জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ নামক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে ক’জন রাজনীতিকের ভূমিকা অগ্রগণ্য ও সর্বজনবিদিত তাঁদের একজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের অন্যতম জাতীয় নেতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে যে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল– সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন সে সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করে রাখায় তখন তিনিই ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রী পরিষদে তিনি শিল্পমন্ত্রী হন। ১৯৭৫ সালে তিনি পুনরায় হন উপ-রাষ্ট্রপতি। এছাড়াও দুই-দুইবার আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা ছিলেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের বীর দামপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া রাজনীতির সিংহপুরুষ সৈয়দ নজরুল ইসলামের রাজনীতি চর্চা শুরু হয়েছিল ছাত্র-রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাশ করার পর পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগের অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চাকরিতে থিতু হননি। কিছুদিন পর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। অল্পদিনের ব্যবধানে ওই চাকরিতেও ইস্তফা দেন তিনি। পরে রাজনীতির টানে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে বেছে নেন আইনজীবির পেশা। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে রাজনীতিই হয়ে উঠেছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি, মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক, ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সর্বশেষ বাকশালের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা-আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয় নেতা। এক কথায় দেশ বিভাগের প্রাক্কাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জাতির প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামে অপরিসীম মেধা, দুরদর্শিতা ও ত্যাগের সমুজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাওয়া এক বীর পুরুষ তিনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ গঠনেও অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা ছিল তার। আদর্শ, সততা, সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বরাবরই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেইমান-বিপথগামীরা সুপরিকল্পিতভাবে স্বাধীন বাংলার স্রষ্ট্রা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। আর এর কিছুদিন পর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর তিন প্রিয় সহযোগী এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও নির্মমভাবে হত্যা করে– যে হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে ‘জেলহত্যা’ নামে উল্লিখিত।
আরও পড়ুন – ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে “বাংলার মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী”
বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রনায়ক সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনালেখ্য নিয়ে তরুণ সাংবাদিক ও লেখক ফয়সাল আহমেদ রচনা করেছেন এক দুর্লভ গ্রন্থ– যার নাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম : মহাজীবনের প্রতিকৃতি। অতি সম্প্রতি (অক্টোবর মাসে) দ্যু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। কিরিটি রঞ্জন বিশ্বাসের আঁকা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছবি অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ১৬৮ পৃষ্ঠায় মূদ্রিত বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বেগম নজরুলকে।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। তাই তার জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি দেয়ার আগে লেখক ‘মহাজীবনের যাত্রা’ উপ-শিরোনামে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসিত সমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চমৎকার বর্ণনা দিয়ে শুরু করেছেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে ২৯টি পর্বে বর্ণনা করেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম-পরিচয়, শৈশব, শিক্ষাজীবন, পারিবারিক জীবন, প্রেরণাদাত্রী হিসেবে তার স্ত্রী সৈয়দ নাসিফা ইসলামের ভূমিকা, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ক্রীড়া অনুরাগী ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা পর্যায়ের সম্পৃক্ততা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্টতা ও সহচর হিসেবে অবদান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকার গঠন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নানা দায়িত্বপালন, বিভিন্ন সময়ে দেয়া সাক্ষাৎকার, ঐতিহাসিক ভাষণ ও বাণী, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচারের প্রসঙ্গ, ৭৩’এর নির্বাচন ও বাকশাল গঠন, জেল হত্যা ও জেল হত্যা মামলা, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তি, দিনপঞ্জি, চিঠিপত্র প্রভৃতি।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনপঞ্জির ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও বইটি মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক অনন্য দলিল। বিশেষ করে ’৭১ এর ১৭ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ডক্যুমেন্ট (তথ্য-প্রমাণ) তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক রিপোর্টেরও বিস্তারিত বিবরণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের লেখা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠিরও বর্ণনা স্থান পেয়েছে বইটিতে। এসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে লেখক বেশ পরিশ্রম স্বীকার করেছেন– বইটি পড়লেই তা অনুমান যায়। তাই বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ এ বইটি পাঠের পর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের সামনে অনেক অজানা বিষয় এবং তথ্য-প্রমাণের সন্ধান দেবে ফয়সাল আহমেদের এ বইটি।