শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নাম প্রথম শুনি কলকাতা নিবাসী সত্যকিরণ আদিত্যের মুখ থেকে। তা অন্তত বছর পঁচিশেক আগে। তখন আমি কলেজে পড়ি। টুকটাক এটাসেটা লিখি আর শখের বশে স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা করি। ওই সময় নেত্রকোনায় বেড়াতে এসে স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর এক অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রবীণ সত্যকিরণ আদিত্য। তিনি একসময় নেত্রকোনা মহকুমা অঞ্চলের বাম রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। দেশভাগ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে পরিবার নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। সেখানে কিছুকাল শিক্ষকতা করে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পান। কলকাতায় তিনি ‘নেত্রকোণা সম্মিলনী’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটি এখনও সক্রিয়।
কানায় কানায় পূর্ণ পাবলিক লাইব্রেরির ওই অনুষ্ঠানে সত্যকিরণ আদিত্যের বক্তৃতাই ছিল দর্শক-স্রােতাদের মূল আকর্ষণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে নানা আলোচনার পাশাপাশি শৈশব-কৈশোর এবং রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুন্দর বক্তৃতা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা থেকেই জানতে পারি, শান্তিনিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম জন্মজয়ন্তী পালিত হয়েছিল আমাদের নেত্রকোনায়। আর এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
নেত্রকোনার আগে বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের আর কোথায়ও রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের খবর পাওয়া যায়নি। সত্যবাবু আরও জানালেন, এটা হয়ছিল শৈলজারঞ্জনের পৈতৃক ঠিকানা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে। আর তাঁদের বাসা ছিল নেত্রকোনা শহরের সাতপাই সড়কে অবস্থিত থানার পাশে, বর্তমানে যেখানে বায়তুল আমান মসজিদ ও খানকা শরিফ অবস্থিত। সত্যবাবু বলেন, নেত্রকোনায় প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের পর কবিগুরু অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এবং শৈলজারঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। সত্যকিরণ আদিত্যের বক্তৃতা থেকেই জানতে পারি, শৈলজারঞ্জন মজুমদার পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করেন এবং একসময় কবি তাঁকে সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। কবির অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সত্যকিরণ আদিত্যের মুখ থেকে শোনার পরপরই শৈলজারঞ্জনের নামটি আমার মনে গেঁথে যায়। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করি, নেত্রকোনার এই কৃতী মানুষটি সম্পর্কে আমাকে আরও বিশদ জানতে হবে। সম্ভব হলে তাঁকে নিয়ে লিখতেও হবে। কিন্তু লেখালেখিতে তখনও আমি অতটা পারদর্শী হয়ে উঠিনি। তাছাড়া বয়সও খুব কম। এ কারণে সত্যকিরণ আদিত্যের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ করতে পারিনি, ঠিক ততটা আগ্রহও দেখাইনি। কিন্তু নীরবে-নিভৃতে আমি ঠিকই শৈলজারঞ্জনকে খুঁজতে থাকি, তাঁর সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান করতে থাকি। একটা সময়ে এসে অনুধাবন করি, শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নেত্রকোনার প্রবীণদের অনেকে চিনতেন, তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জানতেন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে কোনো প্রবন্ধ বা গ্রন্থ রচনার মতো প্রমাণ-নির্ভর তথ্য কারও সংগ্রহে নেই। এর একটি কারণও আছে।
শৈলজারঞ্জনের শুধু বাল্যকাল কেটেছে নেত্রকোনায়। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান। সেখানেই কাটিয়ে দেন সারাটা জীবন। শান্তিনিকেতনে থিতু হওয়ার তিন দশক পর ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন। এরপর আরও দুইবার আসেন ১৯৭৫ ও ১৯৮৬ সালে। তাও খুব বেশি দিনের জন্য নয়। এসব কারণে এখানকার স্বধীনতা-উত্তর প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞাত নন। বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য বা ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু কেবলমাত্র নাম ছাড়া তাঁর সম্পর্কে খুব একটা জানেন না কেউ। এ ছাড়া তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে খুব একটা লেখালেখিও হয়নি। এসব কারণেই এখানকার লোকেরা তাঁর সম্পর্কে খুব ভালো জানেন না।
তবু আমি লেগে থাকি। শৈলজারঞ্জনকে যারা দেখেছেন বা তাঁর সম্পর্কে যারা কিছুটা হলেও জানেন, তাদের কাছ থেকে টুকটাক করে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। যেখানে যা পাই, তা খড়কুটোর মতো কুড়াতে থাকি। একসময় ‘নেত্রকোনার বাতিঘর’ খ্যাত প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎস কুন্তল বিশ্বাস -এর কাছ থেকে একটি ভাঁজপত্র (স্মরণিকার মতো) হাতে পাই। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সত্যকিরণ আদিত্যের সম্পাদনায় কলকাতার ‘নেত্রকোণা সম্মিলনী’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এ ভাঁজপত্রটি। নেত্রকোনায় রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালনের বিষয়টিই ছিল ভাঁজপত্রের মূল বিষয়। এতে শৈলজারঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটিও ছাপানো হয়েছিল। এর সঙ্গে আরও ছিল চল্লিশের দশকে নেত্রকোনায় ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
কুন্তল বিশ্বাস সত্যকিরণ আদিত্যসহ কলকাতার ‘নেত্রকোণা সম্মিলনী’র সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ‘নেত্রকোণা সম্মিলনী’ সুনেত্র নামে একটি স্মরণিকাও প্রকাশ করত প্রতিবছর। কুন্তল দার কাছে ম্যাগাজিনটি পাঠানো হতো।
তাতে আমরাও অনেকে নেত্রকোনা থেকে লেখা পাঠাতাম। এ ম্যাগাজিনটিতে কলকাতায় পাড়ি জমানো নেত্রকোনার লোকেরা এখানকার বিভিন্ন স্মৃতিকথা নিয়ে লিখতেন। শৈলজারঞ্জনকে নিয়ে দু-একটি ছোটখাটো নিবন্ধ লিখেছেন কেউ কেউ। বলতে গেলে এ লেখাগুলোই আমাকে শৈলজারঞ্জনকে খুঁজে বের করবার উৎসবমুখ খুলে দেয়।
উল্লিখিত লেখাগুলোর বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে ২০১২ সালে আমি ‘রবীন্দ্রনাথ, শৈলজারঞ্জন ও নেত্রকোনা’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি। ওই বছরের ৪মে দৈনিক জনকণ্ঠের একটি বিশেষ সংখ্যায় তা ছাপা হয়। লেখাটি পড়ে অনেকে আমাকে ধন্যবাদ জানান। এতে শৈলজারঞ্জনকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আরও বাড়ে। তাঁর সম্পর্কে আরও তথ্যানুসন্ধানে মনোনিবেশ করি। এ পর্যায়ে এগিয়ে আসেন আমারই মতো আরেক তরুণ মুহাম্মদ আকবর। বর্তমানে ‘আমাদের সময়’ এর সাংবাদিক। মোহনগঞ্জের সন্তান আকবরও আমার মতোই শৈলজারঞ্জন সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু। তিনি তখন আমার চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনায় হাত দিয়ে বসেন। জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার লেখাটিও যুক্ত করেন তার স্মারকগ্রন্থটিতে। পাশাপাশি শৈলজারঞ্জনকে নিয়ে আরও অনেকের স্মৃতিকথা সন্নিবেশিত।
আরও পড়ুন – ফিরে দেখা প্রথম বই : তক্ষক ও অন্যান্য গল্প
আকবরের সম্পাদনায় প্রকাশিত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মারকগ্রন্থ থেকেও আমি নতুন কিছু তথ্য পাই। স্মারকগ্রন্থের পর শৈলজারঞ্জনের রচনাবলিও সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন আকবর। আমার আগ্রহের কথা জানতে পেরে তিনি আমাকে আরও বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত এবং রেফারেন্স বই পাঠিয়ে সহযোগিতা করেন। বিভিন্ন সময়ে তাগাদা দিয়ে অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু বড় সমস্যা ছিল, একটি বই রচনার মতো পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে একটি জীবনীগ্রন্থে যেসব প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতে হয়, তার অনেক ঘাটতি ছিল। কাজটি হালকাভাবে করতেও চাইনি আমি।
এরই মধ্যে আমি দুইবার পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু খুব একটা কিছু পাইনি। তাঁর সমকালীন বা সহকর্মীদের কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাছাড়া তাঁর কোনো সন্তান-সন্তুতিও নেই। কলকাতার বর্তমান সময়ের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কেউ কেউ তাঁর নাম শুনলেও খুব বেশি কিছু জানেন না। তাঁর সম্পর্কে ভালো তথ্য জানেন, এমন কারও সন্ধান আমি বের করতে পারিনি। তবে কিছু যে পাইনি, তাও নয়। একেবারে খালি হাতেও ফিরিনি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও রবীন্দ্রসংগীতের সাধক ড. নূরুল আনোয়ারের সঙ্গে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা আগে থেকেই জানা ছিল আমার। বহুবার চেষ্টা করি তার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করার। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যূব্জ স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর সম্পাদনায় ২০০০ সালে ময়মনসিংহের রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ থেকে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রসংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার জন্মশতবর্ষ’ নামের একটি ছোট পুস্তিকা আমার হাতে আসে। এ পুস্তিকাটিতেও শৈলজারঞ্জন সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়ে যাই আমি।
এরপর আস্তে আস্তে সংগ্রহ করি কলকাতা থেকে প্রকাশিত শৈলজারঞ্জনের লেখা বই- ‘রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ’, তাঁর ভ্রাতৃবধূর অনুলিখন করা শৈলজারঞ্জনের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’, কলকাতার অমলেন্দু সাঁই এবং ড. ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আরও অনেকের লেখা কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ। কিন্তু এরপরও কিছু তথ্যের ঘাটতি ছিল। যা পূরণ করতে সক্ষম হই শৈলজারঞ্জনের মামাতো ভাই কলকাতাবাসী সুব্রত সেন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরে।
বলা যায়, ইন্টারনেট সংযোগ এ সুযোগটি করে দেয়। ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে আমি তার কাছ থেকে যখনই যা জানতে চাই, তিনি তার স্মৃতি থেকে অথবা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমাকে উত্তর দেন। এদিকে আকবরও বিভিন্ন সময়ে বইটির কাজ শুরু করার তাগাদা দিতে থাকেন, যা আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়।
বিভিন্নজনের লেখা রেফারেন্স বই, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার এবং চিঠিপত্র নিয়ে আমার ঘরে শৈলজারঞ্জন সম্পর্কিত বেশ বড়সড় একটি আর্কাইভ গড়ে ওঠে। তা ঘাঁটাঘাঁটির পর একদিন মনে হয়, এবার একটি পরিপূর্ণ জীবনীগ্রন্থ রচনায় হাত দেয়া যেতে পারে। সাহস করে শুরুও করে দিলাম। লিখতে গিয়ে যখনই যে প্রশ্নের উদ্রেক হল, তাৎক্ষণিক তা সুব্রত সেন অথবা অন্যদের কাছ থেকে জেনে নিতে থাকলাম। প্রতিদিন প্রায় তিন-চার ঘণ্টা করে টানা বেশ কিছুদিন লিখলাম। একটানে লিখতে গিয়ে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তবে উচ্চ রক্তচাপের (ব্লাড প্রেশার) সমস্যা কিছুটা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বলে থামতে হয়নি।
পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার পর মনে হলো, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞাত আছেন। তাঁকে একবার পাণ্ডুলিপিটা দেখানো যায়। একদিন পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হলাম স্যারের বাসায়। কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর কম্পোজ করা পাণ্ডুলিপিটা হাতে দিয়ে বললাম, ‘স্যার, এটা একটু পড়ে দেখবেন। পড়ার পর যদি আপনি অনুমতি দেন, তবেই ছাপব।’ আমি জানি স্যার যা বলবেন, ভেবেচিন্তেই বলবেন।
পরদিন বেলা ১১টার দিকে অফিসে বসে আছি। হঠাৎ স্যারের ফোন : ‘এই তুমি তো একটা বিরাট কাজ করে ফেলেছ। শৈলজারঞ্জন সম্পর্কে এত কিছু তুমি কীভাবে পেলে? কোথায় পেলে? আমি নিজেও তো এতকিছু জানতাম না! অবশ্যই তোমার এটা ছাপাতে দেয়া উচিত। তুমি বিকেলে আসো।’
বিকেলবেলা আবার স্যারের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আগের কথাগুলোই বললেন স্যার। পান্ডুলিপিটা হাতে দিয়ে বললেন, ‘কিছু বানান আমি সংশোধন করে দিয়েছি। এগুলো ঠিক করে নিও।’ আমি অনুরোধ করলাম- ‘স্যার, একটা ভূমিকা লিখে দেন।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি তো এখন আর লিখতে পারি না। আমি বলে দিচ্ছি, তুমি কাগজে লিখে নাও।’ আমি কাগজকলম নিয়ে স্যারের সামনে বসে গেলাম। এভাবে যতীন স্যারের লেখা একটা চমৎকার ভূমিকাও পেয়ে গেলাম, যা নিঃসন্দেহে আমার বইটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
এবার মুহাম্মদ আকবরের সহযোগিতা চাইলাম। বললাম, ‘একজন ভালো প্রকাশকের সন্ধান চাই। যিনি যতেœর সঙ্গে বইটা করবেন।’ আকবর চারুলিপি প্রকাশনীর হুমায়ূন কবিরের নাম বললেন। জানালেন, তার সম্পাদনায় প্রকাশিত শৈলজারঞ্জনের রচনাবলিও হুমায়ূন বের করেছেন। এরপর আকবর আমাকে প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আকবরই আবার প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টুকে দিয়ে আঁকালেন বইয়ের প্রচ্ছদ। হুমায়ূন সাহেব ২০২০ সালের মেলায় আনলেন বইটি। আমি জানি, মেলায় এসব বইয়ের খুব একটা কাটতি নেই। তাই সাহস করে প্রকাশককে ফোন দিই না। আকবরকেও জিজ্ঞাসা করি না কিছু। নিজে কয়েকটা বই সংগ্রহ করে নিই।
বই প্রকাশের কয়েক দিন পর এক বিকেলে ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের (আমি যাঁকে বইটি উৎসর্গ করেছি) বড়পুত্র বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আমাকে ফোন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আরেক দিন ফোন করলেন তার ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান। তারা বইটির খুব প্রশংসা করে বললেন, ‘আপনি পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। খুব ভালো কাজ করেছেন।’ শুধু তারাই নন, এমন আরও অনেকে ফোন করে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, যা আমাকে মানসিকভাবে পরিতৃপ্ত করেছে। একদিন মতীন্দ্র স্যার (অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার) স্বপ্রণোদিতভাবে বললেন, ‘আমি তোমার বইটির রিভিউ লিখব।’ এরই মধ্যে কয়েকজন রিভিউ লিখেছেনও। এগুলোই আমার পরম প্রাপ্তি।
আরও কিছু বিশেষ প্রাপ্তি আছে। একদিন পশ্চিমবঙ্গের উদীয়মান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, বিশ্বভারতীর ছাত্র কৌশিক সরকার ফোন করে জানালেন, তিনি শৈলজারঞ্জনের সংগীত-সাধনার বিষয় নিয়ে পিএইচডি করছেন। কোনো এক মাধ্যমে আমার বইয়ের খবর পেয়েছেন তিনি। বইটি সংগ্রহও করেছেন এবং তার গবেষণার রেফারেন্স হিসেবে বইটির পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করছেন। এখনও প্রায় সময় আমার কাছ থেকে এটা-ওটা জানতে চান তিনি। আমি তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতার চেষ্টা করি। আমাদের শৈলজারঞ্জনকে নিয়ে পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে, এটা শুনতেও ভালো লাগে।
আমি পেশায় সাংবাদিক। শখের বশে সাংবাদিকতার বাইরে কিছু লেখালেখি করি। আমার লেখার মূল বিষয় ছড়া এবং লোকসাহিত্য। জীবনীগ্রন্থ লেখা আমার লেখালেখির বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু দু’টি বিশেষ কারণে আমার এ বই লেখার আগ্রহ জন্মেছিল। প্রথম কারণটি হচ্ছে, শৈলজারঞ্জন আমার জন্মভূমি নেত্রকোনার একজন কৃতী সন্তান। এমন একজন সু-সন্তানকে জন্ম দিতে পেরে নেত্রকোনার মাটি ধন্য। আরও ধন্য শৈলজারঞ্জনের উদ্যোগে নেত্রকোনায় প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করতে পেরে। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমার নেত্রকোনা জেলার বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা জ্ঞাত নয়। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, শৈলজারঞ্জনের মতো একজন গুণী মানুষের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ ছিল না। বাংলাদেশে তো বটেই, সমগ্র ভারতবর্ষেও ছিল না। ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ নামে তাঁর ভ্রাতৃবধুর অনুলিখন করা একটি স্মৃতিচারণগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এটিও বর্তমান বাজারে দুষ্প্রাপ্য। আমার এ বইটি শৈলজারঞ্জন সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কিছুটা হলেও খোরাক জোগাবে। যারা রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসেন অথবা রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে গবেষণা করেন- এ বইটা তাদের সাধনায় কিছুটা সহযোগী হবে বলে বিশ্বাস করি।
আরও পড়ুন – ফিরে দেখা প্রথম বই : তক্ষক ও অন্যান্য গল্প