• রাহাত রাব্বানী
কবি শামসুর রাহমানের মতো আমিও মৃত্যু পক্ষের কেউ না। প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে ভাবায়, কাতর করে। বিশেষ করে যাদের আমরা পেয়েছিলাম আমাদের জীবন রাঙানোর নায়ক হিসেবে। অস্থির হয়ে উঠে মন। নিজের সাথে চলতে থাকে নিজের সংগ্রাম
সমরেশ মজুমদার এর মৃত্যুসংবাদও তাই। বাঙালিকে আনন্দ-বেদনার কাব্যে ভাসিয়ে কবিগুরুর জন্মদিনে; কি সহজ, কি নিঃশব্দে তিনি চলে গেলেন, হায়! আর তাঁকে নিয়ে লেখার দায় এসে চাপলো আমার কাঁধে, কিন্তু কী লিখবো আমি?
মধ্যকৈশরেই বই পড়ার এক তীব্র নেশায় আক্রান্ত হই। কলেজ কিংবা বিশ্বসাহিত্যের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে একের পর এক পড়তে থাকি হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন হাতে আসে সমরেশ মজুমদার। ততদিনে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছি। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষে বুঁদ হয়ে থাকা আমাকে আচ্ছন্ন করে অনিমেষ। লাইব্রেরিতে বই পড়ার ফাঁকে তীর্যক দৃষ্টিতে কত করে যে একজন মাধবীলতাকে খুঁজেছি! অনিমেষ হবার প্রবল ইচ্ছা কিংবা মাধবীলতার মতোন প্রেমিকা— এ দুইই বোধকরি আমার বহু আগে থেকেই চেয়ে আসছেন সুন্দরপ্রিয় সকলেই, চাচ্ছেন আজও। কল্পনা ছাপিয়ে বাস্তবেও এর অস্তিত্ব জেনেছি সমরেশ মজুমদারের মুখেই, তাঁর সাথে এক ঘরোয়া আড্ডায়। ঢাকায় একবার এক সাংবাদিক দম্পতি দেখা করলেন তার সাথে এবং নিজেদের পরিচয় দিলেন অনিমেষ- মাধবীলতা নামে। প্রথমে রসিকতা মনে করলেও পরে আর ভুল করেননি সমরেশ মজুমদার। সাংবাদিক দম্পতি তাদের পরিচয়পত্র দেখালেন। যেখানে ছেলেটির নাম অনিমেষ এবং মেয়েটির নাম লেখা মাধবীলতা।
শরৎচন্দ্রের পর সম্ভবত সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ই বাংলার নারীদের সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস। দুই বাংলায় এমন নারী আমি খুব কম দেখেছি, যিনি ‘সাতকাহন’ পড়েন নি কিংবা দীপাবলিকে চেনেন না। ‘সাতকাহন’র দীপাবলি চরিত্রের কথাও জেনেছিলাম লেখকের মুখেই। বলছিলেন, আমার বাড়ির পাশে ১২ বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন সকালে সে আমার হাত ধরে বলেছিল, কাকু, আমাকে বাঁচাও। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন মেয়েটির বিয়ে ঠেকাতে পারিনি। তবে বিয়ের আটদিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, কাকু, আমি বেঁচে গেলাম। এখান থেকেই দীপাবলি চরিত্রটি তৈরি হয়।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার। সেই উপন্যাস আরম্ভ করেছেন কি-না জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। বেশসময় নিয়ে কথা বলছিলেন এ নিয়ে। জানিয়েছিলেন তাঁর প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। এবং একইসাথে উঠে এসেছিলো হুমায়ূন আহমেদের প্রতি তার মুগ্ধতার কথা। তার বলা কথাগুলো স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি করছি, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা উপন্যাসটা হুমায়ূন লিখতে পারতো। আমি হুমায়ূনকে বারবার বলতাম এ নিয়ে লিখতে। কিন্তু বড় পরিসরে লিখতো না। বলতো, ‘দাদা, আপনি লিখেন। আমি ভয় পাই।’ হুমায়ূন আসলে কিসের ভয় পেত তা কখনও বলেনি। আমি বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে যত বড় লেখাই লিখি হুমায়ূনের মতো আবেগ দিয়ে লিখতে পারবো না।”এখানেই হুমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গ শেষ হতে পারতো। কিন্তু তিনি করলেন না। তিনি টেনে আনলেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার আড্ডার দিনগুলো। এবং মোটাদাগে বললেন আমরা লেখকরা সাধারণত বলি, আমরা সবার জন্য লিখি কিন্তু হুমায়ূন তা বলতেন না। তিনি তার পাঠকদের বয়সের একটা সীমা টেনে দিয়েছিলেন, তার পাঠক হবে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী। হুমায়ূন আহমেদ একদিন নাকি বলেছেন, “সমরেশদা, যে বাঙালি ১৬ বছর বয়সে পা দিয়েও হুমায়ূন পড়েনি, সে পাঠকই না। আর যে ২৪–এরপর হুমায়ূন পড়ে, সে নির্বোধ। পাঠক নয়।’’ হুমায়ূন এই কথা বলার পর আমি সেটা লিখে নিয়েছিলাম।
সমরেশ মজুমদার এর সাথে থাকা এইসব স্মৃতি আমি বহন করে যাবো আমৃত্যু। একটি মানুষকে নিঃশর্তে ভালোবেসে সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারা মাধবীলতাদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি বেঁচে থাকবেন ‘আমি জেনেছি তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ নই’ বা ‘তোমায় ভাল না বাসলে আমি মরে যেতাম’ বলতে পারা সাধারণ এক প্রেমিকের আকুতিতে। তাঁকে বিদায় বলা অতোটা সহজ?