প্রকাশক, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান খোকা। ১৯৭১ সালে কিশোর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রাাণবাজি রেখে লড়াই করেছেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে একটি মননশীল জাতি গঠনে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান- বিদ্যাপ্রকাশ। এ পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন প্রায় দেড় হাজার বই। দেশের প্রকাশনা শিল্পকে এগিয়ে নিতে নিয়েছেন নানা ধরনের উদ্যোগ। এ খাতের অনেক ‘প্রথম’ কাজটি তাঁর হাত দিয়েই বাস্তবায়ন হয়েছে। এই সময়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভালো বইয়ের তথ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে, লেখককে পাঠকের কাছে পরিচিত করতে করোনাকালে অনলাইনে বেশকিছু অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। মানসম্মত পাণ্ডুলিপি বাছাই, একটি ভালো বই প্রকাশ ও বিপণন করতে তাঁর চেষ্টার অন্ত নেই। তাঁর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, বইপ্রকাশ ও বিপণন, পেশাদারিত্ব, বিদ্যাপ্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট নানা প্রসঙ্গ। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বই সম্পাদক ও প্রকাশক ফয়সাল আহমেদ
এবং বই : আলাপের শুরুটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই করি। যুদ্ধ শুরু হলো। সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। কিশোর বয়সে ভারতে গেলেন ট্রেনিং নিতে, কীভাবে গেলেন, পরিবার থেকে বাধা আসেনি? তখন এত কম বয়স!
মজিবর রহমান খোকা : আমরা তো জানি তখন আওয়ামী লীগের হাতে, বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে। বাঙালি স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, ২৩ বছর পর প্রথম পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা বাঙালিদের হাতে আসবে। আমরা তখন সেই আনন্দে মত্ত ছিলাম। তার পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি, পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। তখন আমরা নাটোরে ছিলাম। আমি তখন এসএসসি ফাইনাল দেবো। পড়াশোনার চাপ ছিল, একইসাথে জাতীয় নির্বাচনে জয়ের আনন্দও ছিল। কিন্ত সেটা স্থায়ী হলো না, পঁচিশ মার্চ মধ্যরাতে হামলা শুরু হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। সারা জাতি তখন স্তম্ভিত হয়ে আছে। কী হবে, কী হচ্ছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। নাটোর শহরের অফিসের বাইরে গ্রামের দিকে আব্বার আরও একটি অফিস ছিল। সেখানে আম্মা ও অন্য ভাই-বোনদের পাঠানো হলো আগের দিন, পরের দিন আমরা রওনা হলাম। এপ্রিলের ১৪/১৫ তারিখের দিন পাকবাহিনী ভারি অস্ত্রসস্ত্রসহ গুলি করতে করতে শহরের দিকে ঢুকছে। এসময় আমরা ওদের সামনে পড়ে যাই…
এবং বই: পাকবাহিনী নাটোর শহরে ঢুকছে, আপনারা বের হচ্ছেন?
মজিবর রহমান খোকা : হ্যাঁ। ঐ সময়ে শহরে ঢোকার রাস্তা ছিল একটাই। চারদিক ফাঁকা ছিল। আশেপাশে কোনো বাড়ি-ঘর ছিল না। তবুও সৌভাগ্যক্রমে আমরা একটি বাড়ি পেলাম। ফাঁকা বাড়ি, আমরা সেখানে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করলাম। এরপর আব্বার সাইট অফিসে যাই। ততক্ষণে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে নৌকায় করে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা করি। তখন কুমিল্লা জেলা ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা আর বাঞ্ছারামপুর থানা। সেখানকার একটি অজপাড়াগাঁ তেজখালী আমাদের বাড়ি। আমরা সেখানে চলে গেলাম। এরপর বাড়িতে থাকা অবস্থায় চারদিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছি। কামানের গোলার আওয়াজ পাচ্ছি।
সিএণ্ডবি রোড ছিল যেটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক, সেখান থেকেও আওয়াজ পেতাম। দূরে দূরে গ্রামগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে পাকবাহিনী। আমরা নৌকায় গ্রামের বাড়িতে আসার সময় দেখেছি পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। নদীতে মানুষের লাশ ভাসছে, পশু-পাখির মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। নদী পথে আসতে দশ দিন লেগেছিল আমাদের। এই সময়ে দুইবার অলৌকিকভাবে আমরা বেঁচেও গিয়েছি। এসব দেখে আমাদের মনে ক্ষোভ জন্মেছে, প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ হচ্ছে শুনছি, দেখছি কিন্তু যুদ্ধ করতে হলে কোথায় যেতে হবে; কার কাছে যেতে হবে, তেমন কিছুই জানি না।
মে মাসের ৩০ তারিখের দিকে আমাদের বাড়ির নদীর ঘাটে ছোট্ট একটি নৌকা এসে ভিড়লো। নৌকা থেকে আর্মসসহ কয়েকজন নেমে এলেন। এই তিতাস নদীরকোল ঘেঁসেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে গেল। আমরা ধারণা করছি নিশ্চয়ই ওরা রাজাকার, আর্মস নিয়ে এসেছে, হত্যাযজ্ঞ চালাবে। আবার আলোচনা হচ্ছে আব্বা দীর্ঘদিন ধরে অফিস করছেন না, তারা আব্বাকে ধরে নিতে এসেছেন কী না। ভয়ে তখন অনেকেই গ্রাম ছাড়তে উদ্যোগি হলো। তারা বললো- ‘ভয়ের কিছুই নেই। আপনারা ভয় পাবেন না। আমরা আগরতলা থেকে এসেছি, ঢাকা যাবো। আমরা মুক্তিযোদ্ধা।’
এ সময় তারা বাসার একজন সিনিয়রের সাথে কথা বলতে চাইলো। আব্বা তখন তাদের সাথে কথা বলে নদীর ধারে আমাদের বাংলা ঘরটায় বসতে দিলেন। তারা খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিলেন। তারপর আমি গিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলাম- মুক্তিযোদ্ধা হলে কী করতে হবে? তখন তারা বললো, এখান থেকে কারো একজনের রিকমেন্ডেশন নিয়ে আগরতলা যেতে হবে। আগরতলায় অনেকগুলো রিক্রুট ক্যাম্প আছে। তারপর সেখান থেকে ট্রেনিং নিতে হবে। এসব তখন কিছুই বুঝতাম না। তবে খোঁজ করতে লাগলাম, এলাকায় কে আছেন, যিনি এই রিকমেন্ডেশন দেন, রিক্রুট করে আগরতলা পাঠান। অবশেষে সেই ব্যক্তিকে পেয়ে গেলাম।
তখন আমি আর আমার বন্ধু মুর্শিদুল ইসলাম, আমরা একই ক্লাসে পড়ি, একসাথে এসএসসি দেয়ার কথা। তখন সেই ব্যক্তি সামসু ডাক্তার আমাদের আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। জুলাইয়ের ২৫ তারিখ আমরা দশজন মিলে যাত্রা করলাম। নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে সর্বশেষে বাসে করে আগরতলা পৌঁছলাম। তারপর রিক্রুট ক্যাম্পে যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। আমরা তখন কোথায় থাকবো, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। ক্যাম্পের পাশেই একটা পোস্ট অফিস ছিল। আমরা এর বারান্দায় কোনোরকমে রাতটা কাটালাম। সকালে উঠে কংগ্রেস ভবনে গেলাম। সেখানে আমাদের রিক্রুট পর্ব শেষ হলো। ভারতীয় কর্নেল বাগচি এই কাজটি করলেন। এর তিন দিন পর আমাদের ট্রাকে করে পাঠানো হলো ট্রেনিং ক্যাম্পের উদ্দেশে, ১৪টি ট্রাক একসাথে চলছে। উঁচুনিচু পথ, পাহাড়ি এলাকা।
আমাদের মধ্যে অনেকেই তখন বমি করছিল। আমরা তো সমতল ভ‚মির মানুষ। এমন পথচলায় আমাদের তো অভ্যাস নেই। ঠিক পরেরদিন বিকালে আমরা ত্রিপুরা থেকে আসাম পৌঁছাই। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট লোহারবন, সেখানেই আমাদের চার সপ্তাহের বেসিক ট্রেনিং হলো। এরপর আরো দুই সপ্তাহের জুনিয়র লিডারশীপ উইংস ট্রেনিং হলো। তারপর চার নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাবসেক্টরে পাঠানো হলো যুদ্ধের জন্য। ওখানে কিছুদিন যুদ্ধের পর আবার আগরতলা হয়ে দুই নম্বর সেক্টরের কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর থানায় যুদ্ধের জন্য চলে আসি। তখন অক্টোবর মাস প্রায় শেষের দিকে।
এবং বই : এই যে গেলেন, পরিবার থেকে বাঁধা আসেনি?
মজিবর রহমান খোকা : না। তেমন কোনো বাধা আসেনি। আম্মা কিছুটা মন খারাপ করেছিলেন। তবে তাঁরা কেউ বাঁধা দেননি। আর বাঁধা দিয়ে তো লাভ নেই। যেভাবেই হোক আমি যাবোই।
এবং বই : ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরলেন যুদ্ধ করতে…
মজিবর রহমান খোকা : হ্যাঁ। তার আগেও আমি যুদ্ধ করেছি। ৪ নম্বর সাব-সেক্টর জালালপুরে। একবার বাঞ্ছারামপুরে তিতাস নদীর ধারে মাত্র তিরিশগজ দূরত্বে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করেছি। যেটা আমার কোম্পানি কমান্ডারও পছন্দ করেনি।
এবং বই : শুনেছি নদীতেও যুদ্ধ করেছেন? মুক্তিযুদ্ধে ‘নদী’ কতটা সয়াহক ছিল আপনাদের জন্য?
মজিবর রহমান খোকা : হ্যাঁ, নদী তীরে যুদ্ধ করেছি। দেখুন বাংলাদেশ তো নদীমার্তৃক দেশ। নদী আমাদের জন্য যথেষ্ট সহায়ক ছিল। যুদ্ধের সময় নদী পারাপারের ক্ষেত্রে নৌকা না পেলে আমরা সাঁতরে পার হয়েছি, কিন্তু পাকিস্তানিরা তো সাঁতার জানতো না। তারা নদীর পানিকে ভয় পেতো। লঞ্চ ছাড়া তারা কোথাও যেতো না। ওরা যে সুযোগটা পেয়েছে, সেটা হচ্ছে আলবদর, রাজাকারের সহযোগিতা, তা না হলে ওরা আরও আগেই পরাস্ত হয়ে যেতো।
এবং বই : ‘একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকথা’ নামে আপানার একটি বই আছে। বইটি সম্পর্কে বলুন…
মজিবর রহমান খোকা : বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এর অষ্টম মুদ্রণ পর্যন্ত পাঠকের হাতে গিয়েছে বলে জানি। তবু এতে আমি অতৃপ্ত। বইতে আরও অনেককিছু যুক্ত করার ছিল, আমি তা করতে পারিনি। কারণ আমার স্মরণে ছিল না। দিন-ক্ষণ অনেককিছু মনে ছিল না। বিধায় আমি লিখতেও পারিনি। লিখলে অসম্পূর্ণ থাকবে তাই লিখিনি। বইটি আমি লিখেছি একজন কিশোর হয়ে, কিশোরদের উপযোগী করে। সামনে নবম সংস্করণ হবে, আমি চেষ্টা করছি, আমার সহযোদ্ধা বন্ধুদের সাথে কথা বলে অসম্পূর্ণ অংশটার পূর্ণতা দিতে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বইটির নতুন সংস্করণ আসতে পারে।
এবং বই : যতদূর জানি আপনার আরও বই আছে…
মজিবর রহমান খোকা : আমি ১৯৯৫ সালে শিশুদের জন্য একটি বই লিখেছিলাম। বিদেশি বইয়ের অনুকরণে চাররঙ্গা একটি বই। বাচ্চারা বইটি ভীষণভাবে পছন্দ করেছিল। বইটির দাম রেখেছিলাম ৩৫ টাকা। মূল্য হিসাবে শুধু কস্টটা ধরা হয়েছিল। বাড়তি মূল্য যুক্ত করিনি। কারণ ধ্রুব এষ বইটির ডিজাইন করেছিল, প্রচ্ছদও করেছিল। ও কোনো টাকা নেয়নি। গ্রাফিক্স স্ক্যান যারা করেছিল ওরা কোনো টাকা নেয়নি। যে প্রেস থেকে ছাপা হয়েছে তারাও কোনো টাকা নেয়নি, এমন কী কাগজ যে কিনতে হয়েছে, তাও আরেকজন কিনে দিয়েছে। মোটকথা, বইটিতে আমার কোনো পয়সা লাগেনি। বইটি তখন সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ খুব পছন্দ করেছিলেন। তারাও তখন এমন ধরনের বই করার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। পরে লুৎফর রহমান রিটন, আহমদ মাজহার এমন ডিজাইনের বই করেছেন। আমি চেয়েছি ভূত-পেত্নি নয়, এমন গল্প দিতে, যাতে বাচ্চাদের নৈতিকতা বিকাশে কাজে লাগে। এর বাইরে আরও দুই-একটি সম্পাদনা বই আছে।
এবং বই : নতুন বই কী লিখছেন?
মজিবর রহমান খোকা : একটি নতুন বই লেখার ইচ্ছে আছে, জানি না করতে পারবো কী না। আমি আসলে লেখক নই। মনের খেয়ালে লিখি।
এবং বই : বইটি কি আত্মজীবনী?
মজিবর রহমান খোকা : আত্মজীবনী না। আত্মজীবনী লেখা তো কঠিন কাজ। ধরেন যেমন সময়ের প্রয়োজনে কিছু কাজ করা দরকার ছিল, কেউ করেনি, আমি করেছি। এরমধ্য দিয়ে সমাজের উপকার হয়েছে, পাঠকদের উপকার হয়েছে, প্রকাশকদের উপকার হযেছে। তারই অভিজ্ঞতা লিখবো, অল্প অল্প করে।
এবং বই : কথা ছিল শিল্পী হবেন, গান শিখেছেন, সেভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন, টেলিভিশনেও গান গেয়েছেন। কিন্তু না! শেষ পর্যন্ত হলেন- প্রকাশক, লেখক। জীবনের শুরুতেই বাঁকবদল?
মজিবর রহমান খোকা : জীবনে কখনো প্রকাশক হবো, এই চিন্তা ছিল না। চিন্তা ছিল চাকরি করবো, সরকারি চাকরি। আর গান গাইবো। গায়ক হবো। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, মামা সরকারি চাকরি করতেন। এর প্রভাব ছিল। গানটা নিজের ইচ্ছে থেকেই শেখা। কোনো ইনস্টিটিউশন থেকে শিখিনি। পারফেক্টলি শেখার চেষ্টা করেছি নিজে নিজেই। স্বরলিপি দেখে গান করার চেষ্টা করেছি। গানের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে আব্বা আমাকে ১৯৭৪ সালে একটি টুইনওয়ান ৩ হাজার টাকায় কিনে দিয়েছিলেন।
এবং বই : এই যে শিল্পী হতে পারলেন না, এ নিয়ে আক্ষেপ নেই?
মজিবর রহমান খোকা : আমি যখন বড় দুলাভাইয়ের ব্যবসায় যুক্ত হলাম তখন গানটা চালিয়ে নেয়া কষ্ট হচ্ছিল। সমন্বয় করা যাচ্ছিল না। আমি যখন টিভিতে গান করতে যেতাম, তখন ব্যবসার ক্ষতি হতো। কারণ ব্যবসাটা দেখতাম আমরা মাত্র দু’জন। অবশ্যই আক্ষেপ আছে। আক্ষেপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একবার যদি কেউ গানটা আত্মস্থ করে ফেলে তখন সেটা ছাড়তে অনেক কষ্ট হয়। যখন ছেড়ে দিতে হলো, তখন গান শোনাও বন্ধ হলো।
এবং বই : বিদ্যাপ্রকাশের খোকা ভাই অথবা খোকা ভাইয়ের বিদ্যাপ্রকাশ। আপনার জীবনের সাথে ভীষণভাবে জড়িয়ে গেল বিদ্যাপ্রকাশ। পেছনের গল্পটা শুনতে চাই…
মজিবর রহমান খোকা : আব্বার চাকরিসূত্রে ঢাকাতে চলে আসলাম। বদলির চাকরি, জেলায় জেলায় ঘুরে ঢাকায় আসলেন। আমার বড় ভগ্নিপতি ছিলেন রাজশাহীতে। তাঁর বই আমদানিকারকের লাইসেন্স ছিল। বিদেশ থেকে বই আমদানি করেন। তো তিনি ঢাকার বাংলা বাজারে একটি বইয়ের দোকান করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি চান আমি এর দায়িত্বে থাকি। কিন্তু আমি রাজি নই, কারণ বইয়ের তো আমি কিছুই বুঝি না। তাঁর কথা হলো, তোমার কিছুই বোঝা লাগবে না, তুমি শুধু টাকার হিসাবটা রাখবে, ক্যাশ দেখে রাখবে। অবশেষে যুক্ত হলাম। তখন আমি দেখলাম যে কী সুন্দর সুন্দর বিদেশী বই। চমৎকার সেটাপ-গেটাপ। ভাবলাম আমাদের দেশের বই এরকম কেন? পড়া যায় না, শব্দ ভাঙ্গা।
১৯৭৭ সালে যখন বাংলা একাডেমিতে স্টল নিলো আলীগড় লাইব্রেরি, তখন আমাকে মেলায় যেতে হতো। তখন দেখতাম প্রচুর মানুষ বই কিনছে। আমি টাকা নিয়ে শেষ করতে পারছি না। পাশে যে আরও বাংলাদেশের প্রকাশনীর স্টল আছে সেখানে কোনো লোক নেই। পরে ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমাদের দেশে বইয়ের ভালো ভালো লেখক আছে, আমি নিজেও পড়ে দেখেছি। তাহলে আমাদের দেশের বই কেন কিনছে না পাঠক, তার কারণ বইগুলো সব বিশ্রি সেটাপ-গেটাপ, মুদ্রণ ভালো নয়। তখন মনে হলো যদি আমি প্রকাশক হতাম, তাহলে তো আমি এটা চেঞ্জ করতে পারতাম।
এবং বই : তখন আপনি ভালো বইয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন…
মজিবর রহমান খোকা : প্রেমে নয়, দেখছি কলকাতা থেকে বই আসছে, আর সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মফস্বল থেকে লাইব্রিয়ানরা আসতেন, আর বই নিয়ে যেতেন। সঙ্গে খবর নিয়ে যেতেন, পরের চালান কবে আসবে। এই যে আসার সাথে সাথে বইগুলো বিক্রি হয়ে যেতো, এসব আমাকে আকৃষ্ট করলো। তখন ১-২ কার্টুন আসতো না, ৫০-৬০ কার্টুন বই আসতো কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর থেকে ইংল্যান্ড থেকে। তখন আমার মনে হলো যে বইয়ের প্রডাকশন যদি চেঞ্জ করতে পারতাম, আমি যদি পাবলিশার হতাম, তাহলে কাজটি করা যেতো।
এবং বই : বিদ্যাপ্রকাশ কীভাবে তৈরি হলো?
মজিবর রহমান খোকা : বিদ্যাপ্রকাশ শুরু করার আগে আমি একটা বইয়ের দোকান দিলাম ‘মেট্রোপলিশ লাইব্রেরী’। তখন বাংলা একাডেমি নিয়ম করে মেলায় স্টল নিতে হলে নিজেদের বই থাকতে হবে, ৪টা বই অন্তত থাকতে হবে।
এবং বই : কত সালে?
মজিবর রহমান খোকা : ১৯৮২ সালে ।
এবং বই : যা বলছিলেন…
মজিবর রহমান খোকা : তো ৪টি বই থাকলে স্টল দেওয়া হবে। আমার তো কোনো বই ছিল না। তখন আমার এক বন্ধুকে দিয়ে লিখিয়ে ৪টি বই বের করলাম। পাবলিশার্স হয়ে গেলাম। তখন আমার মনে হলো আমি তো আরও ভালো বই করতে চাই। প্রেসলাইনে যারা যুক্ত তাদের অনেকেই জিজ্ঞেস করলাম ভালো বই কেন হচ্ছে না?- তারা বললেন, আপনি তো মেশিনই পাবেন না, ভালো বই করবেন কীভাবে? ওদের বললাম- কিন্তু ভারতের আনন্দবাজার কী সুন্দর প্রডোকশনের বই বের করে। এ সময় আমার মনে হলো, বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান নয়, আমি গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য একটি প্রকাশনী দেবো। ভালো মানসম্মত, দৃষ্টিনন্দন বই প্রকাশ করবো, বিদেশি বইয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করবো। তখন শুরু হলো বিদ্যাপ্রকাশ।
এবং বই : বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রথম বই করলেন সৈয়দ শামসুল হকের…
মজিবর রহমান খোকা : বিদ্যাপ্রকাশ নাম দেখে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ রাজা হোসাইনকে জিজ্ঞেস করেন কে এ? প্রকাশনীর নামটা তো সুন্দর দিয়েছে। রাজা ভাইয়ের সাথে আমার তখন বেশ যোগাযোগ। তিনি আমাকে জানলেন, ‘বিদ্যাপ্রকাশ’ নামটির বিষয়ে হক ভাই প্রশংসা করেছেন, পছন্দ করেছেন। তখন সাধারণত প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে লাইব্রেরি, প্রকাশনী এসব থাকতো। সঙ্গত কারণেই নাম নিয়েও ‘বিদ্যাপ্রকাশ’ আলোচনায় আসলো। তখন রাজা ভাইকে বললাম- হক ভাই কি আমাকে একটা বই দেবেন? তিনি বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই দেবেন। ‘স্তব্দতার অনুবাদ’ নামে হক ভাইয়ের প্রথম বই প্রকাশ করলাম। তারপর হক ভাইয়ের আরও অসংখ্য বই আমার প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে। অপসেট মেশিনে প্রচ্ছদ ছাপা হলো। এমনটা কেউ করেনি তখনো।
এবং বই : আপনি তখন বইতে নতুন নতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটালেন, যেটা আগে কেউ করেনি…
মজিবর রহমান খোকা : এটা ঠিক। এটা ঠিক এই কারণেই বলবো। আমি কিছু বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেখাবো বলে। (এসময় তিনি বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বেশকিছু বই দেখালেন) আপনি ঐসময়ে প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের সাথে বিদ্যাপ্রকাশের বই মিলিয়ে দেখবেন, এইরকম লেমিনেটেট কভার, চাররঙ্গা প্রচ্ছদ, লাইন প্রতি একটি শব্দও ভাঙ্গা নেই, অপসেটে ঝকঝকে ছাপা, নির্ভুল বই ওই সময় দুর্লভ ছিল। প্রকাশনা জগতে বুক কাভারের জন্য প্রথম ট্রান্সফারেন্সি ডিজাইন করা হয় ইমদাদুল হক মিলনের ‘নায়ক’ উপন্যাসের কাভার। কাভারটি করেছিলেন আফজাল হোসেন। এই যে দেখুন এই বইটি (কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলনের বই দেখিয়ে) ৫ মাসের মধ্যে সোয়া দুই হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেলো। আমরা তখন সোয়া দুই হাজার করে বই ছাপতাম।
এবং বই : তারমানে সেই সময়টাতে ইমদাদুল হক মিলন বিদ্যাপ্রকাশের বেস্ট সেলার লেখক…
মজিবর রহমান খোকা : এটা বাংলাদেশে প্রথম। হ্যাঁ। মিলন ভাইয়ের এই বই দুটো ‘দিনগুলি’ আর ‘অভিমানপর্ব’ একসেট হিসেবে জেলাগুলোতে বিক্রি হতো। তারপর আবার সোয়া দুই হাজার কপি ছাপলাম। এবারও ৫ মাসের মধ্যে বইগুলো বিক্রি হয়ে গেলো। তখন বাংলাদেশে এক বছরে এটা সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড। তখন আমার বন্ধুদের কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিল এই প্রকাশনা বেশিদিন টিকবে না। ঐ সময়ে এমন বই করতে গিয়ে প্রডাকশন কস্ট অনেক বেশি পড়েছিল।
এবং বই : তসলিমা নাসরিনের বেশকিছু বইও আপনি প্রকাশ করেছেন?
মজিবর রহমান খোকা : তখন হক ভাইয়ের (সৈয়দ শামসুল হক) বই আমি বের করছি। হক ভাই একদিন আমাকে বললেন- ‘খোকা, একজন নতুন লেখিকার বই বের করবেন কি?’ আমি বললাম- নতুন লেখিকা, আমার তো তার সম্পর্কে ধারণা নেই, কেমন লেখে, লেখার মান কেমন। হক ভাই বললেন- ‘ঠিক আছে আমি তাকে পাঠাবো, আপনি দেখেন।’ তারপর তসলিমা নাসরিন একদিন আসলেন তার লেখা নিয়ে। তার লেখা পছন্দ হলো, কবিতা। আমি দুটোই করলাম। বলা যায় প্রায় একসাথে।
এবং বই : বই দুটোর নাম…?
মজিবর রহমান খোকা : ‘আমার কিছু যায় আসে না’, অপরটি হলো- ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’। তখন সবে বাংলাদেশে কম্পিউটার কম্পোজ এসেছে। আমরা কম্পিউটার কম্পোজ ব্যবহার করলাম। তার বই বিক্রি হলো। তখন তিনি আরও একটি পাণ্ডুলিপি দিলেন, সেটা করলাম। তখন তিনি আজকের কাগজের ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ পত্রিকায় কলাম লেখেন। তার কিছু পাঠক তৈরি হয়েছে। সে সময় আমি তার একটানা ৮টি বই প্রকাশ করেছি। এই বইগুলো যখন বের করছি তখন তার প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে, আমারও সমালোচনা হচ্ছে।
অনেকেই বলছে, আমি কেন তসলিমা নাসরিনের বই বের করছি। ঐ সময় যারা আমার সমালোচনা করেছেন, পরে দেখেছি তারাই তসলিমার কাছে পাণ্ডুলিপি ছেয়েছেন, পেছনে পেছনে ঘুরেছেন। তখন যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছিল, আমি সাপোর্ট না দিলে তসলিমা নাসরিন আজকে তসলিমা নাসরিন হতে পারতো না। তাকে আমি মানসিকভাবে, আর্থিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছি। তখন সে পারিবারিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে, আমি তার পাশে ছিলাম। এসব আমি করেছি শুধু নারী লেখক বলে। আমি ছেয়েছিলাম, তার মধ্যে যে লেখার শক্তিটা আছে, লেখকসত্ত্বা আছে তার প্রকাশ ঘটুক। কিন্তু একসময় সে তার শক্তিটাকে, প্রতিভাটাকে নষ্ট করে দিলো।
এবং বই : তসলিমা নাসরিনকে কেন্দ্র করে ১৯৯২ সালের একুশে বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশে হামলা হয়েছিল। আপনি সম্প্রতি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছেন?
মজিবর রহমান খোকা : আমি যদি সে সময় এসব ট্যাকেল করতে না পরতাম তাহলে তসলিমা নাসরিন আর বাংলা একাডেমিতে ঢুকতে পারতো না। ঐ সময় তার পক্ষে খুব কম লোকই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমি জোরালোভাবে তার পক্ষে ছিলাম।
এবং বই : সেদিনের ঘটনাটা বলবেন?
মজিবর রহমান খোকা : সেদিন ছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি। বিষয়টি জানার মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনাটি ঘটে গেলো। সন্ধ্যা সাড়ে সাত বা আটটা হবে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে তসলিমা নাসরিন, কলাম লেখক ফজলুল আলম, আমার স্ত্রী নাসরিন সুলতানা এবং আমি বসে আছি, আড্ডা দিচ্ছি। সামনে পাঠকদের হালকা ভিড়। তারা তসলিমা নাসরিনের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। হঠাৎ পাঠকদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে মিছিল আসছে।’ বিষয়টি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি স্টলের মধ্য থেকে ডানে উঁকি দিয়ে কোনো মিছিল দেখতে পেলাম না। কারণ, আমার স্টলটি পুকুরের পশ্চিম কোণে মাসজিদের পাশে (মসজিদটি এখন স্থানান্তরিত করা হয়েছে) পশ্চিমমুখী অবস্থায় ছিল।
আর মিছিলটি আসছে আমার লাইনের ডান দিকের শেষ মাথায় আনবিক শক্তি কমিশনের পিছনের দেওয়াল ঘেঁসে। মিছিলটি যখন পশ্চিম প্রান্তে স্টলগুলোর সামনে দিয়ে কড়ই গাছের নীচ বরাবর এলো তখন আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো! তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ব্যানার নিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরিহিত ১০/১২ জন যুবক স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। ব্যানারে লেখা ‘তসলিমা নাসরিনের ধর্ম অবমাননা, মানবো না, মানবো না’। এরমধ্যে তসলিমা নাসরিন আর ফজলুল আলম আমার পিছন দিয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে গেল। মিছিলটি বিদ্যাপ্রকাশের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে পাঠকদের একজন বললো-‘আপনিও চলে যান, ওদের কাছে অস্ত্র থাকতে পারে।’ আমি মিছিল আসার দৃশ্যটি দেখতে লাগলাম। কাউকে চিনতে পারছি না।
এত বছর বাংলা একাডেমিতে বইমেলায় অংশ নিচ্ছি। কতজনের সাথে পরিচয় হয়েছে! কিন্তু এদেরকে তো কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। আমার স্টলের সামনের অংশটা ফাঁকা হয়ে গেল। পাঠকরা যে যার মতো নিরাপদ স্থানে সরে গেল। স্টলের ভিতরে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে। মিছিলটি বিদ্যাপ্রকাশের কাউন্টারের কাছে এসে থামলো। কয়েকজন যুবক ধুমধাম লাথি মেরে তসলিমা নাসরিনের বইগুলো দ্রুত ছিঁড়ে মাটিতে ফেলতে লাগলো। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি।
কত কষ্ট করে এক একটি বই প্রকাশ করতে হয়! সেসব বই এরা না পড়ে না বুঝে ধ্বংস করছে! খাটো মতো অল্পবয়সী একটি ছেলে আমার সামনে এসে ধমকের সুরে বললো, ‘তসলিমা কোথায়?’ আমি নীরব। সে উত্তেজিত কণ্ঠে তর্জনী প্রদর্শন করে বললো, ‘এই স্টলে আর যেন তসলিমার বই না দেখি। দেখলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিবো।’ আমি তখন নির্বিকার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি! ওরা ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে বীরদর্পে ফিরে গেল। কেউ একজন এসে জানালো, ওরা ছাত্রদলের ছেলে। বিএনপি তখন জামায়াতের সমর্থনে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। আমার ২/১ জন প্রকাশক বন্ধু সাবধানতার সাথে হাসতে হাসতে এসে ঘটনা শুনে নীরবে প্রস্থান করলো। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ বিষয়টি জানার, শোনার বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এলো না ।
এবং বই : তারপর?
মজিবর রহমান খোকা : রাতে বাসায় ফিরে তসলিমাকে ফোন দিয়ে জানলাম যে, সে মহাপরিচালকের কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষ তাকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পরদিন সকল জাতীয় দৈনিকে বিদ্যাপ্রকাশে হামলার খবরটি ছাপা হলো। ‘ইনকিলাব’ ওদের পক্ষ নিয়ে রিপোর্ট করলো, ‘তসলিমার ধর্ম বিরুদ্ধ লেখালেখির জন্য ছাত্রদের প্রতিবাদ।’ তসলিমা নাসরিন ফোন করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, ‘আমি কি আর মেলায় যেতে পারবো না! দেখেন না খোকা ভাই, কিছু করা যায় কিনা?’ বললাম- ডাকসুতে ছাত্রদলের নেতাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তাদের সাথে কথা বলে দেখি কী হয়। কারা এটা করেছে, তাদের নাম ঠিকানা কিছুই জানি না। সেসব আগে জানা দরকার।
এই ফাঁকে আমি অফিসে জানিয়ে দিলাম, আজ মেলায় তসলিমার বইগুলো যেন ডিসপ্লেতে রাখা না হয়। তসলিমা নাসরিনকে ফোনে ছাত্রদলের নেতাদের সাথে বসার বিষয়টি জানালাম। সে তো ভয়ে অস্থির। বললো, ‘ওরা যদি আমার উপর হামলা করে! ওরা তো মৌলবাদী! ওদের বিশ্বাস নেই।’ বললাম, ‘আমার মামাতো ভাই সাথে থাকবে। ওর সাথে ছাত্রদলের ভালো সম্পর্ক আছে! সম্ভব হলে, আপনিও কাউকে নিয়ে আসতে পারেন। ওরা আমার বাসায় এসে কিছু করার সাহস পাবে না।’ বললো, ‘দেখেন যেভাবে পারেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাকে মেলাতে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন।’ বললাম, ‘আগে আসেন, ওদের সাথে আলাপ করি। ওরা কী বলতে চায় শুনি। তারপর মেলায় যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপার আসবে। আর আমি যদি মেলায় যাই তাহলে আপনিও যেতে পারবেন।
এবং বই : তারপর আপনারা বসলেন? তসলিমা নাসরিন যোগ দিলেন সেই সভায়?
মজিবর রহমান খোকা : হ্যাঁ। ছাত্রদলের ওদের সাথে যোগাযোগ হলো। তারা ৩জন ফেব্রæয়ারির ২১ তারিখ সকাল ১০টার দিকে আমার বাসায় আসবে। তসলিমা নাসরিন সকাল ৯টার মধ্যে লেখক ফজলুল আলমকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এলো। যুবকরা এলো ১০টার আরো পরে। মাক্তু (আমার ছোট ভাই) ওর দু’বন্ধুকে বাসার বাহিরে অপেক্ষায় রাখলো।
আলোচনার শুরুতে তারা তসলিমার বইগুলো সব ধর্মবিরোধী বলে দাবি করলো। তসলিমা নাসরিন জানতে চাইলো- ‘কোন বইটায় আছে বলেন? ওরা বললো- ‘আপনার সব বই ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা। তসলিমা কললো- ‘কোন বইটি নির্দিষ্ট করে বলেন? ‘বললো- ‘নির্বাচিত কলাম’, এই বইতে বেশি আছে! এটা রাখতে পারবেন না। এই বইটা বাদ দিলে আপনি মেলায় যেতে পারবেন। তসলিমা তাতেই প্রায় সম্মত হয়ে যাচ্ছিলো। আমি বললাম, ‘না’। থাকলে সব বই থাকবে। কোনোটাকে বাদ দেয়া যাবে না। তিনি নির্বাচিত কলামে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেননি। তিনি নারী জাগরণমূলক লেখা লিখেছেন। তাতে তিনি তার মতামত তুলে ধরেছে মাত্র। আমাদের যুক্তি পালটা-যুক্তির পর ওরা আমার দৃঢ় অবস্থান দেখে স্টলে সব বই রাখার সিদ্ধান্তে রাজি হলো।
এরপর তসলিমা আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বললো, ‘ওরা তো এখানে রাজি হলো, যদি আবার মেলায় গোলমাল করে?’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়। ফিরে গিয়ে ওদের বললাম, ‘দুপুরে এখান থেকে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা কিন্তু একসাথে মেলায় যাবো। সবাই যেন জানতে পারে যে, বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ওরা বললো-‘না, তা হবে না, এতে আমাদের সমস্যা হবে। আমরা তো রাজনীতি করি। কেরিয়ার নষ্ট হবে। আমি বললাম- ‘তা হলে অন্তত একজন চলো আমাদের সাথে।’ যুবকটি বললো- ‘না ভাই, আপনার আর কোনো সমস্যা হবে না। বললাম- ‘তসলিমা নাসরিন আজ মেলায় যেতে পারবে তো?’ ওরা বললো-‘পারবে।’
খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই বাসা থেকে একসাথে বের হলাম। ওরা ভার্সিটির দিকে চলে গেল আর আমরা মেলার দিকে।
এবং বই : বিশাল এক ঝামেলা মেটাতো হলো আপনাকে?
মজিবর রহমান খোকা : হ্যাঁ।
এবং বই : তারপর তসলিমা নাসরিন ভারত থেকে ‘আনন্দ পুরস্কার’ পেলেন। তাঁর ‘নির্বাচিত কলাম’ বিদ্যাপ্রকাশ থেকেই বেরিয়েছে।
মজিবর রহমান খোকা : একবার সে কলকাতা যাচ্ছে, তখন বেলাল চৌধুরী তাকে বললেন- কলকাতার যাচ্ছো। তোমার কলাম বইটি কয়েকজনকে দিয়ে এসো। কলকাতা ফেরার কিছুদিন পর তসলিমা আমার বাসায় আসলো। বললো- ‘খোকা ভাই, একটি ভালো খবর আছে। আমি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছি।’ তখন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কোন বিষয়ে সে আনন্দ পুরস্কার পেলো? কবিতায় না কলামে? তাকে সবসময় আমি বলতাম তার কলামগুলো টিকে থাকবে, কবিতা টিকবে না। ও বলতো- না, আমার কবিতা টিকবে, কলাম টিকবে না। আমি বললাম- কোনটায় পেয়েছেন? ও বললো- নির্বাচিত কলামে। আমি বললাম- হ্যাঁ কলামেই পাওয়ার কথা।
পরে জানলাম পুরস্কারটি বাংলা একাডেমিকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, বাংলা একাডেমি নেয়নি, তারপর তাকে দেয়া হয়েছে। তবে, আমি মনে করি সে তার যোগ্যতাতেই পেয়েছে। তারপর একদিন আমাকে বললো- ‘পুরস্কার পাওয়া বইটি কলকাতা থেকে বের হবে।’ আমি বললাম- বইটি তো বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে, ওখান থেকে বের করতে হবে কেন? সে বললো- বইটি আনন্দ পাবলিশার্স করতে চায়। ওদের বইয়ে ভুল থাকে না….. ইত্যাদি।’ আমি বললাম- ‘ভুল তো আমাদের বইয়েও থাকে না, বরং ওদেরও বইয়ে ভুল থাকে। আমি আপনাকে দেখিয়ে দেবো। যদি করতে হয় তাহলে যৌথভাবে করবো। কিন্তু সে সেটা চাচ্ছিল না।’ পরে আনন্দ থেকেই বইটি বের হয়। সেখান থেকেই তার সাথে আমার দূরত্বের শুরু। মনকষ্ট তৈরি হলো। এত কষ্ট করে আমি তার বই প্রকাশ করলাম। আর সে কী না…? তারপর থেকে ধীরে ধীরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এবং বই : লেখক তসলিমা নাসরিন, দেশে ফিরতে চান। এ নিয়ে তাঁর তীব্র অকুতি শুনতে পাই…
মজিবর রহমান খোকা : আমি তসলিমার বিষয়ে আগে কখনোই কথা বলিনি, এই প্রথম এবং বইকে বলছি। তার সবসময় একটা লক্ষ ছিল- অনেক টাকার মালিক হতে হবে, অনেক নাম হতে হবে। সেটা যেভাবেই হোক। আমি বলতাম- আপনি লেখেন, লেখার মাধ্যমেই আপনি বড়ো হবেন, খ্যাতি অর্জন করবেন। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবে জেনেও কারো কারো পরামর্শে ‘লজ্জা’ বইটা লিখলেন। কারা পরামর্শ দাতা সেটা আমরা জানি। ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি এই কাজটি করেছেন, যাতে তার নাম হয়। এবং সেটা হয়েছে, তবে তার যে লেখনী শক্তিটা ছিল, সেটা সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি ঐ দিনেই বলেছি সে আর এগোতে পারবে না। এবং সত্যি সত্যি আমার ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হয়েছে।
এবং বই : দেশে আসার বিষয়ে…
মজিবর রহমান খোকা : দেখুন ৭৩ সালে দাউদ হায়দার দেশ ছেড়েছে, তারও তো আকুতি আছে, দেশে আসার, সেও তো আসতে পারছে না।
এবং বই : প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব- এই কথাটা আমরা শুনে থাকি। কিন্তু বাস্তবে দেখি না। কেউ বলছেন- লেখকের পেশাদরিত্ব নেই, কেউ বলছেন- প্রকাশকের পেশাদারিত্ব নেই। আপনি কী বলেন?
মজিবর রহমান খোকা : দেখুন, যে কোনো একটি সংগঠনের কিছু মৌলিক নিয়ম নীতি থাকে, যার ভিত্তিতে সংগঠনটি গড়ে ওঠে। আমাদের এখানে ৮২ সালে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে। যেখানে প্রকাশকদের সদস্য করা হয়েছে, বিক্রেতাদের সদস্য করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে বিক্রেতাদেরও সদস্য করা হয়েছে। এই সমিতিটি তৈরি করা হয়েছে উভয়ের স্বার্থ দেখার জন্য। কিন্তু উভয়ের স্বার্থ দেখতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারো স্বার্থই আসলে দেখা হয় না। তো আমি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেছি আলাদাভাবে কিছু করা যায় কী না। ১৯৯৭ সালে যখন কলকাতা বুক ফেয়ারে আগুন লাগে তখন আমার বুক স্টল পুড়ে যায়। চার লাখ টাকার বই পুরে গেলো, তখন এই সমিতি থেকে আমাকে একটা সমবেদনা পর্যন্ত জানানো হলো না।
আমি তখন এই সমিতির মেম্বার, শুধু মেম্বার নই- সমিতির ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি। তখন আমার মনে হলো শুধু সৃজনশীল বই ও প্রকাশকদের মান্নোয়নের জন্য, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান দরকার। তো সেখানে কী হবে? পেশাদারিত্ব তৈরি করা হবে। লেখক-প্রকাশকের পেশাদারিত্বটা কী। প্রকাশককে অবশ্যই লেখককের রয়্যালিটি দিতে হবে এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। প্রকাশককে তার বাইন্ডারকে ঠিকভাবে টাকা দিতে হবে। তখন আমি প্রকাশক বাবু চিত্তরঞ্জন সাহা, ইউপিএলের মহিউদ্দিন আহমদ এবং সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হকের সঙ্গে কথা বললাম। আমার অন্যান্য প্রকাশক বন্ধুদের সাথে কথা বললাম। তারা একমত হলেন নতুন কিছু একটা হোক।
এবং বই : বলা যায় আপনার উদ্যোগেই তৈরি হলো প্রকাশকদের নতুন সংগঠন?
মজিবর রহমান খোকা : তখন নাম ছিল ‘বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ’। পরে অবশ্য সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে এই নামটি পরিবর্তন করতে হয়। আমরা ইউপিএল অফিসে বসলাম, মহিউদ্দিন ভাই বললেন, মফিদুল ভাইকে দায়িত্ব নিতে। কিন্তু আমি চাইছিলাম মহিউদ্দিন ভাই দায়িত্ব নিক। তখন মফিদুল হক সভাপতি, চিত্ত সাহা সহসভাপতি আর নির্বাহী পরিচালক মানে সেক্রেটারি হলাম আমি।
এবং বই: এটা কত সালে?
মজিবর রহমান খোকা : ১৯৯৮ সালে। প্রথমে এডহক কমিটি হলো, পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলো। এই সংগঠন থেকে সরকারের সাথে যোগাযোগ করে বই ক্রয়ের জন্য আমরা টাকার ব্যবস্থা করেছি। সেবার সরকারিভাবে বই কেনা হলো গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে। তারপর ক্রয়কৃত বই সারাদেশের লাইব্রেরিগুলোতে পাঠানোর দায়িত্বটা পর্যন্ত আমরা পালন করেছি। দেখুন কী বলবো, এই বই ক্রয়তেও দুর্নীতি হলো। যারা এই বাজেট আনার জন্য খাটলেন তাদের বইয়ের তালিকা নেই, অন্যদের তালিকা আছে। একজন প্রকাশক ভিন্ন নামে তালিকা দিলো, তাদের বই কেনা হলো। ইনার চেঞ্জ করে তারা নিজেদের বই ঢুকিয়েছেন তালিকায়। এই ঘটনাটা প্রথম বছরেই হলো। যারা আমাদের সমিতির সদস্য তারাই এটা করলো। তারপর থেকে ২০০২-২০০৩-২০০৪ সালেও এমন দুর্নীতি হলো। ভালো বই আর সংগ্রহ হলো না।
এবং বই : শেষ প্রশ্ন, বিদ্যাপ্রকাশ নিয়ে আগামীর ভাবনা…
মজিবর রহমান খোকা : দেখুন, আমি ব্যবসায় কতটা সফল, তার চেয়ে বড় কথা, আমি আমার কমিউনিটির জন্য সার্ভ করেছি, এখনো করছি। আপনি লক্ষ করে দেখবেন, গত এক বছর ধরে আমি লেখকদের সাথে কথা বলছি। একবার আপনার (এবং বই সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ) সাথেও কথা বলেছি। লেখকদের ইন্টারভিউ নিচ্ছি, একটা অনলাইন ফ্ল্যাটফর্ম তৈরি করছি। লেখদেরকে পাঠকের কাছে, পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষির পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। কোন লেখক কী লিখছেন। এর জন্য অবশ্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এখন বয়স হয়ে গেছে। বিদ্যাপ্রকাশ নিয়ে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলেই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার ইচ্ছে ছিল এই বছরটা লেখকদের সাথে কথা বলেই কাটাই, সেটা হচ্ছে। আরেকটা হলো স্কুলের শিক্ষার্থীরা বই পড়ে কি না, পড়লে তাদের অনুভ‚তি কী, ভালো লাগা, মন্দ লাগা এসব জানার চেষ্টা করবো আগামী বছর। আর বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বই তো বের হচ্ছেই।
এবং বই : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মজিবর রহমান খোকা : আমার কথা ভালো লাগলে এবং বইয়ের পাঠকদের ধন্যবাদ জানাবো, ভালো না লাগলেও ধন্যবাদ জানাবো ধৈর্য্য ধরে ইন্টারভিউটি পড়ার জন্য।