের কষ্ট- মোড়কে এক মিষ্টি গল্প, অনেকটা ফেবল-এর ঢঙে বিবৃত। ‘পাড়ি’ তে যখন দেখি ‘লাটাইটা তাকে ওড়ায় রোজ’ তখনও ট্রান্সফার্ড এপিথেটের কথাই মনে হয়। ‘দিনটায় সন্ধে লাগছে’… বাঃ। ‘বেলা শেষের আলো ‘য় দুই অবসৃতের কথাচার। একজন অধ্যাপক, অপরজন ওই কলেজেরই দপ্তরি। তপোধীর আর নবীন যাদের অবসরের আড্ডায় সামিল হয় আরও কেউ কেউ, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তপোধীরের মনে পড়ে ছেলেবেলার বন্ধুদের কথা যেখানে ছিল না কোনও স্তরভেদ। তবুও আজ নাপিত লোকটি তাকে বিড়ি দিতে চাইলে কোথাও যেন তার বেধে যায়। বিপত্নীক সে বাড়ি ফিরেও নিঃস্ব বোধ করে কেননা ‘বাড়িতে এখন আর তেমন অপেক্ষা নেই। অপেক্ষা ছাড়া কি পা চলে? ‘কী নিগূঢ় বোধ! তাই বাড়িতে অন্যান্যদের কটাক্ষপাতে বিরক্ত তপোধীর আবার আঁকড়ে ধরতে চায় নবীনদের অনাবিল আড্ডা।
অগভীর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ নামকরণ – সম্বলিত ‘চোখের যত্ন নিন’ গল্পের শুরু বেশ গুরুগম্ভীর – ‘দৃশ্যের বাইরে এলে ঘটনা দেখা যায়’ – অনেকটা যেনো ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’। এক ধনীপুত্রের সঙ্গে আলাপিত একটি মেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে অপেক্ষারত ; মাঝে বিবেকের মতো একটি লোক। ছেলেটা আসতে দেরি করলে সে ভাবে ‘দেরিতে কি অপরাধ থাকে?’ এরপর ছেলেটা ঢুকলে মেয়েটি বেঁকে বসে। ছেলেটা ফিরে যায়। ‘মেয়েটা এখন ভিজছে।’ লোকটার প্রশ্নোত্তরে বলছে, ‘কাঁদছি কই। ধুচ্ছি। বড়ো নোংরা ছিল চোখে।’ সুগভীর শব্দপ্রয়োগে নিখাদ বয়ান। ঘটনার অন্ত্য বুঝিয়ে দিতে হয় না আর। ভরপুর জীবনে যখন অনিমেষের কাছ থেকে সুখ পালিয়ে যায়, না তা নয়, সে-ই ‘হঠাৎ সুখটা থেকে পালিয়ে’ যায় তখন দুর্ভর হৃদয়ে সে পিছনের পথে হেঁটে ফিরে যায় স্মৃতিচিহ্নসমূহের কাছে – টালির ঘর, কুয়োতলা, বকুলগাছ সকলেই যেন তাকে দেখে অবাক – হাসে, ফাটতে থাকে শিমুল তুলোর মতো। অনিমেষ ছুটতে ছুটতে চেনা নদীটির পাশে এসে বসে। নদী স্মিত হেসে বলে, ‘জানতাম তুমি ফিরবে’।
‘নদী’ পিছুটানের এক খিন্ন বয়ান। নবপরিণীত জীবনের সুখস্বপ্নদর্শন ও ভয়ংকর পরিণতিতে স্বপ্নভঙ্গের গল্প ‘ কৃষ্ণা’ সার্থক অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য – ভূষিত। নামকরণও যথার্থ। ঘোল খেয়ে, ঘুরপথে ফিরে আসার গল্প ‘ঘুরপথ’ যা চারটি ভাগে বিভক্ত যেখানে কিছু শব্দবন্ধ গল্পের গূঢ়ার্থ প্রকাশ করে যেমন – ‘সবই যায়’ (১)। ‘জীবন ফেরে না কোথাও, পৌঁছোয়’ (২)। ‘ বাড়ির সামনের রোদটা চুরি গেল’ (৩)। আর ‘সন্ধেলাগা দুয়ার’-এ সে ফিরে এসে বলে ‘একটু দেরি হয়ে গেল’ (৪)। এখন আর তার হাতে শাঁখা-পলা নেই। গানের খাতা নিয়ে ফিরে এসেছে সেই মানুষটির কাছে যে শেখাত জীবনসঙ্গীত। বাড়ির কাজের মেয়ে অনীতা। রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য গানাভ্যাস চলছে। ছেলের অসুস্থতা সত্ত্বেও অনীতা তাগিদে এসেছে। সে মানুষের মতো কেঁদে অভ্যাসকারীদের নকল প্রসাধন ধুয়ে দিচ্ছে। অতিথিদের জন্য দোকান থেকে সিঙ্গাড়া- মিষ্টি এনে বিতরণশেষে সে টুকুন পেয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হলে সে নতমুখ হয়। তবুও সে ‘প্রসাধন’ গল্পের ‘অনীতা’। শব্দব্যবহারের গাম্ভীর্যে উত্তরিত।
‘আনন্দ নিকেতন’ আর একটি হারানো জীবনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার গল্প যেখানে একদা অহংকৃত মি. সোম বারংবার এক নির্দিষ্ট পাহাড়ের কাছে আসেন এবং তার বিশালতা তাকে ক্ষুদ্রতার নির্বিণ্ণতায় কাঁদিয়ে ছাড়ে। আসলে সেই পাহাড়তলিতে একটি অনাথ আশ্রম আছে যেখানে এক সময় তার বউ অদিতি চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এসে আর বাড়ি ফেরে না, কেননা স্বামীর অহংবুদ্ধিলিপ্ত মস্তক ‘কোনও সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে গেলে’ বাধাপ্রাপ্ত হত। সোম এবার এসেছেন পুত্র আনন্দকে (দ্বিবিধার্থে ব্যবহৃত) খুঁজে পেতে এবং অন্য সকল অনাথ শিশুদের মাঝে তাকে খুঁজে পান (সেও কি অনাথ!)। কিন্তু নিচু দরজা দিয়ে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মানুষটা সহর্ষে ঢুকতে গেলে কানে আসে ‘দেখো, মাথায় না লাগে’। এভাবেই আড়কথায় অদিতি স্বামীর অহংবোধকে স্মৃতিপটে এনে তাকে বিদ্ধ করতে চায়। ছায়াবিলোনো গাছ ছেঁটে বানানো রাজপথ ঘেঁষে যে বহুতল বাড়িতে বধূরূপে চলে এসেছিল এক অচিন ফুলগন্ধিনী, তার নীরব মনের মানুষটিকে ছেড়ে সে এখন নির্গন্ধী। মধ্যেমাঝে সে পথে এলেও ছেলেটি পুরনো গন্ধের মোহাবেশ পায় না। রাজপথের পেষকযন্ত্রে হারিয়ে গেছে তা। তবুও এখনও সে ছায়াপথ খুঁজে ফেরে। এক বিষণ্নতা -ভরপুর রোম্যান্টিক বয়ান এই ‘ছায়াপথ’।
‘জানলা’ গল্পে ক্ষয়কারী পরিবেশ দূষণকে একটা ভয়ংকর -সুন্দর আখ্যানের মোড়কে মুড়েছেন গল্পকার যেখানে এক প্রকৃতি -কৌতূহলী স্কুলছাত্র গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসে জানলা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিপটে চোখ ফেলে মা- বাবার কাছে ভর্ৎসিত হয় ; তবুও সে জানে, বোঝে ‘পড়ার বাইরে পড়া আছে’। তা সত্ত্বেও নাচার অভিভাবকের হুকুমে সেই জানলা বন্ধ হয়ে যায়, পড়ার সময়টুকুর জন্য। এভাবে ছেলেটা মানুষ (!) হল। সরকারি চাকুরে সে এখন বিবাহিত। বাবা গত। বৃদ্ধা মা পাশের ঘরে। রাতের বন্ধ দরজায় সম্পর্ক হয়ে ঝুলে থাকে সেই জানলা। মৃত্যুমুখী মানুষটা বাইরের ছড়ানো জীবনকে টের পায়। ছেলেকে ডাকে। সে বলে, ‘আমি তো এখন পড়ছি’। মায়ের আকুতি আছড়ে পড়লেও জানলা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই প্রতিশোধস্পৃহ হয় সন্তান। গড় পাঠকের দুর্বল আঁতে ঘা লাগে কি?! গল্পের শুরুতে ‘সব্বোনাশ হয়ে গেছে’র অংশটুকু অবধারিত শ্লেষ – সরল তারাপদ রায়কে স্মরণ করায়।
মায়ান্ধ রহস্য ছাড়িয়ে ইমেজারিতে জড়িয়ে শুরু হয় ‘খেয়া’র গল্পমুখ – ‘রাত তখন স্খলিত খোঁপা ভেঙে ছাড়া চুলের মতো বিছানো।’ মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসা বিপ্র যুক্ত হয় এক বাঙালি বিদেশিনীর সঙ্গে যে তার হেঁয়ালিভরা বাক্যবাণে পীড়িত হয়, হয় উল্লসিতও। তাকে সহজে বিদায় জানাতে চায় না সে। কথাচারের মাঝে হঠাৎ মেয়েটি ভিডিয়োকল করলে বিপ্র চমকে ওঠে। ক্যামেরা অন করার আগে সে তার সামরিক পোশাক ও রাইফেল দেওয়ালের গা থেকে সরিয়ে ফেলে কেননা মেয়েটা যে দেশের তাদেরই সঙ্গে যুদ্ধ চলছে বিপ্রদের। সে চায় না তাৎক্ষণিকতায় উজ্জ্বল এই মধুময় সম্পর্ক রাজনৈতিক বাতাবরণের যূপকাষ্ঠে বলিপ্রাপ্ত হয় – মোহ- রেশ কাটাতে চায় না সে।
প্রবাহিত দীর্ঘ সময়কে সাক্ষী রেখে একটি কুলগাছ কীভাবে অজু আর বুড়িদির মধ্যে স্মৃতি – সেতুর বন্ধন ঘটায় তারই অম্লমধুর আখ্যান – বিজড়িত ‘কুলগাছ’ গল্প। বয়সকালে যে বুড়িদি জোয়ান ছিল, বৃদ্ধাবস্থায় সে প্রকৃত অর্থে বুড়ি হলেও অজুর কাছে মৃতা নয়, যথারীতি জীবিতা। পার্থক্য শুধু পেশাগত – অজু এখন মাস্টারি করে আর বুড়িদি এ বাড়ি, ও বাড়ি বাসন মাজে। ঘুমন্ত পাড়াকে মাঝরাতে ঠেলে দিয়ে কুয়োতে পড়ে যাওয়া এক কুকুরছানা কেঁদে চলে অবিরাম। যুযুধান দুই হিন্দু – মুসলিম পরিবারের দুটি ছোট্ট মেয়ে ছানাটিকে খাওয়াত রোজ। তাই তাকে বাঁচাতে দুই পরিবারের দাসবাবু ও আলমভাই তাকে উদ্ধারের চেষ্টায় লেগে পড়ে। ছানাটির কান্নার সঙ্গে একটি মেয়ের কান্না যেন মিলেমিশে যায়। উদ্ধরণিত হয় ছানাটি কিন্তু তাদের সম্পর্কের উদ্ধার ঘটে না। ভাব হয় না তাদের মধ্যে। কেননা রাতের বিপন্ন মানুষ একত্রে মিললেও সকালে তারা ঢেকে যায়। কী গভীর অনুভবী কথা! দুটি মিলতে চাওয়া মন, অমিলিত থেকে হুতাশনে পোড়ে। বুক ফাটে, মুখ ফোটে না। ছেলেটা একইরূপ থেকে যায় যেহেতু তার পথে কেউ পড়েনি তেমন করে। মেয়েটা অর্থাৎ রুবি ‘এখন রায়, কপালে সিঁদুর’। সংক্ষেপে পট পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। ওদিকে ছেলেটা বলে, ‘প্রতিদিন ভালো থাকি, অভ্যেসের মতো’ – গল্পকার পাঠককে বুঝিয়ে দেন রোজকার রেখেঢেকে ভালো থাকাটাও নিয়ত অভ্যাসের বিষয় করে তুলতে হয়। আবার রুবি সীমন্তের সিঁদুরসহ বাহ্যিক সব আয়োজনে ভূষিত হলেও প্রতারিত জীবনের মতো তার সারা বুক খালি হয়ে যায়।
‘জানলার গার্হস্থ্য পর্দাগুলো’ হয়ে ওঠে গভীর ব্যঞ্জনাময়। গল্পকারের বেশ কয়েকটি গল্প এই ‘গরাদ’-এর মতোই ভাবনা-জারিত। ‘সারা বছর দিনটা মোছা। শুধু আগের রাতে ফুটে ওঠে’ – ট্রান্সফার্ড এপিথেটের আলংকারিক প্রয়োগে ‘হাওয়া’ গল্পের এটাই শুরু। যে কোনও তন্নিষ্ঠ সান্দ্র পাঠক এই বাক্যটি পড়লেই বুঝে নিতে পারবেন, এ কোনও বিশেষ দিন। কারও জীবনের। এখানে খোকার জন্মদিন। আয়োজন -নিমন্ত্রণে সম্পন্ন হয় তা যথাযথ। সেই খোকা সময়ের টানে বয়স্ক হয়। শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনকে মান্যতা দিয়ে ; কিন্তু জন্মদিন তো এসেই যায়। অথচ তারা আর কেউ নেই এখন। লাঠি হাতে একা একা সে ‘হারানো কোলাহল খোঁজে’। একমাত্র মেয়ে বিয়ে হয়ে বাইরে। আজকেও বয়স্কা স্ত্রী ঝুঁকে ঝুঁকে একান্তে ‘খোকা’র প্রিয় পায়েস রাঁধে। প্রয়াতা শাশুড়ি তাকে যেন বলে ওঠেন, ‘খোকাকে পায়েস দাও’। সেই পায়েস খেতে খেতে খোকা যেন সব হারানো প্রিয়তা ফিরে পায়। চরাচর জুড়ে এক স্মৃতিবায়ু সব ফিরিয়ে দেয় তাকে। অশ্রুসিক্ত গলায় সে বলে, ‘প্রণাম করো ’। এমন স্মৃতিতাড়িত হ্যালুসিনেশন সুব্রতর বেশ কিছু গল্পে চারিয়ে থাকে।
‘অনশনের গান’ স্বপ্নপূরণ তথা স্বপ্নভঙ্গের গল্প। ‘বেড়ানো’ আর ‘বেরোনো’ বিষয়ে পার্থক্য – জ্ঞান লাভের গল্প। কোথাও কি সাম্প্রতিক ন্যায্য চাকুরিপ্রার্থীদের দীর্ঘ অবস্থানের প্রতি ইশারা করেছেন লেখক? জানি না, এ গল্প কবেকার রচনা! ডিভোর্স, ছাড়াছাড়ি। একটি বিবাহিত সম্পর্ককে বিদায় জানানোর মোক্ষম সময়ে রূ- কে তার স্বামী মোবাইলে ‘মেসেজ’ (নামগল্প) পাঠায় ; সম্পর্ক রাখার দায় ভাগ করে নিতে বলে রূ- কে আর বলে এই বন্ধন রক্ষা করতে সে ‘বারবার নামানো ফণার মতো দান ছেড়ে’ দেয়। তবুও সে গমনোদ্যত স্ত্রীকে বলে যে চলে গেলেও সে যেন বেশি দূরে না যায় কারণ ‘সম্পর্ক তো দেখা হলে শেষমেশ হাত ধরে টানতেই ভালোবাসে’। মেসেজটি দুবার পড়ে রূ জুড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়; আর অমনি হাতে ধরা ডিভোর্সের কাগজগুলো পাখির মতো উড়তে থাকে যার একটি খোলা আকাশের দরকার ছিল। দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙনের এই চলতি সামাজিক সমারোহের মাঝে এ গল্প ইতিবাচকতার স্নিগ্ধ সন্ধান দেয়।
পূর্বতন গল্পের বিপ্রতীপতায় দাঁড়িয়ে ‘সোনাঝুরি’ মধুর বৈবাহিক সম্পর্ককে শ্লেষবিদ্ধ করে রচিত যেখানে ক্যানসার – আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী সরকারি চাকুরে স্বামী মৃত্যুর আগেই বিবাহ রেজিস্ট্রিকৃত করতে চেয়ে উদ্যোগ নেয় যাতে তার চাকরিটি সহজেই তার বিধবা স্ত্রী পেতে পারে। আর অন্যদিকে বউটা স্বামীর মরণক্ষণে ডুকরে কেঁদে উঠে তাকে আঁকড়ে ধরলেও হাতে ধরা জরুরি কাগজপত্র সাবধানে উঁচিয়ে ধরে যাতে করে চোখের ভেজাল জলে সে সব ভিজে নষ্ট না হয়। শেষে লেখক যথার্থ সিদ্ধান্তে আসেন – মানুষ এখন আর ‘কারও জন্য নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারে না’। প্রলেপ দেওয়া ঝুরঝুরে পারিবারিক সম্পর্কের এ এক কঠিন বাস্তবোচিত বয়ান। সুব্রতর অধিকাংশ গল্পের মতো এই ‘সরীসৃপ’ -এরও প্রথম পরিচ্ছেদটি পড়লেই অনুধাবন করা যায় এক সদ্যবিবাহিতার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ – তার ফেলে আসা প্রেমিকপ্রবর নিজেকে গুটিয়ে লুকিয়ে থাকে। সে যেন তার অপেক্ষার অভিজ্ঞানকে ধরতে পারে না, পৌঁছুতে পারে না তার কাছে ; অথচ সারাদিনের হাবিজাবি হল্লাশেষে প্রতিবেশ স্তব্ধবাক হয়ে ‘সংসার ঘুমোলে বারবার ফিরে’ যায় তার কাছে। নববিবাহিতার স্বামীর বাইকের পেছনে বসে চাপা পড়তে যাওয়া পুরনোকে ঠেলে সরিয়ে সে যখন একবারও তার দিকে না ঘুরে তাকিয়ে স্বামীর কোমর জড়িয়ে চলে যায় তখনও কিন্তু সে শোনে ‘ডানা ঝাপটার মতো একটা দু- চাকার শব্দ’।
চেপটে মরার কী গভীর অনুরণন এই বাক্যে গ্রথিত! ভিনরাজ্য থেকে গ্যারাজের কাজে আসা গোতু অর্থাৎ গৌতম ‘কালি মাখে। বাঁচ’ (নিটোল আণুগল্পিক বাক্যবিন্যাস)। এই গোতুই বিকেলে সেজেগুজে একটি ক্যারামের স্ট্রাইকার পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়ে তার একঘেয়ে প্রাত্যহিকতা থেকে। ক্যারামবোর্ড পায় না বলে তার প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পায় না। হেনা নামের যে নেপালি মেয়েটির চায়ের স্টলে সে চা খায় সেও তেমন পাত্তা দেয় না তাকে। একদিন এই গোতুই ক্যারামবোর্ড পেয়ে অত্যাশ্চর্য গতিতে প্রমাণ করল নিজেকে। এবারে আগ্রহী হয় হেনা। একান্তে কথা বলতে চায় তার সঙ্গে। জানতে চায়, সে কে! সারাদিন গ্যারাজে যে কালিঝুলি মাখে বিকেল হলেই সে পালটে যায় কেমন করে! গোতু তাই উত্তর দিতে গিয়েও পারে না – পালটে যায়। হয়ে যায় ‘অন্য মুখ’। গল্পের জাদুবৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
‘জ্বর’ গল্পেও সেই হারিয়ে যাওয়ার আখ্যান। শহর ছাড়িয়ে পাড়াতুতো দাদার সঙ্গে মেলায় ঘোরা মেয়েটি বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়, একসঙ্গে। তারপর ভিজে জ্বর আসে তার। পরে সে পরস্ত্রী, ব্যাঙ্কের চাকুরে, দূর নক্ষত্রের মতো দূরবাসিনী। এক আষাঢ়ে পিতৃগৃহে এলে দেখা হয় পুরনো দয়িতের সঙ্গে। কথা হয় সামান্যই। স্মৃতিপথে ভেসে ওঠে বৃষ্টি, আবার মুছেও যায়। ‘রাতে মেয়েটির ফের জ্বর আসে’। জ্বর এখানে সিম্বলিক। এ গল্পেও দুটি শব্দবন্ধ বেশ আকর্ষক – ‘বাড়ি তাই সুতো ছেড়েছিল’ আর ‘মেঘের গলায় যে রাগ, আসলে বৃষ্টি’। এমন সব বাক্যালংকারের জন্যই সুব্রতর গল্প টেনে রাখে, এ কথা মানতেই হয়।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত প্রতিবেশে অমিয়-মরিয়মের গল্প ‘অভিমান’। ধর্মীয় কাটাকাটিতে কারা অপরাধী তা নিয়ে একপ্রস্থ ক্যাচালের মাঝেই অস্থির মরিয়ম নিশ্চিত, অমিয়র বাঁচার সম্ভাবনা নেই কেননা মুসলমান – অধ্যুষিত এলাকায় সে কর্মরত। গল্পের শেষে অর্থাৎ টানটান উত্তেজনান্তে জানা যায় কিছু উদারচেতা মুসলমান তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমন তো হয়, কতই হয়। তবুও এই স্বস্তি- খবর পেয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে মরিয়ম যা প্রকৃত অর্থেই ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে ওঠে লেখকের কলমে। এই বিশেষ শব্দটা যেভাবে নেতিপীড়িত সেখানে এমন ইতিবাচক অর্থবহতা গল্পটিকে জোরালো মাত্রা দেয়। এক প্রস্থিত ভিখিরিকে ফিরিয়ে এনে ভিক্ষাদানের বিরল ঘটনায় ভাস্বতীর আধিক্যেতাকেই দায়ি করে দত্ত- কাকিমা। তার মতে এটা না করলে ‘ভিক্ষেটা দিতে হতো না, লাভ হতো’। পক্ষান্তরে ভাস্বতীর সহাস্য প্রশ্ন- ‘লাভবান অপরাধী হয়ে বাঁচা যায়?’
তারপর সে ভিখিরিহীন দেশের এক মিষ্টি স্বপ্ন দেখে যা চকিতেই দত্ত – কাকিমার সশব্দ গজগজানিতে ভেঙে যায়। শেষ বয়ানের মাঝে দীর্ঘ ফাঁক থাকলেও অন্তিম লাইনটি বুঝিয়ে দেয় দত্ত- কাকিমা তার ধারণায় আঘাত পেয়েছে যখন গরিব ভাইকে তার স্বামী গিয়ে বলে, ‘তুই কিছু টাকা রাখ না!’ এমন ‘অপরাধবোধ’ আমাদের শিক্ষিত করে কি? পূর্বা > অভ্র > মানতা > অভ্র > পূর্বা : এভাবে দিকচিহ্নিত করলে গল্পশুরুর বাক্যটির ধোঁয়াশা কেটে যায় যেখানে আছে ‘ভুলের মতো বছর তিন, পূর্বাকে ফেরাল।’
বিবাহিত পূর্বাকে দেওর জাপটে ধরলে স্বামী-শাশুড়ি মিলে তাকে জ্বালিয়ে দেয়। তার পোড়া শরীর সারলেও ‘আগুন নেভেনা’। পুরনো অভ্রকে সে সামান্য মাইনের অনাথ আশ্রমের কাজ করতে বললে সে চাকরির ইন্টারভিউয়ের বাহানা দেয়। মানতার অপেক্ষাও তার মন জুড়ে থাকে। কিন্তু সে চাকরি পায় না। মানতাও তাকে ছেড়ে যায়। এরপর অভ্র পূর্বার চৌকাঠে পা রাখে। গল্পকার বলছেন, এভাবে সে ‘আগুনটার ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর পুড়তে পুড়তে দেখল, ভিতরে কী আলো!’ জীবনের পাকদণ্ডী গোলোকধাঁধা শেষে সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে ‘খালাস’ হয় অভ্র।
গল্পের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় আমার আলোচনাও। খালাস হই আমিও। শেষত শব্দকার অসীম রায়ের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হয়ে বলি, সুব্রতর এই গল্পাবলির নিঃশ্বাস অবশ্যই পাঠকের গায়ে এসে লাগবে।
বিপ্লব বিশ্বাস : লেখক ও সমালোচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
আরও পড়ুন…