“কবিতার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকলেও প্রবন্ধ-গবেষণাধর্মী মননশীল রচনার প্রতি সমান আগ্রহী”

কবি ও প্রাবন্ধিক ফারুক সুমন ১ মার্চ, ১৯৮৫ সালে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার অন্তর্গত শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় দেয়ালিকায় ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখির হাতেখড়ি। তখন শিল্পসাহিত্যে আনাড়ি এই বালকের নতুন বিস্ময় ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ এখানে এসে কিছু সৃষ্টিশীল গুণী মানুষের সংস্পর্শ তার ভাবনাবিশ্বকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, কবি খালেদ হোসাইন, লেখক ও গবেষক আবু দায়েন, কবি ও গল্পকার রায়হান রাইন, কবি হিমেল বরকত, কবি সুমন সাজ্জাদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তাঁকে শিল্পের সড়কে হাঁটতে শেখায়। ছাত্রাবস্থায় যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ছোট কাগজ ‘অক্ষৌহিণী’। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পাঠচক্র ‘কালবোধন’ এর সংগঠক ছিলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে যথাক্রমে স্নাতক (২০০৫), স্নাতকোত্তর (২০০৬) প্রথম শ্রেণি এবং উচ্চতর এম. ফিল. (২০১৪) ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর এম. ফিল গবেষণার শিরোনাম- ‘শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরচেতনা’। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলাদেশের কবিতা: উত্তরাধিকার ও পরম্পরা’ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণায় যুক্ত আছেন। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’-এ ইউনিট ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও শিক্ষকতাই তার আসল ব্রত। তিনি যথাক্রমে ‘গুলশান কমার্স কলেজ’ এবং ‘কুইন মেরী কলেজ’- এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন।  বর্তমানে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ’ (রাইফেলস কলেজ, বিজিবি সদর, পিলখানা, ঢাকা)- এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন।

একাডেমিক কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন ‘নিপ্পন ফাউন্ডেশন অব জাপান’ (২০০৬)  শিক্ষাবৃত্তি। ২০১৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘সার্ক সাহিত্য সম্মেলন’ এবং ‘নেপাল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’-এ যোগদান করেন।

প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে- কাব্যগ্রন্থ : ‘অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে’ (২০১৭), ‘আঙুলের ডগায় সূর্যোদয় (২০১৮), ‘বিচঞ্চল বৃষ্টিবিহার’ (২০২০), ‘বিরামচিহ্নের কান্না’ (২০২২)। প্রবন্ধগ্রন্থ : ‘শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ’ (২০১৫), ‘শিল্পের করতালি’ (২০১৯), ‘শামসুর রাহমানের কাব্যস্বর’ (২০২১), ‘শিল্পের সারগাম’ (২০২২), ‘বঙ্গবন্ধু : অন্তরঙ্গ পাঠ’ (২০২৩), ‘দীপ্তিমান মনীষা’ (২০২৩) ও ভ্রমণগ্রন্থ : ভ্রমণে অবাক অবগাহন (২০২১)।

লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন- রউফিয়ান রিদম সাহিত্য সম্মাননা-২০১৬, উচ্ছ্বাস প্রহর সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯, সমতটের কাগজ লেখক সম্মাননা-২০২০, দোনাগাজী পদক ২০২১।

এবং বই : শুরুতেই এবং বই অনলাইনের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। অমর একুশে বইমেলার সতেরোতম দিন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। মেলায় নিশ্চয়ই গিয়েছেন? কেমন লাগছে এবারের সার্বিক আয়োজন, পরিস্থিতি…?

ফারুক সুমন : আপনাকে ধন্যবাদ। এবং বই আমার প্রিয় একটি পত্রিকা। শুরুতে আমিও এবং বই এর অনলাইন যাত্রাকে অভিনন্দন জানাই। আশাকরি ভালো কিছু হবে।

হ্যাঁ, বইমেলায় গিয়েছি। বইমেলা লেখক-পাঠকের জন্য বিশেষ উপলক্ষ্য। আমরা এই ভাষার মাসের অপেক্ষায় থাকি। প্রথম সপ্তাহে মেলায় আগত পাঠক কিংবা দর্শকের আনাগোনা কিছুটা কম থাকলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে বেড়েছে। ছুটির দিনগুলোতে মেলাপ্রাঙ্গণ জনারণ্যে পরিণত হয়েছে। বইয়ের বিক্রিও ভালো। যদিও মেলায় আগত দর্শনার্থীর তুলনায় কিছুটা কম মনে হতে পারে। আসলে মেলায় নানারকম মানুষ আসবেন এটাই স্বাভাবিক। এদের মধ্যে কেউ প্রিয়জনের হাত ধরে বেড়াবেন। কেউ বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে আড্ডা দিবেন। কিন্তু যারা বই কেনার তারা ঠিকই পছন্দের বই অটোগ্রাফসহ কিনে নিবেন। এখন অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসে সহজেই বই সংগ্রহ করা যায়। তবে বইমেলার আবেদন অন্যরকম। এই মেলার সঙ্গে আমাদের ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা।

এবং বই : এবার নতুন করে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের দাবি উঠেছে। আপনার অভিমত কী?

ফারুক সুমন : আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন হলে তো ভালো হয়। ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা’ নামে আগেও বোধহয় মেলা হয়েছিল। এখন আর হয় না। আসলে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা করতে গেলে কেবল স্টল সাজিয়ে বসে থাকলে হবে না। মেলাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে পাঠকের সমাগম বাড়বে। দেশি লেখকদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের লেখকদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তাঁদের নিয়ে বইমেলায় সভা-সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। মানুষ লেখকেদের সঙ্গে দেখা করবে। আড্ডা দিবে। মোদ্দাকথা হলো, বইমেলার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াতে হবে।

আসলে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা করতে গেলে কেবল স্টল সাজিয়ে বসে থাকলে হবে না। মেলাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে পাঠকের সমাগম বাড়বে।

এবং বই : একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন?

ফারুক সুমন : এবার একুশে বইমেলায় আমার নতুন দুটি বই প্রকাশ হয়েছে। দুটিই প্রবন্ধের বই। একটি ‘বঙ্গবন্ধু : অন্তরঙ্গ পাঠ’ শিরোনামে ‘বৈভব প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের প্রয়াস রয়েছে। অন্যটির নাম ‘দীপ্তিমান মনীষা’। এটি প্রকাশ করেছে ‘পুথিনিলয়’। এখানে ২০ জন দীপ্তিমান মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে মোট ২৫টি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। নতুন দুটিসহ আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা মোট ১১টি। এগুলোর মধ্যে ৪টি কাব্যগ্রন্থ, ৬টি প্রবন্ধগ্রন্থ এবং ১টি ভ্রমণবই।

এবং বই : এবার কি বইয়ের বিক্রি অপেক্ষাকৃত কমেছে? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

ফারুক সুমন : বইয়ের বিক্রি কমেছে, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। দেখুন, বই বিক্রি যদি না-ই হতো তবে বইমেলায় শত শত প্রকাশনীর স্টল কিংবা প্যাভিলিয়ন বসতো না। প্রতি বছর কিছু ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এধরনের কথা বলে বেড়ান। মানসম্মত বই প্রকাশ পেলে নিশ্চয় সেই বই ধীরে হলেও পাঠকের কাছে পৌঁছবে। তবে এটা ঠিক, ১৬-১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যা আমাদের। সেই তুলনায় বই বিক্রি কম। বই বিক্রির ক্ষেত্রে আমাদের মুষ্টিমেয় কিছু প্রকাশক প্রচারণা চালান। অধিকাংশ প্রকাশক বইয়ের প্রচারে নির্বিকার থাকেন। তারা লেখকের দিকে চেয়ে থাকেন। লেখক বই লিখবেন। আবার সেই বই প্রচারও করবেন। এমনটি হতে পারে না। বই যত ভালো কি মন্দ, সেটা পাঠকের কাছে তুলে ধরতে হবে। কেবল প্রচারের কারণে অনেক মানহীন বই পাঠকের কাছে যায়। আর মূল্যবান বইটি আড়ালে পড়ে যায়। কেবল বইমেলা এলে প্রকাশকদের সরব হতে দেখা যায়। বাকী ১১মাস অধিকাংশ প্রকাশক নীরব থাকেন। আমি মনেকরি, কেবল বইমেলা কিংবা শহর নয়, বইকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। বছরব্যাপী উদ্যোগ নিতে হবে।

বই বিক্রির ক্ষেত্রে আমাদের মুষ্টিমেয় কিছু প্রকাশক প্রচারণা চালান। অধিকাংশ প্রকাশক বইয়ের প্রচারে নির্বিকার থাকেন। তারা লেখকের দিকে চেয়ে থাকেন।

এবং বই : আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

ফারুক সুমন : আপনাকেও ধন্যবাদ। এবং বই এর জন্য অফুরান ভালোবাসা। শুভকামনা। বইয়ের সৌরভ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক।

আরও সাক্ষাৎকার পড়ুন…

“অজন্তার গুহা ঘুরে ঘুরে যা দেখেছি তা সহজ ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ‘অজানা অজন্তা’ বইয়ে”

“প্রেমের গল্পগুলোতে রয়েছে বর্তমান সময়ের ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের প্রতিফলন”