পশ্চিমবঙ্গের একটি অজপাড়াগাঁয়ে আমার শৈশব কেটেছে। হুগলি জেলার সেই ছায়াঘেরা শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের গ্রাম, তার ছোট্ট প্রাথমিক স্কুল, খেলার মাঠ, ঝোপঝাড়, ছোট ছোট পুকুর-ডোবা-দিঘি সব মিলিয়ে সে ছিল এক স্বপ্নের ছেলেবেলা। আর এসব কিছুর সঙ্গে জুড়ে ছিল আরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- প্রভাত সংঘের গ্রামীণ পাঠাগার। সপ্তাহ শেষের শনি এবং রবিবার বিকেলে সে পাঠাগার খুলত। খুলতেন গ্রামের অবনী কাকু। তিনি কলকাতায় কোনো এক সরকারি অফিসে সামান্য বেতনের চাকরি করতেন এবং নিতান্তই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র তাগিদে প্রভাত সংঘের পাঠাগারের দরজা খুলতেন। অস্পষ্ট কাচে ঢাকা কাঠের আলমারি দুটিকে একটি ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মুছতেন পরম মমতায়। শীতের বিকেল ফুরিয়ে যেত দ্রুত, ঘরের কোণে রাখা হারিকেনের কাচ মুছে খুলে বসতেন বই দেওয়া-নেওয়ার খাতা। বাইরে তখন ঝুঁঝকো অন্ধকারে ইতিউতি উড়ে বেড়ানো জোনাকির জোট বাঁধা… আর আমাদের সামনে খুলে যাওয়া স্বপ্ন-কল্পনার মায়াবী সফরের দরজা- বই। সেই ছায়াঘেরা স্বপ্নমাখা গ্রামে টিনের চালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কার হিসেবে একটি অষ্টাশি পৃষ্ঠার বই উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম।
দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত সেই বইটির নাম ছিল ‘সুন্দর বনের শিকারী’। চন্দ্রকান্ত দত্ত সরস্বতীর লেখা সেই বইয়ের প্রচ্ছদে একজন মানুষকে আক্রমণ করছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বন্দুক হাতে একজন শিকারি।
ছেলেবেলায় খুব বেশি বই ছিল না আমার নিজস্ব সংগ্রহে, যে কটি ছিল সেগুলো যে কতবার পড়তাম তার ঠিক নেই। ‘সুন্দর বনের শিকারী’ পড়তে পড়তে নিজের কল্পনায় এঁকে নিতাম জল জঙ্গলের ছবি। এখন সে গল্পের অনেক ফাঁক খুঁজে পেলেও ছেলেবেলায় ওই বইটিই ছিল আমার সুন্দরবনের জানালা। একদিন সন্ধ্যাবেলা অবনী কাকুকে বললাম সুন্দরবনের বই দেবে আমাকে একটা? শুনে একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর বইয়ের তাকের পিছনের সারি থেকে বের করে আনলেন একটি বই। একটু বড় সাইজের সেই বইটির মলাটে ছিল একটি হরিণকে জড়িয়ে ধরা এক বিশালাকার সাপের হাতে আঁকা ছবি। বইয়ের নাম ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’ লেখক দুজন ভুবনমোহন এবং বিভূতিভূষণ। তখন রাত্রিবেলা বাবার পাশে শুয়ে চাঁদের পাহাড়ের গল্প শুনি। কাজেই বিভূতিভূষণের নামের সাথে পরিচয় ছিল।
একটি বই কীভাবে দুজন লিখতে পারেন? সে প্রশ্নের উত্তরে অবনী কাকু বললেন প্রথমে গল্পটা শুরু করেছিলেন ভুবনমোহন রায়, পরে বিভূতিভূষণ সে গল্প শেষ করেন। সে বয়সে অত কিছু বোঝার সময় ছিল না, বাড়ি ফিরে পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখে পড়ে ফেললাম সেই বই। পরের শনিবার লাইব্রেরির তালা খুলতে খুলতে অবনী কাকু বললেন কিরে পড়া হয়েছে? আজ তোকে আর একটা সুন্দরবনের বই দেব। আজই এনেছি কলকাতা থেকে। ঘরে ঢুকে কাঁধের ঝোলা থেকে বের করে আনলেন শিবশঙ্কর মিত্রের লেখা ‘সুন্দরবনে আর্জান সর্দার’। এখন বুঝি আর্জান সর্দার পড়ার জন্য সে বয়সটা হয়তো একটু কমই ছিল, তবু সেই বইটি আমাকে চুম্বকের মত টেনে রেখেছিল বেশ কিছুদিন। সত্যি কথা বলতে সে টান আজও অনুভব করি। দশম শ্রেণির গন্ডি পেরোনোর পরই বাবা কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি করে দিলেন। সূর্য সেন স্ট্রিটের একটি জরাজীর্ণ মেসবাড়ির পাঁচ তলার চিলেকোঠায় একটি মাথা গোঁজার জায়গা পেলাম। থাকা-খাওয়ার কষ্ট এক লহমায় চলে গেল মেস থেকে দু পা হেঁটে এসে পাওয়া প্রেসাডেন্সির ফুটপাথে।
আরও পড়ুন – রাজেশ ধর এর কলেজস্ট্রিট থেকে
কলেজ স্ট্রিটের দুপাশের ফুটপাথজুড়ে থাকা অসংখ্য পুরোনো বই দিয়ে সাজানো সোনার খনির সন্ধান পেয়ে গেলাম কয়েক দিনেই। মূল্য কম হলেও সে সময় খুব বেশি টাকা স্বাভাবিকভাবেই হাতে থাকত না। পরপর তিন দিন বিকেলের টিফিন না খেলেই একটা বই কেনার টাকা জমে যেত অনায়াসে। এমনি করে কত বই কিনেছি… আর একটা খুব ভাল ব্যবস্থা চালু ছিল, দোকান বন্ধের সময় কোনও একটি বই মেসে নিয়ে আসতাম রাত্রিটা পড়ে সকালে দোকান খোলার সময় জমা দিয়ে দিতে হত সে বই। একরাত কাছে রাখার জন্য ভাড়া দিতে হত এক টাকা। একরাতে শেষ না হলে পরের দিন আবার আনতাম। বহুবার এমন হয়েছে অর্ধেকটা পড়ার পর সকালে জমা দিয়ে কলেজ গেছি সন্ধ্যাবেলা গিয়ে দেখি সে বই দিনের বেলা বিক্রি হয়ে গেছে। সেসব গল্প উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা হত, আফসোস হত শেষটা জানা হল না ভেবে। যাই হোক প্রভাত সংঘ পাঠাগারের সেই দুটি আলমারি থেকে এসে পড়লাম বই সমুদ্রে। এখানে নানা বিষয়ের বইয়ের ভিড়ে সুন্দরবন নিয়ে আগ্রহ কিছুটা স্তিমিত হলেও পুরোপুরি চলে গেল না। সুন্দরবন নিয়ে বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বই পড়ার সুযোগ হলো এখান থেকেও। মনোজ বসুর ‘বন কেটে বসত’ বা সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ প্রথমবার পড়েছি এই ফুটপাথ থেকেই। তখন অবশ্য এমন একমুখী হয়ে যাইনি পড়া বা বই সংগ্রহের ব্যাপারে। নানা বিষয়ের বই পড়তাম- যখন যেটা ভালো লাগত, ইচ্ছা হত।
২০০৯ সালে আমার জীবনে একটি বড়সড় পরিবর্তন আসে। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আইলা ভারতীয় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশে ব্যাপক তান্ডব চালায়। জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য এবং জঙ্গলঘেঁষা জনজীবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্য অনেকের মতো আমরাও সমমনস্ক কয়েকজন সুন্দরবনের কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে হাজির হই। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে থাকার পাশাপাশি এই বিপুল বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক অঞ্চলের নানা বিষয় নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। ২০১০ সালের অক্টোবর মাস থেকে পথ চলা শুরু করে ত্রৈমাসিক ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পত্রিকা। যা এখনও পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
পত্রিকা প্রকাশের কাজ শুরু করার পর অনুভব করি এ বিষয়ে প্রকাশিত বই পত্রপত্রিকা যা আগে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো পড়া প্রয়োজন এবং সবচেয়ে ভালো হয় যদি সেগুলো নিজের সংগ্রহে থাকে তাহলে। এই ভাবনা থেকেই সুন্দরবনবিষয়ক বই ও পত্রপত্রিকার সংগ্রহ নিয়ে ‘জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ীর সুন্দরবন লাইব্রেরি’।
গত দশ বছরে দেড় হাজারের বেশি সুন্দরবনবিষয়ক বই এবং পত্র পত্রিকার সংগ্রহ গড়ে তুলতে পেরেছি। এই সংগ্রহে ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি অন্য ভাষাতে লেখা সুন্দরবনবিষয়ক বইও আছে। এখন শুধুমাত্র সুন্দরবনবিষয়ক বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসাবে অনেকেই আমার সংগ্রহকে বৃহত্তম বলেন, যদিও এ বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই।
এই সংগ্রহ গড়ে তোলার পিছনে একটি প্রথম এবং প্রধান কারণ আমি সব সময় চেয়েছি ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ সুন্দরবনের এমন বিষয় নিয়ে কাজ করুক যা পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কাজ কী হয়েছে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারনা থাকা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত জানাই সুন্দরবনবিষয়ক অধিকাংশ আলোচনাই চর্বিত-চর্বণ দোষে দুষ্ট। আজও সুন্দরবনের সীমানা বা দ্বীপ সংখ্যা নিয়ে পঞ্চাশ-একশ বছর আগে লেখা বইয়ের তথ্য ব্যবহৃত হয়। যে অঞ্চল প্রতিদিনে দুবার তার রূপ বদল করে, যে অঞ্চলের মানচিত্র কয়েক মিনিটে আমূল বদলে যায় সে অঞ্চল নিয়ে কাজ করা লেখা আর যাই হোক শুধুমাত্র পূর্বপ্রকাশিত বই দেখে করা সম্ভব নয়। কিন্তু সুন্দরবনের নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় বহু অসাধারণ প্রামাণ্য বই লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম সুন্দরবনবিষয়ক কাজ করতে গিয়ে যেসব তথ্য দরকার তার একটি ভান্ডার গড়ে উঠুক এক ছাদের নিচে।
আর একটি কারণ হলো ভারত, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী সুন্দরবন বিষয়ে গবেষণা করেন। তাঁদের কাজের প্রয়োজনে সুন্দরবনবিষয়ক নানা বইপত্রের প্রয়োজন হয়। তারা কোথাও একসাথে সুন্দরবনবিষয়ক পত্রপত্রিকা খুঁজে পান না। এটাও আমি বিভিন্ন বড় বড় লাইব্রেরিতে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করতে গিয়ে অনুভব করেছি। বই খোঁজার কাজে গবেষণার অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। যদিও আমার এই সংগ্রহ একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি এবং আমার হুগলি জেলার ব্যান্ডেলের ফ্ল্যাটের একটি ছোট্ট ঘরে তা সীমাবদ্ধ, তবু আমার ছুটির দিনগুলোতে যখন কেউ না কেউ আসেন তাদের প্রয়োজন মেটাতে তখন একটু হলেও তৃপ্তি পাই।
দুই বাংলার দক্ষিণ অংশে থাকা এই ম্যানগ্রোভ বনভ‚মির গুরুত্ব নিয়ে আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই কিন্তু ভারতে এখনও শুধু সুন্দরবনকে নিয়ে কাজ হবে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠেনি। শুনেছি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্কুল অফ ক্রিকেট’ বা ‘স্কুল অফ ফুটবল’ নামে শুধু সেই বিষয়ে চর্চার প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা কেন যাদবপুর বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ‘স্কুল অফ সুন্দরবন’ শুরু করতে পারব না? সুন্দরবনকে নিয়ে লেখা হাজার হাজার গবেষণাপত্র, বই, পত্রপত্রিকা নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলো একত্রে এক জায়গায় থাকা প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার সামান্যই সংগ্রহ করতে পেরেছি, এ কাজ ব্যক্তি উদ্যোগে হওয়ার নয় জেনেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আজ আমার লাইব্রেরির দিকে তাকিয়ে এক ঝলকেই চোখ চলে যায় ১৯৮০ সালে প্রকাশিত প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া দেব সাহিত্য কুটিরের সেই চার টাকা দামের ‘সুন্দর বনের শিকারী’র দিকে, যা আমার সুন্দরবন লাইব্রেরির প্রথম বই। তারপর থেকে যখন যেখান থেকে সুযোগ পেয়েছি সুন্দরবনবিষয়ক বই কিনেছি, সংগ্রহ করেছি। অনেকে ভালোবেসে উপহার দিয়েছেন। কখনও মূল বইটি সংগ্রহ করতে না পেরে ফটোকপি করে এনে বাঁধিয়ে রেখেছি। আমার সংগ্রহে থাকা সুন্দরবনবিষয়ক সব বইই যে খুব উন্নতমানের তা কিন্তু নয়। উন্নতমানের কথাটি আমি বইয়ের বিষয় বা বইটির নির্মাণ সব দিকের কথা বিবেচনা করেই ব্যবহার করলাম। এই বিষয়ে আমার নীতি খুব স্পষ্ট, সুন্দরবনবিষয়ক প্রকাশিত সবকিছু আমার সংগ্রহে থাকবে এই আমার ইচ্ছা। ভালো মন্দের বিচার শুধু বইটির নির্মাণ, প্রকাশক বা লেখকের নাম দিয়ে করা যায় না। এমন অনেক বই আমার সংগ্রহে আছে যা হয়তো কোনো অনামী প্রকাশকের কাছ থেকে প্রকাশিত, লেখকও তেমন বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু সেই বই পড়তে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছি যা আগে কখনও কোথাও পাইনি। আবার নামিদামি প্রকাশন সংস্থা থেকে বিখ্যাত লেখকের লেখা পড়ে হতাশ হয়েছি, নতুন কিছু পাইনি।
আমার লাইব্রেরির বইগুলিকে ছোট ছোট বিষয়ভিত্তিকভাবে ভাগ করার চেষ্টা করছি বেশ কিছুদিন। যেমন কেউ হয়তো জানতে চাইলেন সুন্দরবনের সাপ নিয়ে বইয়ের কথা, কারও আগ্রহের বিষয় মরিচঝাঁপি, কেউ আবার গবেষণা করছেন সুন্দরবনের মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে, ইকোট্যুরিজম, বাঘ-মানুষ সংঘাত আবার কারও জানার বিষয়। আমি চাই তারা প্রত্যেকেই যেন তার প্রয়োজনের নির্দিষ্ট বইগুলি হাতের কাছে পান।
জানি এ কাজ সহজ নয় তবু কিছু কিছু স্বপ্নই তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।