অতনু রায় এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

চেক-মেট

দূরত্ব কমে এলে ছায়ারা দীর্ঘ হয়
কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপমাত্রা বাড়ায়
সব ঘর ঘিরে ফেলে বিপক্ষ
রাজাও বিপন্ন বোধ করে।

ভেঙে যায় জটিল ব্যুহ
বিষন্নতা হেঁটে আসে
সেরিটোনিনের মাত্রা কমে।

দীর্ঘতম ছায়ার নিচে
আশ্রয় নিতে নিতেই

চেক-মেট হয়ে যায় …
……

অবক্ষয়

এভাবেই অবক্ষয় নেমে আসে
স্বার্থপর হতে হতে ক্রমশ
আমি একা হয়ে যায় …

চেঁচিয়ে বলি – হাত বাড়াও …

কে বাড়াবে হাত !

ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে
বাড়িয়ে দেয় বরফ হাত…

স্পর্শে কেঁপে ওঠে সুষুম্না
আমি চিনতে পারি…

মিশে যেতে যেতে বুঝি
অবক্ষয়ই এখন থার্ড আম্পায়ার…
……

অরিগ্যামি

তোমার কাছে কিছুই নেবো না আর
হটস্পটও না
ধূলো ঝেড়ে পুরোনো কী-বোর্ডে
অক্ষর সাজাবো
ওয়াই-ফাই ছেড়ে ফিরে যাবো
ডেটা কেবেলের কাছে …

এই হাইপার গ্লোবালাইজেশন
তোমার ছোঁয়াচে রোগ
আমি তো সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে
খুঁটে খুঁটে তুলে আনি হারানো অরিগ্যামি …
……

আরও পড়ুন – অতনু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

মোক্ষ

মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে
মনে হয় মুছে ফেলি সব পরিচয়
তারপর নোঙর ফেলা হলে বুঝি
মোছা কি এতই সহজ!

সহজ সস্তা যতটুকু জীবন আমার
অন্ধকার থেকে সেঁচে আনি যেটুকু আলো
তাই দিয়ে ছলাৎ সময় মেপে নেয়
প্রতিটি নকল আস্ফালন

কোথায় লুকাবো আমি
মুছে দেবো কতটা অন্ধকার
রাত শেষে হামাগুড়ি পায়ে
আলো তো ফিরবেই বারবার

তবু যদি মুছে ফেলি আলো
অন্ধকার কলঙ্ক বিহীন
পরিচয় মিথ্যের মতো
নাগালের মধ্যেই চেনাচিনিহীন

তারপর নোঙর পড়ে
আমিও ফিরে আসি ঘরে
সব আলো চাপা গেলে বুঝি
মুছে ফেলা সোজা নয় মোটে।
……

বহমান ঐতিহ্য

কৈশোর থেকে যৌবনের দিকে
ছুটে চলার সময় তোমাকেই ভালোবেসেছি…

আড্ডা ভেঙ্গে গেলে
প্রেমিকার পাড়ার রাস্তায় দশ চক্কর,
সঙ্গে নিয়েছি তোমাকেই।

তোমার সাথে এতোদিনের সহবাস
আজ ক্লান্ত হয়ে গেছে
পুরনো দাম্পত্যের মতো…

আমার বড় হওয়া থেকে বুড়ো হওয়ার
অন্যতম সাক্ষী হয়েও,
আজ তুমি উপেক্ষিত…

কতোবার ভেবেছি বিক্রি করে দেবো,পারিনি …

তুমি গ্যারেজের এককোনে
অভিমান মেখে আজও দাঁড়িয়ে আছো
আমার দাদুর ভাঙা সাইকেলের ঠিক পাশেই…
……

কবিতা ভাবনা

আমার বর্ষার কবিতা ভাবনা

বর্ষা ঋতু শিল্পীমনের খুব বড়ো প্ল্যাটফর্ম। কতো কবিতা, গান এই বর্ষাকে নিয়ে। এখন যদিও বর্ষাযাপনে ভরসা বলতে ব্যালকনি অথবা জানালা থেকে বৃষ্টি দেখা। আরও একটি উপায় অবশ্যই আছে, যদিও তাতে বৃষ্টির ছাঁট মাখার সুযোগ নেই। সেটি হলো সোশ্যাল মিডিয়ার বর্ষাযাপন। যদিও সেখানে মুক্তি নেই। মুক্তির জন্য ছটফট করতে করতে কবিতার কাছে, গানের কাছে নতজানু হয়ে বসি।খুঁজে পাই কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দর সেই আশ্চর্য চরণ- ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূ্বশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ’। সংস্কৃত এই শ্লোকে বর্ষার চিরচেনা ছবি, মেঘে ঢাকা কোমল আকাশ আর শ্যামশোভাময় বন তমালের কী লাবণ্যভরা রূপ! কতকাল আগে কেটে গেছে জয়দেবের কাল- আজও সেই নির্জন বর্ষার ছবিটা তেমনি জীবন্ত! বহুবছরের ওপার থেকে আজও বয়ে আনে – সে যুগের সেই মেঘমেদুর দিন- বর্ষাস্নাত তরুরাজির পেলবতা। আজকের ঘন মেঘে ঢাকা দিনটি গিয়ে মেশে সেই বহুকাল আগের বর্ষার দিনটির সাথে। বর্তমান আর অতীত মিলে মিশে একাকার হয়ে বন্দী জীবনে টাটকা বাতাস বয়ে আনে।

বুঝতে পারি কবিরাই বুঝি পারেন এমন অসাধ্য সাধন! নিবিড় মেঘ আর সজল হাওয়ায় মনে পড়ে মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত।চোখের সামনে ভেসে ওঠে পূর্বমেঘের দৃশ্যপট। রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষ। যক্ষের বিরহী প্রাণের বার্তা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে সুদূর অলকায় ভেসে চলেছে আষাঢ়ের মেঘ। মেঘ চলেছে উত্তরের পথে … পথে বিন্ধ্যপর্বত … তার নীচে পাথর-নুড়ির পথ বেয়ে অজস্র ঝর্ণা এসে মিশেছে রেবা নদীতে … প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা দশার্ণ দেশ … ওপরে ছুটে চলেছে বর্ষার মেঘ- নীচে ছুটে চলেছে বুনো নদী বেত্রবতী … বেত্রবতীর কূলে ঐশ্বর্যময় বিদিশা …। নির্বিন্ধ্যা তটিনী পেরিয়ে অবন্তী নামের দেশ … শিপ্রা নদী তীরে উজ্জয়িনী …। মেঘদূত ভেসে চলেছে প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তরাপথ দিয়ে … অতুলনীয় নৈসর্গিক শোভা আর সমৃদ্ধ সব প্রাচীন নগরীর ওপর দিয়ে- রামগিরি থেকে দূর অলকায়।

কালিদাসের কালও কেটে গিয়েছে বহুদিন।জলভারানত আষাঢ়ের মেঘ আমাদের আজও নিয়ে যায় পূর্বমেঘের সেই পথে– রামগিরি থেকে হিমালয়ে- যে পথে রয়েছে মানস সরোবর- আশ্চর্য সব নদী- পর্বত- বনতল- সে সব নদীর তীরে তীরে বিদিশা- অবন্তী- উজ্জয়িনী …। বর্ষার গহন মেঘ একালের বৃক্ষবিরল ধূসর নগরীকেও সাজিয়ে দেয় সেকালের উজ্জয়িনীর সুষমায়!

আর আমি,মুক্তি খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে। উল্টে পাল্টে দেখি আমার যাবতীয় সঞ্চয়। পেয়ে যায় অবশেষে, আমার প্রাণের আরাম।

এক বর্ষামুখর দিনে- রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর প্রিয় আবাস শিলাইদহে। সেদিন লিখছিলেন ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধ। লেখার মাঝেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লিখলেন একটা।

আরও পড়ুন – সুদীপ দাস এর কবিতা‌ ও কবিতা ভাবনা

‘সমস্ত আকাশ অন্ধকার করে নিবিড় মেঘ জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হল- আমার নীচের ঘরের চারদিকের শার্সি বন্ধ করে বসে বসে মেঘদূতের উপর প্রবন্ধ লিখছি। প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম তাহলে কেমন হত! কি অনায়াসেই জল স্থল আকাশের উপর এই নির্জন মাঠের নিভৃত বর্ষার দিনটি। এই কাজকর্ম ছাড়া মেঘে ঢাকা আষাঢ়ের রৌদ্রহীন মধ্যাহ্নটুকু ঘনিয়ে এসেছে। অথচ আমার লেখার মধ্যে তার কোন চিহ্নই রাখতে পারলুম না। কেউ জানতে পারবে না কোনদিন কোথায় বসে বসে সুদীর্ঘ অবসরের বেলায় – লোকশূন্য বাড়ীতে এই কথাগুলো আমি আপন মনে গাঁথছিলুম।’

এখনো ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ যখন আসে – স্বাগত জানাই তাঁর গান গেয়ে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ তিনিই উপহার দেন আমাদের! ভেজা কদম কেতকীর সুবাসের সাথে স্মৃতিবেদনাও আসে। আমাদের ‘যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’ সেইসব দিনের ছায়াও পড়ে শ্রাবণ আকাশে। তাই, গহন মেঘে আকাশ ঢেকে ‘মধু গন্ধে ভরা- মৃদু স্নিগ্ধছায়া- নীপ কুঞ্জতলে’ যে বর্ষা আসে- তার অন্যতম অনুষঙ্গ –রবীন্দ্রনাথ।

জলদ তালে ‘অম্বরে মেঘ মৃদঙ্গ বাজতে’ শুনেছিলেন নজরুলও। আশ্চর্য মরমী সুরে শুনিয়েছেন আমাদের ‘শাওন রাতে’ স্মরণে আসা বিরহীর মর্মবেদনা। ঝরো ঝরো বাদল দিনে ‘কদম তমাল বনে’ ঝুলনা বাঁধা অন্য এক জগতের দরজা খুলে যায় নজরুলের সুরের জাদুতে। ‘পরবাসী মেঘের’ সাথে সাথে তাই তিনিও সঙ্গী আমাদের।

হাজার বছর ধরে কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরও বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘ-বৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারিত করে– ভাষার সাধ্য কি পৌঁছয় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রঙ রূপ গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্তকাল ধরে।আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের লেখায়- মেঘমল্লারে বেঁধেছেন স্নিগ্ধ বর্ষাবন্দনা। আর এইসবের মাঝেই আমি খুঁজে পাই আমার মুক্তি । বর্ষার চিরকালীন সৃষ্টি এইসব কবিতা, গান আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে।

কবি পরিচিতি: অতনু রায় এর জন্ম ১৯৮৬ সালে, অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের জামুরিয়া থানার বীজপুর গ্রামে। বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে বসবাস। পেশায় শিক্ষক আর নেশায় বাংলা ভাষার একজন স্বেচ্ছাসেবক। লেখালিখির চর্চা ছাত্রজীবন থেকেই। ইতিমধ্যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং সংকলন গ্রন্থে লিখেছেন। পছন্দের লেখার জায়গা কবিতা, অণুগল্প,গল্প এবং প্রবন্ধ। একটি মাত্র প্রকাশিত দুই লাইনের কবিতার বই – ‘ক্লান্ত-Couplet’ (২০২০)। সম্পাদিত কবিতার বই ‘অণুকবিতার অ্যানাটমি’ (২০২১)। সম্পাদনা করেন বই আলোচনা বিষয়ক পত্রিকা ‘বই-বারান্দা’।