গানের জীবন, জীবনের গান

লেখালেখির ক্ষেত্রে আত্মজীবনীর হয়তো একটা স্থায়ী মূল্য আছে। এতে সমাজ ও ইতিহাসকে ব্যক্তি নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় ব্যাখ্যা করার সুযোগ পান এবং তিনি এমন কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছান কখনো কখনো যা হতে পারে বহু মানুষের জীবনোপলব্ধির অংশ। সে-জীবন সেলিব্রেটির কী সাধারণের সে-কথা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো যে-সমাজ ও কালপ্রবাহে তিনি জীবন পাড়ি দিয়েছেন তা থেকে জীবনের অন্তিমে এসে তিনি কী পেলেন যা আগামী প্রজন্মের পরম্পরায় তাদের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারেন। কেননা প্রতিটি জীবনই মূল্যবান এবং সৃষ্টির অপার রহস্য ও মহিমায় তা পরিপূর্ণ।

আমাদের এখানে আত্মজীবনী লেখার প্রচলন নেই তেমন একটা। এ-ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের মধ্যে ছিঁটেফোঁটা আগ্রহ দেখা গেলেও, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকরা কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখতে, মঞ্চ কাঁপাতে ও সেলুলয়েডের পর্দা মাতাতে যতখানি উদগ্রীব, জীবনাভিজ্ঞতা জানাতে ততখানি উৎসাহী মনে হয় না।

বাংলাদেশে সংগীত ও চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে আত্মজীবনী রচনার উদ্যম অথবা তাগিদ একেবারেই চোখে পড়ে না। কিন্তু বাংলা ভাষা-সাহিত্য-শিল্পের আরেক মঞ্চে অর্থাৎ কোলকাতায় সে-ঐতিহ্য বেশ পুরনো। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন সংগীত কিংবদন্তীর নামোল্লেখ করা যায়। ব্যস্ত সংগীত জীবনের ফাঁকেও দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর আত্মজীবনী: ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত’ লেখার জন্য সময় বের করেছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সময় হয়েছিলো আত্মজৈবনিক:‘উজান গাঙ বাইয়া’ লেখার । সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে রবিশংকরের সংগীত জীবনের অনবদ্য স্মৃতিচারণা। কীর্তিমান শিল্পী শচীন দেব বর্মণেরও রয়েছে নিজের স্মৃতিচারণায়:‘সরগমের নিখাদ’।

একে একে আমাদের হাতে এসেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী- ‘আনন্দধারা’, মান্না দে’র ‘জীবনের জলসাঘরে’ ও গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা: ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ বইগুলি। অথচ প্রায় একই সময়কালে আমাদের এখানকার শিল্পীদের লেখা একটি মাত্র আত্মজীবনী পাঠক কতৃক সমাদৃত হয়েছে, সেটি আব্বাসউদ্দীন লেখা: ‘আমার শিল্পীজীবনের কথা’; তাও আবার শিল্পী আব্বাসউদ্দীন মূলত: পাকিস্তান- পূর্ব সময়ে (দেশভাগের আগে) তৎকালীন কোলকাতায় বিকশিত অবিভক্ত বাংলার ফসল।

আমাদের এখানে দেশভাগের আগে বেতার, ও ষাটের দশকে টেলিভিশনের সম্প্রচার এবং এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চলচ্চিত্র  নির্মাণের ধারা চালু হলে সেগুলোকে ঘিরে এখানকার গায়ক, গীতিকার ও সুরকারদের সম্মিলিত উদ্যোগে সঙ্গীতের একটা নিজস্ব বলয় গড়ে উঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলো।

এর প্রেক্ষাপটে একদিকে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু গানের প্রভাব ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তা, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতানন্দিত বাংলা গানের অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা প্রতিহত করার তাগিদ। যদিও সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল পূর্ব বঙ্গের ভাষা-সংস্কৃতি ও লোকজীবনের প্রেক্ষাপটে এখানকার সংগীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা বিনির্মাণের  ভাবনা।

বলা বাহুল্য এই ভাবনার বাস্তবায়ন/রূপায়ন সহজসাধ্য ছিলনা। কিন্তু সেদিনের গায়ক-গীতিকার-সুরকাররা স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরির এই চ্যালেঞ্জটুকু নিয়েছিলেন। অথচ পরিতাপের বিষয়-বাংলাদেশের গান আজ যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য  অর্জন করেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের গান, বাউল ভাব সংগীত ও মনোমুগ্ধকর চলচ্চিত্র গানের সম্মিলনে আজ যে সেই ঐতিহ্য একটা পরিপূর্ণ অবয়ব অর্জন করেছে; তার সামান্যই প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের লেখালেখি ও স্মৃতিচারণায়। কীর্তিমান শিল্পীদের প্রায় কেউই তা লিখেন নি। এদিক থেকে আমাদের মূলধারার একজন শ্রোতানন্দিত গুণী শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর আত্মজীবনী- জীবনের গান একটি অত্যন্ত মূল্যবান রচনা। ২০২২ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ চলছে। এখনও নিয়মিত ও সক্রিয় এই শিল্পী আসছে জুলাই-তে ৮৩ বছরে পৌঁছুবেন। 

সৈয়দ আব্দুল হাদী
সৈয়দ আব্দুল হাদী

আত্মজীবনীর বৈশিষ্ট অনুসারে জীবনের গান স্বাভাবিক কারণেই কোন ইতিহাস গ্রন্থ নয়। এর প্রায় পুরোটা জুড়ে শিল্পীর আগরতলায় কাটানো কৈশোর, ব্রাম্মণবাড়িয়ায় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবাহিত শিক্ষাজীবন, জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা ও টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে স্বল্পকালীন চাকুরী ও সবশেষ গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরে অবসর গ্রহণকাল পর্যন্ত পেশাজীবনের বিবরণ আছে। আছে আজিমপুরে এক ঘরোয়া গানের বৈঠকে গানের মুগ্ধ শ্রোতা তৎকালীন ইডেনের ছাত্রী ফখরুন্নাহার (উষা)-র প্রেমে পড়া ও তা পরিণয়ের সফল পরিণতিতে পৌঁছানো, তিন কন্যার  গর্বিত পিতা হিসেবে আনন্দময় পারিবারিক অধ্যায়ের বিবরণ। ভ্রমণ তাঁর নেশা-তাই এঁকেছেন পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণের টুকরো টুকরো ছবিও।

লিখেছেন তিনি, যে দেশেই গিয়েছি, সে দেশের গ্রাম, প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছি। লক্ষ করেছি, বিদেশভ্র্রমণে প্রায় সবাই শহরেই বেশি সময় কাটায়, কিন্তু আমি তাতে আনন্দ পাই না। কারণ, সব শহরের চরিত্র মোটামুটি একই। গ্রামের মধ্যেই একটি দেশের আসল পরিচয়। (পৃষ্ঠা:১৯৫) জীবনের গান/ সৈয়দ আব্দুল হাদী

বইটিতে প্রায় সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ, বিকাশ ও সাফল্যের  শীর্ষে পৌঁছার বিস্তারিত গল্প। পূর্ববঙ্গে সংগীতের নতুন ভিত গড়ে তোলার জন্য সেদিনের সমাজ, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা-কোনটাই যে শিল্পীদের পক্ষে ছিলনা- তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন সৈয়দ আবদুল হাদী।

তিনি লিখেছেন, ষাটের দশকের সেই রেকর্ডিং পদ্ধতি আর আজকের পদ্ধতিতে রাত-দিন ব্যবধান। একটি মাইক্রোফোনের সামনে শিল্পী, আর একটি মাইক্রোফোন সমস্ত বাদ্যযন্ত্রীর জন্য। একটানা গানটি গেয়ে যেতে হতো, কারও কোনো সামান্যতম ভুলভ্রান্তি হলে আবার প্রথম থেকে গাইতে হতো।বাইরের শব্দ যাতে না আসে সে জন্য রেকর্ডিং হতো রাতের বেলা। আমরা রাত আটটার দিকে ষ্টুডিওতে ঢুকতাম, বেরিয়ে আসতাম ভোরবেলা-এমনই কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। (পৃষ্ঠা:৩৭) জীবনের গান/ সৈয়দ আব্দুল হাদী

সেদিনের আরো অনেকের সাথে গানের নতুন পথ নির্মাণে তাঁকেও ব্যয় করতে হয়েছে শ্রম, সময় ও মেধা। তারই ফসল হিসেবে নিজের প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, আমি ভাগ্যবান, ৭৮ ঘূণির ঘূর্ণির গ্রামোফোনে রেকর্ড থেকে একসটেন্ডেড প্লে, লং প্লে, ক্যাসেট, সিডি- সব মাধ্যমেই কাজ করেছি, বর্তমানে ইন্টারনেট মাধ্যমেও কাজ করছি। (পৃষ্ঠা -১৮১) জীবনের গান/ সৈয়দ আব্দুল হাদী

কিন্তু এই প্রাপ্তি যে তাঁকে অতৃপ্তির আরেক ঘূর্ণাবর্তে  ঠেলে দিয়েছে, সে অনুভূতি শ্রোতা ও পাঠকের কাছে লুকোন নি তিনি। “এখন তো আঙুলের একটি স্পর্শে যেমন ইচ্ছা, যত ইচ্ছা গান শোনা যায়। কলের গানে দম দিয়ে একটি রেকর্ডের এপিঠ-ওপিঠ করে দুটি গান শুনতে হয় না। একটি নতুন গানের রেকর্ডের  জন্য দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হয় না বা কখন একটি নতুন সিনেমায় নতুন গান শুনব সে জন্য বসে থাকতে হয় না । জীবন অনেক সহজ হয়েছে, সমৃদ্ধ হযেছে, আরাম, আয়েশ, বিলাসব্যসনের অভাব নেই। কিন্তু টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ উপভোগ করার সেই রোমান্টিক হৃদয়টি হারিয়ে গেছে। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। তবে মনে হয়, সহজ করার প্রয়াসে জীবনকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছি আমরা। সভ্যতার এটাই নিয়তি।” (পৃষ্ঠা: ১৮৮) জীবনের গান/ সৈয়দ আব্দুল হাদী

নিজের সমকাল ও বর্তমান কালকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে উভয়কালের বৈশিষ্ট ও তুল্যমূল্য তিনি যে অনায়াস প্রাঞ্জলতায় আলোচনা করে দেখিয়েছেন তাতে আত্মকাহিনীর সকল চাহিদা মিটিয়েও জীবনের গান আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান দলিল হয়ে উঠেছে।

ব্যক্তিগত কিংবা পেশাজীবনের সংকট তাঁকে বিচলিত করেনি, পথ পাড়ি দেওয়ার শ্রম তাঁকে ক্লান্ত করে নি। বরং, জীবনের প্রতিটি পর্বে সংগীত যেন তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে- ভরিয়ে দিয়েছে আনন্দ সুধায়, পথের বাঁকে বাঁকে সংগীতের মধ্যেই যেন বারবার খুঁজে পেয়েছেন পুনরায় এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা। দুরারোগ্য ব্যাধিতে ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪০ বছরের সঙ্গি স্ত্রী-কে হারিয়ে লিখলেন : “ এক সঙ্গি ছেড়ে গেলেন, কিন্তু যে সঙ্গি কোনো দিনই ছেড়ে যায়নি তার মাঝেই আশ্রয় খুঁজলাম। সংগীতের মাঝেই ভুলে থাকতে চাইলাম।” কিন্তু জাত শিল্পী যে কখনোই তৃপ্ত হন না, চূড়ান্ত বিচারে গন্তব্য নয় পথই যে শিল্পীর নিয়তি- সে সত্য পাঠকের কাছে এসে ধরা দেয় বইয়ের শেষাংশে! এখানে সংগীত সম্পর্কে শিল্পীর সারাজীবনের সাধনা- নির্যাসেরও খানিকটা খোঁজ মেলে।

তিনি লিখেছেন, সত্যি কথা বলতে কী, গানের যে ক্ষেত্রে সারাজীবন বিচরণ করেছি, সেখানে যেন আর আগের মতো আনন্দ পাচ্ছি না। গাইছি, কিন্তু মন যেন আরও গভীরতর কিছু খুঁজছে। তার সন্ধান আগেই জানা ছিল, এখন নতুন করে খুঁজে পেলাম।

জীবনের যে কোনো পর্যায়ে, সুখ, দুঃখ তথা হৃদয়াবেগের যে কোনো অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝে যে আশ্রয়, তা কি আর কোনো কিছুতে খুঁজে পাওয়া যায়?

রবীন্দ্রনাথের গান একের অনুভূতি হয়েও বহুর, পার্থিব হয়েও অপার্থিব, সীমার মাঝেও অসীম, রূপের মাঝেও অরূপের সন্ধান। কথার সঙ্গে সুরের এমন সহজ মিতালী, এমন মসৃণ বিন্যাস বিরল। নজরুলের গানে সুরের মুক্ত বিচরণ আর রবীন্দ্রনাথের গানে কথা-সুরের ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপ। নজরুলের গান মুক্ত বিহঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের গান ধ্যানমগ্নতার সংযম। এ দুইয়ে মিলেই বাংলা গানের সম্পূর্ণতা ” (পৃষ্ঠা: ১৯৩) জীবনের গান/ সৈয়দ আব্দুল হাদী

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা গানের নতুন পথ নির্মাণে আরো অনেকের সাথে তাঁকেও ব্যয় করতে হয়েছে শ্রম, সময় ও মেধা। কিন্তু যা বিস্ময়কর তা হলো, সুদীর্ঘ ষাট দশকের সঙ্গীত পথযাত্রায় তিনি কখনো ক্লান্ত হন নি। ক্লান্তি, হতাশা, অভিমান কিংবা অভিযোগের বয়ান তুলে পাঠকের আনন্দ পাঠে তিনি বিঘ্ন ঘটান নি। শিল্পীর অপরিসীম সততায় তিনি দেখিয়েছেন সংগীত তাঁর জীবনের সকল অপ্রাপ্তি কী নিপুণভাবে ঢেকে দিয়েছে। এটাই এই আত্মকাহিনীর বিশেষত্ব।

বইয়ের শেষ স্তবকটি সম্ভবত শিল্পীর সমবয়সী আরো অনেকের জীবনোপলব্ধির একটা লিখিত রূপ যার প্রভাব ভাবা যেতে পারে এমনকি প্রজন্মান্তরে প্রসারিত। এখানে এর অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, জীবনের এই অধ্যায়ে এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই, মনে হয় একটা ঘোরের মধ্য দিয়েই যেন জীবনটা কেটে গেল। আসলেই কি তাই? জীবনটা কি শুধুই একটা ঘোর? কত কিছু দেখার বাকি, কিছুই তো হলো না, হওয়া সম্ভবও নয়। -তবু জীবন বড় প্রিয়।

মাঝেমধ্যে ভাবি, শকুন আর কচ্ছপের আয়ু দুইশ বছরের বেশি আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও মানুষের আয়ু কেন এত কম। তবে জীবনের এই ক্ষণস্থায়িত্বই বোধ হয় জীবনকে আরও বেশি প্রিয়, আরও বেশি  আকর্ষণীয়, আরও বেশি গতিময় করেছে। (পৃষ্ঠা – ১৯৯ / শেষ পৃষ্ঠা)

সৈয়দ কামরুল হাসান : কথাশিল্পী

আরও পড়তে পারেন…

বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে ফয়সাল আহমেদের পাঁচ বই

বিধান রিবেরুর নতুন বই ‘কানান্তর’