‘লেখক-সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন


রাহাত রাব্বানী

ছোটো জীবনে বেশকিছু আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমি পড়েছি। কেউ কেউ অকপটে লিখেছেন নিজের জীবন। কেউ কেউ করেছেন সত্য-মিথ্যার মিশেল। কিংবা ভুলে যাওয়া খণ্ড খণ্ড স্মৃতি লিখেছেন নিজের সৃজন ক্ষমতায়। এজন্য কারও কাছে নিজের জীবন হয়ে উঠেছে ‘নরক ও ফুলের কাহিনি’; কারও কারও কাছে ‘অর্ধেক জীবন’ বা ‘স্মৃতির রেখা’।

তবে আত্মজীবনী নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের কথাই আমার কাছে বেশি যুক্তিসঙ্গত ‘প্রণীত জীবন’: ‘জীবনের কাহিনী মাত্রেই রঞ্জিত কাহিনী, শাদা কথায় কাল্পনিক কাহিনী— যদিও তার নায়ক এবং বর্ণনাকারী ওই যাপিত জীবনের বাস্তব ব্যক্তিটিই। শেষপর্যন্ত, আর কিছু নয়, স্মৃতি থেকে উদ্ধারকৃত জীবন— প্রণীত একটি জীবন।’ স্মৃতিগদ্যের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। এসবকিছুর মূলে আমরা প্রধান করে দেখতে চাই সময়; কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়।

যেমনটা পাই আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিতে; জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ কিংবা সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরী’ পাঠে আমরা এখনও শিউরে ওঠি। আবার লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’, বিদিশার ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ স্মৃতিগদ্য আমাদের ভেতর অন্যরকম এক ছবি তৈরি করে। আমরা যা ভাবতে চাইনা, তাই তখন ভাবি। একজন ব্যক্তিকে দেখি ভিন্ন ভিন্ন চোখে। তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ নিয়েও এখানে বলা যায়। তিনি ‘ক’তে সৈয়দ হক, হেলাল হাফিজকে যতটা আলোচনা করেছেন; তারচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন নিজেকে নিয়েই।

সম্প্রতি পাঠ করলাম আনিসুল হকের স্মৃতিগদ্যের বই ‘লেখক-সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’। স্মৃতি থেকে নেওয়া বিষয়গুলো তিনি লিখেছেন। লিখেছেন আনন্দঘন মুহূর্তের কথা। সাহিত্যের ছাব্বিশজন তারকার কথা বলতে যেয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কথাই বলেছেন। নিজের কথা এড়িয়ে চলেছেন সচেতনভাবেই।

সম্প্রতি পাঠ করলাম আনিসুল হকের স্মৃতিগদ্যের বই ‘লেখক-সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’। স্মৃতি থেকে নেওয়া বিষয়গুলো তিনি লিখেছেন। লিখেছেন আনন্দঘন মুহূর্তের কথা।

আর একারণেই আমরা শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজকে দেখতে পাবো ভিন্নভাবে। দেখতে পাবো আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেলাল চৌধুরী বা রবিউল হুসাইনকে। আমাদের পরিচয় ঘটবে অদেখা আনিসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সৈয়দ আবুল মকসুদ, শামসুজ্জামান খান, দেবেশ রায়ের সাথে। পাবো হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ুন আজাদের উপর নিরপেক্ষ দৃষ্টি।

নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে তিনটি লেখা লিখেছেন আনিসুল হক। শিরোনাম তিনটি যথাক্রমে ‘নির্মলেন্দু গুণের রসিকতাগুলো’, ‘নির্মলেন্দু গুণের মডেলিং’, ‘নির্মলেন্দু গুণের আরও রসিকতা’। গুণদার রসিকতার সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। আনিসুল হক এইসব রসিকতার সূত্রধরে ভিন্ন এক নির্মলেন্দু গুণকে আবিষ্কার করেছেন। আসুন পড়ি, ‘ঘরের ভেতরটা দিনের বেলায়ও অন্ধকার। ঘরে কোনো আসবাব নেই বললেই চলে। আমরা ছাত্রাবস্থায় মেসে বা হোস্টেলে যে রকম কাপড়চোপড় ঝুলিয়ে রাখতাম এখানে-ওখানে, তেমনি কিছু পাঞ্জাবি ঝুলছে। স্টিলের আলমারির ওপর তাঁর বইগুলো। একটি কম্পিউটার অবশ্য ঘরে আছে। সেই ঘর, ঘরের পরিবেশ দেখে আমার চোখে জল চলে এল। এই লোক বলে কিনা ‘টাকা দিয়া আমি কী করব! আমার টাকার দরকার নাই!’ একটা লোক এমনি এমনি বড় হয় না। কবির ভেতর একজন ঋষি বাস করে। তাই তিনি বড় কবি। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতার জন্য নিজের জীবনের লোভ-লালসা ও স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছেন।’

আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কবি গুণের চিত্রও ধরা পড়েছে আনিসুল হকের গদ্যে: ‘আমি বললাম, ‘আমি এই ছবিটাও কিনব। কারণ, আপনি তো টাকা দিয়ে আপনার গ্রামে আপনার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের খরচ জোগাবেন।’ নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘খবরদার, তুমি আমার ছবি কিনবা না। তুমি সাহায্য করার জন্য আমার ছবি কিনবা, তা হবে না। তুমি তখনই ছবি কিনতে পারবা, যখন তুমি ছবি পছন্দ করবা।’

নির্মলেন্দু গুণের সমসাময়িক কবি মহাদেব সাহা। এই দুইজনের চেহারা দেখলেই কবির জীবন, কবির চেহারা কেমন হয় তা ভেসে ওঠে। মহাদেব সাহা ব্যক্তি জীবনে তার কবিতার মতোই নরম। আনিসুল হক লিখেন, ‘মানুষ হিসেবে এত নরম! আমি আমার চেয়েও নরম মানুষ ঢাকায় একজনকেই দেখেছি, তাঁর নাম মহাদেব সাহা।’ প্রসঙ্গত বলে রাখি, মহাদেব সাহার জন্মদিনে ‘আমার মহাদেবদা’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেন আনিসুল হক। আমি ফোনে মহাদেবদাকে লেখাটি পড়ে শুনাই। তিনি কাঁদতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, ‘মিটুন, আমাকে গোপনে এত ভালোবাসে? এতসব ও মনে রেখেছে?’

কাব্যপাড়ায় শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ নিয়ে একটি সংঘাত লেগেই আছে। কবিতায় কে বড়ো, কে ছোটো— তা নিয়ে আলোচনা বেশ জটিল। কবি শামসুর রাহমান নিয়ে আনিসুল হকের ভাবনা যেন আমাদেরই কথা: ‘শামসুর রাহমান আমাদের সবচেয়ে মিস আন্ডারস্টুড পোয়েট। আমরা তাঁকে ভুল বুঝেছি। আমাদের ধারণা, তিনি শুধু সমকালীন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। প্রথমবার মৃত্যুর পর জেগে, ল্যাজারস, এই পৃথিবী, এই সাবেকি পৃথিবীকে দেখছে। করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলছে। দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভেসে আসছে। এই ইমেজ একজন কবি তাঁর প্রথম বইয়ের পূর্বলেখে লিখে গেছেন। কতটা শক্তিমান হলে এটা করা সম্ভব!’ শহীদ কাদরীকে এখানে আমি সংযুক্ত করতে চাই। তিনি লিখেছিলেন, আমি বাঙালি হিসেবে দুটি বিষয় নিয়ে গর্ব করতে পারি। এক. বঙ্গবন্ধু, দুই. শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমানের সবচেয়ে দুর্বল প্রেমের কবিতাটিও টিকে থাকবে।

আল মাহমুদ নিয়ে আনিসুল হকের বক্তব্য দেখা যাক: ‘ কাব্যহিংসা নয়, তাঁদের (শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ) এই বৈরিতার মূলে ছিল আদর্শের দ্বন্দ্ব।… কেউ যদি ভালো কবিতা লেখেন, তাঁর কবিতা পড়লে যদি ভালো লাগার অনুভূতিতে হৃদয়-মন আচ্ছন্ন হয়, তখন তাঁর কবিত্বশক্তির প্রশংসা না করে পারা যায় না। আল মাহমুদ আমাদের প্রধান কবিদের একজন। এ স্বীকৃতির জন্য তাঁকে কারও কাছে সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।… সন্দেহ নেই, শামসুর রাহমান বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম প্রধান কবি। কিন্তু তার মানে এই নয়, তিনিই দেশের একমাত্র প্রধান কবি।’

প্রকাশনা জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই নাম হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন। আনিসুল হক তার বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখেছেন তাদের।প্রকাশনা জগতকে দাঁড় করানো এই দুই সাহিত্যিকের সাহিত্যের মূল্যায়নও করেছেন আনিসুল হক। ইমদাদুল হক মিলনের ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’ গল্পের ছোটো এক আলোচনা গল্পটি নিয়ে নতুন করে ভাবনার খোরাক যোগাবে পাঠকদের। হুমায়ূন আহমেদের প্রখর হিউমার কিংবা রসবোধ পাই আনিসুল হকের গদ্যে। তার ‘দখিন হাওয়ার দখিন বারান্দা’ গ্রন্থটি পাঠে ব্যক্তি ও লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে চমৎকার ধারণা পাওয়া যায়।

আনিসুল হক ‘লেখালেখির গুরু’ হিসেবে এনেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। সৈয়দ হক সম্ভবত আমাদের সেই বড়ো লেখক; যাকে নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিল, ততটা হয়নি। সৈয়দ হক নিয়ে লেখা স্মৃতিগদ্যগুলোতে কয়েকটি কাব্য, কাব্যনাটকের নাম এলেও তাঁর সাহিত্যিক বিশ্লেষণ যথাযথভাবে সামনে আসেনি। গদ্যগুলো যেহেতু আড্ডার, সেহেতু তত্ত্ব কথা না-থাকাটাই স্বাভাবিক।

আনিসুল হক ‘লেখালেখির গুরু’ হিসেবে এনেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে। সৈয়দ হক সম্ভবত আমাদের সেই বড়ো লেখক; যাকে নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিল, ততটা হয়নি।

একইভাবে এসেছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ মকসুদের কথা। সায়ীদ স্যার ব্যতীত সবাই আমাদের কাছে গুরুগম্ভীর। কিন্তু তাদের ভেতর আছে প্রবল রসবোধ। সেসব উল্লেখ করেছেন আনিসুল হক। অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকার কিংবা দেবেশ রায়ের সাথে চিঠি চালাচালি আমাদের দেয় অন্যরকম এক আমেজ।

‘লেখক আড্ডা’ গ্রন্থটি পাঠান্তে আমাদের সামনে দৃশ্যায়ন হলো কয়েকটি খণ্ড চিত্র৷ যা কেবল আড্ডার, আনন্দের। আর একইসাথে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এসব আড্ডা আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত।

আরও পড়ুন…

এবং বই’র নতুন সংখ্যা প্রকাশিত