একুশ

রুখসানা কাজল

ট্রামলাইনটা দেখে এসেছে নালন্দা। হিজলের ছায়াগন্ধহীন শুকনো খটখটে পারাপার। ধারে কাছে শেয়ালকাঁটা, ভাঁটফুলের কোন গাছ নেই। নেই লাল শাপলা আর শালুকলতা ভাসা পুকুর। অর্ডিন্যারী নীল ছোপানো মরা আকাশ। একঝাক শালিক খুন চোখে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাইনের উপর। ঘাসফুল চুঁচুরুপাতা আমরুলি ঝোপ ধরে গেঁথে  আছে মাটিতে। দূরে ধূলি ধূসরিত দেহে অকিঞ্চিতের মত কোল পেতে বসে আছে আকন্দ, ঝামটি, বনজামরুল, দুএকটা উলোটকম্বল, মেরুণ বুকের বনচুকাই। উঠতি কবি নালন্দা সাইফুল মহানগর কোলকাতায় এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে কবিতা পড়তে।  মাঝরাতে কোলকাতার আকাশ ওকে ডেকে তুলেছে, ট্রামলাইনটা দেখবি না তুই?       

আকন্দফুলের চোখে সাদা জল। বেগুনি গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে হাহাকার, ‘পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই গেয়ে যাই আমি, মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।’

কতগুলো লাল ভেন্নার গাছ ঝোপ পায়ে এগিয়ে আসে। ছাতার মত পাতা মেলে সিন্ধুসারসের গলায় বলে ওঠে, “ সোনালি –সোনালি চিল— শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে—’’

ও মনু হেইয়া তোর মনে আছে ? আছে আছে— নালন্দার চোখে জল। পালাচ্ছে সে। দলছুট। পেট্রোপোলের সীমান্ত গেট পেরিয়ে বেনাপোলের ভূমিতে ঢুকতে ঢুকতে নালন্দা দেখে যশোর রোড ভাগ হয়ে গেছে জল ও পানিতে। 

ইজেলের গায়ে আঁকা ছবিটায় সকালের রোদ্দুরের মত নরম হলুদ রঙের শেষ টান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে নালন্দা। নাহ, এবার আর ঠেকাবে না সে। নাকমুখ উপচে যত রক্ত বেরুতে চায় বেরিয়ে যাক। বুকের কাছে রক্তে ভেজা গেঞ্জীতে পাঁচ আঙুল প্রসারিত করে চাপ দেয়। একজন হালকা পাতলা রোগা মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে! উষ্ণ গরম অথচ মৃত্যু বাহক!  

হস্টেলের বারান্দা থেকে সামনে বাড়ির চেহারাটা দেখা যায়। পুরনো বারান্দায় লতানো গোলাপ গাছ। ফুল ফুটেছে সুখে। ফ্যাঁকাসে মুখের মা মহিলাটি গুজরাটি। বাংলা উচ্চারণে এখনো গুজরাটি সুবাসের মর্মর। মাঝে মাঝে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে, পানি ঢালতে ভুলে যায় টবে। ওদের হস্টেলে যখন অমর একুশ স্মরণে গান বাজে, ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’, ঠোঁট নড়ে উঠে গুজরাটি এই মায়ের। রুমের সামনে নেড়ে দেওয়া অসংখ্য জামাকাপড়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে নালন্দা দেখেছে মা মহিলাটি বারান্দার জাফরি এত জোরে চেপে ধরে গান শোনে যে আঙুলগুলো থেকে রক্ত সরে যায়। সে কি বাংলায় গায়? নাকি তার নিজের ভাষায়?

 রুমের সামনে নেড়ে দেওয়া অসংখ্য জামাকাপড়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে নালন্দা দেখেছে মা মহিলাটি বারান্দার জাফরি এত জোরে চেপে ধরে গান শোনে যে আঙুলগুলো থেকে রক্ত সরে যায়।

ওর তখন প্রবল চাপ আসে বুকের ভেতর থেকে। নিঃশ্বাস পাক খেয়ে পথ হারায়। ভাঙ্গা হৃদয়ের অলিগলি খুঁজে প্রাণ ছুঁতে বড় দেরি করে ফেলে শ্বাস। ঝুঁকে যায় দেহ।  বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরে আড়াইফুট চওড়া বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে নালন্দা।  সিলিঙ ফ্যান বাতাস দেয় তিন হাতে। বাতাসে ভাসে মা মা গন্ধ। বালিশের নীচ থেকে নেশার সিগ্রেট বের করে। ওষুধের টাকা খরচ করে ফেলেছে কালোসোনা কিনে। যতটুকু বাঁচা যেত তার চেয়ে কম বাঁচলে ক্ষতি কী! কার কী এসে যায় ওর জন্য! বাবাহীন মায়ের ভাঁড়ার থেকে উড়ে যাচ্ছে গয়না, জমি, ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র এমনকি একদিন ছোটবোনটিও। মার তবু আশা, সর্বস্ব পণ আমার। তুই শুধু বেঁচে  থাক লাল্লা, বেঁচে থাক। জয়নুল, কামরুল, সুলতান, শাহাবুদ্দিনের স্নেহ নিবি, পিকাসোর দেশে যাবি, ভিঞ্চির….    

ক্রমশ ফুলে উঠা লালচোখে জল ঝরে, আমি মরে যাচ্ছি পৃথিবী। মরে তো যেতামই কোন একদিন। শুধু আগে যাচ্ছি। স্বেচ্ছায়। এ জন্মে আর শিল্পী হওয়া হলো না গো  আমার!

গেলো কাল বিকেলে ছোটবোন এসেছিল। টিফিন ক্যারিয়ারে পায়েস, নারকেল তক্তি। কাগজের প্যাকেটে মুড়কি, সরভাজা। ওকে দেখলে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। কালোমুখে ক্লান্তিহীন আনন্দ। অনুযোগ জানে না। অভিযোগ তাও করে না। চাপিয়ে দেওয়া ভারেও ভেসে চলেছে খোলা নৌকার মত। কোথাও কি অভিমান আছে?

কেমন আছিস ওখানে?

ভালো। কেবল বই পাইনা, কোনো পত্রিকাও।

খেয়ে নিস তো ঠিক মত? হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে দুলে উঠে, আমার খুব ক্ষুধা পায়না রে। তুই ওষুধ খাচ্ছিস তো ঠিকঠাক ?

হাজার হাজার জোনাক জ্বলা চোখে হেসে উঠে নালন্দা, একদম। ভালো হয়ে যাবো দেখিস। পড়াটা কিন্তু শেষ করিস সোনাই। চাকরি করবি তো? ওরা দেবে?

না দিলে ছেলেকে নিয়ে চলে আসবো তোর কাছে। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা না ভাইয়া! বোনের দৃষ্টিতে আলোর আশালতা। চেনা আলো। বোন কি কুমু ! কুমুদিনি? নালন্দা যে নেই নেই করেও বিপ্রদাসের মত মহীরুহ নয়! ফাঁকা, নিঃশ্বাসহীন!   

পোষ্টারগুলো লিখে রাখিস ত ছোট।

একুশ আমার অহংকার, চেতনায় একুশ, মননে একুশ, আমি বাংলায় গান গাই….. লিখতে লিখতেই রঙে মাখামাখি বোন আর সেই একজন। তখনও হৃদপিণ্ডের ছিদ্রটা গভীর হয়ে উঠেনি। তখনও পুকুর ভরা মাছ, গোয়ালে কাজলি গাই, রূপশালী ধান, বোনের হঠাত হঠাত গেয়ে ওঠা, সেথায় আমার ভাইধন থাকে, আমার কথা কইও তাকে…..নালন্দাকে ঘিরে স্বপ্ন আর স্বপ্ন। কেবল তখনও বলা হয়নি সেই তাকে,  তোমাকে ভালোবাসি মেয়ে। এ জীবনে আর হলো না। যদি আবার জীবন পাই, “তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !”

শেষটানে এক খেয়া পারাপারের ছবি এঁকে রেখেছে। একমুঠো রোদ্দুর। বোন ঠিক  বুঝে নেবে, এটা আলোর পথ। ফিরে আসিস বোন। জলঙ্গির জলে নীলফুল শাপলা হয়ে। আগুনের ছর্‌রা ছেটানো জ্যোৎস্নায় আত্মজকে বলিস শিল্পী হতে গেলে প্রার্থনায় সমিধ রাখতে হয়। সে সমিধে দাহ থাকে, গূঢ় যন্ত্রণা, ঘূর্ণিপথ, উদ্বাস্তু বাবামায়ের  স্বেদক্লান্ত দিনরাত, একটু একটু করে কষ্টেরা খেয়ে যায় স্বপ্নসৌধের সোনালি হৃৎপিণ্ড।    

পথে পথে আল্পনা আঁকছে সহপাঠী বন্ধুরা। সেই পথে হেঁটে যায় নালন্দা। আয়ুরেখা বেয়ে উঠে এসেছে মৃত্যু। নীল চাদরের নীচে মৃত্যুমেয়ে খেয়ে নিচ্ছে ওর শেষ আয়ু। বড় ক্ষুধা মেয়েটার। ঠুনঠুন করে বাজছে তার কোমরের ঘুনসিতে দোলা ঘুঙুর। সম্পর্কের গভীর ঐশ্বর্যে নালন্দাকে জড়িয়ে নিয়েছে সে। রক্তের গন্ধ ছাড়িয়ে ধানসিঁড়ি নদীর গন্ধ ভাসে  মৃত্যুমেয়ের চুলে। বকফুল মুখে প্রজাপতি পাখনার মতো দুটি চোখ। কী মায়া ! কী মায়া! শেষ রক্তবিন্দু খেতে দিয়ে নালন্দা শুয়ে পড়ে বিছানায়।

প্রভাত ফেরিতে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে ছুটে আসবে বন্ধুরা। এরপর কান্নার রঙে আঁকা হবে বেদনার আল্পনা। ছবিটা দেখেই বন্ধুরা বুঝে যাবে, বর্ণমালার খোঁজে জীবনানন্দের পথে হেঁটে গেছে নালন্দা সাইফুল।

আরও পড়ুন…

বিধান রিবেরুর নতুন বই ‘কানান্তর’