ডিসপ্লে
পালাতে পালাতে যে ছেলেটা জীবনের থেকেই পালিয়ে গেল সে তো তুমিও হতে পারতে!
এই কথা ভাবতে ভাবতে আমার গন্তব্য এসে যায়।
আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই গেটের দিকে
ছেলেটাকে ছাদের রেলিং এর ঐ পারে ঝুলন্ত রেখে আমি নেমে যাই গন্তব্যে
সিগারেট ধরাই
অতঃপর মোবাইলে চোখ রাখি,
এ এক আজব যন্ত্র! বুঝলে হে!
যার ছ’ইঞ্চি ডিসপ্লের মধ্যে আমার কলোনী, আমার উবু দশ কুড়ি পরিবার, আমার ভালবাসার তরুণ শহর, আমার প্রথম প্রেমিকা, আমার যৌবন, আমার শত্রু মিত্র উনকোটি জীবনের যাবতীয় ওঠাপড়া যাবতীয় ক্ষয়, জয়, ভয় সব সব পুরে দিয়েছে পটলের পুরের মতো, চুল্লীতে ‘বডির’ মতো, যা কি-না ৪৫ মিনিট পরে কতকটা ভ্যাসভেসে ছাই হয়ে বেরিয়ে আসবে,
সেই ছাই এর দিব্যি
ছেলেটাকে সম্পূর্ণ ভুলেছি আমি! ছাদের রেলিং এর শূন্য-পারে তার মুখ উলটো হয়ে ঝুলে আছে কি-না তাতে আমার ছেঁড়া যায়!
আমি ডুবে থাকি মোবাইল ডিসপ্লেতে, একাকী, নিঃসঙ্গ, দুর্ভাগা ঈশ্বরের মতো!
……
ফেরতনামা
তোমাকে বলা হয়নি বলে ফিরে এলাম
আরেকবার অগোছালো জীবনটাকে চেটেপুটে খেয়ে নেব বলে ফিরে এলাম
ফিরে এলাম তোমার কাছে যেটুকু ঋণ আছে
তার ফেরতনামা লিখব বলে
যেমন বসন্ত ফিরে আসে সদ্য বিধবা মেয়েটির কাছে
আমি ফিরে এলাম সেইমতো
শুধুমাত্র ঋণের ফেরতনামা লিখব বলে
অথচ কী আশ্চর্য দেখ! ফিরবে বলেও
ফেরেনি কনে দেখা আলোয় ভেজা
লাল লেটার বক্স
আর আকাশবাণী কলকাতার সাঁঝবেলাকার অনুরোধের আসর।
……
অরণ্যের ঐ পারে
নিরীহ যুবকের মতো
মদ্যপান করো
একা…একাকী শ্রমণের যাত্রাপথে
জলদানহেতু কেউ তো জীবিত নেই
কেউ তো সহজ নেই, যে
ভালবাসা দেবে
প্রেম দেবে, স্নেহ মায়া আরও যা যা কিছু
অকিঞ্চিত অর্জন মাধুকরী শেষে
কেউ তো থাকবে বসে
পথশেষে… অরণ্যের ঐ পারে
একা… একাকী
……
ঘুম
ঘুম চলে গেছে
সকলের নজর এড়িয়ে
অভিমানী বালিকার বেশে
ঘুম চলে গেছে
ভেজা দিনে আদা দিয়ে চা আর
প্রেমিকার চুমু
যে কোনো সন্ধ্যাকে তুঙ্গে তুলে দেয়
যদিও দুপুরের যৌনতা তার সঙ্গে তুলনীয় নয়
এর চেয়ে
খাবি খাওয়া জীবনের শেষ শ্বাসটুকু
রেখে দিও, জন্মান্তরে যদি কাজে আসে
সেই তার সার্থকতা, সেই তার জয়
বিষাদে চুবিয়ে তারে হারিয়ে ফেলোনা
অন্তরঙ্গ যাপনের কূটকাচালীতে
ঘুম যায়, ঘুম আসে, শরিকী শহরে
……
প্রেম
এইসকল হারামীপনা শেষ হলে
এইসকল বেনিয়াগিরির অবসানে
এক ক্লান্ত বিকেল আছে, অপেক্ষায়
আমিও মাদারির ওলটপালট গুনতে গুনতে
অসময়ে পৌঁছে গেছি মেঘরঙা বিকেলের চিবুকের নীচে
তিরতির কাঁপছে কন্ঠনালী
দীর্ঘচুম্বনের আশ্লেষ শেষ হলে
ঝিলিক দিল শেষ অরুণের হুতাশ
ধারালো ছুরিটি বড় লাল ভালবাসে
……
কবিতাভাবনা
গত একঘন্টা ধরে আমি কবিতা পড়ছি
যদিও ভোরের আলো আমার দরজা পার
হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো কালো বেড়ালের মতো, এত ভোরে বৃষ্টি শুরু হতে নেই, তাই রোদ্দুর আমার সাথে চা খাবে ঘুমচোখে, দুরে কোথাও কাগজওয়ালার ঘন্টি বলছে কেজো দিনের গল্প, রোদ্দুরকে বললাম- আয়, বোস ঐ বেতের মোড়াটায়, ওপরের ফুলকাটা তাকিয়াটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, এই নকশাটা খুব কমন, ঋতুপর্ণের সিনেমায় লাগসই…
-তুমি দেখো? সিনেমা? আমার প্রশ্নে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আলতো হাসল ও, যেন উত্তরটা অপ্রয়োজনীয়, প্রশ্নটাই আসল! পাল্টা প্রশ্ন এল সি এসের মতো ভুরু নাচিয়ে- কবিতা পড়ছো? তুষার রায় পড়েছো? হেলাল হাফিজ? আমি বললাম, সুরঞ্জনা অইখানে… ও থামিয়ে দিলো- ঐ জন্য আসি না এখানে! আমি জড়সড়- বেশ, একদিন সারাদুপুর হেলাল হাফিজ, কথা দিলাম! শুনে জানালায় থুতনি রেখে অল্প হাসলো ও, বলল- ট্রেনের ভিতর থেকে উল্টোদিকে দৌড়নো মাটি ঘাস নয়ানজুলি কালভার্ট দেখতে দেখতে আমার মনে হয় আস্তে করে নেমে যাই, এই খুব জোরে ছুটে চলা ট্রেন থেকে…এই মাঠে…এই আদিগন্ত ফাঁকা মাঠ আসলে ফাঁকা নয়… অনেক গল্প গড়াগড়ি খায় এই ফাঁকা মাঠগুলোয়… সিঁদুর ছাড়া মেজকাকিমার সিঁথির মতো… ফাঁকা… কিন্তু ফাঁকা নয়… অনেক গল্প…অনেক কলেজ…ক্লাস বাঙ্ক…অনেক অপেক্ষা… খুনসুটি… শাঁখ বরণডালা…পুরীর ঝিনুক… বাদ্দাও, যা বলছিলাম…আবার যেন নেমে এল ও আমার সমানে, বললো- চলো পরের স্টেশনে নেমে যাই, আমি বললাম- কি নাম স্টেশনের?
-উষুমপুর,
মুহূৰ্তে উত্তর দিল, তারপরেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল- না না কুর্চিডাঙা! এইটা বেশ নাম! উজ্জ্বল মুখে বলল রোদ্দুর…! আমি তখন পাশে ছুটে চলা ইলেকট্রিকের তারে ফিঙের দোল খাওয়া দেখতে দেখতে কবিতা পড়ছি আর অপেক্ষা করছি কখন আসবে পরের স্টেশন… কুর্চিডাঙা…
কবি পরিচিতি : ইন্দ্রনীল সুমন। কবি ও লেখক। কলকাতার কলোনি অঞ্চল নেতাজীনগরে আজন্ম বাস তাঁর। বিজ্ঞানে স্নাতক। লিখছেন আশির দশক থেকে। প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনেই লেখেন। যুগ্মভাবে প্রকাশ করেছেন ছোট পত্রিকা ‘অয়শ্চক্র’। কবিতার সংবেদনশীলতা ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে তাঁর ভাল লাগে। আর গল্পের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপন তাঁর পছন্দের জায়গা। লেখালেখি ছাড়া নাটক দেখা ও বেড়াতে পছন্দ করেন তিনি।
আরও পড়ুন – কথাশিল্পী আহমদ বশীর এর সাক্ষাৎকার