আহমদ বশীর সত্তরের কথাসাহিত্যের পালাবদলের একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৫৫ সালে জন্ম নেয়া, পুরান ঢাকার আদিবাসী এই লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘অন্য পটভূমি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে, যা হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই— ছোটগল্পের, নায়ক কাপুরুষ। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার, পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস, উরুরংচুরুরং খেলা। ৮০ দশকের আলোড়ন সৃষ্টি করা সাহিত্য আন্দোলন, ‘বিপক্ষে’র একজন সম্পাদক ছিলেন তিনি। সেই সময়ের গদ্যশিল্পীদের একটি সংগঠন ‘কথাসাহিত্যে’র কার্যক্রমেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। নব্বইয়ের দশক থেকে লেখালেখি থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে যান। দীর্ঘ কয়েক বছরের নীরবতার পরে সম্প্রতি আবার সাহিত্যচর্চ্চা শুরু করেছেন। এই পর্বে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কয়েকটি বই : অবাস্তব বাস্তব (২০১৫), তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধেও একটা উপন্যাস হতে পারতো (২০১৬), মুদ্রারাক্ষস (২০১৯), উনিশশ’ তিয়াত্তরের একটি সকাল (২০১৯), স্বাধীনতার পরের এক পরাধীনতা (২০১৭), তিনি (২০২১), আহমদ বশীরের গল্প (২০২৩)। গুণী এই লেখকের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং বই সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
এবং বই: ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পেল গল্পের বই ‘অন্য পটভূমি’। প্রথম বইয়েই বাজিমাত। চারদিকে হইচই পড়ে গেল। বইটির জন্য ১৯৮২ সালে জুটল ‘হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার’। তারপরও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন প্রায় ৩৫ বছর। মাঝের এই দীর্ঘ বিরতি কেন?
আহমদ বশীর: ধন্যবাদ। বলা যায়, আমি ১৯৭৬ সাল থেকে সাহিত্য রচনা করব বলে মনস্থ করেছিলাম । ১৯৮০ পর্যন্ত বিচিত্রা, রোববার, সন্ধানী, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলার রবিবাসরীয়, গণসাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে ‘অন্য পটভূমি’ প্রকাশিত হয়। এরপর দুটো গল্পগ্রন্থ এবং বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায় একটি উপন্যাস ছাপা হলেও হঠাৎ ১৯৮৫ সাল থেকে নিজেকে লেখালেখির জগতের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর কোনো কারণ বলা যাবে না। আমার মনে হয় লেখক যখন নিজেই লেখা থেকে বিরতি নেন, লেখার প্রবাহে যতিপাত ঘটে, তার মূল অর্থ হলো তিনি আর তখন উৎপাদনশীল থাকেন না। এটা তার ব্যক্তিগত অপূর্ণতা, অপারগতা বা ক্ষমতাহীনতা। এভাবে দেখাই উত্তম। তবে যুক্তি হিসেবে আমি অনেক কিছু বলতে পারি, কিন্তু কালের নির্মম বিচারে তার কোনো মূল্য নেই। আমি লিখিনি বা লিখতে পারিনি- এটাই সত্যি।
এবং বই: এত বছর পর আবার ফিরলেন লেখায়। কেন মনে হলো ফিরতেই হবে?
আহমদ বশীর: হ্যাঁ, এরপর দীর্ঘ প্রায় ২০-২৫ বছর পর আমার লিখতে ইচ্ছে হলো। এই সময় পরিসরে হয়তো লিখিনি, কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অজস্র মানুষ-মানুষীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তাদের জীবনধারার বহতা স্রােতে নিজেকে সংযুক্ত করতে চেষ্টা করেছি। এদের জীবনের সুখদুঃখগুলো সারাক্ষণ আমাকে উত্তক্ত্য করত। মনে হতো ওদের জীবনের কাহিনিগুলো লেখার দায়িত্ব আমার। এগুলো না লিখলে আমার রেহাই নেই। এ সময় একটা প্রেরণা পেলাম আবার। কয়েকজন পাঠক আমাকে খুঁজে বের করলেন। রাজু আলাউদ্দিন আমাকে টেলিফোন করে বের করলেন। জাহিদ হায়দার বলল, সাহিত্যের কী হচ্ছে না হচ্ছে- এসব ভুলে গিয়ে লেখ। যদি কলমের জোর থাকে, লিখে দেখা। এসব ভালোবাসার একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। আমি লেখা শুরু করলাম।
এবং বই: আশির দশকের শুরুতেই যৌথভাবে সম্পাদনা করলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘বিপক্ষে’। ‘বিপক্ষে’ কেন? এই নামে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?
আহমদ বশীর: ১৯৮০ সালে আমাদের তিন জনের (জাহিদ হায়দার, আবু সাঈদ জুবেরী এবং আমি) যৌথ প্রচেষ্টা। আমরা সম্ভবত নামটি দিয়ে তৎকালীন সময়ে আমাদের তারুণ্যময় বিদ্রোহ, ক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমাদের মনে হয়, কোনো ব্যাখ্যা না দেয়াই ভালো- পাঠক তার মনমতো অর্থে দ্যোতনা খুঁজে নিলেই হয়। ‘বিপক্ষে’র মানে তো বিপক্ষেই। তবে প্রথম সংখ্যা বেরুনোর পর একজন পাঠকের চিঠি আমরা ছাপিয়েছিলাম। বগুড়ার আক্কেলপুর থেকে আবদুস সাত্তার মৃধা লিখেছিলেন, পৃথিবীর সর্ববিধ অকল্যাণের বিপক্ষে মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলনকারীদের জানাচ্ছি শুভেচ্ছা।
কিন্তু যে তরুণ দলটা আমাদের সঙ্গে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন তারা হলেন- ইকবাল আজিজ, হাসান ফেরদৌস, আবেদীন কাদের, সৈয়দ কামরুল হাসান, হরিপদ দত্ত, সুশান্ত মজুমদার, মুজিবুল হক কবীর, সারোয়ার কবীর, আতা সরকার, তুষার দাস, নাসিমা সুলতানা, আরো কত জন !
এবং বই: যতদূর জানি পত্রিকাটির মাত্র আটটি সংখ্যা মুক্তি পেয়েছিল। তারপর আর এগোয়নি…। সম্প্রতি পত্রিকাটির বাছাই লেখা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার ‘দ্যু প্রকাশন’ থেকে।
আহমদ বশীর: যদিও পত্রিকাটির মাত্র আট টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই আমরা ষাট দশকের পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যের বাঁক বদলকে চিহ্নিত করতে পেরেছি বলে আমাদের বিশ্বাস। যে নতুন তারুণ্য এই সাহিত্যযাত্রাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন তাদের সবারই বাহন ছিল বিপক্ষে। এখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে ‘দ্যু প্রকাশন’-এর কর্ণধার আমাদের প্রচেষ্টার সম্মান দিয়েছেন, উদ্যোগী হয়ে সংকলনটি প্রকাশ করে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। চার দশক আগে আমরা কী সর্বব্যাপী সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেছিলাম, এটা তারই দলিল। ‘বিপক্ষে’- কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আন্দোলন ছিল না, বরং সারা দেশব্যাপী সকল পর্যায়ের তরুণদের মুখপত্র হতে চেয়েছিল পত্রিকাটি।
এবং বই: লিটল ম্যাজিন, লেখালেখি এসবের বাইরে সংগঠনও করেছেন। যুক্ত ছিলেন ‘লেখক শিবির’র সাথে। কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন…
আহমদ বশীর: প্রকৃত অর্থে আমি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলাম না। শাহরিয়ার কবির এবং ফয়েজ আহমদ আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। তারাই আমাকে এক নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন। আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে থাকলে তো কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্য পাওয়ার কথা। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি দেশের পূর্ণ গণতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিক পবিবেশ বিরাজ করলে লেখক এবং বিচারকদের কোনো সংগঠনের সদস্য হওয়া উচিত না।
এবং বই: ‘কথাসাহিত্য’ নামে সংগঠন করেছেন। দর্শনীর বিনিময়ে গল্প পাঠ করে শোনাতেন, বিষয়টি অবাক করার মতোই…!
আহমদ বশীর : ১৯৮২-৮৪ সালে রাহাত খানের নেতৃত্বে আমরা একটা সংগঠন করি, তার নাম ছিল ‘কথাসাহিত্য’। ওই সময় ‘পদাবলী’ নামে কবিদের একটা সংগঠন খুব নামডাক করে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর করত। আর বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমরা কথাসাহিত্যিক হলেও রফিক আজাদ- হাবিবুল্লাহ সিরাজীদের সঙ্গে চলাফেরার স্বার্থে ‘পদাবলী’র আয়োজনে উপস্থিত থাকতাম। তখন আমরা রাহাত ভাইকে বললাম কথাসাহিত্যিকদের জন্য একটা কিছু দল করা দরকার। তিনি রাজি হলেন, তাকে সভাপতি করে, আবু শাহরিয়ারকে সাধারণ সম্পাদক করে একটা কমিটি করা হলো। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আবু সাঈদ জুবেরী, হারুন হাবীব, বুলবুল চৌধুরী আরো অনেকে। আমরা দর্শনীর বিনিময়ে গল্পপাঠের আসর করেছিলাম বৃটিশ কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে। সেখানে গল্প পাঠ করেছিলেন রাহাত খান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ আরো অনেকে। প্রথম অনুষ্ঠানে আমিও গল্প পাঠ করেছিলাম। আমাদের অনুষ্ঠানের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল অনেক পত্রিকায়। সেগুলো কয়েকটা হারিয়ে গেলেও দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন এখনো আমার কাছে আছে। ‘কথাসাহিত্য’ নামে একটা সংকলনও করেছিলাম আমরা- আরো অনেক পরিকল্পনা ছিল। আমি হঠাৎ করে লেখালেখি ছেড়ে দেবার পর আর খবর রাখিনি।
আরও পড়ুন – “কবিতার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকলেও প্রবন্ধ-গবেষণাধর্মী মননশীল রচনার প্রতি সমান আগ্রহী”
এবং বই: ‘অর্থনীতি’ নামে একটি সংবাদপত্রও সম্পাদনা করেছেন কিছুদিন…
আহমদ বশীর: বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের দ্বিতীয় বর্ষে হঠাৎ করে অর্থনীতি বিভাগের দুজন ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। একজন জাভেদ বিন সালেহ, আর একজন জামিল চৌধুরী জামি। ওরা নটরডেম কলেজ থেকেই বন্ধু। ওরা তখন আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আবার একটা পত্রিকার কথাও ভাবত। আমি ওদের দলে যোগ দিয়ে রাজনীতি-অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকার পরিকল্পনা করলাম। বললাম, পত্রিকার জন্য অর্থ দরকার। জাভেদ বিন সালেহের বাবা ছিলেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ওরা বলল বিজ্ঞাপন আর টাকার অভাব হবে না, শুধু প্রথম সংখ্যাটার সম্পাদনা অতি উন্নতমানের হতে হবে। ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হবে। আমি বললাম, টাকা-পয়সার হিসাব তোমরা রাখো- আমি উন্নতমানের সম্পাদনার সব দায়িত্ব বহন করবো। তো তৎকালীন গ্রীনলেজ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় ব্যাংক একাউন্ট খোলা হলো। সে এক এলাহি আয়োজন। ধানমন্ডি ১৯ নম্বরের এক বাড়ির গ্যারেজের শাটার উঠিয়ে আমরা অফিস বানালাম। পত্রিকার নাম হলো ‘অর্থনীতি’। তো একে উন্নতমানের করার জন্য কত পরিকল্পনা নিলাম। প্রথম সংখ্যায় বাংলাদেশের ১৯৪৭ সাল থেকে জিয়াউর রহমানের ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস থাকবে, নাম দিলাম, হে স্বদেশ, তোমার রাজনীতি। একে চিত্রবহুল এবং প্রামাণ্য করার জন্য নানা রকম ছবির অনুসন্ধান করলাম। দৈনিক বাংলা/বিচিত্রার চিত্রগ্রাহক শামসুল ইসলাম আল মাজিকে পটিয়েপুটিয়ে দৈনিক বাংলার ফটোগ্রাফিক সেকশনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। উনি বললেন, আধা ঘণ্টা সময় দিলাম, যা পারো নেগেটিভ নির্বাচিত করে নিয়ে যাও। দৈনিক বাংলা মানে দৈনিক পাকিস্তান আমলের ফটোগ্রাফির নেগেটিভ। জীবনের সেকি দুর্লভ মুহূর্ত! ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইতিহাসের নেগেটিভ দেখছি। আমার হাত-পা কাঁপছিল। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে ইতিহাসের ফটোগ্রাফির নেগেটিভ দর্শন! গণ-আন্দোলন, ৬ দফা দাবি, মিলিটারির গুলি, মতিউরের লাশ, আসাদের লাশ, বঙ্গবন্ধুর কত ছবি- ভাষণ দিচ্ছেন, আলোচনা করছেন, মওলানা ভাসানী, ইয়াহিয়া খান, গণহত্যা… কোনটা রেখে কোনটা নেব। মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতে খেতে আল-মাজি ভাই জিজ্ঞাসা করেন, হলো? আর আধা ঘন্টা।…
সেই অজস্র ছবির নেগেটিভ মার্ক করে দিলাম। আল-মাজি ভাই কপি করে দিলেন। আমি নিয়ে চলে আসলাম ধানমন্ডির অফিসে। পত্রিকার দুই-তিন বছরের খোরাক আমার হাতে।
প্রথম সংখ্যায় কত ঐতিহাসিক ছবি দিয়েছিলাম। একটা ছবিতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনি বন্দুক ধরে একজনকে গুলি করছে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার অগে লোকটির মুখের অভিব্যক্তি সাদাকালো ফিল্মে। আরেকটা ছবিতে সম্ভবত : ১৯৭৪ সালে তৎকালীন মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী চাঁদপুরে দুর্গতের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছিলেন। ওপর থেকে তোলা ক্যামেরার লেন্সে মিজানুর রহমান চৌধুরীর মুখের উপর ত্রাণ বিতরণরত একটি হাতের সামনে কয়েকশ ত্রাণপ্রার্থীর হাত। সামান্য একটু ত্রাণ হাতে নিয়ে শতজন মানুষের সামনে তার করুণ অভিব্যক্তিটি পাঠকদের অশ্রুসিক্ত করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের ইতিহাস- লেখাটা নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছিল। প্রথম সংখ্যার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম পত্রিকায়, এমনকি টেলিভিশনে। পত্রিকা অফসেটে ছাপা হলো মধুমতি মুদ্র্রণালয় থেকে। আমি ভাবতাম, এত টাকা আসে কোত্থেকে? ওরা বলত, ফাইন্যান্সার আছে, এখন দেখা দেবে না।
প্রথম সংখ্যার হাড় ভাঙা খাটুনির পর ওরা বলল একটু বিশ্রাম দরকার। অফিস কয়েক দিন বন্ধ থাকবে। কয়েক দিন পর দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য ধানমন্ডির অফিসে গেলাম। দাড়ওয়ান বললেন, আমার বন্ধুরা গ্যারেজ ছেড়ে দিয়েছেন, গ্যারেজে এখন বসা যাবে না, তবে কোনো জিনিস থাকলে নিয়ে যেতে পারি। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। তারপর নিজেকে সামলে বললাম, শাটার খুলুন, দেখি কী কী নেয়া যায়। উনি শাটার খুলে দিলে দেখলাম টেবিলের ওপর একটা চিঠিতে ওরা জানাচ্ছে যে ওরা ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাচ্ছে। ব্যাংকের চেকবুক পড়ে আছে টেবিলে, তখনও কয়েক পাতা আছে, কোনো স্বাক্ষর নেই।
এবং বই: এবার আপনার লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনার লেখা প্রথম গল্প কোথায় ছাপা হয়েছিল?
আহমদ বশীর: আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা হলো ১৯৭৬ সালে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়, জেমস জয়েসের ডাবলিনার্স-এর একটা গল্পের অনুবাদ, ইভলীন। এর পরের মাসে একটা গল্প প্রকাশিত হয় সরকারি তথ্য দপ্তরের তৎকালীন একটি সাহিত্য পত্রিকা, ’পূর্বাচলে’।
এবং বই: আপনার প্রথম প্রকাশিত বইয়ের ‘অন্য পটভূমি’ গল্পটি সম্পর্কে জানতে চাই। এই ধরুন গল্পটির প্লট কীভাবে মাথায় আসল, লেখার সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল? মনে আছে কি?
আহমদ বশীর: ‘অন্য পটভূমি’ গল্পটিতে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে আগত একটা পরিবারের কথা বলা হয়েছে, যারা ১৯৪৭ সালের পরে ভিটামাটি ছেড়ে চলে এসেছিল। আমার এই গল্পের নায়ক ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরে যাবে বলে মুর্শিদাবাদ যায়, কিন্তু আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে কোনো সমাদর পায় না। মুক্তিযুদ্ধের পরে তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে। আসার সময়ে তাদের দুই ভাইয়ের অনুভূতিটাই আমার গল্প। কাহিনির নায়ক আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। ওর বাবা-মা বগুড়ার তালোড়াতে থাকতেন- ঢাকায় ওর কোনো ঠিকানা না থাকায়, আমার বাসার ঠিকানাতেই ওর মা ওকে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতেন- বাবাজীবন তপু…। ও আমাকে পোস্টকার্ডে চিঠিগুলো পড়ে শোনাত। ওই চিঠিগুলো থেকে কত গল্প হতে পারত!
এবং বই: উপন্যাস বরাবরই আপনার পছন্দের। আমরা ইতিপূর্বে ‘এবং বই’তে আপনার একটি উপন্যাসের উপর আলোচনা প্রকাশ করেছি…
আহমদ বশীর: উপন্যাস লিখতে হলে প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। এটা অনেকটা নির্মাণশ্রমিকের মতো কাজ। কবজির জোর এবং স্মৃতিশক্তি- দুই বৈশিষ্টের সামঞ্জস্য বিধান না হলে উপন্যাস লেখা কঠিন। স্মৃতিশক্তি অর্থ হলো জীবনের অজস্র অভিজ্ঞতাকে পুনর্নির্মাণ। আমাদের দেশের কথাসাহিত্য ১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলা বিভাগের বা অন্য সমধর্মী বিভাগের অধ্যাপকশাসিত। সেই শওকত ওসমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবুল ফজল, মিন্নত আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আশরাফ সিদ্দিকী, রাহাত খান, মান্নান সৈয়দ, আনোয়ার পাশা- বাংলায় অনার্স, এমএ। অবশ্যই এরা অনেক মহৎ সৃষ্টি রেখে গেছেন, কিন্তু এদের জীবন-জীবিকা অবশ্যই বৃত্তাবদ্ধ একটি গণ্ডিকে অনুসরণ করেছে। এদের চরিত্রগুলো তাই মধ্যবিত্তের চেনাজানার বাইরে নাই। হয়তো তাই আমাদের কথাসাহিত্যের উপন্যাস অংশে দেশের বৈচিত্র্যময় জনজীবনের ঘনিষ্ঠ বর্ণনা (যে রকম তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা পথের দাবী) সে রকম খুব কম পাওয়া যায়। অতিসম্প্রতি কিন্তু তরুণ লেখকরা বিভিন্ন পেশা থেকে আসছেন- তাই তাদের জীবনবোধও অনেক গভীর, দেখার চোখও অনুপম। সাহিত্য এদের কাছে অনেক কিছু আশা করে।
এবং বই: নতুন উপন্যাস কী লিখছেন?
আহমদ বশীর: ১৯০৫-১১-এর বঙ্গভঙ্গের সময়কালে ঢাকা শহরকে পটভূমি বানিয়ে সেই জনজীবন নিয়ে একটি লেখা লিখছি। ওই সময়টা খুব আকর্ষণ করে আমাকে। লর্ড কার্জন, নবাব সলিমুল্লাহ, পূর্ববঙ্গের দরিদ্র আত্ম-ঠিকানাহীন মানুষের কল্লোল আমি শুনতে পাই। পূর্ববঙ্গেও সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-বাণিজ্যে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছিল, লর্ড কার্জনদের একটু সুদৃষ্টি পেয়ে একটা প্রদেশে রূপায়নরত হয়েও হলো না। প্রবল এক প্রতিবন্ধকতা এসে সেই ভ্রুণ বাসনাকে নিভিয়ে দিল। মাত্র ৫ বছরে ঢাকা শহরকে যতটুকু দেয়া হয়েছিল -তাই সম্বল করে উঠে দাঁড়িয়েছে এই সম্প্রদায়। আমাদের নেতৃত্বও তখন তৈরি হয়নি। বরং মুসলমানরা তখন তুরস্কের জন্য আত্মবলিদান করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে- প্রতিক্রিয়াহীন জনগোষ্ঠী এই স্বতন্ত্র প্রদেশের মূল্য বোঝেনি। এমনকি বাঙালি হিন্দুরাও বোঝেনি। তারাও স্বতন্ত্র প্রদেশের ফলে কী অর্জন হতো তার হিসাব করেনি। কিন্তু এই সময়ের ঢাকার অনুশীলন সংঘের বিপ্লবী কার্যাবলিও অত্যন্ত সাহসিক প্রচেষ্টা হিসাবে ইতিহাসে উল্লিখিত হতে পরত। এই ঢাকার অনুশীলন সংঘে একজন মুসলমান ছিলেন- তার নাম আলিমুদ্দিন। যার নামে কোলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, যেখানে সিপিএ-এর অফিস। এসব নিয়ে আমার একটা প্রচেষ্টা চলছে।
এবং বই: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আপনার উপন্যাস ‘তিনি’। কীভাবে বইটি লেখার প্রেরণা পেলেন?
আহমদ বশীর: বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আমি প্রথমে ইংরেজি অনুবাদটা পড়েছিলাম। তখন সাহিত্য থেকে নির্বাসনে ছিলাম, তাই নিজের ওপর ক্রোধান্ধ হয়ে বাংলা কিছু পড়তাম না। তাই বইটি পড়তে গিয়ে পাতায় পাতায় অনেক নোট লিখে রাখতাম। দেখেছিলাম বইটি আসলে অনেকগুলো গল্পের আকর। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ইতিহাসের অনেক হারানো মানিক ফিরিয়ে এনেছেন। আর শেখ হাসিনা ম্যানুসক্রিপ্টের কোনোরকম পরিবর্তন করতে দেননি বলে আমার মনে হয়েছে। আমি নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, লেখাটি একবারে অরিজিন্যাল। তো আমার কাছে মনে হতো এই বই থেকে অনেক গল্প পল্লবিত হতে পারে। যাই হোক, তখন লেখালেখি থেকে অনেক দূরে ছিলাম বলে কিছুই লিখিনি।
২০১৯-এর জানুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির মনি হায়দার আমাকে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটা গল্প লিখতে অনুরোধ করলেন। আর সাথে সাথে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর সেই পৃষ্ঠাগুলোর কথা, যেখানে আমি নোট লিখে রেখেছিলাম। প্রথম গল্পটা হলো ‘মধুমালা, গৌরাঙ্গ, সোহরাওয়ার্দী, খোকা’- বঙ্গবন্ধুর কোলকাতায় পাকিস্তান আন্দোলনের সময়কালের এক ছবি, যার প্রামাণ্য নিদর্শন ওই বইতেই আছে। তার পরেরটা ‘বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা’, এর কাহিনি ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত গোপন একটি বই থেকে আমি কিছুটা আহরণ করেছি, বাকিটা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের এক আত্মীয়ের কাছে শোনা। …এই গল্পটা বাংলা একাডেমির ‘বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গল্প’ সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে । যাই হোক, এভাবে আমি একে একে ৪টি গল্প লেখা শেষ করলাম।
সেই চারটি গল্প ‘তিনি’ নামে বই আকারে প্রকাশ করেছেন ‘উত্তরণ’ প্রকাশনীর আহমেদ মাসুদুল হক মাওলা। আমার এবং আমার প্রকাশকের দুর্ভাগ্য, বইটির এখনো যোগ্য সমাদর হয়নি। প্রকাশক এ জন্য প্রায়ই আমার কাছে অনুযোগ করেন- বিক্রি হয় না, তার লগ্নিকৃত অর্থ উঠে আসছে না। আমি নানাভাবে তার দুঃখ অপনোদন করতে চেষ্টা করি, বলি, ইতিহাসের স্বার্থে তাকে একটু ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। এই আরকি!
এবং বই: আপনার একটি উপন্যাসের নাম ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’- বইটির এমন নাম রাখার কারণ কী? এই উপন্যাসে আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একজনের পুত্রকে নায়ক বানিয়েছেন- কেন?
আহমদ বশীর: এই উপন্যাসটির নায়ক আমার বাল্যবন্ধু সাইফ- যার সাথে আমি আরমানিটোলা স্কুলে পড়ালেখা করতাম। ওর বাবা ছিলেন ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলনের মুসলিম লীগার, যিনি সিলেটকে পাকিস্তানে সংযুক্ত করার জন্য আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আবার সাহিত্য রচনাও করেছেন, এবং দৈনিক আজাদের সম্পাদকীয় লিখতেন। সাইফ আমাকে তার বাবার লেখা উপন্যাস পড়তে দিয়েছিল। কিশোর বয়সে লেখা পড়ে তার সম্পর্কে আমার একটা ধারণাও জন্মেছিল। কিন্তু ওর বাবা ১৯৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তান বাহিনির পক্ষ নেন। অথচ সাইফ কিন্তুু তার বাবার মতবাদকে মেনে নিতে পারত না। আমাকে প্রায়ই ওর বাবার বিরুদ্ধে অনেক অনুযোগ করত। আমাদের আরমানিটোলা স্কুলের অনেক সহপাঠী বন্ধুর গ্রামের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের শ্রীনগর-লৌহজং-নবাবগঞ্জ। ওরা খুব তাড়াতাড়ি মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হয়, ওদের কয়েকজনের সঙ্গে সর্ম্পক-সূত্রে সে কয়েকটি অপারেশনে অংশও নিতে চেয়েছিল।
অথচ ১৯৭১ জুন-জুলাই মাস থেকে ওর বাবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ক্রমশ আরও ব্যাপক হয়ে দেখা দেয়। টিক্কা খানের সঙ্গে তার সহবত নিয়ে এম আর আখতার মুকুল চরমপত্রে একটি কটাক্ষও করেন। অবশেষে ওর বাবা নভেম্বর মাসে সম্ভবত রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চলে যান। ডিসেম্বর মাসে দেশ স্বাধীন হলে সাইফ আমাদের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। তারপর ১৯৭২ সালে হঠাৎ একদিন সাইফ তার মা-বোনদের নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। আমরা আর কিছুই জানতে পারিনি। এরপরে বংশাল রোডের ওই বাড়িটার সামনে গেলে আমার মনটা বিষণ্ণ হয়ে যেত।
প্রায় ৩৫ বছর পরে আমার আরেক বন্ধু এমিরেটস এয়ারলাইনসের স্টেশন ম্যানেজার হিসেবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চাকরি করতে যায়। সেখানে এয়ারপোর্টে একদিন সাইফের সাথে তার দেখা হয়। সাইফ ওর কাছে বলে যে সে বাংলাদেশে আসতে চায়, এবং আমার সাথে দেখা করতে চায়। ২০০৭ সালে সে বাংলাদেশে আসে। আমার সাথে দেখা হয় । তখন সে আমাকে বলে যে, সে এদেশে আবার ফিরে আসতে ইচ্ছুক। ওর বাবার কৃতকর্মের জন্য সে অনুতপ্ত। সেই অনুশোচনা সে ব্যক্ত করতে চায়। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিভিন্ন প্রচারণা চলছিলো। সাইফ সেখানে তার বাবার কৃতকর্মের অনেক কাগজপত্র দেখাতে চেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরে একটি নতুন প্রজন্মের অনুশোচনা এবং হতাশাকে আমি একটা উপন্যাসে রূপ দিতে চেয়েছিলাম। সাইফের অসম্পূর্ণ আকাক্সক্ষার কথা স্মরণ করে আমি উপন্যাসটির নামকরণ করেছি ‘মুক্তিযুদ্ধের একটা উপন্যাস হতে পারতো’। আর তিথিডোর নামে সত্যি একটি বাড়ি ছিল বংশালে, আজ নেই।
এবং বই: আপনার ‘মুদ্রারাক্ষস’ উপন্যাসের কাহিনিতে এত জটিলতা কেন? এর নির্মাণশৈলী সম্পর্কে কিছু বলুন। উপন্যাস নিয়ে আপনি কি প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্ট করছেন?
আহমদ বশীর: ‘মুদ্রারাক্ষস’ উপন্যাসে আমি আমাদের দেশের উদীয়মান গার্মেন্টসশিল্পের সাথে সম্পর্কিত একটি কাহিনির কথা বলেছি। এই শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য কয়েকটি দেশের ষড়যন্ত্র ও অর্ন্তঘাতমূলক তৎপরতা রয়েছে- যেগুলো সম্পর্কে আমরা সবটুকু অবগত হতে পারি না। গার্মেন্টসশিল্পের ইউএসএআইডির সমর্থনপুষ্ট একটি শ্রমিক কল্যাণ সংগঠনের কর্মসূচি মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমি এ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাই। ২০১২ সালে একজন শ্রমিকনেতার মৃত্যুরহস্য আজও মীমাংসা হয়নি। এখানে একজন নারী কর্মীর সাথে আমার পরিচয় ঘটে, বলতে গেলে উপন্যাসটি তারই জীবনের কাহিনি। ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার বহিরাবরণ ভেদ করে অন্তর্জগতে পৌঁছুতে হয়- সেখানে অনেক স্থানীয় এজেন্টদেরও জ্ঞানত-অজ্ঞানত অনেক ভূমিকা থাকে। সে কারণেই হয়তো কাহিনি কিছুটা জটিল হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন – আহমদ বশীরের মুদ্রারাক্ষস পাঠের পর
এবং বই: আপনি কবিতাও লিখেছেন একসময়?
আহমদ বশীর: একসময় কবিতা লিখতাম। কবি বন্ধু জাহিদ প্রশংসা করত। কিন্তু আরেক বন্ধু জুবেরী বলত, তোকে গদ্যই লিখতে হবে, তোর গদ্যই ভালো হয়। ওর সহৃদয় শাসনে আমি গদ্যই লিখেছি।
এবং বই: আপনার লেখার সময় কোন কোন লেখক আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?
আহমদ বশীর: আমি জীবনের প্রথম থেকেই প্রচণ্ড দুঃখবাদী লোক। গিয়াকিমো লিওপার্ডি থেকে আবুল হাসান পর্যন্ত সকল দুঃখবাদী শিল্পী আমাকে প্রভাবিত করেন। তবে আমি জানি বাল্যকালে ফিওদর দস্তয়ভস্কি আমার যে মানসিক গঠনটা তৈরি করে দিয়েছেন, সেখান থেকে আর মুক্তি নাই। তাই ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ কিংবা ‘পূর্ব ঘোষিত একটি মৃত্যুর কাহিনি’ যতই হাতে নিয়ে ঘুরি, রাশকলনিকভের সঙ্গ আমার শেষ হবে না।
এ ছাড়া আসলে আমার বন্ধুদের মতো আমার অত পড়াশোনা নেই । তাই মনে করি খুব বেশি প্রভাবিত হওয়ার অবকাশ কম।
এবং বই: লিখতে লিখতে এই জীবনে আপনি মিশেছেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক ও কবি আল মাহমুদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প তাঁদের নিয়ে…
আহমদ বশীর: ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫- এই দশ বছরের আমার উন্মাতাল সাহিত্যজীবনে অনেক গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছি।
আমরা কয়েকজন কথাসাহিত্যিক অনেকটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান আমাদের অভিভাবকের মতো ছিলেন। এখন বলতে গিয়ে দেখি এদের একেকজনের কাছে আমার ভূমিকা ছিল একেকরকম।
হাটখোলার অভয় দাস লেনের বাড়ির দোতলায় থাকতেন শওকত আলী, নিচতলায় ইলিয়াস ভাইয়ের সুখের সংসার। ওরা দুজনেই ছিলেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক। মোটা চশমার ফ্রেমে বসন্তের দাগওয়ালা ফর্সা ইলিয়াস ভাইকে বিদেশিদের মতো লাগত। রাশভারী শওকত আলী মাঝেমাঝে আড্ডায় নামতেন। ওনাদের সঙ্গে হতো একেবারে একাডেমিক সাহিত্য সমালোচনা। অসীম রায়-দেবেশ রায়- অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার কিংবা শ্যামল, গড় শ্রীখণ্ড-খাঁচায়-আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে- সন্দিপনের গদ্য-কুবেরের বিষয়-আশয় থেকে এক্ষণের বিশেষ সংখ্যা। কত আলোচনা। সেখান থেকে আলোচনা চলে যেত জন আপডাইক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। একবার তো আমরা প্রায় বানান করে পড়ছিলাম ফিলিগ্যান ওয়েক। ইলিয়াস ভাই বললেন, বইটার কথা খুব কম লোক বলে, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটাই জয়েসের শ্রেষ্ঠ কাজ। উপন্যাসের চরিত্র-চিত্রণ, ভাষাশৈলী- নিবিষ্ট প্রাবন্ধিকের মতো আলোচনা।
অন্যদিকে মাহমুদুল হক বটু ভাইয়ের কাছে আমি ছিলাম শিকড়হীন, উদ্দাম এক সংসার-বিবাগী তরুণ। তার কাছে পানীয় বোতল হাতে উপস্থিত হতাম। আর আলোচনায় থাকত বিচিত্র সব বিষয় : সাহিত্য-বিজ্ঞান-রাজনীতি-দর্শন-প্রেম-সাংবাদিকতা- পাথর-সোনার দোকান-৪০-৫০ দশকের ঢাকা-আজিমপুর কলোনিতে তার শৈশব-বড় মা-ছোট মা-জিন্দাবাজার-পাটুয়াটুলির সোনার দোকান-বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকায় তৈরি হলো তাসমেন জুয়েলার্স-বনশাই-শহীদ কাদরী ও শামসুর রাহমানের চরিত্রবিচার কত কিছু। মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে কয়েকজন দাদা আসতেন। মধ্যরাতে সবাই মাতাল হয়ে আড্ডা থেকে চলে যেতেন। আমি গুটিশুটি শুয়ে থাকতাম তার ড্রইংরুমে। বটু ভাই এসে একটা কম্বল বিছিয়ে দিয়ে যেতেন আমার উপর পরম স্নেহে। পরদিন সকালে তার শ্যালিকা এসে বটু ভাইয়ের প্রিয় কুকুর দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে আমাকে ঘুম থেকে ওঠাত। আমি মাথার কাছে বটু ভাইয়ের রেখে যাওয়া বোতল থেকে সামান্য গলায় ঢেলে, সেই মানিপ্লান্টের ঝাড় দেয়া দরজা ঠেলে রোদ-ভর্তি রাস্তায় নেমে পড়তাম।
আর আল মাহমুদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম ১৯৮২ সালের দিকে। কবি তখন শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করেন। আর বিকেলে কাকরাইল থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার বাসা তখন মগবাজার মধুবাগে চলে আসতেন। শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক তখন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আমার প্রিয় এক শিক্ষক। হেনা স্যারের কল্যাণে আমি তখন কবির খুব কাছে চলে এলাম। কবির কাছে আমি ছিলাম এক মগ্ন শ্রোতা। তিনি তার সুগন্ধময় মুখ থেকে কী অপূর্ব উচ্চারণে শোনাতেন তার আত্মজীবনী।
আমার বাড়ি ছিল মগবাজার নয়াটোলা, বিকেলটা আমরা একসাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতাম। তিনি এক এক করে তার গ্রামীণ জীবন, শহরের জীবন, ওমর আলী শহীদ কাদরীর সঙ্গে সখ্য, ওয়াপদার ড্রেজার পরিদপ্তরের চাকরি, বালেশ্বর নদীর বালুতে তার পায়ের চিহ্ন… এগুলি বলতে বলতে তার সদ্য পঠিত কোরআন শরিফের নিজস্ব ব্যাখ্যা… বনি ইসরাইলের প্রতি আল্লার উপদেশ…। আমি বলতাম, আপনি যে আমাকে দ্বাদ্বিক বস্তুবাদ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন…। তিনি বলতেন, দূর মিয়া দ্বাদ্বিক বস্তুবাদ ছাড়া আবার দর্শন আছে নাকি! আমি নয়াটোলা খেজুরগাছতলার মোড়ে বাংলা সাহিত্যের এক হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করতাম ‘কত দূর এগুলো মানুষ!’- এই পঙ্ক্তির অর্থ।
পদাবলীর এক অনুষ্ঠান-পূর্ব আয়োজনে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মিন্টো রোডের বাসায় শামসুর রাহমান আমাকে বলেছিলেন- আল মাহমুদের সাথে তিনি একবার নিভৃতে বসতে চান। পদাবলীতে তো আল মাহমুদ নিষিদ্ধ। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি সেই নিভৃতে আলোচনার আয়োজন করে দিয়েছিলাম।
একদিন শিল্পকলা একাডেমিতে আল মাহমুদের কক্ষে সৈয়দ আলী আহসান আর শওকত ওসমান বসে ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান মুখভর্তি দাড়ি, চশমার পুরু লেন্সের ভিতর দুটো চোখ আমাকে যেন নিষ্ঠুরভাবে সেদিন নিরীক্ষণ করছিলো। একটু পরে তিনি বললেন, বশীর, তোমার বয়স কত?
—আমি বললাম, ছাব্বিশ।
তিনি বললেন, শোনো, আমি হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কারের নির্বাচক কমিটিতে আছি। তোমার ‘অন্য পটভূমি’কে আমি মনোনীত করি নাই।
আমার মুখটা ম্লান হয়ে গেল- আমি মাথা নিচু করে থাকলাম।
সৈয়দ আলী আহসান বললেন, মন খারাপ হয়ে গেল? আমি মনোনীত করি নাই, তবু তুমি পুরস্কার পাবে। অন্য দুজন বিচারক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আবু শাহরিয়ার তোমাকে মনোনীত করেছেন।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। সৈয়দ আলী আহসান জিজ্ঞাসা করলেন, কেন মনোনীত করিনি প্রশ্ন করলে না!
—আমি বললাম, কেন স্যার?
তিনি বললেন, আমি মনে করেছি এত অল্প বয়সে তোমাকে পুরস্কার দিলে তুমি নষ্ট হয়ে যাবে। পুরস্কারের ভার বহন করতেও যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
তার কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে।
এবং বই: আমাদের দেশে ভারতীয় বইয়ের বিস্তার কিংবা সহজলভ্যতা রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের বই কলকাতা কিংবা ভারতে দুর্লভ বললেই চলে, ভারতীয় পাঠকরাও তাই বলেন। এর পেছনের কারণ কী বলে মনে করেন?
আহমদ বশীর: আশির দশকের প্রান্ত থেকেই আমাদের পাশ্ববর্তী একটি দেশের প্রবল ক্ষমতাধারী এজেন্টরা আমাদের সাহিত্য প্রকাশনার বাজারটাকে তছনছ করে দেয়। আমাদের সাহিত্যকে আমাদের পাঠক থেকে বহু দূরে পাঠিয়ে ভারতীয় বইয়ের পাঠকের সমাবেশে পরিণত করে। সকল পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশের বই থেকে বিমুখ করে তোলা হয়। আমাদের চোখের সামনেই পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে বাংলাদেশের বই ফেলে দিয়ে সুনীল-শীর্ষেন্দুদের বই দিয়ে সয়লাব করে দেয়া হয়। তখন সুনীল-শীর্ষেন্দুদের বই এত জনপ্রিয় করা হলো যে আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর নামকরণেও ওদের বইয়ের নাম নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। কী লজ্জা… দেখেন কেউ নিল মানবজমিন, কেউ প্রথম আলো…। তখন সুনীলের পরিত্যক্ত পিতৃভিটা, সুচিত্রা সেনের বাড়ি এগুলোর সাথে সাথে প্রামাণ্য অনুষ্ঠানে আমাদের সাহিত্য সম্পর্কেও কটাক্ষপাত চলতে থাকলো। আশির দশকের এই সময় আমাদের দেশের বিপদাপন্ন গণতন্ত্র… আমরা সেখানে মনোনিবেশ করলাম। আমাদের পত্রিকাশিল্প গড়ে উঠল, কিন্তু প্রকাশনাশিল্পর বারোটা বাজল। প্রায় বিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে ২০০ বই ছাপিয়ে সাহিত্যচর্চার কোন মানে হয়! ঠিক এই সময় সমাজের বিভিন্ন কৌতুককর বিষয় নিয়ে টেলিভিশনের ধারাবাহিক সোপ-অপেরা বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। সোপ-অপেরার নাট্যকার, অভিনেতারা জনপরিচিতির সুযোগে ওই নাটকগুলোর স্ক্রিপ্টকে উপন্যাস বলে বাজারে বিক্রি করা শুরু করলেন। দেশের টেলিভিশনের লাখ লাখ দর্শক কৌতুকময় অভিনয়সমৃদ্ধ নাটক দেখেন আর সারিবদ্ধভাবে নাট্যকারদের স্ক্রিপ্ট কেনেন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তা দেখে বলতে শুরু করল, আমাদের কথাসাহিত্যের বোধ হয় উন্নতি হচ্ছে! আদতে কথাসাহিত্যের কিছুই হয়নি, কৌতুকময় নাটকের নাট্যকারদের স্ক্রিপ্ট বিক্রি বেশি হয়েছে। নাট্যকারদের ‘স্যার’ বলে ডাকাডাকি, হুলুস্থুল ব্যাপার। পাঠক দর্শকে পরিণত হয়েছেন।
অমরা এই পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করতে যাই। লেখক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী সমাজ কেউ আমাদের বক্তব্য শোনে না। ইলিয়াস ভাই, বটু ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ি। ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ি, লেখালেখি থেকে বিরতি নিই।
এবং বই: আমরা আলোচনার শেষদিকে আছি। আপনার পারিবারিক জীবন সর্ম্পকে জানতে চাই। আপনি ঢাকার আদি মানুষ। ঢাকাতেই সব…..
আহমদ বশীর: আমি ঢাকা শহরের আদিবাসি ‘কুট্টি’ সম্প্রদায়ের লোক। পিতৃপুরুষরা পুরান ঢাকার রাজার দেউড়ি, বেগম বাজার এসব এলাকায় বড়িঘর তৈরি করে বসবাস করতেন। তারা উর্দু এবং ফারসি-ভাষায় কথাবার্তা বলতেন, ধর্ম প্রচারের কাজ করতেন। আমার প্রজন্ম থেকে বাংলায় কথাবার্তা বলেছি।
এবং বই: শেষ প্রশ্ন, বর্তমানে আপনি জীবনের একটি প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। লেখক হিসেবে আপনার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আহমদ বশীর: আমাদের দেশের মতো দরিদ্র সংস্কৃতির (Culture of poverty) প্রেক্ষাপটে একজন লেখক হিসেবে যতটুকু মর্যাদা পেয়েছি- তাই নিয়ে আমি খুশি। যে দেশে প্রখ্যাত লেখকদেরও বই ২০০-৩০০ কপি ছাপা হয়, যে দেশের প্রকাশক তাদের নিজেদের প্রকাশিত বই লুকিয়ে রেখে ভারতীয় বই ডিসপ্লেতে সাজিয়ে রাখেন, যে দেশে সাহিত্য পুরস্কারের বিচারক হন কর্মচারী-আমলা, যে দেশে সাহিত্য পুরস্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত হন কর্মরত কর্মচারী-আমলা- সে দেশে জন্ম নিয়ে আমার কয়েকজন পাঠক আমাকে চেনেন, সেই আমার সন্তুষ্টি।
এবং বই: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
আহমদ বশীর: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।