স্বপ্নময় চক্রবর্তী একালের একজন প্রতিষ্ঠিত ছোটগল্পকার। নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা তাঁর সাহিত্যের জগত। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা স্বপ্নময়ের গল্পকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। এ জন্য তাঁর কোনও গল্পকেই বানানো মনে হয় না। অত্যন্ত বাস্তব তিনি নিপুণ কারিগরের মতো ছেনি হাতুড়ি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যের কষ্টিপাথরে অত্যন্ত সূক্ষ্ম হাতে নির্মাণ করেছেন ছোটগল্পের মূল্যবান ইমারত। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে (১৯৭৫-২০২৩) স্বপ্নময়ের কলম সক্রিয়। তিনি সমাজের অলিগলি সন্ধান করে খুঁজে আনেন নিত্যনতুন বিষয়। ছোটগল্পের আঙ্গিক নির্মিতিতেও ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা তাঁর মেধাবি কলমকে আরো শানিত করেছে। তাঁর ‘আনন্দ পুরুস্কার’ প্রাপ্ত উপন্যাস (২০১৫) ‘হলদে গোলাপ’ লেখা হয়েছে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে। পরিশ্রমী এই লেখক জানেন আপোস করে সাহিত্য হয় না। পাঠককে ফাঁকি দিয়ে ভোলানোর মতো লেখক তিনি নন। তাই প্রথম থেকেই তার সৃষ্টিতে সেই মেধাবি মননের ছাপ স্পষ্ট। দেশলাইয়ের সেলসম্যান হিসেবে জীবন শুরু করে ধীরে ধীরে বিচিত্র কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁর গল্পের মধ্যে ঘুরে ফিরে এসেছে। তার তীক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি, গভীর সমাজবোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, আশ্চর্য সাবলীল লেখার হাত-এ সমস্ত কিছুই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথম শ্রেণির গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তার প্রায় সমসাময়িক গল্পকার অমর মিত্র, সাধন চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, আবুল বাশার, দেবর্ষি সারগী, নলিনী বেরা, শচীন দাশ, অনিল ঘড়াই, আফসার আমেদ, মুর্শিদ এ এম, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত গল্পকারদের সঙ্গে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখার যথেষ্ট স্বাতন্ত্য আছে। তাঁর গল্পে সেই অর্থে কোনো নিদিষ্ট ভৌগলিক সীমা নেই। নানা জাতের, নানা বর্ণের, নানা স্থানের বিচিত্র পেশার মানুষেরা তার গল্পের অন্দরে ভিড় জমিয়েছে। শুধু অজগ্রাম নয়, মফসসল আধা শহর, এমন কি মেট্রোপলিটন শহরের মানুষের জটিল জীবনের বহুকৌণিক অবস্থানকে স্বপ্নময় অনন্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তার সাহিত্যের ক্যানভাসে। এ কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর গল্প ছুঁয়ে ফেলে আন্তর্জাতিক বাস্তবতাকে। তার আবেদন হয়ে উঠে বিশ্বজনীন।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘ভূমিসূত্র’। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে যায়। বাংলা ছোটগল্পের পোড়খাওয়া পাঠক সাদরে বরণ করে নেন এই নতুন লেখককে। তার দশ বছর পর ১৯৯২ সালে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘চতুস্পাঠী’। এই উপন্যাসটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ওপন্যাসিক হিসেবে নয়, ছোটগল্পকার স্বপ্নময় চক্রবতীকেই বাংলার পাঠক আপন করে নিয়েছে। প্রথম জীবনে লিটল ম্যাগাজিনে অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছেন তিনি। পরবর্তীকালে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করলেও এ কথা বলা হয়তো ভুল হবে না তিনি প্রথমত ও প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তার বহু উল্লেখযোগ্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ছোট পত্রিকার পাতায়। তার মধ্যে ‘অনুষ্টুপ’,’পরিচয়’-এর মতো পত্রিকা পরবর্তী কালে লিটল ম্যাগাজিনের গন্ডী অতিক্রম করে আকারে ও প্রচারে কৌলিন্য লাভ করেছে। বর্তমান কালে বাংলা ছোটগল্পের ভবিষ্যত নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছে। বহু গল্পকাররা অসংখ্য ছোটগল্প লিখলেও তাদের লেখায় কোনো নতুন বিষয় তেমন উঠে আসছে না। ছোটগল্প নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হলেও শেষ পর্যন্ত লেখকরা সেই পুরোনো ট্রাডিশনাল ফর্মেই ফিরে যাচ্ছেন। ফলত পাঠকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে জন্ম নিচ্ছে কিছু উদ্ভট ও দুর্বোধ্য গল্প। যে গুলির সঙ্গে পাঠকরা রিলেট করতে পারছেন না। ফলত ছোটগল্পেরও পাঠক সংখ্যা উল্লখযোগ্যভাবে কমছে। তবে কী বাংলা ছোটগল্প মরে যাচ্ছে? ‘ইছামতী ও বিদ্যাধরী’ (জানুয়ারি, ২০০৮) পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাংলা ছোটগল্পের অতি সাম্প্রতিক দশা’ শীর্ষক নিবন্ধে গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছিলেন-
“ছোটগল্পের মরা সম্ভব নয় এ জন্য, ছোটগল্পই আমাদের প্রতিদিনকার বৈষম্য ও খড়খডে জীবনটাকে উল্টে পাল্টে দেখতে পারে। ছোটগল্প পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের প্রকাশভঙ্গিটাও বদলায়। ইলিয়াস বলেছিলেন, একটা বিজ্ঞাপনের লাইনও ছোটগল্প হয়ে উঠতে পারে। এই সহস্রাব্দে এ বাংলায় দেখলাম লাফার্জ সিমেন্ট বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, “আপনার বাড়ি-ই আপনার পরিচয়। এ ভাবেই হাতিয়ার হিসেবে ছোটগল্পের বীজ সমাজে ছড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিষ্ঠুর উদাসীনতা বাংলা ছোটগল্পের এঁতিহ্য অর্থাৎ বিরোধাভাস চরিত্রটিকে টুটি টিপে মারছে।”
বস্তুত বাংলা গল্পের ঐতিহ্যময় সরণিতে সাহসী পদক্ষেপ রেখেছিলেন স্বপ্নময়। এ ক্ষেত্রে তিনি আজো এক সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর গল্পে পরীক্ষা নিরীক্ষা থাকলেও অকারণ দুর্বোধ্যতা নেই। বর্তমান কালে নতুনদের মধ্যে অনেকেই ভালো গল্প লিখছেন। দ্রুত সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পের বিষয় ও আঙ্গিক অভাবনীয়ভাবে বদলাচ্ছে। স্বপ্নময়ের দক্ষতা এই এখানেই যে তিনি খুব দ্রুত বদলানো সময়ের হৎস্পন্দনকে মেপে ফেলতে পারেন। তাই তিনি আগাগোড়া আপডেট একজন গল্পকার। কমলকুমার মজুমদার বা অমল চন্দের মতো ভাষার জটিল জাল বুননে তিনি অভ্যন্ত নন। পাঠককে প্রহেলিকার মধ্যে ফেলার উদ্দেশ্য তার নেই। সাবলীল ও স্মার্ট গদ্যে অনায়াস দক্ষতায় তিনি একের পর এক গল্প বলে যান। পাঠকরা অনায়াসেই স্বপ্নময়ের গল্পের যাদুময়তায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সমাজের বিচিত্র ধারার মানুষকে আরো কাছ থেকে দেখার এক ভিন্ন আনন্দের শরিক হয়ে যান পাঠক। তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্নবান ছুঁড়ে দেন সমাজের কাছে, মানুষের কাছে, মানুষের বিবেকের কাছে।
২
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় স্বপ্নময় চক্রবতীর প্রথম গল্প ‘ভুমিসূত্র’। মাটি আর মাটি ছোয়া মানুষের জীবনের চালচিত্র দিয়ে সাজানো এ গ্রন্থের গল্পগুলিতে লেখকের মরমি মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি যেন তাদের সুখ-দুঃখের শরিক হয়ে তুলে এনেছেন তাদের শোষনের, যন্ত্রণার, আনন্দ-বেদনার নিরুচ্চার কথকতা। এ গ্রন্থে সংকলিত ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লেখা ‘সত্তর দশক’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘স্বস্ত্যয়ন’ গল্পটির মধ্যে মানুষের সীমাহীন লোভের শিকার হয়ে কীভাবে নারীকে হতে হয় ভষ্টা, নিরপরাধ মানুষকে কঙ্কাল হয়ে শুয়ে থাকতে হয় মাটির নিচে তার মর্মস্পশী আখ্যান রচিত হয়েছে। গল্পটির কাহিনি অংশ সামান্যই। নির্বিঘ্নে আসনপ্রসবা স্ত্রী গর্ভের সন্তান লাভের আশায় গুরুদেব স্বামী অঘোরানন্দকে এনে ‘স্বস্ত্যয়ন’ করাতে চায়। কিন্তু গুরুদেব বললেন-
“স্বোপার্জিত জমির তিন হাত গভীরের এক খাবলা মৃত্তিকা চাই”।
রতিকান্তর কোনও জমিই স্বোপার্জিত নয়। গ্রামের মানুষকে ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছে রতিকান্ত। হেরম্বকে কৌশলে পুরী পাঠিয়ে তার স্ত্রী হেমবালাকে অবৈধভাবে ভোগ করেছে সে। ঘুমের ঘোরে সে নিজের কু-কীর্তির স্বপ্ন দেখে আতকে ওঠে। সাধন মাস্টার প্রতিবাদ করেছিল, সে জন্য তাকে খুন করে লাশটাকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল সে। কিন্তু ‘বলনা মৌজার জামগাছ তলার ডাঙা জমিটার’ মাটি খুঁড়তে গিয়ে উঠে এল বোমার বাক্সের সঙ্গে সবুজ জামা পরা সাধন মাস্টারের কঙ্কাল। রতিকান্ত বুঝতে পারল লাশটাকে ওরা নদীতে না ভাসিয়ে এই জমিতে পুঁতে দিয়েছিল। স্বপ্নময় গল্পটিকে শেষ করেছেন এই ভাবে-
“রতিকান্ত চিৎকার করে, গর্ত বোজা এখুনি, এখুনি। নিচু হয়ে তুলে নেয় এক খাবলা মাটি, সবুজ জামার উপর ছুঁড়ে দেয়। সবুজ জামা নড়ে ওঠে আর ওমনি নড়ে ওঠে জয়া-রতর-আই আর এইট মাঠ। দুহাতে খাবলা খাবলা মাটি তুলে ছুঁড়ে দেয় সবুজ জামায়, সবুজ জামাটা আড়াল করা দরকার। অসহ্য…”
‘স্বস্ত্যয়ন’ করানোর জন্য স্বোপার্জিত জমির এক খাবলা মাটি শেষ পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না রতিকান্ত। সাধন মাস্টারের সবুজ জামা পড়া লাশ দেখে রতিকান্তর গর্দান বেয়ে ঘাম নামে।
এ গল্পে স্বপ্নময় চক্রবতী গ্রামীণ জীবনের সামন্ততান্ত্রিক শোষনের এক ভয়ঙ্কর আখ্যান তুলে ধরেছেন। গল্পের প্রেক্ষাপটে সংলগ্ন হয়ে আছে সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ। তবে তাঁর গল্পকার সত্তার মৌলিক ও স্বতন্ত্র সুরটি এ গল্পে ধরা দেয়নি। অনেকটাই পুরোনো ধাচায় স্বপ্নময় নির্মাণ করেছেন এ গল্পের কাহিনিপট। প্রায় একই সময়ে (১৯৮০) প্রকাশিত অমর মিত্রের ‘দানপত্র’ গল্পে গ্রামীণ সমাজের শোষনের যে নির্মাণচিত্রের প্রকাশ ঘটেছিল, স্বপ্নময়ের এ গল্প সে উচ্চতাকে ছুঁতে পারেনি। যদিও দু’টি গল্পের কাহিনি ও আঙ্গিক সম্পূর্ণ আলাদা। তবে প্রথম দিকের গল্প হিসেবে ‘স্বস্ত্যয়ন’ অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। এ গল্পে লেখকের শক্তিশালী গল্পকার সত্তার পরিচয় ধরা আছে।
সাতের দশককে মুক্তির দশক হিসেবে ঘোষনা করেছিল নকশালপন্থীরা। তরাইয়ের বুকে একটি ছোট্ট অখ্যাত গ্রাম ‘নকশালবাড়ি’। এখান থেকেই একটি কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমে গ্রামে তার পর মফসসলে এবং সেখান থেকে ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’ দ্রুত আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা মহানগরীর বুকে। কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা কৃষকের স্বার্থে, সর্বোপরি অসহায় সর্বহারা মানুষের স্বার্থে শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে। শ্রেণিশত্রু খতমের মাধ্যমে তারা বিপ্লব আনতে চেয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিণামে অচিরেই স্তব্ধ হয়ে যায় এ আন্দোলন। অসংখ্য তরুণের তরতাজা রক্তে ভিজে যায় রাজপথ। নকশাল আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছিল সমাজের সর্বস্তরে। দীর্ঘ দিনের শোষিত বঞ্চিত কৃষক শ্রেণির পক্ষে লেখকরা কলম ধরেছিলেন। এ সময় সমেরশ বসু লিখলেন ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ (১৯৭৭)। ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও কৃষক শ্রেণির শোষিত অপুষ্ট রুগ্ন রূপটি উঠে আসছিল ক্রমান্বয়ে।
আটের দশকের গোড়ায় ১৯৮০-তে প্রকাশিত হয়েছিল অমর মিত্রের সাড়া জাগানো গল্প ‘দানপত্র’। সম্পুর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে দলিল দস্তাবেজের ভাষায় একজন শোষিত সর্বহারা কৃষকের জবানিতে লিখিত হয়েছিল এ গল্প। অভিজিৎ সেন লেখেন ‘বর্গক্ষেত্র’। স্বপ্নময় লিখলেন ‘ভূমির নিত্যতা সূত্র’। প্রায় একই বিষয় নিয়ে সমসাময়িক গল্পকাররা তাদের নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে তুলে আনলেন অসহায় ভূমিহীন কৃষকের উপর অমানবিক নগ্ন শোষনের রেখাচিত্র। ‘ভূমির নিত্যতা সূত্র’ গল্পটি লেখা হয় ১৯৭৯ খ্রিস্তাব্দে। এ গল্পের আঙ্গিকগত নির্মিতির সঙ্গে অমর মিত্রের ‘দানপত্র’ গল্পের অনেকটা সাদৃশ্য আছে। তবে অমর মিত্রের গল্পটি (‘অনীক’, শারদীয়া, ১৯৮০) পরে লেখা। গল্পটির স্বল্প পরিসরে অসহায় বিত্তহীন মানুষদেরকে তাদের প্রাপ্য ভূমি থেকে বঞ্চিত করে কীভাবে অর্থপিশাচ বিষয়ী মানুষরা চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার এক বিশ্বস্ত বৃত্তান্ত রচনা করেছেন লেখক।
যুধিষ্টিরকে লেখা দশাননের একটি চিঠি দিয়ে শুরু হয়েছে এ গল্প। যৌতুক হিসেবে জমির বিনিময়ে দুই বিত্তবান পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সরকারি পদক্ষেপ। দশানন তার ছেলের সঙ্গে যুধিষ্টির ভাইঝি সাবিত্রীর বিয়ে দিতে নারাজ হলে ‘যৌগ্রাম মৌজার ১৮০ শতক’ জমিকে যুধিষ্টির কৌশলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। ভূমিহীনদের মধ্যে এ জমি বিলি বন্দবস্ত করার যে পরোয়ানা জারি হয় তা কার্যত নস্যাৎ হয়ে যায় যুধিষ্টিরের চক্রান্তে। নিজের শ্বশুরবাড়ি যৌগ্রামের সম্বদ্ধীর চার ছেলেকে ৩০/৪০ বিঘে সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও খাতা কলমে ভূমিহীন প্রমাণ করিয়ে অঞ্চলপ্রধানকে ধরে টাকা খাইয়ে সে জমি ভূমিহীন হিসেবে সন্বন্ধীর ছেলেদেরকে পাইয়ে দিল। এবং পরে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে দানপত্র লিখিয়ে ভাইঝির বিয়ের বন্দোবস্ত করল যুধিষ্টির। গল্পের শেষে যুধিষ্টির ভাইঝির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে অনেকটা দার্শনিকের মতো বলে-
“এই বিশ্ব সংসারে কোনো জিনিসের প্রতি টান থাকলে, অনুরাগ থাকলে, সে জিনিস কখনো ছেড়ে যায় না, নদী সাগরে যায়, আবার সে জল মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়ে নদীতে পড়ে-ঠিক ঘুরে আসে। দ্যাখনা যোগ্রামের ড্যাঙা জমিটা কি ছেড়ে গেছে আমাদের? ছাড়েনি। টান থাকলে তুই শ্বশুর ঘর গেলেও আমাদেরই থাকবি, ছাড়া ছাড়ির কথা কেনে? পাগলি, কাঁদিসনে।”
বস্তুত হৃদয়হীন মানুষের কৌশলী পাটোয়ারী বুদ্ধির প্যাঁচে সাধারণ মানুষের বঞ্চনার যে চিত্র এ গল্পে উপস্থাপিত হয়েছে তা অত্যন্ত মর্মস্প্শী। ভূমিহীন কৃষকদেরকে বঞ্চিত করে সেই জমি যৌতুক হিসেবে ভাইঝির বিয়েতে দেওয়ার জন্য কোনো রকম অনুশোচনা হয়নি যুধিষ্টির। উপরন্তু এটাকেই নিজের একটা মহৎ কীর্তি হিসেবে ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে। শোষনের এ এক ঘৃণ্য আবর্তন চক্র। অসহায় মজুর কৃষকরা ভূমিহীন হয়ে যায়, আর ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে ধনীরা। ‘মাটিতে যাদের পা পড়ে না’- তারাই হয় মাটির মালিক। সরকার কৃষকদের উন্নয়নের স্বার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রকৃত অর্থে তা বাস্তবায়িত হয় না। সাধারণ মানুষ মাথার উপর খোলা আকাশ নিয়ে ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে, রোদ্দুরে পুড়ে তবু বেঁচে থাকে। আর ‘শক্তির নিত্যতা সূত্রে’র মতো পুঁজিপতিদের হাতে তৈরি হয় ‘ভূমির নিত্যতা সূত্র’। বর্তমানে শিল্পের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে, সরকারি প্রভাব খাটিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করে বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্স, মান্টিল্পেক্স বানিয়ে প্রোমোটার, দালাল, নেতা মন্ত্রী থেকে ইঞ্জিনিয়ার সেই নিত্যতা সূত্রেরই অমরত্ব ঘোষনা করছে। শিল্পের জন্য কৃষি জমি অধিগ্রহণের ফলে বহু কৃষক হয়েছে ভূমিহীন, বাস্তুহীন। রাজনীতির জঘন্য খেলায় পীড়িত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একালের গল্পকাররা এই সমস্ত রকম অন্যয়ের বিরুদ্ধে তাদের ধারালো কলম দিয়ে শিল্পিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন, জানাচ্ছেন।
স্বপ্নময় দ্রুত বদলে যাওয়া সময়ের দলিলীকরণ করে চলেছেন ছোটগল্পে। পরবর্তীতে স্বপ্নময়ের দেখার চোখ ও লেখার ভাষা হয়েছে আরো তীক্ষ, আরো শানিত। তাঁর ‘চারণক্ষেত্র’ গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে ‘অনুস্টুপ’ পত্রিকায়। এ গল্পে আমরা দেখবো ধীরে ধীরে কীভাবে স্বপ্নময়ের গল্পের ধরণ বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তমান গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটের আগাপাশতলা আলো ফেলে দেখিয়েছেন তিনি। শহরের শিক্ষিত পাঠক অবাক বিস্ময়ে সে সব গল্পের মধ্যে খুজে পেয়েছে সমকালীন সমাজজীবনের নগ্ন বাস্তবতার ছবি। জন্মসূত্রে কোলকাতার মানুষ হলেও স্বপ্নময় যে কত গভীর ভাবে গ্রামীণ জীবনকেও পর্যবেক্ষণ করেছেন তার পরিচয় ধরা আছে অসংখ্য ছোটগল্পে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই কবিয়ালকে আমরা সকলেই চিনি। কিন্তু স্বপ্নময়ের গল্পের গিরিধারী কবিয়াল অন্য মানুষ। তার সময় ও সমাজ আলাদা। সেখানে রাজনীতির অভিঘাত, জমি মাফিয়াদের দৌড়াত্ব। দালালচক্র,গুন্ডা – ক্যাডারদের রমরমা। সাইপুর গ্রামের গিরিধারী কবিয়ালের কাছে ইন্টারভিউ নিতে আসে ‘সাপ্তাহিক চব্বিশ পরগণা বার্তা’র সাংবাদিক, সম্পাদক তথা মালিক অরিজিৎ সিংহ। গিরিধারী ৭৭-এর নির্বাচনী মঞ্চের জন্য গান বেঁধেছিল। মানুষের সাধ আশা স্বপ্ন বাসনার শরিক হয়ে সে একের পর এক রাজনৈতিক আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে ও গান বেঁধেছে। কখনো জয়ের গান, কখনো প্রতিবাদের। কিন্তু তার গ্রাম সাইপুরে মাটি মাফিয়াদের কবলে পড়ে বিশাল গোচারণভূমিটা নাবালে পরিণত হচ্ছে। তা দেখে অন্যদের মতো চুপ করে থাকতে পারে না সে। প্রতিবাদ জানাতে চায়। কিন্তু নিজের ছেলেই বাবাকে বাধা দেয়৷ অরিজিৎ রত্নেশের বাড়িতে খবর নিতে যায়। রত্নেশও তার বন্ধু মাধব চৌধুরী তাকে বিজ্ঞাপন পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে খবরটার মোটিফ অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে। পঞ্চায়েটের সঙ্গে যোগসাজস করে গ্রামের উন্নয়নের দোহাই পেড়ে তারা ‘চারণক্ষেত্র’ থেকে অনায়াসেই হরণ করতে থাকে লড়ি লড়ি মাটি। গ্রামের দু’একজন বেকার ছেলেকে বশ করে সুপারভাইজার বানিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে৷ গ্রামের মানুষ প্রতিবাদ জানায়। থানা, এস.ডি.ও অফিস থেকেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। বাধে গন্ডগোল। জারি হয় ১৪৪ ধারা। গ্রামের মানুষ তাকে তোয়াক্কা করে না।
“গোবিন্দ ভুঁইয়া গোরুটার দড়ি হিড় হিড় করে টেনে এ মাঠে বেঁধে এল। ইয়ারকি, গোরুর উপরও ১৪৪ ধারা মারাচ্ছে।”
কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। গিরিধারীর ছেলে স্বপনও শেষ পর্যন্ত রত্নেশের মাটি কাটার কাজের সুপারভাইজার হতে চলে যায়। গিরিধারী কবিয়ালের দুচোখে তখনও নতুনের স্বপ্ন :
“স্বপন তো আমিও দেখিচি। চারিপাশে কত কি বাবা, উৎসব৷ ব্যাগি জামা, এগরোল, ভিডিও ভিসিয়ার বাবা। পেনের ভিতর ঘড়ি, ক্যাডবেরি, ফ্রিজের মালাই। আমারও শখ হয় বাবা এ জীবনে। নতুন মশারির শখ, ফুটো টিন ফেলে দিয়ে নতুন টিনের, সংসারী হতে সখ হয় বড়ো। ঘরের ভিতর থেকে শোঁ শোঁ শোঁ প্রেসার কুকার। চুড়ির শব্দ, ছেলে চলে যায়। গিরিধারী কবিয়াল নিজের সঙ্গে আপোস করে : ‘নদীর শরিলি চড়া পড়লি সে নদী লষ্ট হল না, সেখানে কৃষিক্ষেত্রর হয়, একটা গোচারণভূমি ছিল, সেটা যদি জলাভূমি হয়, হোক কিছু দুঃখ নাই।”
বস্তুত ‘চারণক্ষেত্র’ গল্পে দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজেতিহাসের প্রেক্ষিতটিকে ভিতর থেকে ধরতে চেয়েছেন গল্পকার। ‘ভূমিসূত্র’ থেকে ‘চারণক্ষেত্র’ পর্যন্ত স্বপ্নময়ের যাত্রাপথে গল্পের বিষয় ও আঙ্গিক বহুবার বদলেছে। মাটি ও মাটি ঘেঁষা মানুষদেরকে নিয়ে লেখা গল্পগুলিই প্রথম দিকে স্বপ্নময়কে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পরিবর্তিত সমাজ পরিস্থিতিতে স্বপ্নময়ের দৃষ্টি পড়ল সমাজের নানা বর্ণের মানুষের দিকে, তাদের বিচিত্র কর্মজীবনের গভীরে।
৩
স্বপময় চক্রবতীর গল্পে তার অস্থায়ী কর্মজীবনের বিপুল অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। রসায়নের ছাত্র হলেও পরে বাংলায় মাষ্টার ডিগ্রি করে দেশলাইয়ের সেলসম্যান হিসেবে জীবন শুরু করেন। এরপর বারবার বদলেছেন জীবিকা। কখনো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ল্যান্ড রিফর্ম অফিসার, আবহাওয়া দপ্তরের রাডার চালক, আবার কখনো বা বেতার প্রজোযক। এরকম বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা ছিল বলেই তিনি একের পর এক লিখে গেছেন বহু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। আদর্শগতভাবে আগে একজন লেখককে সৎ ও সামাজিক মানুষ হতে হয়। স্বপ্নময়ের মধ্যে মানুষকে ভালবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। প্রায় চার দশক ধরে বাংলা ছোটগল্পের জগতে নিজের আসনটি পাকা করে নিয়েছেন স্বপ্নময়। আজো অক্রান্ত ভাবে তার কলমটিকে সক্রিয় রেখেছেন তিনি।
১৯৮২ সালের ‘ভুমিসূত্র’-এর পর একে একে প্রকাশিত হয়েছে তার গল্প সংকলনগুলি। ‘অষ্ট চরণ যোলো হাটু’, ‘ভিডিও ভগবান নকুলদানা’, ‘জার্সি গরুর উল্টো বাচ্চা’, ‘স্বপ্নময় চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘সতর্কতামূলক রূপকথা’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘ফুল ছোয়ানো’, ‘পঞ্চাশটি গল্প’, ‘যন্তর মন্তর’, ‘আমার সময় আমার গল্প’ , ‘ব্লু সিডি ও অন্যান্য গল্প’ ইত্যাদি সংকলনগুলিতে বার বার নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন স্বপ্নময়। আধুনিক বস্তুবিশ্ব খুব দ্রুত গ্রাস করে নিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে। ভোগবাদ তথা বিশ্বায়নের আগ্রাসী থাবার নিচে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান থাইল্যান্ড মায়ানমার ফিলিপাইন্স কম্বোডিয়া (কাম্পুচিয়া) সহ অসংখ্য ছোট বড়ো দেশ। পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন, বাজার দখলের লড়াই, পণ্যবিশ্বের হাতছানি মানুষের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনেও ঢুকিয়ে দিচ্ছে আকাশ-ছোয়া লোভের ভাইরাস। খুব স্বাভাবিকভাবে শিল্প সাহিত্যের ভূগোলটাও দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে৷ আসছে নিত্য নতুন প্রসঙ্গ। সমসাময়িক গল্পকাররা আধুনিক জীবন সংকটের এই চিত্র নানাভাবে তুলে আনছেন তাদের গল্প উপন্যাসে। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্পের ভূগোলেও বড়ো রকমের রদবদল ঘটলো। ২০০৩ এর ‘বর্তমান’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘জননী যন্ত্রণা’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গল্প- যেখানে স্বপ্নময় নিজের চির পরিচিত পরিমন্ডল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়ায়। গল্পকারের মানবিক সত্তা, নৈব্যক্তিক জীবনানুভব, মেধাবী ইতিহাস চেতনা ও বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ‘জননী যন্ত্রণা’কে করে তুলেছে আন্তর্জাতিক মানের একটি সার্থক ছোটগল্প। কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘জননী যন্ত্রণা’-র শিরোনামটি এ গল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন গল্পকার। তার অন্য একাধিক গল্পের নামকরণেও এই ধরণের ব্যবহার চোখে পড়বে। ‘নকশী কীথার মাঠ’, ‘বাবরের প্রার্থনা’,’ফিরে এসো চাকা’ ইত্যাদি গল্পের কথা এ প্রসঙ্গ মনে পড়ে।
‘জননী যন্ত্রণা’ আধুনিক বিশ্বের জটিল আবর্তের প্রহেলিকায় বিপন্ন এক শ্রেণির মানুষের স্বপ্ন সাধ সংস্কার যন্ত্রণার কথকতা দিয়ে নির্মিত মানবিক আবেদননির্ভর মর্মস্পশী গল্প। লেখকের মরমী জীবনবোধ ও আন্তরিকতায় এ গল্পের অভিঘাত পাঠক চৈতন্যকে আলোড়িত করে। এডস সচেতনতা বিষয়ক একটা সেমিনারে এসে এন.জি.ও সংস্থায় কর্মরত এ গল্পের কথক পাড়ি দেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কন্বোডিয়ার নপ্পেন শহরে। কম্বোডিয়াকে ঘিরে আছে ইতিহাসের নানা সংঘাতময় অধ্যায়। আমেরিকার বোমাবর্ষন। যুদ্ধের দামামা, ভিয়েতনামের গেরিলাবাহিনির পদচারণা। সেমিনার পরিচালক কন্বোডিয়ান মহিলার গলায় একটি পুরুষ মানুষের ছবি দেখে তাই কথকের মনে হয়-
“হয়তো লকেটের সূক্ষ্ম সোনার ফ্রেমের ভিতরে স্তব্ধ রয়েছিল একটা গোটা যুদ্ধ, হাহাকার আর যন্ত্রণা”
প্রাচীন ইন্দোচীন ভেঙে তিন টুকরো হয়ে জন্ম নিয়েছিল তিনটি দেশ- লাওস, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়া। এখানে রয়ে গেছিল ভারতীয়দের প্রাচীন কীর্তি আংকোরভাট মন্দির। স্থানীয় কালচার, ডায়ালেক্ট আর স্থাননামের মধ্যে রয়ে গেছে ভারতীয় এঁতিহ্যের গন্ধ। আংকোরভাট মন্দির পরিদর্শন করতে লেখকের সঙ্গী হয়েছিল ইংল্যান্ড, ফিলিপিনস্ আর কয়েকজন আমেরিকান টুরিষ্ট। গাইড বোমবং তাদেরকে সমুদ্রতীরবতী একটি নারকেল গাছে ভরা গ্রামে নিয়ে আসে। সেখানে গ্রামপ্রধান ‘কানহো’র একটি ছেলে ‘কাঠবেড়ালি’র মতো তরতর করে গাছে উঠে ট্যুরিষ্টদের জন্য ডলারের বিনিময়ে নারকেল পেড়ে দেয়। ফাইফরমাস খাটানোর জন্য গাইড ছেলেটি তাকে সঙ্গে নিয়ে নেয়। আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রামপ্রধান আমন্ত্রণ জানায় আবার তাদের ফিরে আসার জন্য। ঘটনাক্রমে গল্পের কথক এখানে তুলে আনেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্বায়নের প্রভাব, নারীর পণ্যায়নের প্রসঙ্গ-
“দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ব্যাপক অঞ্চলে বেশ্যাবৃত্তির সামাজিকীকরণ হয়ে যাচ্ছে। থাইল্যান্ডের বেশ কিছু মেয়ে প্রথম যৌবনের কয়েক বছর বেশ্যাবৃত্তি করে। তারপর পরিবারে ফিরে যায়। এতে ওদের বিয়ে হতে সমস্যা হয় না। এই ধরণের বেশ্যবৃত্তিতে রাষ্ট্রেরও মদত আছে। বিদেশ থেকে হাজারে হাজারে যৌবনলোভী পুরুষরা আসছে। আসলে ডলার আসছে, ডলার। মেয়েদের শরীর বেচা পয়সায় হাইওয়ে, এসি বাস, বেকার ভাতাও, বেশ্যাবৃত্তির সামাজিক সম্মতি থাইল্যান্ড ছাড়িয়ে অন্য দেশগুলিতেও ছড়াচ্ছে।…পাষ্টেররে সমুদ্রের ধারে পুলিশের পকেটেও কন্ডোম রাখা সম্ভব হয়েছে, যদি কোনো ট্যুরিষ্টের দরকার পড়ে যায়, পুলিশের কাছে চাইলেই পাওয়া যাবে। কম্বোডিয়া কী ক্রমশ থাইল্যান্ড হতে চলেছে? ট্যুরিষ্ট স্পটের আশেপাশে সেগুন সুপারি নারকেল গাছ ছাড়াও গ্রামগুলির ভিতরে জন্ম নিচ্ছে ডলারপ্রত্যাশী ব্রথেল!”
গ্রাম প্রধানের ছেলে ‘লিং ঝাউ’কে নিয়ে টুুরিষ্ট বাসটি রওনা হয়। কথকের ক্যামেরার জুমে একটি মন্দিরের পাশের জঙ্গলে কাঠবেড়ালির বাসা দেখে লিং ছুটে গিয়ে গাছে উঠে কাঠবেড়ালির চারটে ছানা পেড়ে কাঠবেড়ালি ওদের প্রিয় খাবার। কথক ভাবে খাওয়ার জন্যই হয়তো ছানাগুলোকে ধরেছে লিং। সেগুলো তার কাছে রাখতে দিয়ে আবার গাছে ওঠে লিং। বিষাক্ত সাপ তাকে কামড়ে দেয়। গাইড ছেলেটি তাকে দুঘন্টার পথ পেরিয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। ছেলেটির আরোগ্যের জন্য চারটে দেশের মানুষ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে। কথক বলেন-
“বারশো বছরের পুরোনো এক মন্দিরের সিঁড়ির সামনে আমেরিকান, ফিলিপিনো, ভারতীয় মিলে একটা আধুনিক বিশ্ব একটা গরিব কম্বোডিয়ানের জন্য আকাশে হাত তুলল।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেটি বাঁচেনি। ছেলেটির মায়ের কান্না যন্ত্রণা হয়ে বাজে কথকেরও বুকে। লিং-এর দেওয়া কাঠবেড়ালির ছানাগুলোকে কানহোর কাছে দিলে কথক জানতে পারে লিং ছানাগুলোকে নিজে খাবার জন্য ধরেনি। এনেছিল ওদের ক্লানের গর্ভিণী মায়েদের জন্য। ওদের মধ্যে সংস্কার প্রচলিত-
”কোনও গর্ভিণী মহিলা যদি কাঠবেড়ালির বাচ্চা খায় তবে আগামী সন্তান কাঠবেড়ালির মতোই গাছে উঠতে পারবে। দ্রুত এনে দিতে পারে বিদেশীদের জন্য গাছের ডাব।”
আগামী প্রজন্মের জন্য লিং-এর এই প্রাণ বিসর্জনে গর্বিত হয়ে ওঠে লিং-এর বাবা। তার মা আবার গর্ভবতী। সে চাইবে তার গর্ভে আবার এক ক্ষিপ্র লিং ফিরে আসুক। কানহোর গোষ্ঠীতে আরো অনেক গর্ভবতী মেয়ে আছে, তাদের সঠিক পিতৃ পরিচয় না থাকলেও গল্পের শেষে কথক অনুভব করেন- ”মরণকে পিছনে রেখে গর্ভবতী দুগ্ধবতী জননীরা উঠে এল। আমার চার দিকে ওরা। হাত বাড়িয়েছে আমার দিকে। দশ, শত, সহস্র হাত।”
এ এক অন্তহীন ‘জননী যন্ত্রণা’র ইতিকথা। গল্পটিকে একটু বিশদভাবে তুলে ধরতে হয়েছে কারণ এই গল্পে স্বপ্নময় পৌছে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের এক গভীর মানবিকবোধের জগতে। যেখানে দারিদ্রতার ভয়াবহ অভিশাপে কাঠবেড়ালির বাচ্চা খেয়ে জননীকে কাঠবেড়ালির মতো তরতর করে গাছে উঠতে পারা সন্তানের কামনা করতে হয়। বিদেশী টুরিষ্টদের কাছে ডাব বিক্রি করে পেট চালানো মানুষগুলোর কাছে এটাই একটা বড়োসরো স্বপ্ন। স্বপ্নময়ের বিশ্বগত নৈব্যক্তিক অনুভব এভাবেই ছোটগল্পের ক্যানভাসে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে উঠে এসেছে।
মতি নন্দীর ‘একটি পিকনিকের অপমৃত্যু’ গল্পের সঙ্গে এ গল্পের কাহিনির পরিণামগত কিছু সাদৃশ্য আছে। তবে সেখানে নারকেল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছিল নিছক মজা দেখবার জন্য কয়েকজন মেয়ের অমানবিক আচরণের কারণে। কিন্তু এ গল্পের শেষে গল্পকার পাঠকের চৈতন্যকে ভিন্ন এক বোধের জগতে নিয়ে যান। তাকে নাড়া দেন, ভাবতে শেখান। সময়ের সরণি ধরে পরিবর্তমান পৃথিবীর জীবনানুভব, উপলব্ধির নানা বর্ণের মিশেলে নির্মিত হয় বহুমাত্রিক সৃষ্টির জগত। স্বপময়ের গল্পে সময় নানা ডাইমেনশনে ধরা পড়েছে। আধুনিক নাগরিক মানুষের সুবিধাবাদী মন, হৃদয়হীনতা, অমানবিকতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন স্বপ্নময়। শহরের মানুষের হিপক্রেসিকে চাঁছাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেছেন।
২০০৯-এ ‘বর্তমান’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘হাড়ের ভিতরের মজ্জা’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নাগরিক মানুষ নিজের স্বার্থে কতটা নীচে নামতে পারে। অনায়াসে বিসর্জন দিতে পারে মানবিক মূল্যবোধ। বাকুড়ার এক অখ্যাত গ্রামে স্কুল মাস্টারি করতে গিয়ে সুমিত জানতে পারে নিবারণ রুইদাসের রক্ত ‘বোন্বাই’ গ্রুপের। সুমিতের ভাগ্নেরও বোম্বাই গ্রুপ। কিন্তু সে ভয়ঙ্করভাবে রক্তাল্পতায় ভুগছে। সুমিতের বৃত্তবান জামাইবাবু এ খবর জানতে পেরে গ্রামে এসে কৌশলে নিবারণকে শহরে নিয়ে যেতে চায়। শিক্ষক সুমিতের সাহায্য নিয়ে সে নিবারণের বাবা-মাকে বোঝায় শহরে নিয়ে গিয়ে নিবারণকে তারা অনেক পড়াশুনো করিয়ে বড়ো করে তুলবে। বদলে তার ছেলেকে বাচানোর জন্য নিবারণকে রক্তদান করতে হবে। নিবারণের বাবা মা প্রথমটায় রাজি না হলেও নিবারাণের মাস্টার মশাই সুমিতের উপর ভরসা করে ছেলেকে ছেড়ে দেয়। শহরে সুমিতের জামাইবাবুর বাড়িতে নিবারণ ভালো খায়, ভালো পড়ে কিন্তু ‘মুচি’ বলে সে রান্নাঘর বা শোবার ঘরে ঢোকার অনুমতি পায় না। সুমিতের ভাগ্নেকে বাঁচাতে চার মাসে দশ বারো বার তার শরীর থেকে রক্ত টেনে নেওয়া হয়। পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসার সময় নিবারণ ওদের দেওয়া টাকায় মায়ের জন্য শাড়ি না কিনে ফুটপাথ থেকে ‘রক্তবৃদ্ধিকর’ বড়ি কিনে নিয়ে আসে।
সুমিতরা বোঝে নিবারণের ভাইবোনের শরীরেও থাকতে পারে ‘বোম্বাই’ গ্রুপের রক্ত। তাই তাদের রক্ত পরীক্ষা করানোর কথা বলে। অমানবিকভাবে একজন দরিদ্র কিশোরের রক্ত দিয়ে বড়ো লোকের ছেলে বাচানোর এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়া আরো ভয়ানক জায়গায় চলে যায়। ‘বোনম্যারো টরান্সপ্লাটেশনে’র মাধ্যমে সুমিতের ভাগ্নেকে বাচানো সম্ভব কী না তা জানার জন্য ভেলোরে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে গ্রামে বেচারা নিবারণ রুগ্ন ছেলেটার আরোগ্যের জন্য “পোড়ামার” থানে মানত করে টিল বাধে। লেখক গল্পের শেষে বলেন-
“কিন্তু নিবারণ তো জানে না ‘বোনম্যারো ট্রানসপ্লাটেশন’ করতে গেলে আবার দরকার হবে সেই বোম্বাই গ্রুপ। বোম্বাই গ্রুপের মজ্জা। সেই মজ্জা একটা শরীরের হাড়ের ভিতর ভিতর থেকে টেনে অন্য শরীরের হাড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।…বেচারা ঢেলাটাও তো জানে না এ সব। পোড়া মায়ের থানে সরল গ্রাম্য বালকের সুখে দোল খাচ্ছে মানসিকের ঢেলাটা।”
এ গল্পের নিদারুণ অভিঘাত সংবেদনশীল পাঠককে বাকন্তৰ করে রাখে। সুবিধাবাদী নাগরিক মানুষের অমানবিকতার এক চরম নিদর্শন তুলে এনেছেন গল্পকার। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নিবারণের মতো অসংখ্য কিশোর, ধনীরা নিজের স্বার্থে প্রতিনিয়ত যাদের ব্যবহার করছে। তাদের রক্ত চুষে নিচ্ছে, প্রয়োজনে টেনে নিচ্ছে হাড়ের ভিতরের মজ্জাও। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে পরিচালক মৃণাল সেন-এর ‘খারিজ’ ছবির সেই পালানকে। মাসে ৫০ টাকার বিনিময়ে বড়োলোক বাড়ির ফাইফরমাস খাটার জন্য তাকে রাখা হয়েছিল। তীব্র শীতে একটা ভালো মোটা পোশাকও তাকে দেওয়া হয়নি। শুতে দেওয়া হতো সিঁড়ির নীচে। শীতের কামড় থেকে বাঁচতে সে বন্ধ রান্নাঘরে আশ্রয় নেয়। সকালে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। না নেভা কয়লার উনুনের ধোয়াতে বিষাক্ত ‘কার্বন মনোক্সাইড’ গ্যাসের প্রভাবে মৃতু হয় ছেলেটির। ‘খারিজ’-এর পালান আর স্বপ্নময়ের গল্পের নিবারণ রুইদাস একই চরিত্র। হৃদয়হীন মানুষগুলোর চরম অমানবিকতার শিকার হয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায় এরা। আর বড়লোকের নাদুস নুদুস ছেলে বেসিনে মায়ের চোখে ফাকি দিয়ে ঢেলে দেয় গরম দুধ।
৪
“গল্প আমি লিখিনা, বাস্তবে গল্পই আমাকে লেখে।”, -বলেছিলেন সাদাত হাসান মান্টো ‘আমি কীভাবে লিখি’ শীর্ষক নিবন্ধে। আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। একজন স্রষ্টা বাস্তব জীবনের সেই অনুভবে জারিত হয়ে নিজেকেও নতুন করে নির্মাণ করেন। ছোট গল্প কোনও কল্পলোকের বায়বীয় পদার্থ নয়, তা বাস্তব জীবনের সংগ্রামের আবহমান ইতিহাসের টুকরো অধ্যায়। বিচিত্র রঙ রূপ রস মাধুর্য নিয়ে শব্দের পর শব্দের বাধনে নির্মিত হয় ছোটগল্পের শরীর। আধুনিক ছোটগল্প যন্ত্রণার ফসল। চারপাশের অসহায় মানুষের কান্না বেজে ওঠে সংবেদনশীল শিল্পীর হদয়ে। তিনি পীড়িত হন, আহত হন। স্বপ্নময় চক্রবর্তী সেই সংবেদনশীল মনের গল্পকার যিনি সোচ্চারে ঘোষণা করেন-
“চারপাশের অভিঘাত লিখতে বাধ্য করায়।… একজন লেখকের চেতনা হাসের পালকের মত জল পিছলানো হতে পারে না। চেতনার জল লাগে। চোখের জলও। ভালবাসার উষ্ণতাও। মানুষের প্রতি ভালবাসা ছাড়া সাহিত্য হয় না।”
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্প বিশ্বে বহু উল্লেখযোগ্য ফসল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই ক্ষুদ্র আলোচনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই সবগুলোকে স্থান নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার নানা স্বাদের পাঁচটি গল্পকে আলোচনার অন্তর্ভূক্ত করে স্বপ্নময়কে বুঝে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর কলম আজো বিরামহীন। পরিশ্রমী এই গল্পকারের কাছে বাংলা ছোটগল্পের পাঠকের প্রত্যাশা অনেক। পুরস্কার আর প্রাতিষ্ঠানিকতার মোহে আচ্ছন্ন হওয়ার মতো লেখক স্বপ্নময় নন জানি। পাঠকের ভালবাসাই একজন লেখকের কাছে সব চেয়ে বড়ো পুরস্কার আর তা তিনি অর্জন করে নিয়েছেন।