প্রথম বইটাতো বেরুল! যেদিন প্রকাশকের বইয়ে-ঠাসা স্বল্পালোকিত দোকান ঘরের সামান্য চৌহদ্দিতে কয়েকটি কপি সেজেগুজে প্রথম এল, মানে বাঁধাই হয়ে, একেবারে ঝলমলিয়ে উঠল যেন চারিপাশ। মনে হলো শেলফে-রাখা সব মহারথির মাথা ছাড়িয়ে অস্থির বইক’টি এখুনি উড়াল দেবে। আর তাদের বর্ণালি বিভূতি ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে, হ্যাঁ, সৌরভও থাকবে কিছুটা। বাস্তবিকই সদ্য-ছাপা-বাঁধাই হওয়া সামনে রাখা বইক’টি থেকে একধরণের ভেজা গন্ধ ও ভাঁপ যে উঠে আসছিল উপস্থিত সকলেই তা টের পাচ্ছিলাম।
শিল্পীর যত্নে -আঁকা প্রচ্ছদ ভালোই-তো লাগছে ছাপা হওয়ার পর। দৌড়-ঝাঁপ দিয়ে কভারটা আমিই করিয়েছিলাম। শিল্পী ভদ্রলোক চারুকলায় স্নাতক, একটু সিরিয়াস টাইপের মানুষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’র ভক্ত; একটা ডকুমেন্টারিও করেছিলেন ‘খোঁয়ারি’র বাড়িটার ওপর, আবার নিজেও পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। আমার দুষ্পাঠ্য গল্পগুলি পড়ে তিনি যে প্রচ্ছদ করতে রাজি হয়েছিলেন এবং একটা কভার দাঁড় করিয়ে আমার কাছে মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলেন, সে আমার ভাগ্য। সবশেষে এই যে আমার অস্থির অক্ষরগুলি দুই মলাটের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে এখন আরও অস্থির আনন্দে ফের ছড়িয়ে পড়তে চাইছে সেটাই বড় সত্যি।
কিন্তু একটু পরই কিনা বোঝা গেল এই সত্য আসলে সবটা সত্য নয়, অন্তত অর্ধেক আমার কল্পনামাত্র। ইতিমধ্যে দেখলাম বিরক্তিতে আমার প্রকাশকের কপালে কুণ্ডুলী ভাঁজ হয়ে ঝুলে পড়েছে। ছাপা বাঁধাই তাঁর মনমতো হয়নি। পেজ মেকআপ হয়নি মাপমতো, মেশিনে উঠে গেছে। কভারে রং ঠিকমতো পড়েনি আর বাঁধাইও দায়সারা গোছের বলে বইখানার একেবারে ম্যাঁড়ম্যাড়ে ছিরি-এ-বই ক্রেতা নেবে কেন? এমনিতে তরুণ হলে কি হবে, এই প্রকাশক নিজেও একটু খুঁতখুঁতে টাইপের-নিজে লেখালেখি করেন, নিজের লেখা তাঁর ক’টি বইও আছে বাজারে। সব বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি নিজে পড়েন, নিজেই প্রুফ দেখেন, অকপটে লেখককে জানিয়ে দেন নিজের মতামত। তারপর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছাপার কাজ তদারকি করেন। কিন্তু একা আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি এবার।
রোজ বাংলা একাডেমিতে যেতে হচ্ছে, যত ছোটই হোক না কেন একটা স্টল তো নিয়েছেন, এদিকে বেশ ক’টি বই প্রকাশ করছেন এবারও-এর কোনটা ছাপাখানায়, কোনটা বাঁধাইয়ে, কোনটা পৌঁছেছে মেলায় স্টলে। এই অবস্থায় আমার বইয়ের দশা দেখে তিনি ঠিক কার ওপর যে বেজার হবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এখন কি তবে আমার কাঁচুমাচু হওয়ার পালা! এক তো আমি এক খারিজ-হওয়া লেখক! হারিয়ে যাওয়া কিংবা বুড়িয়ে যাওয়া। তার ওপর কঠিন ধরনের ভাষা আর সব গরিব মানুষের গল্প। ২-১টি তো গল্পই নয়-রীতিমত ‘না-গল্প’! তা-ছাড়া এইসব পুরনো গরিবদেরইতো লাশ গুম করে দিয়ে তাদেরই স্বজনরা ইতিমধ্যে উন্নয়নের মহাসড়কে এসে দাঁড়িয়েছে! ঝকঝকে ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনের হাওয়া বইছে চারদিকে। তাই আর নয় মৃত জীবনের গল্প-চাই নতুন ভাষা, বোধ, চরিত্র! দেখছেন না ভাই সময়টা যে পাল্টাচ্ছে! কত নতুন পাঠক যে গজিয়েছে, কত বড় আজ বইয়ের বাজার! প্রকাশক অবশ্য নিজে ‘কনভিনসড’ আমার গপ্পোগুলি পড়ে। কিন্তু ক্রেতা যে কিনছে না এই বই, সে-ব্যাপারে তিনি বোধ হয় অনেকটা নিশ্চিত বলে নিজের বই নিজে বিক্রির কিছু টিপস আমায় দিলেন। বেশ ক’খানা বইও পেলাম।
প্রকাশকের ডেরা থেকে বইয়ের একটা বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ার পর আর খুশি লুকানোর দরকার পড়ল না। প্রথম বইয়ের প্রথম কপি আমি কাকে দেবো? আমার প্রয়াত পিতা বরাবর নাখোশ ছিলেন আমার লেখালেখির পাগলামিতে-এমনকি এককালে দেশের একনামে-চেনা কাগজেও ছাপার হরফে আমার নাম দেখে তিনি মোহাবিষ্ট হননি। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন মা-মরা এই ছেলে উচ্ছন্নে গেলে আর কে সামলাবে? নিজে দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহণের সুযোগ না নিয়ে যা পেরেছেন তো করেছেন। যাহোক, এখন তাদের দুজনের অনুপস্থিতিতে প্রথম বইটা তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে আর বাধা থাকল না। বেঁচে থাকলে এও সম্ভব হতো কিনা কে জানে।
বাসায় ঢোকার পর প্রথম কপি স্বাক্ষর করে সহধর্মিনীর হাতে তুলে দিলাম। তিনি খুশিতে ডগমগ, কুলুকুলু হাসি মুখের দুই প্রান্ত গড়িয়ে নামছে। তিনি অবশ্যি এর একটি গল্পও পড়েননি। পাণ্ডুলিপি তৈরির সময় সবকিছু একার হাতে সামলে নিয়ে সর্বতোভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তা আমি নিজেই উদ্যোগী হয়ে চেষ্টা করেছিলাম ২/১টি গল্প তাঁকে পড়ানোর, ডেকে রীতিমত ক্লাস নেওয়ার মত। কিন্তু এক তো খটমটো ভাষা, তায় আবার ওই সব হাড্ডিসার জীর্ণশীর্ণ মানুষ, গল্পে অদল বদল করা ২/১ টি চরিত্র চিনেও ফেলেছেন তিনি। মৃদু অনুযোগ: না, আশেপাশে ছিল ওরা বেশত ছিল, আবার বইয়ের পাতায় তুলে আনার দরকার কী?
কিন্তু পড়তে পারছেন না তাতে কি, আমার বই বের হয়েছে এতেই তিনি মহাখুশি। একঘেঁয়ে জীবনে একটু তো অন্যরকম কিছু! তৎক্ষণাৎ মুঠোফোন টেনে নিয়ে সবার আগে জানিয়ে দিলেন ছোট বোনকে, ছোট বোনকে জানানো মানে ঢ্যাঁড়ায় ঘা! আত্মীয়, তস্য আত্মীয়-ফোন আসতে থাকল-ওরে আল্লাহ সে কি কথা, বই লেখেন আপনি, তলে তলে এত, কই আমরা তো জানি না! মেসেজ পাঠিয়ে অভিবাদন জানিয়ে শরীক হলেন অনেকে। স্ত্রীর কল্যাণে রাত পোহাতেই নৈঃশব্দ্যমোড়ানো ফ্ল্যাটবাড়ি জুড়ে মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। ঢেউয়ের দোলায় পরদিন বিকালে হাজির হলেন নিচের তলার ভদ্রমহিলা, জনৈক ডাক্তারের সহধর্মিনী। দ্বিতীয় সন্তানটি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরা। একসময়, কলেজ জীবনে বইয়ের পোকা ছিলেন, নিজেও বুঝি লিখতেন কলেজ ম্যাগাজিনে। স্ত্রীর হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিয়ে বই কিনে নিয়ে গেলেন, আমার বইয়ের প্রথম ক্রেতা! পাশের বাসার কলেজগামী তরুণী সন্ধ্যায় আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে দুয়ার চেপে দাঁড়াল-আন্টি, আংকেল নাকি বই লিখেছে! তার বিস্ময় মাখানো মুখে ছড়িয়েছে সন্ধ্যার মাধুরী। নাছোড় কিশোরী এক কপি চেয়ে নিল আজ রাতেই পড়বে বলে।
পরদিন। ক’টি বই সংগে এনেছি। অফিসে মৃদু হইচই। খোদ একাউন্ট্যান্ট ব্যাকব্রাশে প্রাক-তিরিশেও বুড়িয়ে-যাওয়া রাশভারী মানুষ, এগিয়ে এসে নগদ টাকায় বই কিনলেন। অন্য সহকর্মীরা তাকে অনুসরণ করল। আমি মনে মনে প্রকাশককে ধন্যবাদ জানালাম-এই বাজারে বইয়ের দামটা তিনি অন্তত ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখেছেন। বোধ করি তিনি ভেবেছিলেন আর যা না হোক-বিক্রি হোক বইটা; বইটা যেন তাঁর দোকান কিংবা ভাড়া করা গুদামঘরের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার দখল করে পড়ে না থাকে, সে আরেক হ্যাপা! আমার দুই জুনিয়র সহকর্মী-সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়েছেন-একরকম ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন দুটি বই, টাকা রেখে দিলেন টেবিলে। আমার অন্য এক সহকর্মীকে আমিই দিলাম একটা বই শুভেচ্ছা কপি-ভদ্রমহিলা পেশায় সমাজবিজ্ঞানী-একসময় চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মী, কিঞ্চিৎ আঁকাআঁকির অভ্যাস ছিল, বই হাতে নিয়ে একটু নস্টালজিক হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।
সেদিন বিকেলেই প্রকাশকের কাছ থেকে আরেক বান্ডিল বই চেয়ে আনলাম। ‘পুশিং সেলের’ সম্ভাবনায় প্রকাশকের মুখ স্মিত দেখাল। এবার তালিকা ধরে বই পাঠানোর পালা নানা ঠিকানায়। ভাবলাম কৈশোর থেকে শুরু করি। কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন ছোট বেলার বাছাই করা বন্ধুবান্ধব, প্রিয় স্কুল শিক্ষক। নিজে বই নিয়ে গেলাম বড় আপার বাড়ি-ভদ্রমহিলা অবসরপ্রাপ্ত স্বামী নিয়ে নিজ বাসভবনে কুমিল্লায়। ইতোমধ্যে দৃষ্টিশক্তি প্রায় পুরো খুইয়ে ফেলেছেন, আমার প্রথম বই পেয়ে পরম মমতায় প্রথমে অক্ষরগুলি তারপর ভাইয়ের সারা শরীরে হাত বুলিয়ে গেলেন শুধু। স্কুল শিক্ষকের চোখও গ্লকোমায় আক্রান্ত। কানেও তেমন শোনেন না। বই পেয়ে তিনিও খুব খুশি-রীতিমত লেখক হয়েছে তাঁর ছাত্র! আমার গাঁয়ের বাড়ির ২/১ জনের ঠিকানায় বই গিয়ে ফেরত এল, প্রাপক মৃত।
হওয়ারই কথা, আমার নিজেরই যাওয়া আসা নাই অনেক বছর! লেখকদের তালিকাটা করলাম খুব যত্নে, খুব বাছাই করে। সংখ্যায় তারা বেশুমার, পরন্তু ফি বছর বাড়ছে। চেনা জানার গন্ডিতেই থাকলাম, দীর্ঘ অদর্শনেও আমি যাদের ভুলতে পারিনি। তাদের মধ্যে থাকল কয়েকজন মৃত লেখক (মানে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন) ও জীবিত, খ্যাতিমান ও খ্যাতি-আকাক্সক্ষী লেখকক‚ল। এঁদের কয়েকজন সাহিত্যকর্মে রীতিমত একাডেমি কর্তৃক পুরস্কৃত। কবি, প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী। তবে বলতেই হয় নিজে সামান্য গদ্যচর্চা করলেও আমার সখ্যতার পাল্লা কবির পালেই ভারী, এটা হতে পারে তাবড় গদ্যশিল্পীদের সমালোচনা এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ানোর এক রকম ছল! এক দুপুরে নিজেই গেলাম বই নিয়ে দেশবরেণ্য এক কবির বাসায়-বয়সের ব্যবধান থাকা সত্বেও একসময়ের ভারি ঘনিষ্ঠ, তুখোড় কবি দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে এলেন। কোথায় সেই কবি-এ-যে দেখছি রীতিমত তাঁর ফসিল-ডায়াবেটিসে বেহাল দশা। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় আদর করেই কি যে বললেন কিছুই বোঝা গেল না। এর বছরখানেক পর তিনি মারা গেলে ক’দিন প্রায় পুরো জাতি শোক পালন করল। আর হ্যাঁ, বই প্রাপকের তালিকায় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক যেন কিছুতেই বাদ না পড়ে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন প্রকাশক।
২/৪ দিন পর। একটা ফোন এল-অপরিচিত গলায়-অমুক বলছেন? জী বলছি। হ্যাঁ আমার বই তিনি পেয়েছেন-পড়েওছেন কয়েকটি গল্প। কুরিয়ারে আমার সেলফোন নম্বর পেয়ে এখন ফোন করছেন। কলেজে পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেই তিনি চাইছিলেন একটু সময় করে নিয়ে হলেও আমার সঙ্গে কথা বলবেন। বেশ খানিকক্ষণ বললেন একটানা। প্রশংসাসূচক নানান মন্তব্য-আমার গল্পের বিষয়বস্তু, গল্প বলার ভঙ্গী ইত্যাদি নিয়ে। এদিকে পরিচয় জানতে পেরে আমি তো রীতিমত থ। এই লেখক অল্পকালের মধ্যে নিজের শ্রেণি, মানে যে অন্ত্যজ শ্রেণি থেকে তিনি নিজে উঠে এসেছেন তাদের জীবনছবি কথাশিল্পে ফুটিয়ে তুলে দেশজোড়া খ্যাতি কুড়িয়েছেন, জুটেছে একাডেমিসহ নানা পুরস্কার। আমার লেখা সম্পর্কে ঠিক কি কি বলেছেন তা কি আর ছাই মনে আছে! ফোন এল ঘনিষ্ঠ আরও ক’জন লেখক বন্ধুর কাছ থেকে, সামাজিক মর্যাদায় অনেক উঁচুতে তাদের অবস্থান।
অনেকে নানা পুরস্কার ও পদকে ভূষিত, রয়েছে তাঁদের নিজস্ব স্তাবক কিংবা পাঠকমণ্ডলী। ভিন্ন ধারায় লিখে নাম কুড়িয়েছেন সামান্য অনুজ এক লেখক নিজেই বললেন-দিন, আপনার স্বাক্ষর করে দিন বইটায়। আরেক বন্ধুর সাথে দেখা এক সান্ধ্য আড্ডায়-সম্প্রতি মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কারে সম্মানিত। বলল, তোর বইটা স্টল থেকে নিজের পয়সা দিয়ে কিনে পড়েছি। চট্টগ্রাম নিবাসী সিরিয়াস ঘরানার নামজাদা সাহিত্যিক বন্ধু টেলিফোনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। দীর্ঘদিনের অদর্শনেও যে ম্লান হয়নি বন্ধুত্বের মহিমা সেটা টের পেলাম বই পেয়ে অকুণ্ঠে শুভেচ্ছা জানালেন যে সব বন্ধু ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ থেকে।
ভিন্ন ধারার নামকরা বাম বুদ্ধিজীবী লেখক, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ও টিভি টকশোর নন্দিত কথক দেখা হতেই বললেন, হ্যাঁ বই পেয়েছি আপনার, কয়েকটি গল্প তো আগেই পড়া আমার! আরও কেউ কেউ দেখা হতে মৃদু হেসে কিংবা টেলিফোনে গলা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, আরে এতদিন পরে! আপনি বেঁচে আছেন! এরি মধ্যে দেখা হলে প্রকাশকও একদিন বললেন, আপনার কয়েকজন পুরনো বন্ধু আপনার খোঁজ করে আমার কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নিয়ে গেছে। ফোনে কি কথা হয়েছে? হ্যাঁ আপনার বই সংগ্রহ করেছে তারাও। অপর এক কবি দোস্ত নিজ অফিসের পিয়ন পাঠিয়ে বই সংগ্রহ করলেন।
ক’জন যেচেই বললেন বইটার উপর লিখবেন। এদের মধ্যে অন্তত দুই জন কবি, একজন আবার বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত। আমার নাতিদীর্ঘ বইটার ওপর দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখবেন জানালেন আরেক বিজ্ঞ লেখক-বেশ কয়েক পৃষ্ঠা নাকি ইতোমধ্যে লিখেও ফেলেছেন, তবে ছাপবেন কোথায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন তিনি। তবে আমি যে কথাসাহিত্যিক বন্ধুকে চেয়েছিলাম আমার বইটির ওপর দু’চার কলম লিখুক (একাডেমি তাকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত হয়েছে), তিনি ‘আরে ভাই সম্প্রতি আমার হার্টের বাইপাস সার্জারি হয়েছে, ডায়াবেটিসে একেবারে কাবু হয়ে গেছি’ বলে এড়িয়ে গেলেন। ঘনিষ্ঠ আরেক কবি বন্ধু (একাডেমি পুরস্কৃত)-র বেলায় একেবারে উল্টো ঘটতে দেখা গেল, তখন বহুপঠিত এক দৈনিকের সম্পাদক তিনি; বইটি তাঁর দফতরে পৌঁছানো মাত্রই কালবিলম্ব না করে কভার ছেপে দিয়ে ২/৩ লাইন মন্তব্য ছেপে দিলেন পরদিনই তাঁর পত্রিকার পাতায়।
এককালে জনপ্রিয় কিন্তু বর্তমানে দ্বিতীয় সারির আর একটি দৈনিক বেশ যত্ন করে একটি আলোচনা ছাপল। আরেক বড়ভাই সম্পাদক-বলতে গেলে তাঁর কাগজও দ্বিতীয় সারির (প্রচারসংখ্যার হিসাবে), একেবারে আধাপৃষ্ঠা জুড়ে বইটির ওপর একটি উপসম্পাদকীয় লিখে ফেললেন। কেবল লিখেই ক্ষান্ত হলেন না; মনস্থ করলেন আলোচনাটি তিনি তাঁর আসন্ন প্রবন্ধ সংকলনে যুক্ত করবেন। প্রথম সারির যে দৈনিক পত্রিকাগুলিতে আমার কোন বইয়ের আলোচনা, এমনকি নামোল্লেখও হলো না-তাদের অসুবিধাটা আমি বুঝতে পারি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে-সেটা কেমন! ছাত্রজীবনের শেষদিকে কয়েক বছর রুচিশীল একটি সাপ্তাহিক কাগজের (বর্তমানে বিলুপ্ত) সম্পাদনা বিভাগে, বিশেষত সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি ডাকে প্রেরিত অনেক বইয়ের জায়গা হয় ফেলে-দেওয়া কাগজের ঝুড়িতে! কি বড় লেখক কি ছোট লেখক সব একাকার ওই ঝুড়িতে!
কতধরণের প্রায়োরিটি কাজ করে সম্পাদনায়-জনপ্রিয় দৈনিকের তো কথাই নেই-সব লেখকের বই পড়া দূরে থাক, এমনকি মোড়ক খোলারও সময় থাকে না। অনেক সময় পত্রিকার পাতার স্থানাভাব থাকে, আছে বিজ্ঞাপনের জবরদখল, আবার লেখক-সম্পাদকের নৈকট্য কিংবা দূরত্বও কম যায় না। অতএব সম্পাদকদের অনিচ্ছুক হাতের মুঠো গলিয়ে কখন যে আমার বইখানা নেমে গেছে আঁস্তাকুড়ে! ভাবলাম আমার এককালের সম্পাদকগিরি/লেখক হওয়ার মাশুল অন্তত ‘প্রাকৃতিকভাবে’ হলেও কিছুটা উশুল হল এবার। যাকে বলে পাপক্ষয়! পরিশেষে একটা বড়সড় পূর্ণাঙ্গ আলোচনা লিখলেন আমার বহুকালের শুভাকাক্সক্ষী ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত (সম্প্রতি প্রয়াত) মফস্বল নিবাসী দেশের স্বনামধন্য একজন প্রাবন্ধিক। বলা বাহুল্য বাংলা একাডেমি তাঁকেও প্রবন্ধ সাহিত্যে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে।
বইটির ভালোমন্দ নানা দিক উল্লেখ করে, বলা যায় ‘ইন-ডেপথ’ একটা সমালোচনা লিখে হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি সরাসরি পাঠিয়ে দিলেন আমার ঠিকানায়, ছাপানোর দায়িত্ব নিলেন না। হয়ত ভাবলেন অপরিচিত এক লেখকের বইয়ের ওপর আলোচনা দেখে সম্পাদক যদি আবার না ছাপান, তা’হলে তাঁর অপমান হবে। এখন এই লেখা নিয়ে আমি কি করি! দৈনিক পত্রিকার কথা তো বলেছিই। অনেক ভেবেচিন্তে এক বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম, তিনি নিজেও কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক-আবার জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদপত্রের এক করিৎকর্মা সাহিত্য সম্পাদক। সে-যাত্রায় তাঁরই সহায়তায় ওই সমালোচনার একটা সদগতি হল।
এরই মধ্যে আরেক রোমাঞ্চকর ঘটনা। একদিন কি একটা পেশাগত কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে আছি, মোবাইল বেজে উঠল, কণ্ঠস্বর অপরিচিত, ভদ্রলোকের নামটিও। বিখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার-সারা বছর জুড়ে প্রকাশিত বই থেকে বাছাই করে তাঁরা সেরা লেখককে পুরস্কৃত করেন। জানালেন এই বছর (২০১৪) বিচারকমণ্ডলী সেরা যে ৬টি বই পুরস্কারের জন্য ‘শর্টলিস্ট’ করেছে তাতে আমার বইও রয়েছে। বলতে কি, শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল-পুরস্কারের জগতে এদের নিরপেক্ষতার একটা সুনাম আছে। পুরস্কারের অর্থমূল্যও মন্দ নয়। আমার লম্বা ইন্টারভিউ করলেন, কি করি, কোথায় থাকি, কতদিন ধরে লিখছি, কেন লিখছি না কিংবা কেন এত কম লিখছি-কিছুই বাদ গেল না। প্রকাশকের কাছ থেকে ৬টি বই যোগাড় করল তাঁর প্রতিষ্ঠান। ক’দিন পর কাগজে দেখলাম, সে-বছর আরেকজন কথাসাহিত্যিক পুরস্কৃত হয়েছেন। মনকে প্রবোধ দিলাম ‘প্রতিযোগিতায়’ হেরে গেছি, তাতে কি রিয়ালিটি শো’র ফাইনালিস্ট তো!
বই প্রকাশের পর এইভাবে কয়েকটা মাস একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। কিঞ্চিৎ ফান মিশিয়ে এই অবস্থাটাকে ‘হানিমুন পিরিয়ড’-ও বলতে পারি!
দিন যায়। এক সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাসায় গেছি। সুরসিক বন্ধুর ফর্শা মুখখানা থমথমে, অনুমান করলাম বেশ বড় কোন হাসির বিষয় গুটিয়ে রাখছেন (যেমন কেশের আড়ে পাহাড়…)। বললেন, ভাই আমার টাকা ফেরত দেন, আপনার বইটা কিনেছিলাম, এবার ফেরত নেন; না হয় কিন্তু জরিমানার মাশুল গুনতে হবে। তা, ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলুন তো ভাই! ব্যাপার মানে…আমাদের ভেবেছেন কি আপনি-আপনার ওই প্যাঁচানো গদ্যের লেখা, ওহ আমার দাঁত ভেঙে গেছে ভাই! আচ্ছা লেখার কি আর কিছু পেলেন না আপনি, তা লিখলেন তো লিখলেন, সোজা কথা অমন প্যাঁচিয়ে-জড়িয়ে বলবার দরকার কি ছিল; নিন, পয়সা ফেলুন।
এইবার যেন আমার দৃষ্টি খানিকটা স্বচ্ছ হতে শুরু করল আর আমি যেন কিছু কিছু বুঝতে পারলাম কেন আমার তরুণী সহকর্মীরা বই পাঠের অভিজ্ঞতায় টুঁ শব্দটি করেননি। আমি ২/১ বার জিজ্ঞেস করাতে সভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফের কাজের ব্যস্ততায় নিজেদের গুঁজে দিয়েছিলেন। অপর সহকর্মী প্রাক্তন আঁকিয়ে ও চলচ্চিত্রকর্মী আমার দিকে ছুড়ে দিলেন অন্তর্ভেদি দৃষ্টি-ওই একবারই; ফের নিজকে সঁপে দিলেন কমপিউটারের হিজিবিজি পর্দায়। আমার ফ্ল্যাটের নিচতলার ওই গৃহবধূ (বইয়ের প্রথম ক্রেতা) আর আমার খোঁজ নিয়েছিল কিনা-সে-কথা স্ত্রীকে বার দুই জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর পেলাম না। কলেজ পড়ুয়া গোধূলীলগ্নের সেই তরুণীকে একবার সিঁড়ির গোড়ায় দেখেছিলাম। আমাকে দেখেই চট করে সালাম দিয়ে একপাশে দেয়ালের সাথে একেবারে সেঁটে দাঁড়িয়েছিল।
এক ছুটির দিনে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে এসে আনন্দমোহন কলেজের স্নাতকোত্তর শ্যালিকা অনুযোগের স্বরে জানালেন তাঁর বাচ্চাদের অভিভাবকদের যাদেরই বইটা দিয়েছেন নগদ টাকা দিয়ে হাসিমুখে বইটা নিয়ে ব্যাগে পুরেছেন তাঁরা; কিন্তু ওই পর্যন্তই। ওই সব কি লিখেছি আমি, ওই কি বাংলা ভাষা! গল্প হবে সহজ সরল আনন্দে ভরা, দুঃখও থাকবে, থাকবে না কেন-দুঃখ কি মানুষের জীবনে নাই! কিন্তু তাদের জীবনের সাথে বেশ মিলে যায় ওই রকম একটি লেখাও তো নাই বইয়ে! পরন্তু অমন কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে পাঠকদের শারিরীক বিপর্যয় ঘটানোর কি মানে থাকতে পারে! আমার মনে হলো শ্যালিকার অনুযোগের মধ্যে তিনি যে তাঁর বান্ধবীমহলে আরও একটু মর্যাদা বাড়ানোর সুযোগটা হারিয়েছেন সেই বেদনাও মিশে থাকতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভায়রা এসে সামাল দিতে চাইলেন। তিনি বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা হলেও এককালের ডাকসাইটে নাট্যকর্মী, হুমায়ূন আহমেদের (শরৎচন্দ্রের নয়) পাঁড় ভক্ত। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, আপনি চালিয়ে যান তো ভাই, হাল ছাড়বেন না, এ বছরও বই বের করুন, প্রতি বছর একটি করে বই করুন-আরে কি আছে এভাবেই তো হয়। লেগে থাকুন, লেগে থাকতে হয়!
আরও অনেক কাল আগের কথা। এক বৃষ্টিবিহ্বল বিকেলবেলায়। পাবলিক লাইব্রেরিতে চলচ্চিত্রকর্মীদের এক আয়োজনে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় সেলিম আল দীনের কাহিনিভিত্তিক ‘চাকা’ ছবিটি দেখেছিলাম। নিঃসন্দেহে ইসলামের সেরা কাজের একটি। একটি বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে দুই গরুগাড়ি চালক রওয়ানা হয়। কেউই লাশটি দাফনের দায়িত্ব নেয় না-না মসজিদের ইমাম, না কোন এলাকার গ্রামবাসী-ওই লাশ কার-কি তার নাম ঠিকুজি, কি তার ধর্মীয় পরিচয়! মাঠ প্রান্তর পথ পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে-পঁচে ওঠে সেই লাশ! শেষমেষ দিনের শেষে এক মেঠো নদীর ধারে দুই গাড়িওয়ালা নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে সেই লাশ কবরস্থ করে। অতঃপর হু হু করে কেঁদে ওঠে তারা।
নিজের বইটি নিয়ে কিংবা আর একটুখানি বদলে নিয়ে এভাবে বলা যায় যে বইয়ের চরিত্রগুলি আজ যেন আমায় সেই শেষ বিকেলে দেখা ‘চাকা’ ছবিটির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। গল্পের সেই মাঝি নীলমনি, দুঃখিনী আসমাবিবি, চোখে-ছানি-পড়া বৃদ্ধ হরকুমার, নাম-গোত্রহীন মুক্তিযোদ্ধা কসিমুদ্দিন, হবিবর মৌলবীর বৌ গরিব রবিউলের মা কবেই মরেছে ওরা-এদের লাশ নিয়ে আমি এখন কোথায় যাই! এদের সৎকারের দায়ভার কার! আর দেখুন কিনা কী বুকের পাটা, এই চরিত্রগুলির সিক্যুয়েলে আমি কিনা আবার আমার নতুন গদ্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করছি! এখনও সাহস হারাইনি মাত্র দুই জন-আমি ও আমার প্রকাশক।
লেখক : সৈয়দ কামরুল হাসান : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।
আরও পড়ুন…