ঢাকায় কি রেনেসাঁ বা নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল? ইতালীয় রেনেসাঁ ও বঙ্গীয় রেনেসাঁর আলোকে এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করলে সংশয়িত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। যেমন সংশয় রয়েছে বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা কলকাতার নবজাগরণকে ঘিরে। কেউ কেউ ইতালীয় রেনেসাঁর আলোকে বঙ্গীয় রেনেসাঁর প্রতি তুলনা দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, অন্তর্গত শক্তিকে উপেক্ষা করেন এবং বঙ্গীয় রেনেসাঁকে রেনেসাঁ বলতে গররাজি প্রকাশ করেন। যদিও উনবিংশ শতকে উদ্ভূত বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা কলকাতার নবজাগরণ প্রতিষ্ঠিত এক সত্য। যার চেতনায় বঙ্গীয় সমাজ আলোকিত।
ঢাকার রেনেসাঁকে যদি ইতালীয় রেনেসাঁ ও বঙ্গীয় রেনেসাঁর আলোকে অন্বেষণ করা হয়, তাহলে এই রেনেসাঁ সম্পর্কেও সংশয় ও বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। বিদ্বৎ-সমাজ কেন, এই রেনেসাঁকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত ও মূল্যায়ন করেনি, তা মস্তো বড়ো এক হেঁয়ালি বৈ অন্যকিছু নয়। ঢাকায় বিংশ শতকে সংঘটিত রেনেসাঁ বিশেষভাবে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। ইতালীয় রেনেসাঁ যেমন পুরো ইউরোপকে আলোড়িত করেছিল। বঙ্গীয় রেনেসাঁ কলকাতায় সংঘটিত হলেও তার ছোঁয়া লেগেছিল পুরো বঙ্গে। ঠিক তেমন ঢাকার রেনেসাঁ ঢাকায় সংঘটিত হলেও তার ধাক্কা লাগে প্রথম পর্বে পুরো পূর্ববঙ্গে এবং দ্বিতীয় পর্বে তদানীন্তন পুরো পূর্ব পাকিস্তানে।
হাসান হাফিজুর রহমান এর এক লেখায় এই কথার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে। তিনি ‘সমকাল’ পত্রিকার প্রকাশের কারণ সম্পর্কিত এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘পাকিস্তানের আগে মুসলমান স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় উত্তেজিত ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে পরেই দেখা গেল স্বাতন্ত্র্যই মুক্তি নয়। দুর্বল ন্যাশনালটি প্রবল পাঞ্জাবি ন্যাশনালটির বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জায়গায় নতুনভাবে দেখা দিল আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রশ্ন।’
এই ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’ই হল ঢাকার রেনেসাঁর বিরল বৈশিষ্ট্য। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, উদারনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্তি, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার চর্চা, ন্যায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রত্যাশা পুরণ। রেনেসাঁ বা নবজাগরণ কীভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঢাকার রেনেসাঁ। যেখান থেকে উপ্ত হয়েছিল পুরো জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার বীজমন্ত্র। এই রেনেসাঁর শুরু ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এই সূত্রে সেই সময়ের বিদ্বৎ-সমাজের একট বড়ো অংশের এখানে বসবাস ও একত্রিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। যার কল্যাণে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। যার মুখপত্র ছিল ‘শিখা’ পত্রিকা। যাদের শ্লোগান ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। উল্লেখ্য, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের আদর্শ ছিল, ‘ইউরোপের নবজাগরণ-ইতালীয় রেনেসাঁ, উনিশ শতকের নবজাগরণ-বঙ্গীয় রেনেসাঁ, তুরস্কের নবজাগরণ-কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে সংঘটিত মুসলিম রেনেসাঁ।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হুসেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন অনেকেই। উল্লেখযোগ্যরা হলেন : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ প্রমুখ।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’কে খুব বেশিদিন আলো ছড়াতে দেওয়া হয়নি। ১৯৩৬ সালে সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে ১৯৩৮ সালে। আবুল হুসেনের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত স্মরণানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। ‘শিখা’ পত্রিকার সংখ্যা বেরিয়েছিল পাঁচটি। প্রথম সখ্যার সম্পাদক ছিলেন আবুল হুসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক হন কাজী মোতাহার হোসেন। চতুর্থ ও পঞ্চম সংখ্যায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ও আবুল ফজল।
ঢাকার রেনেসাঁ কতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ও ধর্মের ধ্বজাধারী কূপমূণ্ডুকদের ধাক্কা দিতে পেরেছিল তা আবুল হুসেনের ওপর নেমে আসা খড়গ থেকেই বোঝা যায়। চার্চের কাছে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও হয়ে উঠেছিলেন যেমন, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর বিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন ঠিক তেমনই।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আত্মপ্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের শিকার হয়। এরা হলো— এক. ঢাকার আশরাফতন্ত্রী আলেম সমাজ, দুই. ঢাকার নবাব পরিবার, তিন. কলকাতার ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা গোষ্ঠী।
আবুল হুসেন একটা লেখায় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে চাকরি সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিলেন। সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’তে গোলাম মোস্তফা ওই লেখার তীব্র সমালোচনা করেন, যা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে পড়ে এবং অশোভন ও আপত্তিকর। তিনি বলেন, মুসলমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কারণেই আবুল হুসেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছেন। এতে ভীষণ অপমান বোধ করেন আবুল হুসেন এবং শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আইন ব্যবসায় যোগ দেন।
মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার পরপর চারটি সংখ্যায় কাজী আবদুল ওদুদের লেখা নিয়ে আক্রমনাত্মক সমালোচনা করেন মাওলানা আকরম খাঁ। এই বিতর্কের ইতি টানতে কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন পৃথক ‘ঘোষণাপত্র’ দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথ ও লিটন হলে।
আবুল হুসেন এর ওপর ক্ষিপ্ত ও বিরাগ হওয়ার নেপথ্যের কারণ বুঝতে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র দফাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ১৯২৯ সালের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশন শেষে গ্রহণ করা হয়েছিল সমাজ সংস্কারের পাঁচ দফা প্রস্তাব—
এক. এই সভা বাংলার মুসলমান নর-নারীকে বিশেষভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালীকে কোরানের সহিত পরিচিত হইবার অনুরোধ জানাইতেছে।
দুই. এই সভা বাংলার পল্লীর বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠাগার ও গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে উদ্যোগী হইবার জন্য দেশের কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানাইতেছে।
তিন. এই সভা বাংলার বিভিন্ন মক্তব ও মাদ্রাসায় যাহাতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যায়াম শিক্ষার ব্যবস্থা হয় তজ্জন্য গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানাইতেছে।
চার. এই সভা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দকে পর্দাপ্রথা দূরীকরণার্থে আদর্শ স্থাপন করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।
পাঁচ. এই সভা সাহিত্য সমাজের কর্মীবৃন্দকে মুসলিম ইতিহাস, দর্শন ও ধর্মবিষয়ক আরবী ও ফার্সি গ্রন্থ সমূহ অনুবাদ করিবার জন্য একটি অনুবাদ কমিটি গঠনের করিতে অনুরোধ জানাইতেছে।
উল্লিখিত দফাসমূহেই স্পষ্ট হয় যে, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ কতোটা প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক ছিল। শুধু দফা দিয়েই তারা আলোকিত সমাজ গঠণের দায়িত্ব শেষ করেন নাই। লেখালেখি করেছেন এইসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করার নিমিত্তে। যার কয়েকটি লেখার নমুনা এখানে উল্লেখ করা হলো—
এক. ‘বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা প্রবন্ধে আবুল হুসেন লিখেছেন, ‘কেন মুসলমানের এই দুর্গতি? এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দিতে গেলে বলতে হবে আমাদের শিক্ষা নাই-জ্ঞানের সঙ্গে বহুদূর ক্ষতি ও বিরোধ করে বসেছি এবং বিজ্ঞান ও আর্টকে আমাদের শিক্ষা কেন্দ্র হতে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি-এই ভয়ে, পাছে তাতে আমাদের ধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম আমাদের এতই নাজুক।’
দুই. কাজী মোতাহার হোসেনের ‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’ প্রবন্ধটির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি লিখেছেন: ‘মুসলমান গান গাইবে না, ছবি আঁকবে না, এককথায় মনোরঞ্জনকর ললিতকলার কোনো সংশ্রবেই থাকবে না। মুসলমান পুরুষেরা কেবল কাজ করবে, আর ঘর শাসন করবে; মেয়েরা কেবল রাঁধবে, বাড়বে, আর বসে বসে স্বামীর পা টিপে দিবে; তাছাড়া খেলাধুলা, হাসি-তামাসা বা কোনও প্রকার আনন্দ তারা করবে না। সব সময় আদব-কায়দা নিয়ে দুরস্ত থাকবে।
আনন্দ? কোথায় আনন্দ? কী হবে আনন্দে? মুসলমান তো বেঁচে থাকতে আনন্দ করে না, সে মরে গিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করে পেট ভরে খাবে, আর হুরপরীদের নিয়ে অনন্তকাল ধরে আনন্দ করবে। ব্যস! এই তার সান্তনা! গৃহে যখন আমাদের থাকতেই হবে, তখন আমরা এর সংস্কারে লেগে যাই না কেন? সমাজকে যখন আমরা বাদ দিতে পারি না, তখন একে সরস শোভন এবং আনন্দময় করেই গড়ে তুলি না কেন?’
মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ সম্পর্কে আবুল ফজল বলেছেন, ‘শিখার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখাচিত্র ছিল, শুনেছি তা-ও এঁকেছিলেন আবুল হুসেন সাহেব। একটি খোলা কোরান শরিফ-মানব বুদ্ধিও আলোর স্পর্শে কোরানের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এই ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তাঁরা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গোড়া থেকেই গোঁড়ারা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল।’
মুসলিম সাহিত্য সমাজের এক সভায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াবো। আর একটা কথা- এতদিন আমি মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলভী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে, এর চেয়ে বড় সান্ত¡না আর আমি চাই না।’
বলা প্রয়োজন, কেবল মুসলিমরাই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্য ছিলেন এমন নয়। কবি মোহিতলাল মজুমদার, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো বহু অমুসলিম মনীষী সভায় অংশ নিতেন এবং তাদের মুখপত্র ‘শিখা’য় লিখতেন।
‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর প্রাণ ছিলেন আবুল হুসেন। শুধু বৌদ্ধিকভাবে নয়, আর্থিকভাবেও। ‘শিখা’ পত্রিকা প্রকাশের পুরো ব্যয়ভার বহন করতেন নিজে। ফলে, অনেকেরই জানা ছিল যে, আবুল হুসেনকে কোনোভাবে পর্যুদস্ত কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে পারলেই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ও তার ‘শিখা’কে নিভিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। এলক্ষ্যে তাদের সকল ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটালো ঢাকার নবাব পরিবারের সভ্যরা।
১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার নবাব বাড়িতে আবুল হুসেনকে নিয়ে বসেছিল এক সভা। যার সমাপ্তি ঘটে এভাবে-নবাব হাবিবুল্লাহ ঘোষণা দেন, ‘আপনি (আবুল হুসেন) জীবনে আর কখনো কিছু লিখবেন না- এই শর্তে মুচলেকা লিখে দিন, তবেই আপনার দণ্ড শিথিল হতে পারে বা আপনাকে ক্ষমা করা যেতে পারে।’ উত্তরে আবুল হুসেন বলেন, ‘আমি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কিছু লিখব না, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে লিখব-এই শর্তে আমাকে মুক্তি দেওয়া হেক।’ ক্ষমাপত্র লিখে দেয়ার বিনিময়ে ভোর রাত সাড়ে চারটায় আবুল হুসেনকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঢাকার রেনেসাঁর প্রধান পুরুষ আবুল হুসেনকে এভাবেই সরিয়ে দেয়া হয়, প্রকারান্তরে ঠেলে দেয়া হয় মৃত্যুর দিকে। গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আবুল হুসেনকে করা হলো দেশান্তরী। ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আবুল হুসেনকে এমন ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। এই ঘটনার এক দশকের মধ্যেই মারা যান তিনি। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে কর্মঠ, সবচেয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষটাই মারা যান সবার আগে। যদিও স্বল্পায়ুর জীবনেই ঢাকার রেনেসাঁয় যে দীপশিখা তিনি জ্বালিয়ে যান, তা কখনোই নিভে যাওয়ার নয়।
ঢাকার রেনেসাঁর দ্বিতীয় পর্বের সবচেয়ে সাহসী ও বৌদ্ধিকভাবে সবার থেকে এগিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব হলেন হাসান হাফিজুর রহমান। বাঙালির বুদ্ধিজীবীতায় ধ্রæপদী এক নাম। জন্মেছিলেন এই ভূখণ্ডের মানুষের এক মাহেন্দ্রক্ষণে ১৯৩২ সালের ১৪ জুন, মারা যান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল। মাত্র একান্ন বছরের স্বল্পরেখার জীবন। কিন্তু এই জীবন ক্ষণকে তিনি রাঙায়িত করে গেছেন নানাভাবে, যার নজির ছিল না সমসময়ে, এমনকি আজও নয়। স্বল্পরেখার জীবনকে সৃজন ও মননশীলতায় নিয়ে গেছেন মহাকালের অসীমতায়।
ঢাকার রেনেসাঁয় হাসান অনন্য এক চরিত্র। বাঙালির পুনর্জন্ম ও বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসকে আলোকবিস্তারী করতে পালন করে গেছেন অসামান্য এক বুদ্ধিজীবীর ভ‚মিকা। ইতিহাসের সঙ্গে থেকেছেন শিরদাঁড়া সোজা করে। ইতিহাসের বিনির্মাণে নির্মাণ করেছেন তুলনারহিত সব উদাহরণ। যা থেকে দীপিত হওয়ার ঐশর্য রয়েছে অজস্র। আগুনের পরশমণি সম এক প্রাণ ছিল তাঁর। যার ছোঁয়ায় আলোকিত হওয়া যায় নিজেকে-আলোকিত করা যায় দেশ ও জাতিকে। বাঙালিত্বের জন্য বাজি রেখেছিলেন আপন জীবন, বিক্রি করেছিলেন মায়ের গহনা। কারণ, হাসান জানতেন আবুল হুসেনের পরিণতি। তখনতো সমাজ ও তার নীতি নির্ধারকরা প্রতিপক্ষ ছিলেন, এখনতো যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রও। সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতাকে উচ্চকিত করতে, মহিমা ও মর্যাদা দিতে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। হাসান এসবকে পায়ের তলার ভৃত্য মনে করেছেন।
হাসানের জন্ম অবিভক্ত ভারতে-ব্রিটিশ শাসিত সময়ে। ব্রিটিশ যখন নিচ্ছে বিদায় এবং ভারত হচ্ছে স্বাধীন ও খণ্ডিত, তখন সদ্য কিশোর। পাকিস্তান নামক অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের যাত্রা ও এক কিশোরের যৌবনযাত্রা একই দ্বৈরথে তবে বিপরীত মাত্রায়, ঝাঁকের কৈ হয়ে নয়।
কেউ যায় যুদ্ধে কেউ যায় ভিক্ষায়। কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সেই হাসান বেছে নেন যুদ্ধের জীবন। ক্ষমতাবলয়ের-ক্ষমতাকাঠামোর লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জীবনকে দেখার, সমাজ-রাষ্ট্র-বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলাকাক্সক্ষার লক্ষ্যে কবির ধর্ম পালনের ব্রত। এ পথই হাসানকে রাজনীতি সংলগ্ন করে তোলে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাসলত বোঝার আতসীকাঁচ হয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পা পা বয়সেই দেশটির শাসকবর্গ সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে। হাসান তখন কলমের শক্তিকে পুঁজি করে রুখে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রকাশ করেন দাঙ্গাবিরোধী পাঁচটি গল্পের সংকলন। বয়স তখন মাত্র আঠারো। যাকে সাক্ষী রেখে সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি। এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়/ পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,/ এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়- এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’ হাসান কবির প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে, দায় মিটিয়েছিলেন ইতিহাসের।
হাসানের আঠারো রূপে যে যাত্রা বিশে এসে তা হয়ে উঠেছিল কিম্ভূত রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য সমূহ মাথা ব্যথার কারণ। তখন বায়ান্নো, বাঙালির জাগরণ ও পুনর্জন্মের ক্ষণ। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ। হাসান ও অলি আহাদ আলাপরত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। অলি আহাদ বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওখানে যেতে। কিছু ছাত্র তখন ইট পাটকেল ছুঁড়ছে পুলিশের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে। অলি আহাদ বললেন, ‘ওখানে গিয়ে ওদের থামতে বলো। তা না হলে ওরা গুলি করতে পারে।’ হাসান গেলেন-নিষেধও করলেন, কিন্তু ওরা শুনল না। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল হাসান নিজেও ইট পাটকেল ছোড়া শুরু করেছেন। একটা টিয়ারশেল এসে সামনে পড়ে। ফাটে না। কিন্তু ওটাই যখন উল্টোদিকে ছুঁড়ে মারেন, ফাটে। গোলাগুলি শুরু হয়। বরকত যখন গুলিবিদ্ধ হয়, হাসান তখন ওখানকার গেটে। হাসান এবং মুর্তজা বশীর অন্য একজন আহতকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসান এক্ষণে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অংশ। যদিও ইতিহাসের আরেক কালপর্ব অপেক্ষা করছিল তখনও। ইতিহাসের ভেতর থেকে নাকি ইতিহাসকে অবলোকন করা যায় না। ইতিহাসের আগাপাশতলায় চাপা পড়ে যায় প্রকৃত ঘটনা। নানা চাপানউতোরে হোঁচট খায় মূলস্রোত। কিন্তু হাসানকে এসবের কিছুই ছুঁতে পারে না। কারণ, আঠারোয় হাসান ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁর ভূগোল ও ভগবান। হাসান কিবলা চিনেছিলেন, একজন প্রকৃত প্রতিভার সহজাতগুণে, ধ্রæপদী বুদ্ধিজীবীর ওজস্বীতায়। সম্পাদনা করেন একুশে ফেব্রæয়ারি সংকলন।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলন গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, ‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রæয়ারি সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্মম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারি তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।’
কী সাংঘাতিক কথা, একুশের ঘটনার এক বছরের মধ্যে হাসানের সম্পাদিত গ্রন্থে বলা হচ্ছে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা।’ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে ওই সত্য আক্ষরিকভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে পরাধীনভ‚মে দাঁড়িয়ে কতোটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হলে ওরকম সোনায় মোড়ানো কথা বলা যায়? সত্যিই সেদিন একবিন্দু বাড়িয়ে বলা হয়নি, করা হয়নি সত্যের অপলাপ। একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় স্বীকৃত-বিশ্বজুড়ে সম্মানিত। যে একুশের বৌদ্ধিক বীজ রোপিত হয়েছিল হাসানের পৌরহিত্যে। একুশে বাঙালির প্রাণের বাতিঘর-বাংলাদেশের জন্মের পবিত্র ভ্রমণ, হাসান হলেন এসবের বৌদ্ধিক নায়ক। হাসান শুধু নিজে লেখেননি, অন্যের লেখা সংগ্রহ করেননি, অর্থনৈতিক দিক সামলাতেও রেখেছিলেন সাহসী এক ভূমিকা-তুলনারহিত উদাহরণ।
একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান লিখেছেন, ‘তেপান্ন সালের প্রথমদিকে হাসান প্রস্তাব দিল, ’৫২-এর উত্তাল ভাষা-আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখকসমাজ তুলির কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকাকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। সেই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বইটা বের করতে সেই মুহূর্তেই ৫০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা তাই করল হাসান। কথা দিলাম বই বিক্রি করে তার টাকা ফেরত দেবো। বই আমরা ছেপেছিলাম, বইয়ের প্রচারও যথেষ্ট হয়েছিল, ক্রেতারও ভিড়ও হয়েছিল। বইটার দাম রেখেছিলাম আড়াই টাকা। ১৯৫৩ সালের মার্চের শেষদিকে বইটা বেরুল আর সে বছরই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। ১৯ তারিখের দুপুরে লালবাগ থানার দুই ট্রাক পুলিশ এসে দোকান তছনছ করে দিয়ে গেল। ছাপান্ন সাল পর্যন্ত বইটি সরকার কর্তৃক বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল। (আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘একুশের প্রথম সংকলন’)।
হাসানের সহোদর খালেদ খালেদুর রহমানের জবানিতে পরে জানা যায়, হাসান জমি নয় মায়ের গহনা বিক্রি করে ‘একুশে ফেব্রুযারি’ সংকলনের টাকা যুগিয়েছিলেন। এরকমই ছিলেন হাসান। কেবল কবি নন। কেবল সাংবাদিক নন। কেবল সম্পাদক নন। এসবেরও অধিক ছিলেন। আর এখানেই হাসানের বুদ্ধিজীবীতার মহোত্তম উদাহরণ, অদ্বিতীয় অর্জন।
সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, ‘১৯৫৩ সালেই হাসান ছাড়া আর কে ভাবতে পারতেন আমাদের ভেতরে যে, একুশে ফেব্রæয়ারি আসলে তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ, তার বপন, তার লালন, তার পরিচর্যায় লেখকদের প্রত্যক্ষ অংশ নিতে হবে।’
একুশে ঘিরে যে দায় পালন করেছিলেন হাসান, তা জারি ছিল মৃত্যু অবধি। বায়ান্নোর পূর্ব এবং পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হাসান ছিলেন সক্রিয় যোদ্ধা-সাংগঠনিকভাবে প্রধান নেতৃত্বে। বায়ান্নো থেকে একাত্তরের সময়পর্ব হাসান শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে শুধু বিকশিত করেননি, বৌদ্ধিক লড়াইটাও জারি রেখেছিলেন সর্বতোভাবে। সেই সময় এমন কোনো সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল না, যারা প্রগতিপন্থায় সমর্পিত অথচ হাসানের সেখানে উজ্জ্বল উপস্থিতি নেই।
মুক্তিযুদ্ধে হাসান হারিয়েছিলেন দুই সহোদর। স্বাধীন দেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন সবকিছু নতুন করে সাজানোর। মানুষের দুঃখমোচনের জন্য যে লড়াই জারি রেখেছিলেন দুই যুগ ধরে। এবার সবকিছু উসুল হবে। হাসি ফুটবে সাধারণ মানুষের মুখে। বৈষম্য দূর হবে সমাজ-রাষ্ট্রের সব জায়গা থেকে। জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। বাক স্বাধীনতা রক্ষিত হবে। বিকশিত হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আমলারা সত্যিই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে অন্যের তরে-জনগণের সেবায়। সমাজ রাষ্ট্রে অন্যায়কে অন্যায় বলার সুযোগ তৈরি হবে। প্রশ্ন করার অধিকার থাকবে সবার। স্বাধীনতার সুফল কেবল ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া অধিকার হয়ে উঠবে না, আম জনতার সমঅধিকারকেও নিশ্চিত করবে। স্বাধীনতার অর্জন কেবল পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে-ব্রিটিশের একশ নব্বই বছরে যতো অপ্রাপ্তি ঘটেছে-অন্যায় অবিচার দুর্নীতি হয়েছে সেসব রুখে দিয়ে শুদ্ধতাকে নিশ্চিত করবে। কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতা নয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও নিশ্চিত করবে। কিন্তু স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় হোঁচট খেলো হাসানের ব্যক্তিগত খোয়াব- প্রত্যাশিত স্বপ্নের বাংলাদেশ।
হাসান নানারকম পেশায় যুক্ত ছিলেন। তবে সাংবাদিকতায় ছিলেন অনেকটা সময় জুড়ে। পাকিস্তান আমলে নানা পত্রিকায় চাকরি করে থিতু হয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। সরকারি পত্রিকা কিন্তু মাথা বিকোননি কখনো। হাসানের ধাতেও নেই সেটা। দেশ স্বাধীনের পর হাসান দৈনিক বাংলা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। শুরু হয় বাংলাদেশ অধ্যায়ের কর্মজীবন। এসময় তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও হন।
ঊনিশত তিয়াত্তর সালের ১ জানুয়ারি রাজধানীতে ঘটে অভুতপূর্ব এক ঘটনা। ভিয়েতনামে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক শোভাযাত্রা বের করে সমাজতন্ত্রীদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে যখন ওরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তখন পুলিশ আচমকা গুলি করে। এতে মতিউল কাদেরসহ দুজন নিহত হন। পাঠকের কাছে দ্রুত এ খবর প্রকাশের লক্ষ্যে দৈনিক বাংলা বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে হাসান লেখেন, ‘এত বড় একটি মর্মান্তিক ঘটনা কী করে ঘটতে পারল স্বাধীনতা-উত্তর পটভূমিতে, এ আমাদের বুদ্ধির অগম্য। এত লোকের মধ্যেও আবার নতুন লোকের আঘাত সইতে হবে, কী করে তা বিশ্বাস করা সম্ভব।’
গণমাধ্যমের নৈতিকতার জায়গা থেকে জাতির প্রতি দায় পালনের এই সাংবাদিকতাকে ভাল ভাবে নেওয়া হয় না। তাঁকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু তিনি যে নির্ভীকতা, দায়িত্ববোধ, জনহিতৈষণার পরিচয় দেন, তা অনন্য-সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য গর্ব ও গৌরবের ধন-পরম সম্পদ। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলকের সম্পাদকের দায় যে শেষ হওয়ার নয়, বুদ্ধিজীবীর ছাতা যে সুযোগ বুঝে বন্ধ হওয়ার নয়, হাসান সেটা প্রমাণ করেছেন চাকুরি খুইয়ে-অন্যদের বিরাগভাজন হয়ে। বায়ান্নো থেকে বাহাত্তরের এই যাত্রা হাসানকে পূর্ণতা দেয় বুদ্ধিজীবীর ধ্রুপদী তালিকায় নাম লেখায় সোনার হরফে।
‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র সংকলনের সম্পাদককে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের দায়ে করা হয় দেশান্তরী। সারা জীবন যিনি কবিতা চর্চায়-সাংবাদিকতায় লেখালেখিতে-সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে- সাংগঠনিক ভ‚মিকায় ও জনকল্যাণের প্রশ্নে দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন তাঁকেই পেশাগত জীবনে অবনমন দিয়ে চেনা মানুষ-চেনা চৌহদ্দি থেকে দূরে পাঠিয়ে হতাশাগ্রস্ত এক জীবনের দিকে রাষ্ট্রের প্রযত্নে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। এ ঘটনায় শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি, দেহে দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধে। কিন্তু হাসান বৃন্তচ্যুত হয় না।
স্বল্পরেখার জীবনের একেবারে শেষাশেষি এসে হাসান আরেক দায়িত্ব পালন করেন, যা কেবল তাঁকেই মানায়। একি কাকতাল নাকি ইতিহাসের অনিবার্য দায় পালন, তা জানার উপায় নেই। হাসানের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ষোলোখণ্ডের এই কাজকে হাসান প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে অন্য এক মর্যাদায় উচ্চকিত করেন। এই কাজে স্পষ্ট হয়েছে এবং দালিলিকভাবে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, নিরপেক্ষতায় তিনি ছিলেন তুলনারহিত এক নাম। নির্মোহ ও অবিচল থাকার গুণে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের সম্পাদকের প্রযত্ন ও পৌরহিত্যে যখন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জি ও দলিলপত্র প্রকাশিত হয় তখন মনে হয় এ বুঝি ইতিহাসেরই চাওয়া। ইতিহাস তার নায়ককে পূর্ণতা দেন এভাবেই।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সম্পাদনার অভিজ্ঞতা থেকে হাসান লিখেছেন, ‘সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার মতো দলিল ও তথ্যাদি সংগ্রহ সংখ্যার দিক থেকে বিপুল বলতে হবে। তবু আমাদের ধারণা এই যে, বহু দলিল ও তথ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি লোকই কোন না কোন ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িতে ছিলেন। গ্রামে গ্রামে বস্তিতে বস্তিতে বহু ঘটনার উদ্ভব হয়েছে, বহু বীরত্বগাথা, বহু ত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার, নিপীড়নের কাহিনী স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। এর পরিমাণ অনুধাবন করা কঠিন। তাছাড়া সারা বিশ্বজুড়েও ছিল এ সম্পর্কে সমর্থন ও প্রতিক্রিয়া এবং প্রবাসী বাঙালিদের ব্যাপক তৎপরতা। তাই সংগ্রহের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, তা বলা যায় না। দেশ ও বিদেশের তথ্য সংগ্রহের কাজ তাই কেবল বাড়তে পারে। শেষ সীমায় পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়া এখনই সম্ভব নয়। এর জন্য দীর্ঘ পরিক্রমা ও সক্রিয়তা প্রয়োজন।’
আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, ‘তারুণ্যের যে অগ্নি সেদিন প্রজ্বলিত করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান আর তার সাথীরা, আজো তা অনির্বাণ, অনির্বাণই থাকবে চিরকাল। (সূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘একুশের প্রথম সংকলন’।) একরত্তি মিথ্যে নেই সৈয়দের এই উবাচে। দুঃখ হলো, হাসানের উত্তরসূরীদের দেখা নেই, আতশকাঁচেও তালাশ হচ্ছে না তাদের অবয়ব।
হাসানের লেখা থেকেই শেষ করব দীর্ঘ পরিকল্পিত লেখার আজকের অংশুটুকু। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের একুশে ফেব্রুয়ারির সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে তাঁর লেখায় উল্লিখিত হয়েছে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই জোয়ার সৃষ্টি করেনি, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এনেছে দিগন্ত-বিস্তারি প্লাবন। প্রতিক্রিয়ার নির্মম হিংসা ও লোভের আগুন থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাবার জন্য দেশ জুড়ে জনতার যে দুর্জয় ঐক্য গড়ে উঠেছে, পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে তার কোন নজির নেই।… একুশে ফেব্রুয়ারি দেখিয়েছে জনতার সকল শ্রেণির প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে প্রতিক্রিয়ার সমস্ত ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করা সম্ভব।
একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রথম ব্যাপক পশ্চাদপসরণের সূচনা করেছে। সূচনা করেছে জনতার ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়াভিযান এবং সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক নবজাগরণের।’
আমরা মনে করি, হাসান হাফিজুর রহমান যে ‘সাংস্কৃতিক নবজাগরণ’র কথা বলেছেন সেটা শুধু সংস্কৃতিতে লাগেনি-সর্বত্রই লেগেছিল। এবং এটাই হলো ঢাকার রেনেসাঁ, যার শুরু হয়েছিল ১৯২১, চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ এ। এই রেনেসাঁকে যারা নানাভাবে ঋদ্ধ করেছেন প্রথম পর্বের সেইসব পথিকৃতদের অন্যতম ছিলেন আবুল হুসেন। দ্বিতীয় পর্বের নায়কদের অন্যতম হাসান হাফিজুর রহমান। ঢাকার রেনেসাঁকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে এঁদের এবং আরও অনেকের জীবন ও কর্মের প্রতি বিশেষভাবে আলোকপাত করা প্রয়োজন। এই লেখা সেই প্রচেষ্টার সূচনামাত্র কিংবা সূচনারও সূচনা।
লেখক : কাজল রশীদ শাহীন- কবি, গবেষক ও সম্পাদক।
আরও পড়ুন….