কলেজস্ট্রিট থেকে

এক মধ্যবৈশাখের শনিবার। রাত প্রায় নটা-সাড়ে নটা। কফি হাউসের সবকটা আলো নিভিয়ে দিয়েছে। আর উপায় নেই। বেরোতে হবে। আমরা জনা তিনচার এরপর নিয়মমত প্রথমে সংস্কৃত কলেজের গেটের চা-ওলার কাছে যাব। প্রায় আধঘন্টা যকৃৎ, পাকস্থলী এবং অবশ্যই নিকোটিনের ধোঁয়ায় ফুসফুস রিচার্জ করব তারপর ফিরব। ফুটপাথে পা দিলাম। দেখি, প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে আশির দশকের কবি অদীপ ঘোষ। অদীপদার স্নেহমাখা গালাগালের ব্যাপক স্বাদ। আমরা ঘিরে ধরলাম। কিন্তু অদীপদা মুডে নেই। চোখদুটো যেন আমাদের দেখেও দেখছে না।

কী ব্যাপার? আরে ঐ তো সেই গেট, আটচাকার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে বেরিয়ে আসছেন ডিরোজিও। গাড়িটা চলে যেতেই অদীপদা পেছনে ঘুরলেন। তাকালেন সংস্কৃত কলেজের দিকে। ঐ তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যাসাগর, দেরি করে আসা অধ্যাপকদের লজ্জা দিতে। অদীপদার সাথেসাথে তারপর আমরা ট্রামরাস্তার দিকে তাকালাম। হেঁটে যাচ্ছেন দুই বন্ধু তারা আর বিভূতি, একটু আগেই রবিবাবু অ্যালবার্ট হল থেকে সংবর্ধনা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। একটু এগোলে কলেজ স্কোয়ারের মোড়। বাঁদিকে পরিচয়ের অফিসে গোপাল হালদার বসে আছেন। মধুসূদনের ঐতিহ্য বহন করে মানিক এসে পাঁচটাকা ধার চেয়ে নেবেন। দুম্ করে বোমা পড়ল কয়েকটা। আত্মারাম খাঁচাছাড়া। তিন পথের তিন লাল-বিপ্লব। রক্ত ঝড়ছে, লাশ। মুক্তিসূর্য, যুগযুগ জিও।

কেষ্টবাবুর কালিপুজোর ফাংশানে বিগবি। উত্তমবাবুরও যেনো ঘরের পুজো। একেবারে রাস্তার ওপারে সেই চারপাঁচ বন্ধু। মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। লম্বাটে এক ব্যাকব্রাশ, শুয়ে পড়ল আচমকাই ফুটপাতে। সোনার মাছির খুনি এই শহরে হৃদয়হীন আর হৃদয়হীনাদের আকাশ। তবুও কত তারা! কত নক্ষত্র!

সে দিন অদীপদা নিজের গায়ের কাঁটা দেওয়া লোম দেখিয়ে বলেছিলেন , ‘তোদের রোমাঞ্চ হয় না! আমরা কোন ইতিহাসের মধ্যে আসি আর যাই রোজ! ভাবিস কখনও?’ সে তো শুধু এই রাস্তা কেন! গোটা কলকাতা, বাংলা , ভারত, মায় পৃথিবীটার প্রত্যেকটা মুহূর্তই ইতিহাস। ইতিহাসের জন্ম হচ্ছে। সেই ইতিহাসকে বুনেছে আমাদের আগের প্রজন্মরা, আমরাও বুনছি। বড় হাউসের স্কলারশিপের দলবল, সেলেবেল ইতিহাস খুঁজছে। রণজিৎ গুহর অনুসারীরা খেটেখাওয়া ছোটলোকদের ইতিহাস লিখে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা, মানে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই বাংলা বাজারের ফিফথ ডিভিশনে যারা লেখালেখি করি আমাদের এসব ইতিহাসের গল্পে কী-ই বা এসে যায়! আমাদের বরং কাগজের রিমের দাম কমা বা একটা সরকারি পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের বিজ্ঞাপন কীভাবে বাগানো যায় সেইসব নিয়েই আমাদের চিন্তা। পরিহাস করে সেদিন বলেছিলাম, ‘ ওরা তো ইতিহাস হয়ে রয়েছেন সোনার জলে। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে লিটিল ম্যাগাজিনদের যে হালৎ হবে, তার ইতিহাস গুল-কয়লার ছাই দিয়েও কেউ লিখবে না!’

কবিসাহেবের কী আঁতে ঘা লাগল? জাদুবাস্তব থেকে নেমে এসেছিলেন সেই রাতের আলোঝলমলে কলেজস্ট্রিটে। সারা দিনের পোড়ানো-ভ্যাপ্সানির শেষে গঙ্গার দিক থেকে ঠান্ডা জোলো হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছিল আমাদের শরীর। এলোমেলো করে দিচ্ছিল, অদীপদার কাঁচাপাকা চুল আর চাপ দাড়ি। ‘ওরে…ইতিহাস তৈরি করার কাজ লিটিল ম্যাগাজিনের। দ্যাখ গে, যারা পুরস্কার পাচ্ছে, সবার সেরা লেখাগুলো ছেপেছে কোনো না কোনো লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনকে ইতিহাস বানিয়ে দেবে অত সহজ?’ অকালপক্ক একজন অদীপদার থেকেই একটা সিগারেট চেয়ে নিয়েছিল। গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘পুরস্কারের কথা আর বলবেন না! সেই একটাই সবেধন নোবেল! যে ভাষায় পরের আশি-নব্বই বছরে আর নোবেল এল না! তার সাহিত্য, তার ম্যাগাজিন…লিটিল ম্যাগাজিন!’ অদীপদা চোখ কটমট করে উঠলেন। কিন্তু হাতঘড়ির দিকে নজর গেল। ফাঁকা একটা লোকালের টাইম চলে যাচ্ছে। দৌড়োলেন শেয়ালদার দিকে!

গুলতানি মারায় সিজনড আমাদের বন্ধুর ঐ শেষ কথাটি নোবেল পুরস্কার ইত্যাদি; প্রত্যেক বছর যেন হাহাকারের মত বেজে ওঠে সামাজিক মাধ্যমে। এপার-ওপার মিলিয়ে প্রায় সাঁইতিরিশ কোটি বাংলাভাষী থাকি আমরা এই গরম-বর্ষার ভূগোলে। লিখতে ও পড়তে জানার সংখ্যাও যথেষ্ট, যথেষ্টই বেশি এখন। তা সত্ত্বেও ঐ যাকে আমরা পুজোর ঠাকুর বানিয়ে ছেড়েছি তিনি ছাড়া আর আমাদের গতি নেই। বিশ্বের সাহিত্য-বাজারে তিনিই একমাত্র আমাদের মত ভরসা। তাও সেক্সপিয়ার না হোক, বার্নাড শ বা ইদানিং কালের নেরুদা, মার্কেজদের মতো তিনি কি সারা পৃথিবীতে বহুপঠিত? এসব প্রশ্ন আছে। থাকুক সেসব অধ্যাপক-পণ্ডিত আর খবরের কাগজের কলাম-লিখিয়েদের উপজীব্য। কিন্তু আমরা যে শরমে মরে যাই! আমাদের নোবেল নাই।

সান্ত্বনা আছে, তারাশংকর পেয়ে যেতেই পারতেন! আমাদের মত চন্ডালের দলবল আছে। আমরা বলি অনুবাদ হলো না বলে নইলে শুধু তারাবাবু না, মানিক-বিভূতি-ওয়ালিউল্লাহ-সতীনাথ-কমলকুমার-অমিয়ভূষণ-সন্দীপন-সুনীল-বীরেন-শঙ্খ-শামসুর-আল মাহমুদ-শক্তি-ইলিয়াস-হাসান আজিজুল…আরও কত যে নোবেল আসতে পারত তার ঠিক নেই! কিন্তু এল না, আসে না! মহাশ্বেতা ম্যাগসাইসাই পাওয়ার পর তৈরি হয়েইছিলাম নোবেলটা এল বলে। আর তারপরেই গিয়ে তার পায়ে ঝাঁপ মারব। সেই এক গল্প; হলো না!

এই দুঃখপাঁচালি চলে কয়েক সপ্তাহ! অ্যানি এরনো, সারা পৃথিবীতে খুব বেশি হলে দশ কোটি মানুষের ভাষায় আত্মজীবনী লিখে নোবেল বাগিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন। আর তারপরেই আবার আমাদের মনে হয় একটু নিজেদের দিকে তাকানো যাক! পুরস্কার কী? সে তো স্বীকৃতি! যে যতদিন লিখছি, কেউ যদি আদর করে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়! তবেই তো লোকে জানবে আমি একটা লেখক, নাকি! ব্যাস শুরু হয়ে যায় মালাদাদের দৌড়। (মালাদা মানে মালা নিতে পছন্দ করেন যে দাদা…এটা কবি প্রেমাঙ্কুর মৈত্রের আবিষ্কার)। একটা উত্তরীয়, মানপত্র, প্লাস্টিক-পিতল-কাঁচ ইত্যাদি নির্মিত মোমেন্টো আর সামনে কিছু লোক! মালাদারা ইদানিং দৌড়ে কুল করতে পারছেন না। ফেসবুক আসার পর, নতুন নতুন কমিটি, কত নতুন নতুন মালাদা! তবে এই মালাদাদেরও দেখেছি জনান্তিকে দুঃখ জানাতে, ঠিক করে কেউ চেষ্টা করলে নোবেলটা হয়ত…।

কিন্তু ‘দুঃখ, মৃত্যু’ই তো শেষ কথা হতে পারে না! তাই নতুন উদ্যম শুরু হয়। বাজারের লাখটাকার পুরস্কারটা, নিদেনপক্ষে সাহিত্যসম্রাট বা বর্ণপরিচয়ের উদ্ভাবককে জাপটে ধরতে পারলে পিঠে জ্ঞানের ঝুলি চাপতে পারে। একশো তিরিশ কোটির কাছে সেটাও নোবেলের থেকে কম কী? এ তো গেল এপারের কথা! ওপারেও তো লাখি পুরস্কারের ছড়াছাড়ি তার আবার প্রচুর হিসেব! আদার ব্যাপারি ভুল করে শিবের গীতে চলে যাচ্ছি। ধান ভানতে এসে মোদ্দা কথা! আমাদের নোবেল নেই, তার জন্য পরিকল্পনা নেই! মালাদাদের সাথে আমাদেরও বড় দুঃখ!

এখন এই দুঃখ যায় কী করে? যারা আমাদের নাকি শিক্ষিত করলো। তাদের কাছে বুকার নাকি নোবেলের থেকে কম না! আমাদের মত নেটিভ, কেলোকালা ভারতীয় অথচ ইংরেজি ভাষার লেখকরা সেই বুকার পেয়ে ধন্য হয়ে যায়! দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ইংরেজি ভাষায় কথা না বলতে পারলে নিজেকে শিক্ষিত মনে করতে পারি না! দুঃখের সাথে প্রশ্নটা ধাক্কা মারে! ওদের এইদিকটা আমাদের চোখে পড়ে না? দুপারের দুই একাডেমি এবং আকাদেমি আছে। এখন তো, গঙ্গা-পদ্মার জোয়ার ভাঁটার মত লেখক-লেখিকারা ঢাকা-কলকাতা করছেন। তিনটে বইমেলাতে ভক্তদের সই বিলোচ্ছেন! অধ্যাপক-গবেষকেরা পেপার পড়ছেন দুপারের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে কেন একটা অভিন্ন পুরস্কার বা সম্মান থাকবে না, যে পুরস্কার দুই অ্যাকাডেমি যৌথভাবে প্রতিবছর দেবেন। সাঁইতিরিশ কোটি পাঠক একসাথে জানবে আমার ভাষা আর সাহিত্য কতটা মহান এবং সৃষ্টিশীল!

কথায় আছে ‘বাজার বানায় রাজা’। আমাদের এই সাঁইতিরিশ কোটির বাজারটাও কিন্তু ছোট না। ছুটে আসবে বহুজাতিকেরা, যারা নাকি নোবেল নিয়ে লবি করে। তা আসুক, যাক। করুক ব্যবসা। আমার ভাষার কাছে নত হয়ে , আমার সাহিত্যের মহত্ত্বকে অনুভব করে মুনাফা করুক। ক্ষতি নেই! আমাদের দরকার নিজেদের দিকে চোখ ফেরানোর। এক ভাষা, ভূগোল, জলবায়ু এবং সংস্কৃতির জন্য একটি অভিন্ন সাহিত্য পুরস্কার থাকবে না কেন! ইলিয়াস, সন্দীপনকে পড়লে কি আলাদা ধরণের রক্তস্রোত বুকের মধ্যে তোলপাড় করে! যে ভাষার জন্য সারা পৃথিবীর মাতৃভাষা মর্যাদার আসনে বসেছে। সেই ভাষার একটি অভিন্ন সাহিত্য পুরস্কার প্রয়োজন। সদ্য কিশোর তার আঙুল কি-বোর্ডে ছোঁয়াবে একদিন সেই পুরস্কারের স্বপ্নে। গঙ্গা-পদ্মার জল-পানি ভিজিয়ে দেবে তার লেখকসত্ত্বা। নোবেল এলো না গেলো তাতে, তার কোনকিছুই যাবে-আসবে না। কলেজস্ট্রিট থেকে আজ এই পর্যন্ত।

রাজেশ ধর : কথাশিল্পী, কলকাতা, ভারত।

আরও পড়ুন..

চিরকুট একটি মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প-সংকলন