মূত্র পদাবলি : কয়লাখনি অঞ্চলের অমলিন দলিল

লেখা মানে তো অভ্যেসের আরাম আর কিছু কৌশলের পুনরাবৃত্তি নয়, প্রথাগত গল্প বলার কৌশলগুলিকে অস্বীকার করার প্রতিনিয়ত পরীক্ষা। প্রথাগত গল্প বলার মধ্যে অভ্যেসের আরাম আর বস্তাপচা ক্লিশের পুনরুচ্চারণ ঘটে চলেছে। মাটি তথা মাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের খোঁজ হারিয়ে ফেলা কলমচিদের অবশ্য সেই একঘেয়েমির গোলোকধাঁধা থেকে বেরোনোর পথ থাকে না। তবু মুষ্টিমেয় ক’জন মাত্র লেখকই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল! তন্মধ্যে হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম। মাটির সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। আজ আমাদের অভিনিবেশের কেন্দ্রে অবশ্য ওঁর গল্পগ্রন্থ ‘মূত্রপদাবলী’।

শরীরের অন্যতম রেচন পদার্থ মূত্র, সেটিও যে আবার কোনো রচনার কেন্দ্রে থাকতে পারে এবং ওই ঘৃণ্য বর্জ্য নিয়ে পদ রচনা হতে পারে তা এই নতুন শতকের আগে ভাবা যায় নি! প্রচলিত ধারণা ছিল, নামকরণ ও মুখপাতের কাব্যময়তা পাঠপ্রস্তুতিতে সহায়তা করে। গল্পকার হিরণ্ময় বোঝালেন, নিতান্ত অকাব্যিক ভঙ্গিতে শুরু করেও গল্পপাঠে প্ররোচিত করা যায়! তবে এখানে মূত্র ঘৃণ্য বা বর্জ্য নয় , পীড়নদগ্ধ প্রান্তিক পরিসরের প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্রও বটে। ব্যাপারটিকে বোঝার জন্যে আমরা কিছুদূর হাঁটবো হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ ‘মূত্র পদাবলী’র সঙ্গে। কখনো শ্রমিক হয়ে, কখনো কৃষক বা চাকুরীজীবী হয়ে কখনো বা কলেজ ছাত্র, কখনো আবার নিছক খবরের কাগজ কাগজ পড়া তার্কিক হয়ে। এই ধরণের যতগুলি সাংস্কৃতিক ঝিল্লির বহুত্ব থেকে আমরা গল্পগুলির দিকে তাকাবো, দেখবো ঝিল্লিগুলি পরস্পরকে গ্রাস করে ফেলছে না, বরং পরস্পরের মিশেলে থাকছে বহুক্ষণ! যাহোক, সকলেই তো যে কোনো টেক্সটকে একইরকমভাবে দেখেন না। হাইজেনবার্গ কথিত Observer Effect মাথায় রেখে পাঠকগণ এই আলোচনার সঙ্গে হাঁটবেন বা থেমে যাবেন তো বটেই।

গল্পগ্রন্থটির প্রথম গল্প– ‘ছুরি -কাঁচি’। কয়লাখনি সংলগ্ন অঞ্চলের গল্প। কয়লাখনির ওপরে মাটি, সেই ভূস্তরে কোলিয়ারি কর্মচারী নন্দীবাবু, নিউট্রাল কমরেড বাপ্পা মাস্টার আর কয়লাখনির বাইরে এবং ভেতরের অন্ধকারের জীব লুলা, নফরা, মড়িরামদের গল্প। সমগ্র গল্পগ্রন্থটিতেই ধূয়ার মতন বারবার ফিরে আসে লুলা, লুলার সঙ্গীসাথীরা ( ‘লুলার তাহারা…আর তাদের মোতার গল্প.’) প্রথমে লুলার সঙ্গে পরিচয় করে নেওয়া যাক। ‘… লুলার কর্মশালার প্রথম কোর্স কোলিয়ারীর কয়লা চুরি। চুরি হওয়ার জন্যেই তো ইসিএলের জন্ম- চুরি চুরি খেলা শেষে অল্পস্বল্প রেলে চুরি তারপর পকেটমারি, ছিনতাই, তারপর যার যেমন স্কিল….! অসামাজিকদের সামাজিক স্রোতে ফেরানোর কর্মসূচিতে লুলা বামফ্রন্টের সংশোধনাগারে আসে এবং অচিরে দলকে চোখের মণির মতো রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব পালন করে দলের পতন অন্তে এখন টিএমসিতে। গুণীলোকের চিরকাল কদর। গুণীলোকের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চাই।.. সরকারি দলে না থাকলে গুণীলোকের গুণ ঠিকঠাক প্রকাশ পায় না। সরকারি দলের গৌরবে মণি মুক্তা তো লুলারাই, তাদের ফোকাসেই পার্টির জৌলুস।

হুড়ুম বলে, তুমার মতন কবে লুটব লুলাদা?

–উটাই ভরম। লুটবার তুই কে রে? তুই শালা লুটমারের যন্তর। ‘এই উপলব্ধির জেরেই লুলা থানার বড়বাবুকে বলতেই পারে, ‘গরিব লোকের সিনায় খুনখারাবি হবার লয়। হামলোক জানে সার, কী তকলিফে বুকের ভিতর জানটার ধুকপুকি জারি রাখতে হয় – সে জান কি লিয়া যায় সার? দেখ সার, সময়টা কভি এমন বুরা হতে পারে না যে চাইলে ভালো থাকা যায় না। পার্টিগুলোর কাজই হল সময়টাকে বুরা করে দেখানো আর ভালো দিন আনার খোয়াব ছিটানো। দেশটা যে কি চাইছে… কি যে বদলাও, কি যে উন্নয়ন…কি যে আচ্ছে দিন… আমার বাপও চুরি ডাকাতি করত, দাদুও ছিনতাই করত, আমিও ত…’ আবার, অন্যত্র দেখি – বিপ্লবীয়ানা ছেড়ে এখন নিউট্রাল কমরেড বনে যাওয়া বাপ্পা মাস্টার বোঝাচ্ছেন, ‘টাকায় ঘটানো যায় না এমন অনর্থ আছে রে লুলা? জলকে দূষিত করা হয়েছে জল নিয়ে ব্যবসা করবে বলে। বাতাসকেও ব্যবসার সামগ্রী করা হবে জলদি, দেখে নিবি। জীবনকে মহামূল্যবান করে তোলা পুঁজিবাদের লক্ষ্য। পুঁজিবাদ কোন হিতৈষীর ছলে তোর সাহায্যে হাত বাড়াবে বুঝতেই পারবি না।’

গল্প শুরু হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট ওপেন কাষ্ট কোলিয়ারীর মেশিনের খোঁড়াখুড়িতে বিপর্য্যস্ত জনজীবনের বিরক্তি নিয়ে। গল্প এ জায়গায় এসে আর স্থানিক রইল না। আসলে, আদি, মধ্য, এবং অন্তের স্পষ্ট পরিচ্ছন্নতার পরিবর্তে বহমান জীবনকে, বয়ে চলা মানুষকে গল্পের ঘটনাক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কাজটি অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। মেলাতে গিয়ে দেখি, ‘ভোটের অস্ত্রে ক্ষমতা দখল করলে কমিউনিস্ট, বুর্জোয়া ভাই ভাই। রাষ্ট্র সুরক্ষার, উন্নয়নের জন্য, প্রগতিশীলতার জন্যই তখন এইসব রেপ কিংবা খুন সংবিধান সম্মত। রাষ্ট্রীয় নিয়মেই রেপ কিংবা মার্ডার না হলেও হয়েছে অথবা হলেও হয়নি – উভয়েরই রাষ্ট্র তখন ছোটো ছোটো ম্যাপের টুকরো।’

আজকের পাঠক তো কাহিনীর প্রত্যাশায় থাকেন না, গল্পশরীরের কাঠামো উপচে কী বার্তা বেরিয়ে আসে সেদিকেই তাঁর করা নজর। এই বার্তা সম্প্রসারণের কাজটি নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে টুকরো বা ভগ্ন দৃশ্যর কোলাজটিই বেশি জরুরি। সেখানে লেখকের টানা narrative গল্পের গতিকে অনাবশ্যক মন্থরগামী তোলে। তাই আজকের গল্পে কাহিনী শোনার প্রত্যাশা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে ওঠে। খুব স্বাভাবিকভাবেই হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মকে বুঝতে গেলে এই তথ্যটি মাথায় রাখতে হবে। হিরণ্ময় তাঁর টেক্সটকে কাহিনীর ঘেরাটোপে আটকে রাখেন না। পরের গল্প, ‘লাফান্ডু’। ‘লাফান্ডু’ শব্দটি লোফার বা ‘ফোর টোয়েন্টি’র সমগোত্রীয়। গোদা বাংলায় অশিক্ষিত, নিম্নস্তরের মানুষ। হিরণ্ময়ের গল্পের পটভূমি কোলিয়ারী অঞ্চল, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আসানসোলের লাগোয়া কালিপাহাড়ি এলাকা, গল্পের বিষয়, উল্লিখিত এলাকায় জীবিকা নির্বাকারী মানুষজনের যাপন অভ্যাস।

কোলিয়ারী মানেই যেমন মাটির নিচের বৈধ অবৈধ কয়লাখনি, তেমনই মাটির ওপরে সার সার একতলা বা দোতলা বিবর্ণ কোয়াটার্স। এই কোয়াটার্স গুলির বহুকাল ধরে সংস্কার করা হয় নি / হয় না ফলে অধিকাংশই পতনোন্মুখ। ই সি এলের খাতায় সেগুলি এবানডনড, ইললিগ্যাল এবং অকুপায়েড এই তিনটি গোত্রে বিভক্ত। শ্রমিকদের থাকার জন্যে বিতরিত কোয়াটার্সগুলি যেমন আছে, তেমনই ভগ্নদশার বিপজ্জনক বহু কোয়াটার্স যেগুলি এবানডনড সুতরাং আর এলট করা হয় নি অথচ গায়ের জোরে দখল করা হয়েছে। ফলে এই কোয়াটার্সগুলি ইললিগ্যাল তকমা পেয়েছে। ওই সমস্ত পরিত্যক্ত কোয়াটার্স গুলিও কিভাবে লাফান্ডুদের অর্থাগমের উৎস হয়ে দাঁড়ায়, সেই নিখুঁত প্রতিবেদনে গল্পের সূচনা–‘কথা হচ্ছে পোসেশনের দিন মালিক শ্রীযুক্ত শ্যামলাল বাউরি এক হাতে ঘরের চাবি এবং ওপর হস্তে লছমী (চার হাজার ) লেনদেন করে উভয় পক্ষে মিঠাই বিলোবে। বাঞ্চোৎ নিম্নচাপ সব প্ল্যান ভেস্তে দিল। (নিম্নচাপের কারণে লাগাতার বর্ষণের ফলে ফলে ছাদ চুইয়ে জল পড়ে মেঝে থৈ থৈ!) মাতলু চকিতে ঘরে পা দিয়ে ততক্ষণাৎ বেরিয়ে এসে শ্যামলালের কলার চাপে, ‘বহেনচোদ! রুপিয়া ওয়াপস কর। ঘর নেহি লেঙ্গে।

–তুই শালা তো ঘর দেখেই এডভাঞ্চ দিয়েছিস।

–এমন পানি গিরতৌ, তুমি হারামি বোলা?

–বর্ষাৎ কা দিন, পানিই ত গিরব্যাক। পিসাব ত গিরে নাই। এডভাঞ্চের লছমি রিটান হয় না। লেনা হ্যায় তো লো, নেহি তো ভাগো!’

পরিষ্কার কথা! গা জোয়ারি। এই ভূখন্ডে শ্যামলাল আর রবিয়া জুটি যা স্থির করবে সেটাই আইন। ‘কলিয়ারীর কোয়াটার বেচা যায়, বিচে রিটান নেওয়াও যায়। কেনাবেচা সহ দুনিয়া জয় করার তত্ত্বটি শ্যাম -রবিয়া ম্যানিফেস্টো হিসেবে বহুদিন চলেছিল কোলিয়ারীতে’ ……এই গায়ের জোরে দখল করে নেওয়ার ইতিহাস সুপ্রাচীন, বলা যেতে পারে প্রাক ব্রিটিশ যুগ থেকে। ‘দ্বারকানাথ কেলো – গণেশ উল্টে বেলগাছিয়ায় রিটার্ন হলে রানীগঞ্জের কোল প্রিন্স হয় বেঙ্গল কোল কিম্পানি। তাঁদের প্রায় অধীনে মনসবদারহেন গুজরাটি পাঞ্জাবী মাড়োয়ারি পারসিদের এক আধটা কয়লাখনি। কয়লার পুরো বাজারটাই বেঙ্গল কোলের, মনসবদারদের বিক্রিবাটা নাই…’ এর কাছে, ওর কাছে টাকা নিয়ে একই খাদানের মালিকানার চুক্তিপত্র দুজনকেই দিয়ে মালিকের হাওয়া হয়ে যাওয়ার খেলা! দুজনেই দখল নিতে এলে পহেলবান লাগিয়ে চুক্তিপত্র ছিঁড়েছুঁড়ে দুজনকেই ভাগিয়ে দেওয়ার গল্প সেই অতীতকাল থেকে আজকের রবিয়া, শ্যামলাল অব্দি চলে আসছে। শুধু কি কোয়াটার্স, নারীদেহের ফাঁদে ফেলে বোকাসোকা পুরুষদের কাছে টাকা আদায় থেকে ভোটের রাজনীতির ময়দানে একবার এ দল, একবার ও দলে ঢোকা বেরোনো, সর্বত্র এই লাফান্ডুরা বিরাজমান! ‘চারিদিকে একটর গায়কদের মতন বাবুল সুপ্রিয় গায়ক যখন, জিতে গেল। আসানসোলের প্রেস্টিজ পাংচার করে দোলা সেনও রাজ্যসভায় এমপি, শ্যাম রবিও ঝুঁকে গেল বিজেপির দিকে।’ আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিখুঁত প্রতিবেদন দেখি এখানে। ‘সারদা–নারদার ঝাপটায় শুনশান সিপিএম অফিস যখন জেগে উঠছে, লোকজনও ভালো হচ্ছে মিটিং মিছিলে, মার্কসবাদের ভারে গম্ভীর কমরেডের সমীপে শ্যামলাল বলল, ‘আমরা সিপিএম।’

–জানি তোমরা ভুল করে চলে গেসলে। সর্বহারার শেষ আশ্রয়…

–ভুল আবার কি বাঁড়া? সব ঠিক। বলতে দিলে তো কমরেডকে, পদনা টেবিল থাবড়ায়, আজ থিকে ক্যালা আমরা সিপিএম। সোবাই। জিন্দাবাদ! ইনকিলাব!

পার্টি অফিসেই বিপ্লব হয়ে গেল ছোটামোটা।’

নির্বাচনমুখী রাজনীতির অন্তসারশূন্যতাকে এমন নিপুণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করাই শুধু নয় গল্প এবার বাঁক নেয় অন্য দিকে। আমরা কাহিনী বলতে বসি নি, আমরা শুধু কথন সৌন্দর্যের কিছু নমুনা তুলে ধরে গল্পটির অনোন্যতা সম্পর্কে আভাস দিতে চাই। তাই বলি, দুই লাফান্ডু, শ্যামলাল সাফাইকর্মী আর ক্রমে রবিয়া ট্রাফিক ভলান্টিয়ার পুলিশের চাকরি পায়। তবু ‘দুজনেই ভেতরে ভেতরে বড়ো অশান্ত। নির্বিবাদ জীবন চে -র ও পছন্দ ছিল না। রাইফেল তুলে নিয়ে বেঘোরে মরাও শান্তি। বেঁচে থাকার ইয়ার্কিতে শ্যামলাল ক্রুদ্ধ, রবিয়াও ক্রুদ্ধ।’ গল্প এবার আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কঙ্কালসার অবয়বের ঢাকনা খুলে বাঁক নেয় অন্যদিকে! আমাদের পরবর্তী নজরে গল্প– ‘সরোরিটি’, অর্থ –ভগ্নীত্ব। নিত্য ব্যবহার্য ইংরেজি শব্দগুলির তালিকায় ‘সরোরিটি’ শব্দটি পড়ে না তবু এরকম একটি নাম বেছে নেওয়ার মধ্যে লেখকের এই অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে লেখক তাঁর এ গল্পটির জন্যে দীক্ষিত পাঠকদেরই চাইছেন।

গল্পটি একটি নামহীন মেয়ের গল্প! নাম থাকলেই তো সে বা সেটি চিহ্নিত হয়ে গেল! পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ এভাবেই সমস্ত কিছুকে চিহ্নিত করতে চায়। মেয়েটি, তার দাদা আর তাদের মা, এই তিনজনের গল্প।তাদের আপাত বিচ্ছিন্নতার অনুঘটক হিসাবে রয়েছে মোবাইলে নানান আকর্ষক প্রোগ্রাম। কাহিনীরেখা এটুকুই। গল্পটি একটি নতুন তত্ত্বের কথা বলে। প্রচলিত যাপন অভ্যাসকে প্রশ্ন করে। নামহীন চরিত্রগুলি প্রচলিত সমাজবিদ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ‘মেয়েটির একটি নাম দেওয়া প্রয়োজন। নামকরণে নামধারীর কোনো ভূমিকা নেই, নাম না থাকলেও সে তো কেবল হোমোস্যাপিয়েন্স, সে কেবল হিউম্যান জিওগ্রাফি। একটা ক্যানিস লুপাস ফেমিলিয়ারিস কেবল নামের গুণেই বিশিষ্ট হয়ে যায় যেমন নিউটনের ডায়মন্ড, যেমন প্রথম মহাকাশচারী লাইকা। প্রাণীবিদ্যা কিংবা ভূগোল থেকে তার ইতিহাসে উল্লম্ফন ওই নামের গুণেই।’ গল্পটি চিন্তাশীল পাঠকের মধ্যে এক নতুন ভাবনার উদ্রেক করবে।

আমাদের পরবর্তী আলোচ্য, নামগল্প ‘মূত্র পদাবলী’। এখানেও সেই ‘লুলা ও লুলার তাহারা’ ‘কালিপাহাড়ি মোড়ে জি টি রোডের ওপর নির্ণিয়মান ফ্লাইওভারের ওপর একটি বোতল নিয়ে,….থুথা নামের পাতলাদুবলা মতন চ্যালাটি সম্প্রতি যোগ দিয়েছে বলে ভক্তি অনেক বেশি। প্রথমে অন্ধ সেজে ভিক্ষে তারপর হিজড়া সেজে লোকাল ট্রেনে ডেগাংডুঙরিদের চড়থাপ্পড় মেরে পয়সা কামাই করত। কী মন গেল, লুলাকে একদিন ইংলিশ খাওয়াল, তাইতেই রুজি বদল।

–বকাচদা! সিঙ্গাপুরি কলার মতন মাল থাকতে হিজড়া সাজিস! অমন রোজগারে কুত্তা মুতুক!

–রোজগার লিয়ে বাত। যেথায় কামাই হয় সেটাই বিত্তি। আর কন শালা রে মরদ! হিজড়ায় দেশটা ভরে গেলছে।

নকলি দুদ খুলে হাওয়া লাগায় থুথা।’

আসানসোল ঢোকার মুখে কালিপাহাড়ি নামের গ্রামটির ওপর লম্বালম্ম্বিভাবে নির্নিয়মান ফ্লাইওভার এবং তার জেরে উৎখাত হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ ও তাঁদের জীবিকা এ গল্পের প্রেক্ষাপট। যেকোনো ধরণের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির রাস্তার দুপাশে তো তাল রাখতে না পারা পুরনো মানুষ আর পুরনো জীবিকাগুলির এই হালই হয়! তাই তারা এই তথাকথিত উন্নয়নের ওপর এক ধরণের বিদ্বেষও পুষে রাখে। এই ফ্লাইওভারটির নিচের অন্ধকারে লুলার জামাইবাবুর অর্থাগমের একমাত্র উৎস দোকানটি ঢাকা পড়ে গেল, সাটার বন্ধ।” দুঃখী জামাইদাকে লুলা সান্ত্বণা দেয়, ‘জুবিলি পার্কের পাঞ্জাবীর অত বড় মদের দোকানটা খাল হয়ে গেল, তুমার ত জুনপুকির মতন ইতটুকু পোঙা–লাহন ত হবেকই। দুখালে চলে?’

–তাহলে ক্যালার দুহাত তুলে লাচব?

–ত ভাঙে দাও ফেলাইওভার।

–দুব ত!

–অডার হাঁকাও, ডিনামাটি ফুটাই দিছি। লেবেল করে দুব।

–শালারা আবার বেনাবেক।

লুলা চিন্তায় পড়ে, দাঁড়াও দাঁড়াও, দিমাক লাগাই।

কিছুক্ষণ থেমে লুলা ফিচিক করে হাসে। দেখ, সরকারি কাজ একবার ফিনিস হলে, ফুটুক -ফাটুক দুবারা বাল হয়! মুতেই ক্যালা নুন্যা ধরাই দুব!

ত সেই মুত। ‘…………’ ওই থোকাথুকি মোতামুতি বাহেশবিচারের ভেতরই লফরা এসে লুলাকে ধাঁকালে, তোর বউকে লিয়ে ভাগ্যে গেলেক হুড়কা।

কী শান্ত লুলা যেন গীতার বাণীটি : বৌ ত ক্যালা ভাগবারই জিনিস! নাহালে কী হামরার চার নম্বর বিবি জুটে! সেও ত ক্যালা ভাগামালই।’ আবার অন্যত্র দেখি, ‘থুথাই বোধহয় ট্রেনে – বাসে কোনখানে শুনে থাকবে, এই বতরে বিজেপিতে নাম লেখায় লে, কখন কী কাম দেই! পরে নাম ফাম আর লেখব্যাক নাই। কলোজ হয়ে গেলে পস্তাবি।

নেতার সঙ্গে ঘোরা লুলা জানে পোকিত কর্মীর কদর। বললো, বাল কোলোজ। যাকে জরুরত তার টেইমউইম নাই, সবসময়ই অয়েলকাম।

একটা বিড়ি ধরায়, ধোঁয়া ওড়ায়, তর্জনী ঠুকে সিগারেটের মতন ছাইও ফ্যালে।

–শুন ক্যালা! ল্যাখে লে, যে মেয়র, যে মন্ত্রী, যে এমলে, যে শালা এম পি –সব ভোঁসড়িবালাই ওই থাকবেক, কেবল বদলে বদলে যাবেক পার্টিটা। তবে নাম লেখায় রাখাই দোষ নাই।’

নবারুণের দাদামশায়, মনীশ ঘটক (যুবনাশ্ব ) ‘পটলডাঙার পাঁচালি’ লিখেছিলেন। সাহিত্যের ইতিহাসে সেটি খুবই বিশিষ্ট কাজ। সেখানে চেষ্টা ছিল বাস্তবতার একটা পূর্বনির্ধারিত ছকেই বাংলা গল্পের বাস্তবতার সম্প্রসারণ ঘটানো। কিন্তু সেখানে কল্পনার সীমার কোনো প্রসারণ ঘটে নি। যে সাহিত্য কল্পনা ও সৌন্দর্য তৈরী করে না, সে সাহিত্যের নানারকম সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মূল্য থাকতেই পারে কিন্তু শিল্পমূল্য নেই।

তাঁর মাতামহের ওপর নবারুণের এইখানটাতেই জিত যে তাঁর ফ্যাতাড়ু ও চোকদারেরা বাংলা উপন্যাসের বাস্তবতার বা সাব–অল্টার্ন ইতিহাসের সত্যের ম্যাপ আঁকার স্কেল বদলায় নি। তারা বাস্তবকে মাপার নতুন একটা সংজ্ঞা জারি করেছে। হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় এমন এক বাস্তবকে তুলে ধরেন যা আমাদের পরিশীলিত বেঁচে থাকার ভীষণ বিপরীত ও বিপক্ষে। তাঁর গল্পের চরিত্ররা তাদের যাবতীয় স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হুড়মুড়িয়ে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসে। কয়লাখনি অঞ্চলের আকাঁড়া বাস্তবকে মাপতে গেলে লুলাদের স্কেলেই মাপতে হবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নির্মাণ পটুত্বে পাঠককে আটকে রাখার সপ্রতিভতা এ গল্পের সম্পদ। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের Can Sub-altern Speak পড়া না থাকলেও এ কথা সহজেই অনুমেয় যে sub-altern দের ভেতর একটা শ্রেণীহিংসা কাজ করেই। নগরায়ণ যেভাবে এগোতে এগোতে প্রান্তিক মানুষকে কোণঠাসা করছে তাতে কি তারা ঘুরে দাঁড়াবে না? গল্পশরীরে এসব ভারী ভারী কথা নেই, তাতে পাঠ্যবস্তুর তারল্য প্রকট হোত। লুলা, থুথা, মড়িরাম প্রমুখ subaltern রা এস্টাব্লিশমেন্টকে ধ্বস্ত করতে চায় কিন্তু তাঁদের অস্ত্র কোথায়! অক্ষমের প্রতিবাদের অস্ত্র তাঁদের শরীর নিঃসৃত বর্জ্য– মূত্র। ‘মুতেই শালা নুন্যা ধরাইন দুব’ তো, সেই মুত! এবং মূত্রপদাবলী!

আমরা খালি সংকলিত গল্পগুলির আত্মার দিকে নজর রেখেছি, গল্পগুলির অস্থি, মাংস তথা চামড়ার দিকে আমরা তাকিয়ে দেখছি না তাতে ভাবী পাঠকের ওপর অবিচার করা হবে। তাই কাহিনীসূত্র সম্পর্কে আলোচনা থেকে বিরত থাকবো।তাছাড়া এ উপলব্ধি তো শিরোধার্য যে নতুন শতকের লেখালেখিতে কথাবস্তু আর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, আংশিক উপাদান বা কাঠামো মাত্র। কথাবস্তুকে উপলক্ষ করে নানারকমের সাংস্কৃতিক বীক্ষার অন্তর্বয়নই পাঠকৃতিকে বিশিষ্ট করে তোলে। হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পগুলি পড়তে বসার আগে এ তথ্য মাথায় রাখতে হবে।

পরবর্তী গল্প–কিসি কিত্তন। আমাদের মূল্যবোধ কিভাবে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে তার আধুনিক দলিল।

আমাদের পরবর্তী নজরে গল্পগ্রন্থের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প, ‘ওড়াওড়ি’।

‘ওই জামগাছটা পর্যন্ত আপনার।

ঋত্বিকের তর্জনী এক লপতে উনিশ একর জমি নাড়ায়।

গাঙ্গুলি দেখছে, পার্থনিয়াম ঝোপ, তাতে গোছা গোছা সাদা নির্দোষ ফুল, তার তলায় একদার সুফলাং মৌজা…..

গাঙ্গুলির অক্ষর ঋত্বিক পড়ে নিয়েছে :

–দাদা, এখন আর সবার দ্বারা চাষ হবে না। কৃষি ব্যাপারটা এখন ইনডাস্ট্রি….’ গল্পের সূচনায় ঋত্বিক নামের এক যুবক শহরবাসী গাঙ্গুলিকে এসে বোঝায় গাঙ্গুলির ফেলে রাখা পৈতৃক জমিগুলি কেন বিক্রি করে দেওয়া উচিত। একথা সেকথার পরে তার ব্যাগের কাগজ হাটকে একখানা জমির নকশা বার করে, ‘তর্জনী ছুঁইয়ে মার্ক করে একটিতে, এইটা আপনাদের পুকুর।

পুকুর!

আয়তকার জমির ওপর ধড়ফড় করে পাড় ভর্তি অর্জুন গাছ, হাওয়ায় পাতার কাঁপন, শুনছে গাঙ্গুলি। পাড়ের কাশফুলে দোলা, জলে শুকনো পাতা তিরিবিরি, ছোট ছোট মাছ খেলছে,…

– এর নিচেই আপনার উনিশ একর। এক লপতে। এই যে দেখুন…

ঋত্বিক আঙুলের নখ ডোবায় ম্যাপে, তার নখে মাটি। গাঙ্গুলিও পুকুর থেকে মাঠে ঢোকে :

যাবট ক্ষেতে জল ছিটিয়ে কাদা করছে বলদ।

টুপটাপ আফর পোঁতে একদল কামিন।

বাতাস কেমন ঢেউ খেলে যায় এমন অনন্ত অসীম হরিৎক্ষেত্র।..’

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হোল বর্ণিত দৃশ্যটির দৃশ্যমূল্য বোঝাতে! জমি ক্রেতা ঋত্বিক গাঙ্গুলির বাড়ির টেবিলের ওপর জমির নকশা রেখে আঁকা পুকুরটির ওপর আঙ্গুল রাখে, গাঙ্গুলি দ্যাখে,তার নখে মাটি! ওঃ! গায়ে কাঁটা দেয়! এইরকম দৃশ্যমূল্য তৈরী করার নজির বাংলা সাহিত্যে নেই বললেই চলে! এহ বাহ্য! গল্পে /কাহিনীতে ফিরে আসা যাক –

শহরবাসী গাঙ্গুলির উনিশ একর পৈতৃক জমি এক জ্ঞাতিভাইয়ের তত্বাবধানে প্রায় আ -চষা হয়ে পড়ে আছে। সেই জমিগুলি কিনে চাষ করতে চায় ঋত্বিক নামের যুবক। গাঙ্গুলির দ্বিধা লক্ষ্য করে সে এবং গাঙ্গুলির স্ত্রী নানারকম ভাবে গাঙ্গুলিকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। গাঙ্গুলি বলে, ‘কোন খাবারটি মানুষ খাবে ঠিক করে দেবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। চাষ হবে সেই মোতাবেক।

ঋত্বিক উত্তেজিত, আপনি কি জানেন, ভারতে ৪২০০০ রকমের ধান ছিল? দশ হাজার বছর ধরে কৃষক বুনো ধানকে ধীরে ধীরে চাষযোগ্য করে তুলেছিল। কোন শালা মনসেন্টো ফুতকারে উড়িয়ে দিল, যাঃ! ভ্যানিস করে দিলুম তোর দশ হাজার বছরের জ্ঞান, হয়? একবার যদি কৃষক তার জানা বীজ হারিয়ে ফেলে তাহলেই সে কোম্পানির দাস হয়ে গেল। আমি দাসত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জমি চাইছি।

মাস্টারদা, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজির পাশে ঋত্বিকের ছবি জ্বল জ্বল করছে গাঙ্গুলি ইতিহাস পাতায় দেখছে।

–আমাকে জমি দিন দাদা!’

পৈতৃক জমি বিক্রিতে বর্তমান উত্তরাধিকারী গাঙ্গুলির সায় নেই অথচ তার স্ত্রীর ভীষণ আগ্রহ। স্ত্রীর আগ্রহ জমি বিক্রির টাকায় শহরে একখানা ফ্ল্যাট, গাঙ্গুলির ভাবনায় তার স্বদেশ ও স্বজন। গাঙ্গুলির ভাবনায় তার বদলে যাওয়া গ্রাম, বালকবেলা, ‘এটিও গ্লোবাল ভিলেজ। ছেলেরা রস্কিঝোলা হাপ প্যান্ট পড়ছে, বারমুন্ডা, মেয়েরা লেগিস, বউরা ব্রেসিয়ারের ওপরে নাইটি পড়ে আধুনিকতা মারায়। শিমুল ফুটেছে আগের মতোই লালে, পলাশ ফুটেছে ওমনি থোকা থোকা। পাখি, যতটা শুনতে চাইছে ঋত্বিক, তার চেয়ে কমই কাকলি। বাতাস হালকা হালকা মোটা। নদীর জলে গেঁড়ি গুগলি কম, পুকুরে আমেরিকান রুই তড়বড় করে বাড়ে। কাতলা মৃগেলের বাড় কম। ছোটো আঁটির খড় বলে বাড়ির চালে এশবেশেটাস। প্রধানমন্ত্রীর হয়ে গরিবের পাকা ঘর বানিয়ে দিচ্ছে টিএমসি’র গ্রাম পঞ্চায়েত। জলখাবার হয় ম্যাগি দিয়ে। মেশিন ফড়ফড় মুড়ি ভাজে। প্যাকেটে ভুট্টা খই আসে কোম্পানির নাম সাঁটা পলিপ্যাকে। এ গাঁ -ও জানে মমতা ব্যানার্জীই একমাত্র বাংলার গর্ব। সিপিএমের বিপ্লব দীর্ঘজীবী। কংগ্রেস বলে কোনো দল ইতিহাসে ছিল। মোদীই একমাত্র আচ্ছে দিন অনেবালা।

……

কর্পোরেট প্রথমে সংস্কৃতিকেই বদলায়

যে কোনো প্রগতিশীল ভাবনাকেই দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়।

….

প্রতিদিন ২০০০ কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক হচ্ছে। প্রতিদিন দশটা ফুটবল ময়দানের সময় পরিমাণ ভূমি উজাড় হচ্ছে। শিল্পায়িত কৃষি আমাদের মাটি, পরিবেশ, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ নষ্ট করছে।’ ওদিকে গাঙ্গুলির গৃহিনীর ভাবনায় কঠোর বাস্তববাদ, ‘চাকরি থাকতে থাকতেই গিন্নি সুদে টাকা ধার দিত মহল্লায়। গান গেয়ে তরী বেয়ে ততদিনে যতটা পেরেছে সোনার ধানে ভরিয়ে দিয়েছে ছোটো সে তরী, এখন দাঁড়ে পালে নৌবহর, গাঙ্গুলি সাগরে ফেলেছে নৌবহর, তাহার ঝান্ডায় দেশপ্রেম।’ এদিকে গৃহিনী ওদিকে ঋত্বিক ক্লান্তিহীন উৎসাহে গাঙ্গুলিকে বোঝায়, ‘চাষ না করে জমি ফেলে রাখা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া। তার চে বেচে দেওয়াই পুণ্যের। আপনার জমি অচষা পড়ে থাকতে পারে না, থাকবে না। কর্পোরেট আইন বানিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। তারচে…’

এতক্ষণ ছিল সুহৃদের ভঙ্গিতে বোঝানো পর্ব, এবার কর্পোরেট আধিপত্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেল!

‘ওড়াওড়ি’ গল্পটি এবার ইকোফেমিনিজম এর আঙিনায় ঢুকে পড়ল, যা আধুনিক সাহিত্যতত্ব বিচারের অন্যতম মাপকাঠি। পুরুষের আধিপত্য শুধু নারীর ওপরেই নয়, বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পরিচালিত যে বিশ্বায়ন সেখানে নারী, প্রকৃতি, তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলি যারা পুঁজিবাদী আধিপত্যের শিকার, সকলেই শোষিত হয়ে চলেছে। কর্পোরেট দুনিয়া যে শুধুমাত্র বৃহৎ আকারের শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করছে তা নয়, কৃষিও তাঁদের মুনাফার উপকরণ হয়ে উঠেছে। ফলে হাতে গোনা কয়েকটি গোষ্ঠী কৃষক কে কি চাষ করবেন সেটা স্থির করতে চাইছে কর্পোরেট হাউস। পণ্যনারী নিজেকে কতখানি আবৃত করবেন, তার পরিধান, চালচলন, তার মূল্যবোধ – সবই ঠিক করবে কর্পোরেট হাউস।পুরাণের বলীরাজার সেই বামনের মতোই তার দুটি পা দিয়ে জল ও স্থলকে তো কর্পোরেট হাউস আগেই গ্রাস করেই ফেলেছে এবার তৃতীয় তথা মাঝের পা’টি কোথায় রাখবে সেই চিন্তা!কর্পোরেটের প্ররোচনায় ঋত্বিক উড়ছে, গাঙ্গুলির স্ত্রী ও! ওড়াওড়িতে আমাদের বিরাম নেই!

আমাদের পরবর্তী আলোচ্য, ‘দেশমাতৃকাপ্রেমপ্রকল্প’। নামকরণে ভিন্ন ভিন্ন শব্দগুলির মাত্রাহীনতার মধ্যে ইঙ্গিতময়তা কিছু রয়েছে কিনা ধীমান পাঠক লক্ষ করবেন। গল্পটি সূচনা থেকেই পাঠকদের এক অদ্ভুত জগতে নিক্ষেপ করে। গল্পটি ভঙ্গুর মধ্যবিত্তের দৈনদিন যাপনের ছবি যেখানে যুবসমাজ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যৌন বাণিজ্যের উপকরণ হয়ে উঠেছে। ‘আজ যে মেয়েটিকে মথুর সন্তুষ্ট করেছে সে স্ক্রিমিং সিক্সটিস, পড়ন্ত বলে খানিক বেশি। লটকে থাকার জেদ বেশি। উর্ধরেতা। ডায়েট নিয়ন্ত্রিত পেটভারি সিক্সটিস, প্রকৃত প্রস্তাবে মথুরকে দুয়ে নিয়েছে– কত গহন গভীর কলুষময় গর্ত টেনে বের করেছে শেষ বিন্দু পর্যন্ত বীর্য – মথুর যাকে জানত বেদনৌকো, আসলে তা নাকি কুড়াদানি, যাবতীয় আবর্জনা ধারণ করার পরা –পশ্যন্তি –মধ্যমা – বৈখরীজননীর অপ্রাকৃত শক্তি, মথুর তাই জানলো। তার জানার দিকচক্র বালের কতটুকু?….. তাকে ধোঁয়া জানানো হয়েছে বৃক্ষরোপণের উপকারিতা জানানো হয়েছে মাঠে ময়দানে মলত্যাগের কুফল জানানো হয়েছে জানানো হয়নি একদা – সুন্দর নীলসবুজের পৃথিবীকে একটি বৃহৎ ডাস্টবিন বানানোর সুসভ্য ইতিকথা।’ এ কথা তার কাছে কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে যে যৌন বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারে প্রায় প্রতিটি মানুষ আজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির এক একটি উপকরণ মাত্র, ফলত মানবিক সম্পর্কগুলিও ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে!

সংকলনভুক্ত দশটি গল্পই স্বকীয়তায় উজ্বল। তবে যেহেতু ভুরিভোজনও স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তাই প্রতিটি গল্প নিয়ে আলোচনায় এবার দাঁড়ি টানা উচিত। আমাদের অভিপ্রায় ছিল গল্পগুলির অনোন্যতা সম্পর্কে ইশারা দেওয়া যাতে ভাবী পাঠক গল্পগ্রন্থটি সংগ্রহ করতে উৎসাহী হন। আমাদের শেষতম আলোচ্য সংকলনের শেষ গল্প ‘লাপরবাহাতত্ত্ব’। একটি তীব্র রাজনৈতিক গল্প। গড়পড়তা অক্ষরকর্মীরা যখন প্রানপণে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলেন, ‘‘লাপরবাহা তত্ত্ব’ তখন চূড়ান্তভাবে বেপরোয়া। ‘লাপরবাহা’ শব্দটির অর্থও সেই বেপরোয়া ভঙ্গিরই সমগোত্রীয় তবে চোখের চামড়াহীন তথা লাপরবাহা শাসকবর্গই লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য। গল্পের সূচনায় অবশ্য এক সন্ধ্যের কালিপাহাড়ি মোড়ের ফটোগ্রাফিক উপস্থাপণা। ‘ভারী বুটের শব্দ তুলে লালমুখে বড়বাবু, লুলার দরজায় খাড়া, লুলার ব্যাটা তখন চাকা ঘুরাচ্ছে ট্রুরর ট্রুরর।

–কান্ডটি তোর শালা! বড়বাবু ব্যাগটি হাতে নেন।

–ভাবলাম ত লাহরমোহর পাব সার, গুচ্ছের ঝলমলে সিনথেটিক শাড়ি ছিল।

ব্যাগটার চেন খুলতে খুলতে, ‘শালা বেঙ্গলের প্রেস্টিজ পাংচার করে দিলি!’, বড়বাবু বললেন। ব্যাগের অভ্যন্তর দেখে, সত্যি করে বল নগদ রকড়া কত ছিল?

বড়বাবুর পুলিশি চোখ ছুঁচলো।

–বাল ছিল। ফুটা টিকলিও ছিল নাই, মাইরি!

–শালারা এফ আই আরে লেখাইছে নগদ বিশ হাজার ছিল।

–ওই জন্যে ক্যালা ছোটলোকের মাল ছুঁতে নাই।

–সেটা আমি কি বুঝছি নাই রে খ্যাপা! বড়বাবু লুলার পিঠে হাত বোলান। মালকড়ি রইলে তুই এতক্ষণ সিধা থাকতিস!

–তাহালে ব্যাগটা দিয়ে যাও। নুনুটা চাক ঘুরাই খেলুক।’

কথাবস্তুর ফটোগ্রাফিক উপস্থাপণার নমুনা বোঝানোর জন্যে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হল । লুলার এই ছিঁচকে চুরিতে বড়বাবু ব্যথিত, এইসব ছোটখাটো চুরির কিনারায় তাঁর ক্রেডেনশিয়াল কিছু বৃদ্ধি পায় না। তিনি চান লুলা /লুলারা বড় কিছু করুক।

‘দুঃখিত হন বড়বাবু, আসলে কারোরই কোনো দোষ নাই, দোষ টিএমসিরই। কোনো চুনাওয়েই পার্টি গ্যারেন্টি দিতে লারছে জিতবোই! হারতে হারতে জিতে যাচ্ছে। এমন রিস্কি গম্মেন্টে সবারই তাড়াহুড়ো থাকে, সামনে পড়ে আছে মাত্র পাঁচটি বছর।

সিপিএম আমলে যেই পারতো সেই দূ চার বরা কয়লা তুলে এক বোতল মদ আর একটা জ্যান্ত মুরগা নিয়ে ঘর ফিরত, অত বেকার সমস্যা ছিল না। অত বড় বনজঙ্গল মেলা ময়দান মাঠ পড়ে আছে, যা, যেখানে খুশি কয়লা তুলগা, তখন সবাই সিপিএম। টিএমসি আসার পর সবাই টিএমসি, তবুও পাবলিকের কয়লা – পোটেকশন নিয়ে নিল সিন্ডিকেট। যে দলের যা ডাস ক্যাপিট্যাল।

………. বড়বাবু টুপি খোলেন। কত কিস্তি ডি এ বাকি, রেশন সুদ্দা তুলে দিল, শুকনা কটা টাকায় ইজ্জত রক্ষা হয়, অসম্ভব, বুঝলি?

চিন্তিত লুলা, আমাদের অবস্থার কনডিশনটা তাহালে ভাব? পাতি ছিনতাই কেসে ছুটে আসছেন!

–তাহালে রেপ মাডার কর!’

আবার এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি এটা বোঝাতে যে শুধুমাত্র শব্দ ও বাক্যেই চিত্রিত হয়ে যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ডের আর্থ- সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডল। শাসক ও শাসিতের এই খোলামেলা আলোচনা এক অজানা পৃথিবীর উন্মোচন করে। ড্রয়িংরুমের জানালার পাশে বসে নিরাপত্তাভিলাসী লেখকের লেখা নয়, কোনো নির্দিষ্ট দলের আনুগত্য স্বীকার নয়, নির্দ্বিধায় লেখা হয়, ‘সব বিপ্লবী পার্টি যেমন গ্রুপে উপগ্রুপে বিভক্ত, এস ইউ সি যেমন টিএমসিকেই বিপ্লবী পার্টি মনে করে সিঙ্গুরে কাঁধে কাঁধ দেয়, মাওবাদীদের একটা গ্রুপ যেমন মমতাকে লুক্সেমবার্গ ধরে নিয়ে জান লড়িয়ে দিয়েছিল, তদ্রুপ লুলার সংগঠনেও সংশয়, ছোট ছোট ভাঙন, মতাদর্শগত বিতর্ক এবং বিভাজন স্বত্বেও তারা রিভেলিউশোনারি পাওয়ার। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যত দুর্বল হবে টিএমসির প্রতিপক্ষ হবে লেফট – লুলার মত। ‘সে তো না হয় হবে বা হবে না, এখন লুলাদের চলে কি করে!’ সম্প্রতি তাঁদের ছিনতাই কর্মসূচী বাতিল। নব নব প্রযুক্তি বহু সাবেকি জীবিকার মৃত্যু ঘটায়। এখন ইমিটেশনের যুগ, আসল নকল একাকার। তারপর পেটিএম, ফুটা টিকলিও রাখার দরকার নাই পোকেটে। এমন দুঃসময়ে কোনো বাদ আর দাঁড়াচ্ছে নাই, সব সময় কি পুংলিঙ্গ খাড়া হয়, স্বয়ং ক্যাটরিনা থুতু কাপড় খুলে শুয়ে পড়লেও…তারজন্য নিরন্তর উত্তেজনা, নিরন্তর তত্ত্বের উষ্ণতা লাগে। ঘুরে দাঁড়ানোর মৃদু প্রয়াসে মতীশ কমরেড বড়ো দুঃখ নিয়ে একান্তে লুলাকে ডেকে বললো, তোরা সাপোর্ট ঠুকে দিলে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে আমরাই জিতে যাবো। ইবেরে ভালো সাপোর্ট পাচ্ছি। ইবেরে…

মতিশকে কিছু বলতে দিলে তো, হাঁ হে কমরেট, সবাই বুঝছে টিএমসি চোর চুয়াড়ের ফালতু দল, বিজেপি দেশটাকেই বিচে দিলো, তবু তুমরা ভোট পাচ্ছে নাই কেনে বলবে?” প্রশ্নটি বঙ্গীয় রাজনীতির অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উত্তরটাও বোধহয় একটু পরেই পেয়ে যাই, ‘ফেসবুকে দেখলাম তুমাদের বুড়া কমরেটগুলা ভাবতে ভাবতে ঘুমাচ্ছে! সম্মেলন না কি একটা সার্কাস তুমরা হর সাল কর না, সেখেনে। হেয়ার কন্ডিশন ছিল বোধহয় হলটা? বুড়া গরু দিয়ে বোহালে চাষ হয়!

–কেনে! একপাল নতুন বিটিছেলা, ইয়াং জেনারেশন, দেখছিস নাই, জেল যাচ্ছে, আন্দোলন করছে….

–তুমাদের কাচড়া সাফ করতেই জুয়ানিগুলা ওল্ড হয়ে যাবেক কমরেট! ছাড় উসব, একটা মিছিল কর দেখি কমরেট, আমি লোক দুব। শস্তা দরেই দুব।

–পাইকারি দরেই দিয়ে দুব। টাটকা গোটা মিছিল, ধর হাজার পাঁচেক দিবে। ফুট হিসাবে তুমাদের দিবার হিম্মতে নাই।

–ফুট!?

–ফুট হিসাবে মিছিল করি এখন। এডভান্স দিয়ে যাও

…….

–বুদত্তালে কমরেট, বিজেপি আধ মাইলের মিছিল বুক করেছে। টিএমসি বলছে, আমাদের দু -ফুট হলেও বড় মিছিল চাই। যতই হোক রুলিং পার্টি। পেস্টিজ ম্যাটার!’

গল্পটি এখানে এক হাঁ মুখের সামনে এসে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়! বিস্মিত কমরেডকে লুলা প্রশ্ন করে, ‘যদি না জিত, খুব কি গরিবের লুকসান হবেক, হাঁ কমরেট?

–হবেক নাই বলছিস? গরিবগুলো বড়লোক হয়ে গেল দিদির শাসনে?

–গরিব লোকেদের গরিব করে রাখাই ত পাটিপলিটি। রেশনে ফিরি চালগমআটা, ব্যাংকে লখখি ছিরি, ইস্কুলে সাইকেল। বলছে নাকি মোবাইল দিবেক, ফটফটি দিবেক, ল্যাপটপ দিবেক।…….

…এত গরিব প্রেম কম্পিটিশন আজাদ ইন্ডিয়ায় কভি হয়েছিল! লুলা তত্ত্বের ইতিহাস খুঁজে পাচ্ছে না।’

মার্কস সাহেবের তত্ত্ব ছিল শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার, শ্রেণীসংগ্রাম, স্মিথ সাহেবের দাওয়াই ছিল সিভিল গভর্নমেন্ট। ‘লুলা মার্কস সাহেবের পক্ষে থেকে দেখেছে কমরেটরা স্মিথ সাহেবেরই বেশি ভক্ত।

এতসব আগুন ও একোয়া, খরা ও মনসুন!’

লাপরবাহাদের নিয়ে লেখা একটি বেপরোয়া গল্প। কোনো পক্ষকেই কোন রেয়াত করা হয় নি এখানে। তীব্র প্রতিবাদের গল্প। এখন অবশ্য কোনো প্রতিবাদের পেছনে কোনো আবেগের ওসকানি ধর্তব্য হয় না, প্রতিবাদ কর্মসূচীটির প্যাকেজিং হয়, তার টিআরপি কতখানি সে অনুযায়ী প্রতিবাদের গুরুত্ব মাপা হয়।

শিল্প তথা গল্প- উপন্যাস বা নান্দনিক যা কিছু তা তো চিত্তগত প্রবৃত্তি, হৃদয়কে যা আচ্ছন্ন করে। মানুষের অনুভবের নানা স্তরকে ছুঁয়ে যায়। এইরকমই আমরা জানতাম। কিন্তু নতুন যুগে পা দিয়ে দেখছি, শিল্পকে হতে হবে বাজার নির্ভর, ইন্দ্রিয়জ। এই দুয়ের দ্বৈরথে সাহিত্য তথা শিল্প এখন একটি টালমাটাল দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে!

‘মূত্রপদাবলী’ সমাদৃত হলে তা বর্তমান শতকের সাহিত্যধারায় খানিকটা জোয়ার তো আনবেই!

মূত্র পদাবলী- হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় । প্রকাশক- একলব্য। কলকাতা -৪৯ । মূল্য- ৩০০ টাকা ।

আরও পড়ুন…

মৌহূর্তিক উদ্ভাস তথা আণবিকতায় প্রখর সুব্রত ভৌমিকের অণুগল্পের সম্ভার