শাহেদ কায়েস এর কবিতা ও কবিতা ভাবনা

নদী

ঘাটে গিয়ে শুনি বেড়াতে চলে
গেছে নদী, ফিরবে সন্ধ্যায়।

এমন এক দিনও কী ছিল—
যেদিন নদীর সঙ্গে দেখা হয়নি!

সন্ধ্যা গড়িয়ে মধ্যরাত—
ফিরে তো এলো না নদী…

ঘাটকে শুধাই— দেখেছ নদীকে
ঘাট ইশারায় বলে— খুঁজে দেখ

ও নৌকা— নদীকে দেখেছ তুমি
একটু আগেও তো উজানে ছিল

ঘাটের কাছেই জাহাজ-ভাঙা
শিল্প-বর্জ্য, সিমেন্ট কারখানা

সবাই আছে যার-যার মতো—
কোথাও তো নদীকে দেখি না

বলল ডেকে বিষণ্ণ গাঙশালিক—
নদী ভীষণ অভিমানী,

ভালোবাসা না পেলে নদীও—
মুখ ফেরায় অন্যদিকে।

শূন্যতা

নির্বাক কবরস্থানে জোনাক-জ্বলা সন্ধ্যায়—
ফেলে এসেছি আমার শৈশব; পাশেই শীর্ণ
ব্রহ্মপুত্র নদ— শুনি জলের অধরা বিস্মৃতি

আমাকে জানে ওই শতবর্ষী বট, যে দুঃখ না—
পাওয়ার দুঃখে ঝুঁকে থাকে ব্রহ্মপুত্রের জলে

কুমারীপথ, শৈল্পিক বাঁক, ট্রেনের হুইসেল
গেল কি বিশ্রামে— বটগাছটির আড়ালে?

দল বেঁধে শূন্যতা ঝাঁপ দেয় নবীন কবরে
সারারাত গোর-খোদকদের আলাপ শুনি

সেই জোনাকিদের কোথাও দেখিনা আর।

প্রকৃতি গণিত

জঙ্গলে ঝাঁকে-ঝাঁকে নেমেছে আলো
অপরূপ জ্যামিতিক নকশায়…
বাঁশঝাড় ছুঁয়েছে বিষাদ, বিগত রাতের

ফুটি তুলো উড়ছে ভোরের আকাশে
বেগুনী রঙের জামদানি বাতাসে―
চোখ জুড়ানো বুনন ও সৌন্দর্য…

বৃক্ষের পুস্তকে রেখেছি তৃষ্ণার্ত চোখ
এ কোন ভাষায় কথা বলছে প্রকৃতি!

এই স্থির, এই অস্থির রাজ্যে এসে বুঝি
প্রকৃতির গণিতে আমরা সবাই সংখ্যা―
জগতের প্রতিটি প্রাণ, এমনকি মানুষও।

গণিতের চেয়ে সংখ্যা বড় হয়ে উঠতে নেই।

সম্পর্ক

চিরস্থির কেন্দ্র বলে কিছুই নেই
কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে…

একেকটি সম্পর্ক কেন্দ্রের মতো
পরিধি ঘিরে এতো-এতো আয়োজন!

যদিও প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন আমি…
জন্ম নেয়া নতুন আমি— পুরনো আমি
দুই আমির মাঝে বয়ে চলে এক নদী
ঠিক তেমনি, তুমিও— প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন

আমির সঙ্গে তুমি, তুমির সঙ্গে সে
এভাবেই সম্পর্কগুলো ছড়িয়ে পড়ে…

উড়ে গেলেও প’ড়ে রয় সম্পর্কের পালক
এ-ঘরে, ও-ঘরে পায়চারি করে—
তোমার ফেলে যাওয়া স্পর্শ

কোনো সম্পর্ক চিরতরে হারিয়ে যায় না
ফিরে ফিরে আসে— তুমি, আমি, সে…

যেমন পৃথিবীর জল মেঘ হয়ে ওড়ে—
ভাসতে-ভাসতে একদিন বৃষ্টি হয়ে ফেরে।

হারানো সম্পর্ক যদিও আগের মতো—
থাকে না— ফিরে আসে নতুন মাত্রায়…

আমরা কেউই কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নই।

প্রেম

প্রেমে আক্রান্ত মানুষ প্রতিধ্বনি হয়ে যায়, চতুর্দিকে
ছড়িয়ে পড়ে প্রতিধ্বনি— গাঙের ঢেউয়ে, অরণ্যে

সমুদ্র, পাহাড় সব একাকার করে তোলে প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনির কাছে আমি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করি

ফিরিয়ে দাও দরোজা-জানালা-দেয়ালহীন একটা
জীবন— প্রাণপ্রকৃতির দোলায় দেহহীন নিঃশ্বাস

উৎসের কাছে কেন যে বারবার ফিরে আসো তুমি!
প্রেম মানেই আংশিক মৃত্যু, আংশিক নতুন জন্ম

কবিতা ভাবনা

কবিতা যেন মহাবিশ্বের এক কৃষ্ণগহ্বর

আমার বেড়ে ওঠা নদ-নদীর কূলে কূলে― ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, শীতলক্ষ্যাঘেরা ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা অসম্ভব সুন্দর এক স্থান ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ে। জন্মেই দেখেছি বিশাল আকাশ, জ্যোৎস্নামাখা প্রান্তহীন মাঠ, বর্ষার জল-জঙ্গল। এই দেখা কখন যে খুলে দেয় আমার মনের জানালা! সেই জানালাপথে আলো আসে, হাওয়া আসে, প্রজাপতি, গঙ্গাফড়িং, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে, প্রকৃতির গান আসে, সুর আসে, আর আসে মানুষ। আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এই সমস্ত কিছুই আমাকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়, গভীরে কোথাও তৈরি হয়ে ওঠে ভিন্ন এক জগত। কবিতা হচ্ছে আমার কাছে সেই দুরন্ত কিশোরী― যে একই সঙ্গে স্মার্ট এবং সহজিয়া, যার সঙ্গে আমি অনুভব করি অলৌক এক আত্মীয়তা, যার আছে কাছে টানার দুর্বার আকর্ষণ, সমাহিত এক রূপ। মাঝে মধ্যে মনে হয়, কবিতা যেন মহাবিশ্বের এক কৃষ্ণগহ্বর, রহস্যে ভরা মহাবিস্ময়!

কবিতায় সময়কে ধরার একটা চেষ্টা থাকে। সময়কে ধরে, সময়োত্তীর্ণ একটা স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে আমার কবিতায়। আমার লেখা আমার নিজের সঙ্গে নিজের, এবং একই সঙ্গে জগতের অন্য সকল বস্তু-প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে আমার ইন্টারেকশন। হ্যাঁ এটা সত্য যে লেখালেখিতে শিল্প সৃষ্টির একটা বিষয় থাকে, যা এক সময় আমার মধ্যে প্রবল ছিল, তখন ‘শিল্পের জন্য শিল্প’, নাকি ‘জীবনের জন্য শিল্প’ এসব নিয়ে খুব ভাবতাম। এখন আমার মনে হয় বাস্তব ও কল্পনা, জীবন ও শিল্প কেউ কারো কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জীবন মানেই লড়াই, এই পৃথিবীতে লড়াই করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। আমার কাছে লেখাটাও আমার লড়াইয়েরই একটি অংশ, অপ্রত্যক্ষ লড়াই।

কবি পরিচিতি

শাহেদ কায়েস মূলত কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। পৈতৃক নিবাস, সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে। পড়াশুনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই; এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে মাস্টার্স। কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে। থাকেন নিজ গ্রাম সোনারগাঁয়। পেশা ফ্রি-ল্যান্স গবেষক। তিনি একজন মুক্ত-চিন্তক, সংস্কৃতিকর্মী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা (দোয়েল প্রকাশনী, ১৯৯৯), চূড়ায় হারানো কণ্ঠ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), মায়াদ্বীপ (ঐতিহ্য, ২০১৫), কৃষক ও কবির সেমিনার (অভিযান, ২০২০), সহজিয়া প্রেমের কবিতা (অভিযান, ২০২১), নৈরাজ্যবাদী হাওয়া (চৈতন্য, ২০২৩), স্বনির্বাচিত কবিতা (ভাষাচিত্র, ২০২৩)।

সম্পাদিত গ্রন্থ: মঙ্গলসন্ধ্যা প্রেমের কবিতা (ধ্রুবপদ, ২০১৭)।

অন্যান্য গ্রন্থ: এশিয়ার বারটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি (ইংরেজি গ্রন্থ, মে এইটিন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৫), বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)।

পুরস্কার ও সম্মাননা: চন্দ্রাবতী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (কবিতায়, ২০২১), শালুক সম্মাননা (২০১৯)।

আরও পড়ুন.. উন্নয়নের বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন চোখে বাংলাদেশ দেখার বই ‘উন্নয়নপাঠ: নদী ও প্রাণ’