খাদিজা তাবাসসুম বিথী
‘একটা মেয়ে তার যাবতীয় শেষ স্বপ্নটুকু নিয়ে কাঁদছে। তার সাক্ষী কোনো কাছের মানুষ ছিল না সেদিন। কোনোদিনই অবশ্য থাকেনি ইন্দুবালার পাশে কেউ। কিন্তু জামগাছটা ছিল। তুলসীতলা ছিল। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠে আমগাছটা যেন ডালপালা নেড়ে বলেছিল “কাঁদিস না ইন্দুবালা। একটুও কাঁদিস না। এটা তোর নিয়তি”। এরপর ইন্দুবালার আর কোনোদিন বসা হবে না নিজের বাড়ির এই দাওয়ায়। ফেরা হবে না জন্মভূমিতে। খুলনার কলাপোতা গ্রামটা সশরীরে মুছে যাবে তার ভৌগোলিক স্থাবর অস্থাবর সব কিছু নিয়ে। ইন্দুবালার শুধু মনে রয়ে যাবে এক অলৌকিক অনুভূতি। দেশ নামের স্পর্শ না করা এক স্বপ্নকে।’
বলছিলাম ভিন্ন ধাঁচের ঔপন্যাসিক কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস ইন্দুবালা ভাতের হোটেল এর ইন্দুর কথা।
রিভিউ দিয়ে গল্পের রহস্য উন্মোচন করার ইচ্ছে আমার একদমই নেই। শুধু বলতে চাই একটা উপন্যাস কতোটা আবেদন রাখলে মাত্র দু’বছরের মধ্যেই (প্রথম প্রকাশ: জুলাই ২০২০) এটা নিয়ে সেই রকম হাইপ ওঠা সিরিজ বের হয়ে যায়। যদিও সিরিজটা এখনো আমি দেখিনি। কারণ আমার ইচ্ছে ছিল আগে কাগজ, কালি, মলাটের সংস্পর্শে আসা তারপর ভার্চুয়াল! যদিও বইটা পরে মনে হয়েছে ভার্চুয়ালের আর দরকার হবে না। কেননা বইটার অদ্ভুত রকমের শক্তি আছে আপনাকে খুলনার অজ পাড়া গ্রাম কলাপোতা থেকে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে গিয়ে ফেলার। পুরো বইটাতে আপনি ইমিগ্রেশনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকবেন। খুলনায় কলাপোতা নামের কোনো গ্রাম আমার জানা মতে র্বতমানে নেই। তবে আমার বাড়ির খুব কাছেই শহরের কেন্দ্রে একটা জায়গার নাম আছে ময়লাপোতা। যেটার অবশ্য নাম পরিবর্তন করে এখন সোনাপোতা করা হয়েছে। তাই অনুমান করছি হয়তো এই জায়গারই আদি নাম ছিল কলাপোতা। আর কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের র্বতমান অবস্থান কেউ জানলে জানাবেন।
এখন আসি লেখক সম্পর্কে: ভিন্ন ধাঁচের ঔপন্যাসিক বলেছি এ কারণে যে, গ্রাম বাংলার সাধারণ রেসিপিকে অসাধারণ করে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে একটা গল্প কথনে তাঁর যে মুন্সীয়ানার পরিচয় তিনি দিয়েছেন তা আমার কাছে চিংড়ির হলুদ গালা ঝোলের মতোই লেগেছে। আর অতীত র্বতমানের যে দৌঁড়-ঝাপ তার সাথে কঁচুবাটাটা একদম জমে গেছে। সেই সাথে কুমড়ো ফুলের বড়া, বিউলির ডাল, আম তেল, কুমড়োর ছক্কা, পুঁইশাকের ছ্যাঁচড়া, চন্দ্রপুলি সব মিলিয়ে মৈত্রী রেলে করে কলকাতা ঘুরে আসার আবেশ এখনো কাটেনি! এতোসব রেসিপির স্বাদ নিতে চাইলে পাসপোর্ট করার আগেই বইটা পরে ফেলতে পারেন। সময় বিফলে যাবে না আশা করি।
দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, নকশী কাঁথার মাঠ, আর মৈত্রী রেল কোনো কিছুই বাদ যায়নি ইন্দুবালার জীবন সংগ্রামের দোলাচলে। এককথায় একজন অতি অভিমানী নারীর জীবনের গোপন সুখ-দুঃখের সাথী এই ইন্দুবালা ভাতের হোটেল।