রুখসানা কাজল
কোথাও বেড়াতে যাবো ভাবলেই ঘুম উবে যায় আমার। বেড়ানোর জায়গা, আবহাওয়া এবং মানুষজন বুঝে জামাকাপড়সহ অন্যান্য জিনিসগুলো অনেকবার করে গুছিয়ে রাখি। এমনিতে হালকা সম্ভারে থাকতে আমার ভালো লাগে। তাছাড়া বাংলাদেশের শহর বা গ্রামে আজকাল প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। তাই অযথা টেনশন করিনা। এবার ভোরেই বেরিয়ে পড়েছি। অস্বাস্থ্যকর কুয়াশা গলে পড়ছে আমার শহরে। খবর ভাসছে, এবছর জাঁকালো ঠান্ডায় দেশ কাঁপাবে না প্রকৃতি। অশীতল পৌষের হালকা অন্ধকারে হিনো কোম্পানীর বিশাল বাসটি ছুটছে।
নিদ্রাকুসুমের আবেশে সামান্য ঘুমে ঢুলছে সদা জাগরী ঢাকা। এসব দেখতে দেখতে ধূলোময় গাছ, ঘুমন্ত রাস্তা, মানুষ এবং কুকুর, আবর্জনার স্তুপে ফেলেছেড়ে থাকা পলিথিনের অপরিমেয় বিস্তার পেছনে ফেলে হঠাৎ আমরা ঢুকে গেলাম আধাশহরের এক অনাবিল প্রকৃতিতে। গতি কমিয়ে বাস উঠে পড়েছে একটি সাদা ব্রিজে। গতিছন্দের তারতম্যে ঘুম কেটে গেছে অনেকের, এটা কোন ব্রিজ ভাই ? ওহো তাই ত ! ফের ঘুমিয়ে পড়ার আগে তারা সরল বিস্ময়ে বলে ওঠে, বাহ ! ধলেশ্বরী ব্রিজ তো কম সুন্দর নয় !
নদীর বুক থেকে পাকিয়ে উঠছে অথৈ কুয়াশার হালকা মেঘ। জল শুকিয়ে এপার ওপার প্রায় মুখোমুখি। দুধের সরের মতো জেগে ওঠা চরে একটি লাল ট্র্যাক্টর অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গরু নিয়ে এসেছে কয়েক জন নারী। উপরে চলন্ত বাস দেখে ঘোমটা তুলে দিয়েছে পরম্পরা অভ্যাসে। একটি কিশোর চপলতাহীন গম্ভীর মুখে শ্যাওলা সরিয়ে নৌকা ভাসান দিচ্ছে। হঠাৎ বাসযাত্রী একজন তরুণী কান্নারুষ্ট গলায় বলে ওঠে, এত স্লো চালাচ্ছে কেন ! আব্বাকে কি আর দেখতে পাবানি !! ভরসা দিয়ে কেউ সান্ত্বনা দেয়, ধলেশ্বরী পেরুলেই স্পীড তুলবে…. ধলেশ্বরী ! ধলেশ্বরী ! আচমকা দেখতে পাই এক চেনা মুখ।
নব্বুই একানব্বইয়ের এক সন্ধ্যা। নিম্নমধ্যবিত্তের সাঁড়াশি চাপে পরাজিত সেই প্রেমিক। পালিয়ে আসা সালংকরা প্রেমিকাকে বিয়ের আসরে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছিলেন। এখন দুজন পৃথিবীর দুপ্রান্তে দুধেভাতে ডলারে-টাকায় দিব্য আছে। বহু বছর কাপুরুষ ভেবেছি তাকে। ঘৃণাও করেছি সমস্ত আবেগ দিয়ে। ভেবেছি ক্ষমা নেই। এমন পুরুষকে আবার ক্ষমা কিসের? এখন মায়া জাগছে মনে। দূরে ধলেশ্বরীর ঘন সবুজ বাঁকে একটি টিনের ঘর শুভ্র পরিন্দার মতো ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল গতির তোড়ে।
সে কোন আমলে ঠাকুর বাড়ির রবীন্দ্রনাথ দোয়াতে কলম চুবিয়ে লিখেছিলেন, ‘ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া, পরণে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর।’ ধলেশ্বরী নদীতীরের গ্রামে পিসির দেওরের মেয়েটিকে হতদারিদ্র অবস্থার সঙ্গে জড়াবে না বলে যে কেরানী বরটি পালিয়ে এসেছিল, সেই মেয়েটা কি বেঁচেছিল ?
এখন মনিরামপুর উপজেলা ছুঁয়ে যাচ্ছে বাস। পথে পথে ছড়িয়ে আছে সবুজের মায়াছায়া। দুপুরের রোদ পড়েছে গাছের গায়ে পাতায় পাতায়। এতক্ষণে বুঝে গেছি, গন্তব্য ঠিক হলেও ভুল বাসের টিকিট কেটেছি আমরা। যশোর ঘুরে তবেই খুলনা পৌঁছাবে এ বাস। আমন্ত্রণদাতা যে বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চ করার কথা ছিল, তারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়বে। তা পড়ুক না হয় ! আমি ত মানুষ দেখতে পথে নেমেছি। সোনা মানুষ, রূপো মানুষ, মাটি ও আগুন মানুষ। মেঘ বৃষ্টি, শস্যসুফলা মানুষের সঙ্গে নুনক্ষারে পোড়া নিরন্ন হাঘরে মানুষের পাশে বসে আমি খুঁজতে বেরিয়েছি, ‘আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপার লীলে —-’ সঙ্গের সঙ্গী বন্ধুটি মুচকি হেসে গুনগুণ করে, এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়—- ওর দিকে ঘুরে ভালো করে চেয়ে দেখি, ঠিকঠাকই আছে মানুষটা। কিন্তু রোদ্দুরের পাল তোলা এই প্রদীপ্ত দুপুরে ও কোথায় খুঁজে পেল স্বর্ণালী সন্ধ্যার সুন্দরকে !
আরও পড়ুন…
ইউপিএল-এর নতুন বই ‘সময়ের কুয়াশায়: দীপেশ চক্রবর্তীর সম্মানে প্রবন্ধগুচ্ছ’