উন্নয়নের বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন চোখে বাংলাদেশ দেখার বই ‘উন্নয়নপাঠ: নদী ও প্রাণ’

রূপসী বাংলার কবিখ্যাত জীবনানন্দ দাশের ধানসিড়ি নদীটি বয়ে গেছে বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে। ধানসিড়ি খুব বড় বা বাণিজ্যিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ নদী না হলেও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেহেতু এর কথা অনেকবার এসেছে, সে কারণে ঝালকাঠিবাসী তো বটেই, পৃথিবীর সকল জীবনানন্দপ্রেমি ও সাহিত্য অনুরাগীর কাছে ধানসিড়ি একটি বিশেষ অনুভূতির নাম। কিন্তু এই বিশেষ নদীটি খননের নামে ড্রেনে পরিণত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর প্রতিবাদে মানববন্ধনও করেছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা। গণমাধ্যমে সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু ধানসিড়ি নদীকে ড্রেন বানানোর প্রক্রিয়া থামানো যায়নি।

শুধু ধানসিড়ি নয়, খননের নামে দেশের আরও অনেক নদী ও খাল এভাবে ড্রেনে পরিণত করা হয়েছে। নদীর জায়গা উদ্ধারের নামে ভুল জায়গায় সীমানা পিলার দিয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। ‘নড়াই’ নামে একটি নদীর নাম ও চরিত্র পাল্টে ফেলার ঘটনা ঘটেছে খোদ রাজধানীতে—যার একটি অংশ এখন রামপুরা খাল, আরেকটি অংশের নাম হাতিরঝিল লেক।

২০১৯ সালে দেশের সবগুলো নদীকে লিভিং এনটিটি বা ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তার মানে মানুষের মতো নদীরও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অধিকার রক্ষায় কতটা সতেচন, তা শিল্পায়নের নামে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, গাজীপুরের লবনদহ ও তুরাগ, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা, সাভারের বংশী ও ধলেশ্বরী ইত্যাদি নদীর ভয়াবহ দূষণ ও দখলের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়। উপরন্তু চাকিরপশার নামে কুড়িগ্রামের একটি নদীর দিকে তাকালে বোঝা যায় রাষ্ট্র কী করে একটি নদীকে লিজ দিয়ে সেখানে খণ্ড খণ্ড পুকুর বানিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেয়। নদীর সঙ্গে এরকম নির্মমতা পৃথিবীতে বিরল।

দেশের নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বেশ কিছু আইনও আছে। কিন্তু সেইসব আইন ও বিধান সাদা কাগজে কিছু কালো অক্ষর বৈ কিছু নয়। কথিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির নামে; শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে দেশের নদী, খাল ও জলাশয় দখল ও দূষণ ঘটিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে যে নদীকেই গায়েব করে দেয়া হচ্ছে—তার লিখিত প্রতিবাদ এই বই।

নদী দখল বা দূষণ নয়, বরং নদীকে নদীর মতো বইতে দেয়াই যে উন্নয়ন; এক কোটি বা একশো কোটি টাকা থাকলে একটি কারখানা বানানো যায়, কিন্তু এক হাজার কোটি টাকা দিয়েও যে একটি নদী বানানো যায় না; একটি নদী মরে গেলে শুধু যে একটি নদীই নয়, বরং তার সঙ্গে সঙ্গে শত বা হাজার বছর ধরে ওই নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত পুরো ইকো সিস্টেম বা প্রতিবেশও ধ্বংস হয়ে যায়—এই বার্তাগুলো নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছে দেয়াই এই বইয়ের উদ্দেশ্য।

এটি শুধু নদী ও প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে একজন প্রকৃতিপ্রেমি সাধারণ মানুষের নির্মোহ বয়ান বা দুঃখগাথা নয়। এটি একটি জার্নালিস্টিক কাজ। একজন সাংবাদিক এবং একইসঙ্গে নদীরক্ষা আন্দোলনের একজন নিঃস্বার্থ (দেশের স্বার্থ) কর্মী হিসেবে কথিত উন্নয়নের নামে কীভাবে গত অর্ধ শতকে দেশের নদী-খাল-জলাশয় ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে, সেটির সচিত্র প্রতিবেদন এই বই। এখানে রয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের রেফারেন্স। রয়েছে লেখকের নিজের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ।

এই বইটি কোনো অর্থেই উন্নয়নবিরোধী নয় বা উন্নয়নের বিরোধিতা করা এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে উন্নয়নের যে বিভ্রান্তিকর ধারণা জনমনে দেয়া হয়েছে এবং ভুল ও মুনাফাকেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে যে দেশের লাইফলাইন নদীগুলো হত্যা করা হয়েছে, সেই নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।

বলা হয়েছে, নদী খুন করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো উন্নয়ন নয়। বরং নদীকে নদীর মতো বইতে দেয়াই উন্নয়ন। আমাদের উন্নয়ন লাগবে। কিন্তু তার আগে নদী লাগবে। নদী ও প্রাণপ্রকৃতিক বাঁচিয়ে বা অক্ষত রেখে এবং যতটা সম্ভব কত আঘাত করে উন্নয়ন করতে হবে। সড়কপথ উন্নয়নের জন্য হাজার হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করে যেভাবে ওই সেতু ও কালভার্টের নিচে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বা ক্ষীণ করে দেয়া হয়েছে, সেটি যে কোনো অর্থেই উন্নয়ন নয়—সেটি ধরিয়ে দেয়াই এই বইয়ের উদ্দেশ্য।

আমীন আল রশীদ এর উন্নয়নপাঠ নদী ও প্রাণ বই কিনতে চাইলে ক্লিক করুন
এটি নির্দিষ্ট করে কোনো আমলের, কোনো একটি সরকারের বা কোনো একটি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয়। বরং বছরের পর ব্ছর ধরে উন্নয়নের নামে যে দেশের প্রাণপ্রকৃতির টুটি চেপে ধরা হয়েছে—সেই কথাগুলোর জার্নালিস্টিক বয়ান এই বই। এখানে আবেগের চেয়ে তথ্য বেশি।

উন্নয়নের ‘ষড় ক’ অর্থাৎ ছয়টি ‘ক’ এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে এই নদীর ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াতে পারে, তার একটি প্রেডিকশন বা ধারণা দিয়ে বইটি শুরু। কেননা বছরের পর বছর ধরে আমাদের উন্নয়নভাবনায় যেহেতু নদী, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির বিপরীতে স্ট্রাকচার বা অবকাঠামোর দৃশ্যমানতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, ফলে ঘরপোড়া গরুর মতো এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে দেশের দীর্ঘতম সেতুর জেল্লা দেখে যারা উন্নয়নমুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে ভাবেন, তাদের মনে এই শঙ্কাই প্রবল হচ্ছে যে, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এই নদীটির দশাও বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী বা তুরাগের মতো হবে কি না?

রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে যে নদীকে কেন্দ্র করে, সেই বুড়িগঙ্গাকে বিপন্ন করা হয়েছে উন্নয়নের দোহাই দিয়েই। একই অজুহাতে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত করা হয়েছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী আরেক গুরুত্বপূর্ণ নদী তুরাগকে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারিপল্লী সরিয়ে নিয়ে সেখানে বিপন্ন করা হয়েছে ওই এলাকার মানুষের লাইফলাইন ধলেশ্বরী নদীকে। অর্থাৎ বারবার আমাদের নদীগুলোকে ধর্ষণ করা হয়েছে কথিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অজুহাতে।

সড়কের উন্নয়ন নৌযোগাযোগ বিলুপ্ত হবে কি না; নদী খুন ঠেকাতে রাষ্ট্রে আইন-কানুন ও নদীরক্ষা কমিশনের এখতিয়ার; হাওরের ফসল ডুবে যাওয়ার পেছনে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কীভাবে ভূমিকা রেখেছে; রাজধানীর যানজট মানেই উন্নয়ন কি না এবং প্রতি বছরের দুই ঈদে কেন আমাদের সকল যোগাযোগব্যবস্থা মুখথুবড়ে পড়ে; বাংলাদেশ কেন এবং কীভাবে একটি ‘প্রকল্পরাষ্ট্রে’ পরিণত হলো—এইসব বিশ্লেষণও রয়েছে উন্নয়নপাঠ নদী ও প্রাণ বইতে।

উন্নয়নের একটি বড় প্রশ্ন হলো, কোন উন্নয়নের বিনিময়ে কী বিসর্জন দিতে হলো? এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, গত অর্ধ শতাব্দীতে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় ভিকটিম নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি। নদীর জায়গা দখল করাই সবচেয়ে সহজ কাজ। প্রভাবশালী ও সম্পদশালীরা নদীর তীরে কলকারখানা গড়ে তুলে সেখান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করেছেন; প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে; দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু ওই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে যে কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলে কতগুলো নদী খুন করা হয়েছে, তার হিসাব কে রাখে? গত অর্ধ শতাব্দীতে কলকারখানা ও শিল্পায়নের নামে দেশের কতগুলো নদী খুন করা হয়েছে সেই পরিসংখ্যান কি রাষ্ট্রের কাছে আছে? এখনও কি এই প্রশ্ন করার সময় আসেনি যে, গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশের কলকারখানাগুলো কত হাজার কোটি টাকা সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে আর তার বিনিময়ে যে নদী ও প্রাণ-প্রকৃতির ওপর ব্যাভিচার চলল, তার আর্থিক মূল্য কত? এইসব প্রশ্ন করার নামই যে উন্নয়ন সাংবাদিকতা—সেটিও স্মরণ করে দেয়া হয়েছে এই বইতে।

বইটি প্রকাশ করেছে ঝালকাঠি পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদশিল্পী মুজিব মুহাম্মদ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে এই সময়ের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নদীরক্ষা আন্দোলনের নিঃস্বার্থ কর্মীদের।

আমীন আল রশীদ এর উন্নয়নপাঠ নদী ও প্রাণ বই কিনতে চাইলে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন…

ফয়সাল আহমেদ এর নতুন বই- সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম : রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ