মহিদুননেসা খাতুন : অপরাজেয় আগুনপাখি

বাংলাদেশের কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাস সমসাময়িককালে দেশভাগ বিষয়ে রচিত বাংলা সাহিত্যের একটি সেরা দলিল। ২০০৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটি এপার বাংলায় প্রথম আলো বর্ষসেরা বই এবং ওপার বাংলার মর্যাদাবান আনন্দ পুরষ্কার লাভ করে।

বইটিতে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের এক নারী নিজ জবানীতে তাঁর জীবন-আখ্যান বর্ণনা করেছেন। এই আত্মবয়ানের পুরোটাই স্থানীয় ভাষায় ধারণ করায় বইটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এক স্বচ্ছল কৃষিজীবী মুসলিম পরিবারে সেই নারীর বিবাহ, সন্তান ধারণ ও লালনপালন এবং সেখানকার নিরুপদ্রব শান্ত জীবনের পটভূমিকায় তাঁর স্নেহ-সুধা ও বাৎসল্যরসে জারিত মনোজগত কীভাবে ধীরে ধীরে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চলমান বিভাজন নীতির কালো মেঘ গ্রাস করেছিল তার অসাধারণ ছবি ফুটে উঠেছে ক্ষুদ্রায়তন এই উপন্যাসে।

বইটিতে দেখানো হয়েছে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশভাগের পর যখন পুত্র, কন্যা এবং এমনকি নিজ স্বামীও তাঁকে ফেলে নতুন দেশ পাকিস্তানে পাড়ি জমায় তখনও তিনি শেকড় ছেড়ে যেতে রাজি নন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও হিন্দু-মুসলিমের রক্তাক্ত দাঙ্গার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সেদিন কেবল ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা (ও পাঞ্জাব) যেভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজ নিজ শেকড় থেকে উপড়ে ফেলেছিল ইতিহাসের সেই অমোচনীয় ক্ষত আজো শুকোয়নি-আজো গড়িয়ে যাচ্ছে যেন সেই রক্তের ধারা। লেখকরা আজো লিখছেন, চলচ্চিত্রকাররা সেলুলয়েডে তুলে আনছেন ছবি আর ইতিহাস গবেষকরা আজো খুঁজে ফিরছেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত সেই রাজনৈতিক ট্র্যাজিডির উত্তর।

বলা বাহুল্য হাসান আজিজুল হক নিজেও ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে আগত বাস্তুচ্যুত দেশত্যাগী। শুধু হাসান আজিজুল হক একা নন, দেশভাগজনিত কারণে আমাদের কৃতি কবি-সাহিত্যিক শিল্পীদের একটি বড় অংশ নিজ পিতৃভূমি থেকে শেকড়চ্যুত হয়ে এদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) থিতু হয়েছেন। এঁদের মধ্যে শওকত ওসমান, বদরুদ্দিন ওমর, শওকত আলী, কবি শহীদ কাদরী, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন, চিত্রনায়ক রাজ্জাক, সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম, আবদুল আহাদ ও বিচারপতি মুহম্মদ হাবীবুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য।

এঁদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস, আত্মজৈবনিক রচনায় ও বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে সেই দু:সহ স্মৃতি ও নীড়ে ফেরার আকুতি শৈল্পিক রূপ পেয়েছে। আবার এই স্মৃতির মর্মদাহ এবং দেশভাগজনিত অভিঘাত প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ধরা দিয়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে যাঁরা ওপার বাংলায় পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড ও সমাজ গবেষণায়। এদের মধ্যে যেমন আছেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদারের মত বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার, সুচিত্রা সেন ও উৎপল দত্তের মত দাপুটে অভিনেতা, মানবেন্দ্র মুখার্জী, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন ও নচিকেতার মত শ্রোতানন্দিত সংগীতশিল্পী, সমরেশ বসু, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল, শীর্ষেন্দু, অতীন, গৌরকিশোর ঘোষ, অমিয়ভূষণ মজুমদারের মত বিখ্যাত লেখক এবং ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ ও তপন রায় চৌধুরীর মত নামজাদা ঐতিহাসিক ও সমাজ গবেষক।

খুব বেশি দৃষ্টান্ত দেবার দরকার নেই। সমরেশ বসুর গল্পসমগ্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বারো ঘর এক উঠোন’, অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখীর খোঁজে’, কিংবা সুনীলের ‘পূর্ব পশ্চিম’ পাঠ করলে অথবা ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ‘কোমলগান্ধার’ ছবি দেখলে বোঝা যায় উনিশশো সাতচল্লিশের দেশভাগের সেই বেদনা ও ক্ষতি ব্যক্তি ও সমাজমানসের কতোটা গভীরে প্রভাব ফেলেছিল!

তথাপি বলতে হয়, ইতিহাসের সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি নীরবে বহন করে চলেছেন দুই বাংলার উন্মুল আরো যে লক্ষ লক্ষ মানুষ, তাদের কথা আজো রয়ে গেছে অনেকখানি অব্যক্ত কিংবা আমাদের শোনার বাকি। দেশভাগের ঘটনায় তাঁদের সম্পৃক্ততা না থাকলেও নিজের শেকড়ের বিনিময়ে তাঁরা তিলে তিলে এর দায় শোধ করছেন। এটা দু:খজনক যে, কথ্য ইতিহাস গ্রন্থনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দেশভাগের স্মৃতি ও বেদনাবহ জীবনাভিজ্ঞতার বিবরণী ধরে রাখার প্রয়াস পশ্চিমবঙ্গে এখনো চলমান থাকলেও বাংলাদেশে এর ছিটেফোঁটাও নেই। এ-ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে কেবল কয়েকটি আত্মজৈবনিক রচনাই আমাদের সম্বল, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোন উদ্যোগ কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা চোখে পড়ে না।

সম্প্রতি সমাজবিদ্যার গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী সুরাইয়া বেগম নিতান্ত ব্যক্তিগত আবেগ ও বিবেকবোধের তাড়নায় তাঁর শতবর্ষী জননী মহিদুননেছা খাতুনের দেশভাগের স্মৃতি গ্রন্থভূক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বইটির নাম- ‘খন্ডিত উঠোন: অখন্ড স্মৃতি / দেশভাগ ও আমার মা মহিদুননেছা খাতুন’। লেখকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বইটি ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। নিজ কন্যার কাছে এক জননী তাঁর অবসরের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতি নিংড়ে বলে গেছেন তাঁর জীবন কাহিনী-এই বইটি তারই গ্রন্থিত রূপ।

বইটির ফ্ল্যাপে সুরাইয়া বেগম জানিয়েছেন, “এই বইতে দেশভাগের প্রভাব আমি দেখেছি আমার মায়ের জীবনের প্রেক্ষিতে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত একজন সাধারণ গৃহবধূর দেশভাগ পূর্ববতী গতানুগতিক জীবনে দেশভাগ নিয়ে আসে অস্থিরতা, সঙ্কট, দোলাচল এবং অনিশ্চয়তা। যার পরতে পরতে রয়েছে হাহাকার আর নীরব আর্তনাদ। দেশভাগ পরবর্তী জীবনে রয়েছে দারিদ্র, সংগ্রাম এবং টানাপোড়েন। রয়েছে উন্নতির সোপান থেকে শূন্যতে ছিটকে পড়া এবং নতুন করে ওপরে উঠার সোপান রচনা। এক জীবনে সবাই তা পেরে উঠে না, স্বপ্নভঙ্গ জীবনকে নি:শেষ করে দেয়। ব্যক্তিজীবনে দেশভাগের প্রভাব প্রথম যৌবনে একরকম মাত্রা বয়ে আনে, শেষ জীবনে তার দ্যোতনা ভিন্ন। যখন কী না মন আকুল হয় নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে, কিন্তু কোন সম্ভাবনা থাকে না, থাকে শুধু কষ্ট আর স্মৃতির সম্ভার।”

কেবল মায়ের সংগ্রাম ও স্মৃতি-জর্জর জীবন উপাখ্যান রচনাই নয়, বইটি রচনার নেপথ্যে সমাজ-গবেষক সুরাইয়া বেগমের অন্বিষ্ট আরো সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূণ। বইটি লেখার যুক্তি হিসেবে সুরাইয়া বেগম এর ভূমিকায় আরো যা লিখেছেন, তা উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি লিখেছেন,

“দেশভাগ উপমহাদেশের সমাজ জীবনে বহুমাত্রিক প্রভাব রেখে গেছে, কিন্তু নারীর জীবনে তার প্রভাব গভীর এবং জটিল। এই জটিলতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। যা ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বিশেষ করে সাধারণ নারীর জীবনে যে প্রভাব রেখে গেছে তার অনেকটাই অব্যক্ত। দেশভাগের শিকার নারীর বেদনা, ত্যাগ এবং সংগ্রাম জীবনব্যাপী বহমান। এর কারণে নারীর জীবন বদলে যায়, অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়াতে হয়। ….সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশের উপর দেশভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রকট। এসব দিক যদিওবা সময়ের সাথে সাথে সমাধান করা যায়, কিন্তু মননে যে প্রভাব রাখে তা গভীর এবং চিরস্থায়ী।” (পৃষ্ঠা-১৪)

২. মহিদুননেছা খাতুনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত থানার দাদপুর গ্রামে ‘আনুমানিক’ ১৯২৩ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন উক্ত এলাকার সম্ভ্রান্ত, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুনশী আবদুল আজিজ, যিনি জীবদ্দশায় ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাইশ গ্রামের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মহিদুননেছা তাঁর বাড়ির পাশে পিতার প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৯ সালে ১৬ বছর বয়সে মহিদুননেছার বিয়ে হয় পাশের গ্রামের কৃষক আহাদ বখশ-এর ছেলে মোসলেম আলী মন্ডলের সাথে। মোসলেম ১৯৩৮ সালে মেট্রিক পাশ করে তখন কলেজে পড়ছেন এবং কলকাতায় চাকুরির চেষ্টা করছিলেন। পরবর্তীতে শ্বশুরকুলের প্রভাবশালী আত্মীয়দের চেষ্টায় তিনি সরকারি চাকুরি লাভ করেন এবং দেশভাগের আগ পযর্ন্ত তিনি কলকাতায় ডাক ও তার অফিসে চাকুরিরত ছিলেন।

সম্ভান্ত পরিবারে বিয়ে ও সরকারী চাকুরী লাভের পর মোসলেম আলী তাঁর উদ্যমী ও পরিশ্রমী কৃষক পিতার সহায়তায় পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং অচিরেই ধানী জমি, ফলের বাগান ও পুকুরসহ স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনেন। মহিদুননেছা তখন তিন সন্তানের জননী। ইতোমধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষিত হলে অখন্ড বাংলাদেশ টুকরো টুকরো হয় এবং সামাজিক জীবনে এক নয়া পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বাংলার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দারুণভাবে জখম হয়, সৃষ্টি হয় সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু হওয়ার আশংকা ও নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ১৯৪৭-১৯৬৪ পর্যন্ত প্রায় ধারাবাহিকভাবে পূর্ববঙ্গ থেকে যেমন হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ পশ্চিম বংগে চলে যায়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীরও একটা বড় অংশ পূর্ববঙ্গে/তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয় (এদের একটা অংশ আবার বিহার থেকে আগত)। একথাও ঠিক যে, শুধু সংখ্যালঘু হওয়ার আশংকা কিংবা নিপীড়িত হওয়ার আতঙ্কে নয়, অনেকে আবার নতুন দেশে নতুন পরিস্থিতিতে নিজ জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার স্বপ্নে জন্মভিটা ত্যাগ করেছিলেন। চাকুরী-ব্যবসা-কৃষিসহ একটি নতুন দেশ জন্মভিটা ত্যাগীদের সামনে সেদিন নতুন আশা ও অপার সম্ভাবনা জাগিয়েছিলো। মহিদুননেছার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পিতা জামাই মোসলেম আলীকে বলেছিলেন, “বিদেশ যাও, নয়ত ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে না।”

বিদেশ বলতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়েছিলেন। ওদিকে মহিদুনননেছার শ্বশুর আহাদ আলী বখশ চেয়েছিলেন-সবে মাত্র স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে তাঁর পরিবার, ছেলে পরিবার পরিজন নিয়ে এখানেই থাকুক! তিনি নিজেও তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে আমৃত্যু নিজ বসতভিটায় থেকে গেলেন। কিন্তু মোসলেম আলী মন্ডল শ্বশুরের পরামর্শ শিরোধার্য করে ১৯৪৯ সালে সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান। মাণিক ব্যাণার্জীর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মিয়া সৃষ্ট ময়নাদ্বীপ যেমন মাঝি কুবেরের কাছে একটা স্বপ্নের ঠিকানা, সেদিন পূর্ব পাকিস্তানও তেমনি মুনশী আবদুল আজিজ অথবা তাঁর জামাই মোসলেম আলীর কাছে একটা নতুন দ্বীপের হাতছানি। কিন্তু তখনও কি জানা ছিলো সেই স্বপ্নকে পেতে হলে কত তার দাম দিতে হবে?

১৯৪৯ সালে মোসলেম আলী মন্ডল টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগের চাকুরী নিয়ে সপরিবারে ঢাকার দয়াগঞ্জে একটি বস্তিসদৃশ টালির ঘরে এসে উঠেন, সেখানে বিদ্যুতের আলো নেই, ব্যবহারের জন্য খাট্টা পায়খানা। মহিদুননেছার তিন ছেলেমেয়ে তখন কোলে ও কাঁখে। এভাবেই শুরু হয়েছিলো স্বপ্ন দেখার জীবন। মহিদুননেছা পরবর্তীকালে তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছে স্মৃতিচারণায় আক্ষেপ করে বলেছেন, “দেশভাগের কারণে জমিতে সোনার মত পাকা ধান ফেলে রেখে এসে ঢাকায় রেশনের কাঁকরভরা চাল খেতে হয়েছে। এ যে কী যাতনার!”

পেশাগত উন্নতির জন্য স্বামী মোসলেম আলী নাইট শিফটে পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রী নিলেন, পরবর্তীকালে চাকুরীর পাশাপাশি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়ে চলে এলেন মতিঝিলে কলোনীতে। ততদিনে সংসার বড় হতে শুরু করেছে। মতিঝিলের কোয়ার্টারে চাকরিতে অবসরে যাবার আগেই মোসলেম আলী মন্ডল মারা যান ১৯৬৪ সালের ১৯ অক্টোবর। মাত্র ২৫ বছরের বিবাহিত জীবন, এই সংক্ষিপ্ত দাম্পত্য জীবনে মহিদুননেছার কোল জুড়ে আসে ১০টি সন্তান। স্বামীর মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর এবার সংসারের জোয়াল ১৫ বছর বয়সী বড় ছেলে মোহাম্মদ মুসার কচি কাঁধে তুলে দিতে হয়। তখনও মুসা মেট্রিক পাশ করেন নি। ঐ অবস্থায় পিতার সহকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতা ও সুপারিশে পিতার কর্মস্থলে অস্থায়ীভাবে ছোটখাটো একটি চাকরির ব্যবস্থা হয়, কলোনীর বাসাটিও তাঁর নামে পুন:বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিশাল সংসারের হাল ধরে রাখার জন্য মায়ের সাথে জীবন যুদ্ধে মুসা তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। চাকুরীর পাশাপাশি নাইটে পড়াশোনা চালিয়ে যান, বাড়তি রোজগারের জন্য সাংবাদিকতা ও ধারাভাষ্যকার হিসাবে খন্ডকালীন কাজ জুটিয়ে নেন। সেই সংসার যখন একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে ২০১৩ সালে হার্ট এটাকে ছেলের মৃত্যু হলো মহিদুননছো যেন আরেক শোকসাগরে নিক্ষিপ্ত হন।

এর আগে অপুষ্টির শিকার হয়ে তাঁর সর্বশেষ সন্তান কিশোর মামুনের মৃত্যু হয়েছিলো ১৯৭১ সালে। আরেক মেয়ে রাজিয়া খাতুনের মৃত্যু হয় শিশুকালে। ক্যানসারের শিকার হয়ে পরপর ২০১৪ ও ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করে পরিবারের দুই সুসন্তান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপিকা রাবেয়া মঈন ও সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা রোকেয়া রায়হান। মহিদুননেছার ১০ সন্তানের মধ্যে ৫ সন্তান এখন জীবিত। ১৯৭৯ সালে মতিঝিলের কলোনী ছেড়ে গোটা পরিবার মীরপুরে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এই বাড়িতেই ২০২৩ সালের ২২ এপ্রিল নিজের জীবনের শতবর্ষ পূর্ণ করে সর্বংসহা নারী মহিদুননেছা খাতুন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর আগে ছেলেমেয়েদের এক পারিবারিক সমাবেশে তিনি বলছিলেন, “কত জমজমাট সংসার ছিল আমার যখন সবাই বেঁচে ছিল। প্রথমবার আমার ঘর অন্ধকার হয়ে গেল ১৯৬৪ সালে। ১৯৭১ সালে চলে গেল মামুন। দুই ভাই হাফিজ আর আলিম চলে গেল,বাপের বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। মুসা, রাবেয়া, রোকেয়া চলে গেল। আমার বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। কী বাজার তৈরি করেছিলাম! আহ! সব এখন অন্ধকার !”(পৃষ্ঠা-১৪৮)

৩. এবার হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’র সেই নারীর কাছে ফেরা যাক। উপন্যাসের শেষ পর্বে দেখা যায় দেশভাগের পর তাঁর কন্যারা ভাগ্যান্বেষণে স্বামী -সন্তানসহ পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন। পুত্র চলে গেছে আরো আগে। কন্যারা মাকে বুঝিয়েছেন অনেক, কিন্তু সেই বৃদ্ধা মা কিছুতেই রাজি হলেন না। দেশ ছেড়ে যাবার আগে স্বামী নানাভাবে, এমনকি ভয় দেখিয়েও তাঁকে সঙ্গে নিতে ব্যর্থ হলেন। বৃদ্ধা কিছুতেই নিজের শেকড় ছেড়ে দেশান্তরী হতে রাজী নন। অবশেষে গোটা পরিবার বসতভিটায় তাঁকে একা ফেলে রেখেই চলে যায়। সেই বিদায় বেলায় বৃদ্ধার আত্মকথনের মধ্য দিয়ে কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক বৃদ্ধার যুক্তি তুলে ধরেছেন এভাবে,

“সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝুইতে পারে নাই। পেথম কথা হচে, তোমাদের যে একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশ, একই রকম মানুষ, একই রকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদনি হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ, একটি তালগাছ উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ, একটি তালগাছ। তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐ খানটোয় আসমানতো দুরকম লয়। ….. আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ ” /আগুনপাখি, হাসান আজিজুল হক।

মহিদুননেছা খাতুন যেন রূপান্তরিত আরেক আগুনপাখি। শেকড় ছেড়ে আসতে গিয়ে তাঁকেও নিশ্চয়ই যুক্তির সাথে অনেক যুঝতে হয়েছে, মনকে প্রবোধ দিতে হয়েছে, হয়তো অধিকতর শিক্ষিত পরিবারে জন্মাবার সুবাদে তাঁর দেশত্যাগের যুক্তির মধ্যে সারবত্তা ছিল। প্রথম যৌবনের মহিদুননেছা হয়তো নতুন উৎসাহে নতুন ভূমিতে আপন সংসার রচনার স্বপ্ন দেখে স্বামীর সাথে শেকড় ত্যাগ করতে রাজি হয়েছিলেন পেছনের মোহ ফেলে। উভয়ের সে যাত্রায় ছিল তারুণ্যের উত্তেজনা, এক অনাস্বাদিত, অদেখা জীবনের হাতছানি। তাঁর সে-স্বপ্নের অনেকখানি পূরণও হয়েছিলো। জীবনসংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। জয়ী সে-জীবনের একটা সামাজিক প্রাপ্তিও ছিল। সমাজ-গবেষক সুরাইয়া বেগম তা চিহ্ণিত করেছেন এভাবে, “মা মহিদুননেছা প্রায় ১৫ বছর আগে একবার দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সামাজিক অবস্থার ব্যাপক কোন উন্নতি বা পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়ে নি। ঢাকা শহরের যে পরিবর্তন হয়েছে তার তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়। এমনকি বিত্তবান পরিবারেরও জীবনযাপনের যে মনোভঙ্গি, স্ট্যাটাস তা ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তদের সাথেও তুলনার নয়,কোথায় যেন একটা পার্থক্য আছে। মেট্রোপলিটান সিটি এবং একটি রাজ্যের অন্তর্গত গ্রামাঞ্চলের মধ্যেকার ফারাক যেমন হয় ।” (পৃষ্ঠা-১৫০)

কিন্তু যতই দিন গড়িয়ে গেছে ততই যেন শেকড়ে ফিরে যেতে উন্মুখ হয়েছেন মহিদুননেছা। এটা অনুধাবন করা কঠিন নয় যে, একদা তিনি যখন স্বামীর হাত ধরে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়িয়েছিলেন তখন তিনি ২৬ বছরের এক অপরিপক্ক তরুণী মাত্র- তখনো তাঁর ব্যক্তিত্ব অবিকশি। বিয়ের আগ পর্যন্ত একটি মসৃণ, নির্ভার জীবন বিয়ের পর থেকে নানা বাঁক বদলের মধ্য দিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে-অভিবাসিত জীবনের নানা পর্বের সংগ্রাম ও জয়-পরাজয় তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে-তাঁর ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটিয়েছে; তিনি হয়ে উঠেছেন এক পরিপূর্ণ নারী। আর তখুনি তিনি যেন মুখোমুখি হয়েছেন আর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে পেরেছেন ‘আগুনপাখি’র সেই নারীর দিকে, যে কিনা জন্মভিটার শেকড় আঁকড়ে ধরে বসে আছে (যেন অনাদিকাল থেকে!), একদা যে শেকড় ফেলে মহিদুননেছা অজানা গন্তব্যে পা বাড়িয়েছিলেন।

একথাও সত্যি যে সেই অজানা গন্তব্যে পৌঁছে তিনি নতুন বীজ বপন করেছিলেন, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বৃক্ষরাজি আর নতুন শেকড়-বাকড়। কিন্তু তাতে মূল শেকড় ছিঁড়ে-আসার ক্ষত শুকোয়নি, বরং মুলে ফিরে যাবার আকুতি তাঁর দিনে দিনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগেও অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্খায় তিনি কিশোরীর মত প্রগলভ হয়ে উঠেছেন। ছোট ছেলের বউকে বলছেন, “চল রূমপা, এই ইট-কাঠ পাথরের দেশে না থেকে গুনপুকুরে ফিরে যাই। ওখানে পুকুর থেকে মাছ ধরব, শাক-সবজী ফলাব, ধান চাষ করব আর আমবাগানে ঘুরে ঘুরে যেটা খুশি সেই আম পেড়ে খাব। বুক ভরে বাতাস নেবো আর দুচোখ ভরে আকাশ দেখবো।’ (পৃষ্ঠা-১৫০)

মহিদুননেছা জানেন এ কখনো হবার নয়, কিন্তু পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই উক্তি আরেক আগুনপাখির অন্তরের আকুতির প্রকাশ:দু’জন দুই উঠোনের বাসিন্দা বটে কিন্তু তাদের উৎস ও জন্মস্মৃতি অখন্ড। অথবা এ যেনো একই আগুনপাখী যার দুই ডানায় ভর করে আছে জন্ম-উৎসে ফিরে যাওয়ার আদিম আকুলতা। শেকড়ে বড় মায়া, তা মানবসৃষ্টির এক প্রাকৃত ও আদিম সত্য!

৪. এই বই কোনো সাহিত্যকর্ম নয়; বইটি আসলে মহিদুননেছা খাতুনের জীবনী। কখনো তাঁর আত্মবয়ানের মধ্য দিয়ে, কখনো তা কন্যা সুরাইয়া বেগমের শ্রুতিলিখন থেকে রচিত। অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় ১৫০ পৃষ্ঠার বইখানিকে পাঠের সুবিধার্থে (ভূমিকা ও তথ্যপঞ্জি বাদে) ১৫টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এতে জুড়ে দেওয়া মহিদুননেছার বংশলতিকা, তাঁর উত্তর-প্রজন্মের বিশদ বিবরণ, জীবনের বিভিন্ন পর্বে আত্মীয়-স্বজনের সাথে বৈষয়িক পত্রালাপ, পারিবারিক অ্যালবামের ছবি -ইত্যাদি থেকে হঠাৎ করে বইটিকে নিছক একটি পারিবারিক ইতিহাস বলে ভ্রম হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু বইটির বৈশিষ্ট্য হলো লেখক সুকৌশলে এই পারিবারিক কাহিনীকে উপমহাদেশের ইতিহাসের বড় ঘটনা ‘দেশভাগের’ প্রেক্ষিতে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। ফলে নিছক পারিবারিক ইতিহাসের গন্ডি ছাড়িয়ে মহিদুননেছার জীবন হয়ে উঠেছে দেশভাগের শিকার আরো অনেক নারীর জীবনসংগ্রামের প্রতীক।

বইটিতে জীবনকাহিনী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে চলমান সময়প্রবাহে সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের নানান তথ্য ও সত্য। এই প্রতীকী উপস্থাপনার আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো বইটিতে উত্তর প্রজন্মের এক নারী পূর্ব প্রজন্মের এক নারীর জীবনকে দেখছেন আপন দর্পণে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে এক মেয়ে দেখছেন তাঁর মাকে। ফলে সবকিছু ছাপিয়ে বইটিতে সঞ্চারিত হয়েছে গভীর এক মানবিক আবেগ, যা পাঠকের অন্তর স্পর্শ করে। মায়ের প্রতি ভালোবাসায় লেখক বইয়ের শেষে ‘আমার মা’ -শিরোনামে একটি কবিতাও জুড়ে দিয়েছেন।

সুরাইয়া বেগম নাতিদীর্ঘ বইটির উপসংহার টেনেছেন এভাবে:

“দেশভাগ মহিদুননেছার জীবন নামক উঠোনকে দুভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছে। জীবনের একভাগ উঠোনের ওপারে, একভাগ এপারে। কিন্তু স্মৃতি তো ভাগ করা যায় না। স্মৃতি ঘুরে বেড়ায় এ উঠোন থেকে ঐ উঠোনে। নীরব আর্তনাদ করে মন, কষ্ট-দু:খ-বাস্তব জীবন মহিদুননেছার স্মৃতির উঠোনকে একাকার করে দেয়, দেশভাগ সেখানে কোন বিভাজন রেখা টানতে পারে না।”

খন্ডিত উঠোন: অখন্ড স্মৃতি – দেশভাগ ও আমার মা মহিদুননেছা খাতুন / সুরাইয়া বেগম । প্রথম প্রকাশ: জুন ২০২১। প্রকাশক: সুবাস, মিরপুর, ঢাকা

আরও পড়ুন…

জীবনে কখনো প্রকাশক হবো, এই চিন্তা ছিল না- মজিবর রহমান খোকা