তোত্তোচান : জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা

সুদেষ্ণা ঘোষ

তোত্তোচান : জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি’ বইটি পেলাম গতকাল, হাতে হাতে করে এল সে কলকাতায়। গ্রন্থখানা হাতে নিয়েই যেন নিজের সবকিছু ভুলে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর গোলাপী রঙের ছোট্ট মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, মন ভরে যায়। বাংলাদেশের দুন্দুভি থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। শুরুতে গ্রন্থটির ভাষান্তরকারী চৈতি রহমানের দীর্ঘ একটি ভূমিকা। ওটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল যে, একটা ভূমিকাও এমন সুন্দর করেই বুঝি ভাবা যায়? চৈতি রহমান তা করে দেখিয়েছেন।

একটা সময়ে জাপানিজরা ছিল দারুন গোঁড়ামিতে ভরা। জাপান মানেই চোখে ভেসে ওঠে সামুরাইদের চেহারা। যুদ্ধংদেহী সে চেহারা। আর এরা মানে জাপানিজরা নিষ্ঠুর জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে। এরা অন্যদের কাছ থেকে জাপানিজদের শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে ছিল চরম উন্নাসিকতা। সেই সময়ে পশ্চিমাদের সাথে মেশার ব্যাপারে আইন ছিল খুব কড়া। কোনো জাপানিজ লেখাপড়া শিখতে পশ্চিমের দেশে সহজে যেত না। সময়টা এমনই নিষ্ঠুর ছিল যে, কেউ শিক্ষার জন্য জাপানের বাইরে গেলেই তাকে অচ্ছ্যুত ভাবা হতো। কিন্তু এসব একজন মানুষ বদলে দিয়েছিল, জাপানিজদের নাক উঁচু স্বভাব।

ছেলেটির নাম-মাঞ্জিরো নাকাহামা। সমুদ্রের ধারে ছিল তাঁর বাস। জন্মেছিলেন জেলে পরিবারে। ১৮৪১ সালের কোনো এক দিনে ১৪ বছরের নাকাহামা তাঁর চার বন্ধুকে নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ডুবির শিকার হয়। তারপর তারা সাঁতরে জনমানব শূন্য এক দ্বীপে ওঠে, যেখান থেকে কখনও তাদের উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এই অচেনা দ্বীপের বিপদগ্রস্থ অবস্থা থেকে নাকাহামা এবং তাঁর বন্ধুদের উদ্ধার করেন, এক তিমি শিকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন জন হাওল্যাণ্ড। তিনি প্রথমে চার বন্ধুকে নামিয়ে দেন হনলুলুতে। কিন্তু মাঞ্জিরো নাকাহামা জেদ করেন জাহাজেই থাকবেন এবং ক্যাপ্টেনের সঙ্গেই থাকবেন। তখন জন নাকাহামাকে তাঁর সাথে নিয়ে নেন আমেরিকার ম্যাচাচুসেটস-এ এবং সেখানে তাকে ইংরেজি সহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেন। ২৪ বছর বয়সে ১৮৫০ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে নাকাহামা লেখাপড়া শিখে পুরোদস্তুর বিদেশি ভাষায় পন্ডিত হয়ে ফেরেন জাপানে।

কিন্তু ফিরলেই তো হলো না-নাকহামা তখন জাপান সরকারের রোষানলে পড়েন। তাকে সরকারের একলা চলো অর্থাৎ (National Seclusion Laws ) সাকুকো আইন ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী ঘোষণা করা হয় এবং একারণে তিনি জেলেও ছিলেন কিছুদিন। এরপর তাঁর গুণ প্রকাশিত হতে থাকে ধীরে ধীরে এবং পরবর্তীতে তিনি আমেরিকায় জাপান দূতাবাসে দোভাষীর কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু নাকহামা শুধু দোভাষীর কাজই করেননি। মিথ আছে, তিনি ঐ সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার একটা বড় পরিবর্তন আনেন।

আমরা জানি যে, জাপানিজ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পূণর্গঠন করা হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। আরও একজন মানুষ জাপানিজ শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেন, তিনি-তেৎসুকো কুরোইয়ায়ানাগি। তিনি ধারাবাহিকভাবে একটা লেখা লিখতে থাকেন সেই সময়ে, পরে সেটি একটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত- The Little Girl at The Windo। বাংলায় ভাষান্তর করলে হয় এমন-জানালার ধারে তোত্তোচান। আমার আসলে আজ এই তোত্তোচান গ্রন্থটি নিয়ে কথা বলবার ইচ্ছে। তোত্তোচান-এর লেখক গল্পের যে বর্ণনা করেন তা আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে যেন অদ্ভুত মিল রয়েছে।

তিনি শুরু করেছেন এভাবে- It had happened only a week ago. Mother had been sent for by Totto-chanÕs homeroom teacher, who came straight to the point. Your daughter disrupts my whole class. I must ask you to take her to another school. The pretty young teacher sighed. IÕm really at the end of my tether.

১৯৮০ সালে যখন তেৎসুকো দেখলেন, জাপানিজ বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে এবং শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নানান জটিলতা তখন তিনি ধারাবাহিকভাবে এই লেখাটি লিখতে শুরু করেন। সেই সময়টায় অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের সাথে নানা ধরণের ভায়োলেন্স বেড়ে গিয়েছিল। তোত্তোচান সেই গল্প যা শিশুর মনের বিশ্বের বদল করতে সহায়ক হবে। তোত্তোচান পড়তে শুরু করে থেমে যেতে পারিনি-নিজের জগতে ঘুরপাক খেয়ে ফেরা একটা বাচ্চা মেয়ে তোত্তোচান। ওর জগৎটা কেউ বুঝে উঠতে পারে না, কেউ যদিও বা বুঝে নেয় তাহলেও সে জগতের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া তো সহজ নয়। ক্লাসের পাঠ বাদ দিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে কোন স্কুল-ই বা তার সাথে মানিয়ে নেবে? তাই স্কুল থেকে ওকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বের করে দেওয়াই ওর সামনে খুলে দেয় নতুন জানালা।

সে জানালায় হাত বাড়িয়ে সোসাকু কোবায়াশি তাকে প্রকৃতির ছন্দে মানিয়ে নিতে শেখান। নিজেকে খুঁজে পেতে শেখান। জীবনবোধ শেখান। ওকে জানান যে, ও (তোত্তোচান) খুউব ভাল মেয়ে। সোসাকু কোবায়াশি কে? হতে পারেন তিনি হেডমাস্টার। আবার স্টেশনমাস্টারও হতে পারেন। ট্রেনের বগিতে স্কুল খুলে বসেছেন, ট্রেনের বগিতে স্কুল এটা শুনলেই তো অবাক লাগে, দারুন মজা হয় তো সেখানে তবে! কী অদ্ভুত সেই স্কুল। যে স্কুলের নাম ‘তোমোই গাকুয়েন’। সে স্কুল কি শুধু স্কুল? নাহ, সেটা স্বপ্নের কারখানাও। শুধু তোত্তোচান নয়। ওর মতো আরও পঞ্চাশ জনের জন্য স্বপ্নের আর ছন্দের পসরা খুলে বসেছেন সোসাকু কোবায়েশি। সে স্বপ্নের ছোঁয়া থেকে বাদ যায় না ইয়াসুয়াকিও, যার কিনা একটা সময় পোলিও হয়েছিল। তাকাহাশি যে কিনা ক্লাস ওয়ানের অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ছোট্ট-ভাবা যায় সে আর কোনোদিন বড়ো হতেও পারবে না?

সবার কথা মন দিয়ে শোনেন-হেডমাস্টার সোসাকু কোবায়েশি। সবাইকে ইচ্ছেমত পড়বার ব্যবস্থা করেন। ছন্দ শেখান। সবাইকে নিয়ে ‘সাগর থেকে পাহাড় থেকে’ নিয়ে আসা টিফিন খান। একত্রে গান করেন। পড়া শেষ হয়ে গেলে হাঁটতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। খেলার জন্যও অনেকটা সময় রাখেন। সুইমিং পুলের জলে সবাই খালি গায়ে সাঁতার কাটেন। আবার ক্যাম্প করেন তারা। পড়বার লাইব্রেরি বানান। আরও কতকিছু যে এভাবে পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গেঁথে দিতে থাকেন টুকরো টুকরো রঙিন স্বপ্ন, জীবনবোধ। এই গেঁথে দেওয়া জীবনবোধগুলো স্মৃতি হয়ে, স্বপ্নগুলো অনুপ্রেরণা হয়ে কখনো পিছু ছাড়ে না এই বাচ্চাগুলোর।

তারপর একটা সময় ধীরে ধীরে যখন যুদ্ধ কাছে আসতে থাকে, আমার ভয় হতে থাকে। নাআআআআ, এ যুদ্ধ যেন না আসে। এই স্বপ্নের কারখানাকে তো আর যুদ্ধের মাঝে ফেলা যায় না। সত্যিই তো একটা স্বপ্ন না এখানে, এখানে হাজারও স্বপ্ন টিংটং করে দোল খাচ্ছে যেন। সেই স্বপ্নে ভেতর যুদ্ধ এলে কী হয়? যুদ্ধ ওদের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেয় না সাময়িকভাবে। কিন্তু তোত্তোচান আর বাকিদের পরিচয় হয় বন্ধু হারানোর বেদনার সাথে। তোত্তোচানের আর ফেরত দেওয়া হল না ইয়াসুয়াকি-চানের কাছ থেকে নেওয়া সেই মজার আঙ্কল টমস কেবিন বইটা। ইয়াসুয়াকি চান-বড়ো আগে চলে গেল। বাচ্চাদের সাথে কাঁদেন সোসাকু কোবায়াশিও। উনি যে বাচ্চাদের বড্ড ভালবাসতেন। তাদের চলন বলন কথাবার্তার ধরণ থেকে শুরু করে নিশ্বাস নেওয়া পর্যন্তও চিনতেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা এসেই যায়। ‘সাগর থেকে পাহাড় থেকে’ টিফিন আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি লজেন্সের মেশিনটা থেকেও লজেন্স বেরিয়ে আসে না। তোত্তোচানের বন্ধু রকিও হারিয়ে যায়, যে রকি তোত্তোকে না বলে কোথাও যেত না। কুকুর রকির কানের বিদঘুটে গন্ধটাও তোত্তোচানের ভীষণ প্রিয় ছিল।

তোত্তোচানের ফোঁপানোর ধাক্কা সামলানো পাঠক হিসেবে আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও রক্ষে, স্কুলটা তো ঠিক আছে। কিন্তু যুদ্ধে তবে স্কুলটা আর ঠিক থাকে কই। বোমার আঘাতে প্রিয় তোমোই ধ্বংস হয়ে যায়। সোসাকু কোবায়েশি এবার জাত চিনিয়ে দেন পুরোদস্তুর, ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে বলেন-এরপর আমরা কেমন স্কুল তৈরি করবো? আর তখন আমার ইচ্ছে হয় বড় হয়ে আমি সোসাকু কোবায়েশি হবো। সোসাকুরা যুগে যুগে বদলে দিতে আসেন, দেখা যায়-দিনের পর দিন চলে আসছে মহাসমারোহে সমস্ত ভুল। কিন্তু সেই সকল ভুল নিয়মের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ায় না। দাঁড়ানোর সাহস করে না। শিশুরা একেবারে তো কোমল আর ফুলেরই রূপ, দেবদূতও বলি আমরা। এখন এই দেবদূতদের বাঁচাতে আসা উচিৎ একালের সব দেশে দেশে সোসাকুর মতো কারও না কারও।

এই হলো তোত্তোচান – জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি, যার স্মৃতি হাতড়ে গল্প বলাবার অভ্যেস রয়েছে। গ্রন্থখানা পাঠের পর মনে হবে এ যেন আমার নিজের গল্প, মনে পড়বে নিজের স্কুলের সেই সময় এবং শিক্ষকদের সঙ্গেকার সব স্মৃতি। শিশুর মনের বিকাশের জন্যে আসলে গ্রন্থখানা বড়োদের পাঠ জরুরি, আমি বলছি মা-বাবাদের কথা। কেননা, আমাদের শিশুরা কেমন হবে তা আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চাই, ছেড়ে দিন না ওদের একবার, ওরাই শিখে নিক ওদেরটা, খুঁজে নিক মজার গ্রন্থ, মজার নদী, মাটির রাস্তা, পুঁইশাকের পাকা ডিম আর তা দিয়ে লিখুক দেয়ালে, ভাত, কাগজ আর শলাকা জুড়ে বানিয়ে নিক নিজের ঘুড়ি; উড়–ক তা আকাশে-খুঁজে নিক ওরা ওদের নিজেদের পছন্দের আনন্দের সেরা শিক্ষাটা।

লেখক : সুদেষ্ণা ঘোষ, কলকাতা

নোট: এই লেখাটি এবং বই এর প্রিন্ট সংস্করণ প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।

আরও পড়ুন…

বিধান রিবেরুর নতুন বই ‘কানান্তর’