কার্পেটের নিচে
হাহাকারের নৈঃশব্দ্য উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছে
ভুয়া নামে, শূন্য একাউন্টে
আর দেশপ্রেম দেখাতে বলে দেশ
নিজেই উধাও হয়ে যাচ্ছে মাথার চারপাশ থেকে
ক্যানেস্তারা টিন ফুটো করে আকাশে উঠে যাওয়া গাছ
ক্ষমতার চলাচল টের পেল নিজের হারিয়ে যাওয়া ছায়ার ভিতর
কোনও এক চলমান এক্স পাচারচক্রের প্রতিটা জংশনে বহুকাল দাঁড়িয়ে
তারা বৈরাগ্যের জল ও বাতাসে ক্রমে মিশে যায়
আর নিরীহ ঈস্ট গেঁজিয়ে ওঠে ঘরের ছদ্মবেশে
আদরের কার্পেট তুলে দেখায় লুকিয়ে থাকা মৃত্যুগুলোকে
……
অপেক্ষাই নিরাময়
নিষ্পাপ খেলায় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে অভাবসমুদ্র
যাওয়া-আসার রাস্তা আগলে বোতল-মুক্ত দৈত্য
তার সঞ্চয় খুলে দেখালেই
মগজের স্নায়ু স্থির
বাঁচার খিদেও নিশ্চুপ
নিস্তব্ধ শরীর যেন আকাশে ভেসে বেড়ানো চিল
নশ্বরের ধ্যানে
সমস্ত জমিই কি পেরিয়ে আসে
কোর্টকাছারি, শরিকি রক্ত, মানুষের অন্তহীন লোভ !
প্রতিদিনই একটা না একটা রক্তাল্পতার নিমেষ
একটা অসাড় হাত
হাড়হিম দৃশ্য
নিরাময়ের খোঁজ
ঘটনার অভাববোধে ভুগতে ভুগতে
একটা প্রাচীন গাছ রাস্তার পাশে তবু দাঁড়িয়ে আছে বহু বছর
……
মাটির ড্রাগন
ফাঁকা মাথার চারপাশে
বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে জল
নদীতে এত জোয়ার, এত ঘূর্ণি যে
সমস্ত শপথ মিথ্যে করে বিধ্বস্ত কাপ্তেন
দক্ষতা আয়ত্ত করেই নেমে যায় তা বেচার প্রকল্পে
সিংহের থাবাওলা চেয়ারে বসেছে প্রেমিক
থেকে থেকেই মাটির ড্রাগনের শূন্য হাঁ-এর ভিতর আঙুল ঢোকাচ্ছে
আর তার অনুভূতির লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠছে অন্তর্বর্তী একাধিক সত্তায়
ছাই রং খুব প্রিয় বলেই
ছাই থেকে ফিনিক্স হওয়ার স্বপ্নও একদিন ছাই হয়
আর নাকচবাদীরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলে স্মৃতির তীক্ষ্ণতা
নিধিরামের মৃত্যুর পর
আইসিসিইউ এর ভিতর থেকে দেখছি বাইরের দৃশ্য
আমাদের অস্ত্র কাঠের তলোয়ার
……
শান্ত এলার্ম
অন্তরের কোলাহলে জেরবার লোকটা
বুলস আই-এর ধারেকাছে ঘুরঘুর করে
খেলনা পিস্তল হাতে
পানজর্দার ভারী গন্ধে থৈ থৈ তার ঘর বারান্দা
রহস্যময়
শরীরঘেঁষা
অন্যের মোক্ষ অন্যের তুলসীচন্দন
ছায়া ফেলে তার জলে, গ্লাসে
কেউ যেন হাত নাড়ে দূরে
বায়োস্কোপ থেকে
রেডিও থেকে
কেউ কি বেরুলো মিথ্যে আলোয় !
বহু-জানালাময় ভোরের স্বপ্নে
দেখো কি শান্ত এলার্ম !
গায়ে প্রাচীন উদ্বৃত্ত অন্ধকার
বালির ভাস্কর্য থেকে উড়ে যায়
মানুষের ক্যাম্প, দেদার পতঙ্গ
বর্তমানের পিঞ্জরের পোষা পাখিগুলো
মিথ্যেই ডানা ঝাপটায়
বেশি বেশি
……
মহাজাগতিক ক্লাশরুম
খোলা মাঠের স্বপ্নে কোত্থেকে এসে বসেছে উঁচু উঁচু পাথর। রঙিন তাপ্পি কাপড়ের
জামা গায়ে কেউ হাত পা নেড়ে নিঃশব্দে নানান অঙ্গভঙ্গি করে। ডগায় দরহুমকিপত্র
নিয়ে অসংখ্য তির ছুটে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। আফ্রিকান মুখোশে মুখ ঢেকে এইসব
অপ্রবেশ্য দৃশ্যমালা দেখছি দূর থেকে আর ভাবছি আমিই টোটেম। আমিই চিন্তা।
আমাতেই আত্মসাৎ হয় অনুভূতি। কারণ আমি জানি সকালের প্রতিজ্ঞা রাতে ব্যর্থ হলে
আমার ভিতরের সাইলেন্স টাওয়ারটা আর একটু বড়ো হয়।
……
আরও পড়ুন – অতনু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা ও কবিতা ভাবনা
কবিতা ভাবনা
কবিতা যখন ভাবনার বিশৃঙ্খলা
যত দিন এগোয় তত ভাবনার বিষয়গত একাগ্রতা কমে আসে। আগে ছিল গভীর মনোনিবেশ, নিজে নিজেই সম্মোহিত হওয়া। আর আবেগের ঘন উৎসারণ। দায়দায়িত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে লেখা। সদ্য শেখা ছন্দের তরোয়াল ঘোরানো আর ছন্দের শৃঙ্খলার মধ্যে বেপরোয়া শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া – এই ছিল অভীষ্ট। কবিতা তখন অত রহস্যময় ছিল না।
মাঝে মাঝে নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম কবিতায় ঠিক কী রাখতে চাই – আলো? অন্ধকার? জন্ম? মৃত্যু? প্রেম? শূন্যতা? নৈঃশব্দ্য? সৃষ্টি? ধ্বংস? মঙ্গল? একাকীত্ব? সংঘ? আদি? অনন্ত? – উত্তর পেতাম না। আমার কবিতাভাবনায় উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই ছিল বেশি।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবন হয়ে এলো একটা অভ্যেস। জীবন থেকে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকল। আর কবিতা হয়ে উঠতে শুরু করল যেন আরও রহস্যময় যাকে ধরতে গিয়েও ধরা যায় না। আগে ভাবনারা ছিল একমাত্রিক, পরিণতিমুখী। এখন এক ভাবনা থেকে সরে সরে যায় মন। সব চিন্তারই পরিণতি অজানা। এখন একটা বিক্ষিপ্ত মন সম্বল। অনেকগুলো scattered ভাবনাকে কোন যোগসূত্রে জুড়ে দেওয়া যায় সেই নিয়েই ভাবতে থাকি। একটা চায়ের দোকানের আড্ডার কথা মনে হয়। যেখানে একজন কথা বলে না, অনেকে বলে। একটা বিষয়েও সীমাবদ্ধ থাকে না আড্ডা।
বহু ভাবনার, বহু কথকের স্বর একটা কবিতায় ভরে দেওয়া এবং ক্রমাগত সংকোচন ঘটাতে থাকা। সংকুচিত হতে হতে সে একসময় হয়তো একটা কোড ল্যাংগুয়েজে বা কুহকে পরিণত হয় যাকে কোডমুক্ত করে তুলবে পাঠক। এইরকম পাঠকের সংখ্যা কতজন তা অবশ্য আমার জানা নেই। আর এইরকম কবিতায় কতটা “কবিতা” শেষপর্যন্ত থেকে যায় তাও আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবু এই হল আমার এখনকার কবিতা।
আমার কবিতার প্রথম পাঠক অবশ্য আমি নিজে। নিজেকে পাঠক করতে হলে আগে নিজের কবিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। সেজন্য মাঝে খানিকটা সময় বয়ে যাওয়া চাই। সেটা করতে গিয়ে লেখা কমে আসে। এটাই ভবিতব্য।
শব্দঝংকারের প্রতি অনীহা থেকেই এখন গদ্যকবিতা লেখার চেষ্টা করি। শব্দ থেকে ধ্বনির বিলোপ ঘটাতে এখন আমার ভালো লাগে। ছন্দ মিলের তাড়নায় শব্দ তার ইশারা প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করে। কবিতায় শব্দের ফর্মালিটির চেয়ে আড্ডা দিতে দিতে দুটো কথা বলতে বা ইঙ্গিত দিতে বড়ো ভালো লাগে। অবশ্য গদ্যকবিতায় ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।
আমার মনে হয় ছন্দ শব্দের জোগান দেয়, শব্দের আগমনের পথ সুগম করে। ছন্দের কবিতার শব্দের দলবল ভারী। তার আঁটোসাঁটো কাঠামো কবিতাকে নেতিয়ে পড়তে দেয় না, সবসময় উজ্জীবিত করে রাখে। গদ্যকবিতায় সেই সুযোগ নেই। এখানেই গদ্যকবিতার চ্যালেঞ্জ।
ছন্দের কবিতার একটি শব্দের সঙ্গে গদ্যকবিতার একটি শব্দের অনেক তফাত। গদ্যকবিতার শব্দ বড়ো একা। নিঃসঙ্গ। সঙ্গী পাওয়ার জন্য সে নিজেকে খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তেই থাকে। আর তার চারপাশে জমতে থাকে ভ্রম, কুয়াশা। সে তার আত্মীয় এবং প্রতিবেশী শব্দকে খুঁজে পাবার আগেই হয়তো শেষ হয়ে যায় কবিতা। তাই প্রত্যেকটা গদ্যকবিতাই অসমাপ্ত, অনিশ্চয়তায় ভরা।
কবিতা বাইরে থেকে বিষয়হীন হতে পারে কিন্তু তার ভিতরে পাওয়া চাই ফিলিংসের শিরশিরানি। কবি কি পারে কবিতার শব্দকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ফিলিংসে পৌঁছতে ? শব্দকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে প্রথমে তো হত্যা করতে হবে তার অর্থকে, তারপর তার ধ্বনিকে। এই অর্থহীন ধ্বনিহীন শব্দ তারপর জাগিয়ে তুলবে নৈঃশব্দ্য। কবিতায় শব্দহীন শব্দ লিখে যাওয়া সম্ভব ? এইভাবে জৈবতা হারিয়ে কবিতা হয়ে যাবে না তো রক্তমাংসহীন ! ঘটে যাবে না তো কবিতার নির্বাণ ? এরপরেও পারব তো নিজের ভেতরের জেগে ওঠা হাউইকে জ্বালিয়ে নিঃশেষিত হয়ে যেতে ?
এখনও আমার কবিতাভাবনায় উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই বেশি।
এইসব ভাবনা কি প্রতিফলিত হয়েছে আমার কবিতায় ? না। কবিতাভাবনা হল দিকনির্ণয়ের যুক্তি আর কবিতা হল অযুক্তির জাদু। ফলে তফাত তো থাকবেই।
কবি পরিচিতি : জন্ম ১৯৬৪, নিবাস- কলকাতা।
প্রকাশিত কবিতার বই : তোমাকেই প্রস্তাব দেব, নৈঃশব্দ্যের পাসওয়ার্ড, অগাধ জলে খড়কুটো।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘নীললোহিত’ সাহিত্য পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক।
সংস্কৃতি জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দিত্রশিল্পী হিসেবে নয়ের দশকের শুরুতে। নয়ের দশকের শেষদিক থেকে ক্রমশ সরে আসেন কবিতার জগতে।